বছর খানেক আগেও রাইফেল স্কয়ারের ফুড কোর্ট ছিল নিচতলায়। তখন সকালের দিকে রাইফেলস স্কয়ারে গেলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। ফুড কোর্টের চেয়ারগুলোতে, রাইফেল স্কয়ারের চওড়া সিঁড়িতে- সব জায়গায় দেখা যেত স্কুল ড্রেস পরা ছেলে মেয়েদের; হাসি- গল্প করছে, কেউ কেউ হাত ধরাধরি করে বসে আছে। এদের কাউকে কাউকে দেখে মনে হতো বয়স ১০/১২ বছরের বেশি না! এদের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আমি এর ওর দিকে কট কট করে তাকাতাম, যেন ওরা বোঝে আমি ওদের এভাবে দেখতে পছন্দ করছি না, তবে আমাকে তারা থোড়াই কেয়ার করতো...
এখন ফুডকোর্ট ছাদে, হয়ত এখনো এই শিশুরা সেখানে এভাবে আড্ডা দেয়...
এই শিশুগুলো ধানমন্ডি আর এর আশপাশের স্কুল থেকে পালিয়ে আসা। শুধু এই জায়গা না, ঢাকার সব এলাকার একই চিত্র। ঢাকার প্রতিটি এলাকায় এমন অসংখ্য খাবারের দোকান, সেসব দোকানে অনেক ছেলে শিশু মেয়ে শিশু স্কুল পালিয়ে আসে। এই শিশুরা দুষ্টু বুদ্ধিতে মোটেও শিশু নয়, তালাশ টিমের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এদের সম্পর্কে যা জানলাম তাতে আমি লজ্জা আর বিস্ময়- দুটোতেই বাক্যহারা হলাম। দেখুন ভিডিও: view this link
বাবা মা এদের পড়াশোনা করার জন্য স্কুলে পাঠান অথচ নানা ছলচাতুরি করে তারা স্কুল থেকে এভাবে পালায় কেন? তালাশ টিমের ভিডিওতে দেখলাম, এমন একজন স্কুল পালানো মেয়ে বলছে, "স্কুলে টিচারদের লম্বা লেকচার শুনে কি লাভ! ফ্রেন্ডের সাথে এভাবে সময় কাটানোই ভালো।" বাহ! চমৎকার! শুনে মনে পড়ল আমার নিজের এই বয়সটাকে; বিজ্ঞানের ক্লাসে নতুন জিনিস শেখার কি আনন্দ যে ছিল!! মাটির কলসিতে পানি রাখলে তা কেন ঠান্ডা থাকে, অথবা কাঁথার তুলনায় লেপ গায়ে দিলে কেন বেশি গরম লাগে, সাবানের সাথে হলুদ মেশালে কী আশ্চর্যজনক ভাবে রং পাল্টায়- এসব জানতে পেরে আমরা যে আনন্দটা পেতাম, এই শিশুরা সেই জানার আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে!! তার বদলে তারা কি পাচ্ছে! তাদের ভাষায়, "ফ্রেন্ডদের সাথে সময় কাটাবার আনন্দ"!
খুব ইচ্ছা করে জানতে, এই শিশুরা কি নিয়ে গল্প করে! মানুষ যত বড় হয় ততো তার জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, তখন সে নানা বিষয়ে কথা বলতে পারে। এই ছোট বাচ্চাগুলোর জানাশোনার পরিধি খুবই কম, কি নিয়ে তবে কথা বলে তারা? আর এই যে এরা স্কুলের সময়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রেম করে বেড়ায়, তাহলে লেখাপড়াটা যে একটা ধারাবাহিক প্রসেস, এদের শেখার বিষয়ে যে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, সেটা পূরণ হবে কি করে? নাকি এই ঘাটতি কখনোই পূরণ হয় না!! এজন্যই কি প্রশ্ন ফাঁস করে এদের সংকট নিরসন করে দেয়া হচ্ছে? এটা খুবই সম্ভব, আমি শুনেছি অধিকাংশ স্কুলের পরীক্ষারতেও "ইম্পর্টেন্ট" এমন ভাবে দাগিয়ে দেয়া হয়, যাতে সবাই পাশ করতে পারে। এই যদি হয় খুবই পরিস্থিতি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার, খুব অন্ধকার!
তালাশের ভিডিওতে দেখলাম, ক্লাস ফাইভের মেয়েও প্রেমের তাড়নায় এভাবে স্কুল পালায়! বাল্যপ্রেমের বহু ঘটনা আমি দেখেছি সন্তানরা যখন স্কুলে পড়তো, তখন। আমি উন্নত দেশের স্কুল দেখিনি, শুনেছি সেখানে ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব/প্রেম হয়, কিন্তু 'পড়ার সময় পড়া', এই কাজটা তারা মেনে চলে, প্রেম করবার জন্য তারা জ্ঞান আহরণে ফাঁকি দেয় না। বাবা মাকে ঠকিয়ে, শিক্ষকদের লুকিয়ে, শপিং মলে গিয়ে, পোশাক পাল্টে প্রেম করা- আমাদের শিশুদের এই আচরণ কি তাদের সততার কোন পরিচয় বহন করে?
আর এই যে হরেক রকম বিদেশি খাবার- বার্গার, পাস্তা, নাচো, পিজা, আরো কত খাবার, যার নাম আমি জানিনা, তার সাথে কোলড্রিংকস- এসব খেতে দুজনের অন্ততপক্ষে ৪০০ টাকা লাগে! প্রতিদিন খরচ করার জন্য বাচ্চাগুলো এত টাকা কোথায় পায়! এরা তো রোজগার করে না! এদের দেখে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা স্মৃতি মনে পড়ে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ জুটিই সময় কাটাতো বিশাল খেলার মাঠের জায়গায় জায়গায় বসে। একদিন আমাদের সিনিয়র এক আপুর কথা শুনলাম, তাকে এক সিনিয়র ভাই প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ায় তিনি রাজি হয়েছেন এক শর্তে- তিনি মাঠে হাঁটু মুড়ে বসে ঘাস খেতে পারবেন না, গল্প করতে হলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় নিয়ে গিয়ে বসতে হবে!! তখন আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় পাওয়া যেত শুধু সিঙ্গারা, সমুচা, পরটা, কোক, পেপসি চা এসব। এই কমদামি খাবারগুলো খাওয়ার রেস্তই থাকত না বেশিরভাগেরই। তাই জুটিরা মাঠে বসত, আর মাগনা মাঠের ঘাস ছিঁড়ে খেতে খেতে গল্প করতো...
স্কুলের শিশুরা এভাবে টাকা কোথায় পায় এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি। এমনকি তালাশ টিমের প্রতিবেদনেও এই প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে এই প্রতিবেদনে দেখলাম, এই শিশুদের বেশিরভাগেরই স্মার্ট ফোন আছে, সেই ফোন তাদের মা বাবা কিনে দেয় নি, তারা জানেনও না যে সন্তানের স্মার্ট ফোন আছে!!! স্কুলে ফোন নেয়া নিষিদ্ধ, তাই তারা পায়ের পাতার নিচে ফোন রেখে, মোজা পড়ে, তারপর জুতা পড়ে ফাঁকি দিয়ে ফোন নিয়ে ঢোকে। এত বুদ্ধি তারা পড়াশুনার কাজে যদি ব্যবহার করত...
সংজ্ঞানুসারে ১৮ (নাকি ১৬?) বছরের কম বয়সীদের শিশু বলার কথা। তাই আমি এদের শিশু বলছি; এদের আচরণ দেখলে অবশ্য শিশু বলে মনে হয়না। এদের এই আচরণ একজন মনোবিজ্ঞানী ব্যাখ্যা করেছেন ভিডিওতে।
শিশু শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ পড়াশোনা, সেই পড়াশোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এরা যা করছে, তা কোন ভালো ফল বয়ে আনবে না; না তাদের মা-বাবার জন্য, না সমাজের জন্য না দেশের জন্য! আর এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, শিশুদের মধ্যে পড়াশোনা বাদ দিয়ে তথাকথিত ফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটানোর প্রবণতা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। তালাশের ভিডিওটা দেখুন, আর মাঝে মাঝে খাবার দোকানে ঢু মারুন; দেখবেন আমি সত্যি কথাই বলছি। তবে আমাদের করণীয় কি এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। এইসব শিশুদের উপদেশ দেব, তাদের মা-বাবাদের বলে দেব??
সেই সব দিন আর নেই
সব ছবি অন্তর্জাল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪০