somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ: অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী

১০ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাথা থেকে করোনা কিছুতেই তাড়াতে পারছি না, এদিকে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সম্পর্কে লিখতে চাচ্ছি। তাই করোনা নিয়ে তাঁর কার্যক্রম দিয়েই লেখা শুরু করি... 

করোনা মোকাবেলায় দেশে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয় মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে, খুব ঢিলেঢালা ভাবে, ধারণা করা হচ্ছিল যে গরম পড়লেই করোনা বিদায় হবে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এমন ধারণা নিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকলেন না, তিনি মার্চের শুরু থেকেই করোনা মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন। এর কয়েক মাস আগে তাঁর স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে, বয়স সাতাত্তর বছর, নিজে উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন, তাই ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করলেন কিন্তু কম্পিউটার আর নিজের কম্পিউটারের মতো মস্তিষ্ক ব্যবহার করে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন নানা সমস্যার সমাধান করতে। সেসময় স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই পিপিই পাচ্ছিলেন না, তাই স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিই তৈরির কাজকে তিনি অগ্রাধিকার দিলেন। মার্চের মাঝামাঝি, তিনি যে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন, সেই বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনসহ চার প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে তৈরি শুরু হলো চার লক্ষ পিপিই। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, রোটারি ক্লাব ঢাকা নর্থ ওয়েস্ট ও পে ইট ফরোয়ার্ড /অনেস্ট।

দেশে- বিদেশে তার অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাদের তিনি অনুরোধ জানালেন সবাই যেন নিজের নিজের কর্মপরিধির মধ্যে থেকে এই নতুন ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বের করতে গবেষণা করেন। (বিদেশে অনুরোধ করতে হয়, কারণ দেশে ফান্ড না পাওয়ায় কেউ গবেষণা করতে সক্ষম হয় না)। তাঁর ছাত্র  ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় এট আরবানা শ্যাম্পেনের অধ্যাপক ডা. তাহের সাইফ, তার দুজন ছাত্র নিয়ে গবেষণা করে দেখলেন সহজলভ্য কাপড়ে স্বল্প খরচে সার্জিক্যাল মাস্কের কাছাকাছি কার্যকারীতা সম্পন্ন মাস্ক তৈরি করা সম্ভব। এই মাস্ক সহজে তৈরি করা যায় বলে বিপুলসংখ্যক মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারেন, ফলে ডাক্তাররা সহজে তাদের একান্ত প্রয়োজনীয় N-95 মাস্ক পাবেন। ছোট আবিষ্কার, কিন্তু এর প্রভাব বড়। (গবেষণা পত্রটি একটি নামী জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি নিউজে অধ্যাপক তাহের সাইফের এই গবেষণার খবর দেখানো হয়।)

তিনি বুঝেছিলেন, দেশে যত ভেন্টিলেটর আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল, করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে, এত অল্প সংখ্যক ভেন্টিলেটর দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া যাবে না। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজলেন তিনি। মার্চ মাসেই ইউরোপ আমেরিকায় পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের অভাব দেখা দেয়, তখন সেসব দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প খরচের বহনযোগ্য ভেন্টিলেটর নির্মাণের নকশা করা হয়। তিনি নিজ উদ্যোগে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ডিজাইন করা ভেন্টিলেটরের নকশা সংগ্রহ করে সেটা বুয়েটের বায়োমেডিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টকে সরবরাহ করেন, যাতে এই নকশা অনুসরণ করে ভেন্টিলেটর তৈরি করা যায়। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানও তিনি করেছিলেন বুয়েট অ্যালামনাইদের থেকে, বুয়েট অ্যালামনাইরা তাঁর সকল কর্মকান্ডে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে তাঁর পাশে থেকেছেন। আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, মার্চের শেষ দিকে যখন আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন মাত্র ৪০/৪২ জন, সবাই নিশ্চিন্তে ছিলেন করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে, সেই সময় তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন পরিস্থিতি খারাপ হলে কী করা যায় তা ভেবে। তিনি বলেছিলেন, 'যদি কোভিড-১৯-এর আরও বেশিসংখ্যক আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়, যাঁদের হাসপাতালে নিতে হবে এবং তাঁদের আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, তাহলে আমাদের সামনে যন্ত্রের একটা অপ্রতুলতা দেখা দিতে পারে। সেটা কীভাবে সমাধান করা যায়, সে জন্য বুয়েট অ্যালামনাই বুয়েটের সাথে, আমাদের যারা প্রাক্তন ছাত্র আছে তাদের সাথে একটা উদ্যোগ নিচ্ছে। কীভাবে দ্রুত আমাদের ক্যাপাসিটি বাড়ানো যায়।' অন্তিম আহ্বান

এই প্রকল্প সম্পর্কে কোন আপডেট পাইনি কোন পত্রিকায়, পরে এই ভিডিওতে তাকে বলতে শুনলাম, বায়োমেডিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এমন ভেন্টিলেটর তৈরি করছিল যা একই সাথে একাধিক রোগী ব্যবহার করতে পারে, সেই ভেন্টিলেটরের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ডিজি হেলথ থেকে সেই ভেন্টিলেটর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়নি!!

 মৃত্যুর আগের দিনে করা এই ভিডিও কনফারেন্সে তিনি তিনি কোভিডকালীন সময়ে দেশের বিভিন্ন  পরিস্থিতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়াস্থ বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের প্রশ্নের উত্তর দেন দীর্ঘ সময় ধরে।সবশেষে উপস্থাপক অনুষ্ঠান শেষ করেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর দীর্ঘায়ু কামনা করে... এর পরদিন তিনি সেহরি খেতে জাগবেন বলে ঘুমিয়ে পড়েন, কিন্তু আর তিনি জাগেন নি...

দেশে করোনা প্রথম শনাক্তের (৮ই মার্চ) পরের সাত সপ্তাহ (২৭ এপ্রিল) তিনি করোনা সংকট নিরসনে এইসব কাজ ছাড়াও আরো কাজ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন উপার্জনহীন দরিদ্র মানুষদের প্রাপ্য সাহায্য তাদের না দিয়ে অন্যরা আত্মসাৎ করছেন। তিনি ব্যবস্থা করলেন প্রথমে এমন মানুষদের তালিকা তৈরি করে সরাসরি তাদের কাছে অর্থ সাহায্য পাঠাতে, তিনি গ্রামীণ ফোন বোর্ডের সদস্য সচিব হিসাবে দেড়শ কোটি টাকা অর্থ সাহায্য এভাবে দরিদ্রদের দেবার ব্যবস্থা করেন। (সূত্র: উপরের ভিডিও)

এই ভিডিওতে তিনি হাওরের ধানকাটা থেকে শুরু করে গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট আরও অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন, এমনকি অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেনেরও সংকট দেখা দেবে সেই আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। অক্সিজেন সংকট বিষয়ে  তাঁর এই আশংকা এখন সত্যি  বলে দেখা যাচ্ছে!!

সাতাত্তর বছর বয়সী মানুষটি করোনা শুরুর পর মাত্র সাত সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন, কিন্তু এর মধ্যেই করোনা সংকট উত্তরণে অনেক কাজ করেছিলেন। এটা তাঁর কোন চাকরি ছিল না, কেউ তাকে এসব দায়িত্ব নিতে বলেনি, তবু তিনি নিজের অন্য অনেক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে এইসব কাজও করে চলেছিলেন। কেন করেছিলেন? জাতীয় অধ্যাপকদের কি কোন দায় আছে জাতীয় দুর্যোগে কাজ করার? সেক্ষেত্রে আর কোন জাতীয় অধ্যাপককে দেখতে পেলাম না কেন তাঁর সাথে?

 কোন দায় থেকে তিনি কাজ করতেন না, তিনি ভালবাসতেন এদেশকে আর এদেশের মানুষকে।পরিচিত অপরিচিত সকল মানুষের উপকারের জন্য তিনি হাত বাড়িয়ে দিতেন। জগৎ সভায় বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকুক এটা তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল, সেজন্য চাইতেন দেশে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার, চাইতেন দেশের আগামী দিনের নাগরিকেরা হবে ধীমান ও বিজ্ঞানমনস্ক। এজন্য তিনি প্রবল উৎসাহ নিয়ে ছুটির দিনে ছুটে যেতেন গণিত অলিম্পিয়াড কিংবা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায়, তাঁর উপস্থিতি প্রতিযোগীদের অনুপ্রেরণা যোগাত, এইসব তরুণ- কিশোরদের  তিনি নিজের বাসায় তাদের আমন্ত্রণ করে নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন, সবশেষে ভূরিভোজে আপ্যায়িত করতেন(তাঁর মৃত্যুর পর অনেকের  স্মৃতিচারণ থেকে জেনেছি)। এই সব প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের সাফল্যে তিনি খুব আনন্দিত হতেন।

তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছিলেন, কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হলে রাজনৈতিক কিছু চাপ মেনে কাজ করতে হয়। ভিসি থাকাকালীন নিয়মিত ভাবে বিদেশে কর্মরত গুণী বাংলাদেশীদের তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন, যেন তাদের কাজের সাথে তাঁর ছাত্ররা পরিচিত হয়ে তাদের মত হতে অনুপ্রাণিত হয়। (যেমনভাবে সামুতে গিয়াসউদ্দিন লিটন প্রবাসী গুণীজনদের সাথে পরিচয় করাতেন)!
 
এদেশে প্রযুক্তির বিকাশেও তাঁর অবদান অনন্য।
স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম কম্পিউটার আসে তাঁরই উদ্যোগে, ১৯৭৮ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই থেকে দেশে কম্পিউটার শিক্ষার সূচনা হয়, তিনি কম্পিউটার কাউন্সিলের সভাপতি হয়ে নানা ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার করেন। তাঁকে বলা হতো চলন্ত কম্পিউটার, তার মনে রাখার ক্ষমতা এত অসাধারণ ছিল যে কোন রকম বই বা কাগজপত্র ছাড়াই তিনি ক্লাসে স্ট্রাকচার বিষয়ের কঠিন সমস্যা অনায়াসে সমাধান করতেন; কারো ফোন নাম্বার জানার দরকার হলে তিনি হাসিমুখে শুনতেন আর নিজের মাথায় কপি করে রেখে দিতেন।

 "আমার চোখের সামনে দিয়ে একটা পরিচ্ছন্ন নগরকে বসবাসের প্রায় অযোগ্য মহানগরে পরিণত হতে দেখলাম। আমার কাছে মনে হয়, এই ঢাকা এখন জনসাধারণের চলাচলের জন্য সবচেয়ে বিপৎসংকুল মহানগরীর অন্যতম।" খুব দুঃখের সাথে তিনি একথা বলেছিলেন, কারণ রাজধানী বাঁচাবার শেষ উপায় হিসেবে তিনি ড্যাপের বাস্তবায়ন চেয়েছিলেন, রাজধানীর পরিবেশ উন্নয়নের জন্য গৃহীত নানা উদ্যোগে তিনি পরামর্শক ছিলেন, অথচ ড্যাপ বাস্তবায়িত হয়নি। গভীর হতাশা নিয়ে বলেছিলেন, "--- আমরা বলেছিলাম, বেআইনিভাবে যেগুলোতে মাটি ভরাট করা হয়েছে, কোনো দালান বানানো হয়নি, সেগুলোতে মাটিটা সরিয়ে ফেললেই হয়। পেশায় আইনজীবী মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘আমাদের আইনে একটা কথা আছে যে একটা অবৈধ শিশু যদি জন্মগ্রহণ করে, তার বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে হবে।’ তারপর তো আর এই ড্যাপের বাস্তবায়ন হলো না। ল্যান্ড ডেভেলপারস আর এক্সট্রিমলি পাওয়ারফুল। এদের বিরুদ্ধে কথা বললে জীবনের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে।" ড্যাপ

দেশের সমস্ত বড় অবকাঠামো নির্মাণের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন, বিদেশি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ব্যবস্থাপনা ও অর্থব্যয়ের পরিকল্পনা বুঝতে তাঁকে আইন ও অর্থনীতি সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয়েছে, যাতে ভুল কোন চুক্তির ফলে দেশের আর্থিক ক্ষতি না হয়। এই সব লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় তিনি দেশের পক্ষে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, অথচ কখনোই এ থেকে কোন আর্থিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টাও করেননি... কয়েক বছর আগে ডেভেলপারকে দেবার আগে পর্যন্ত তিনি প্রায় সারাজীবন পঞ্চাশের দশকে পিতার নির্মিত বাড়িতেই থেকেছেন...

এই শান্তশিষ্ট, সাদাসিধা মানুষটি যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর হয়ে উঠতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থান নিতে কম মানুষই পারে!! একথা বলছি, সম্প্রতি (তাঁর মৃত্যুর পর) সততার জন্য প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হলো। কিন্তু সকলে, বিশেষ করে প্রকৌশলীরা নির্লিপ্ত রইলেন!! কাউকে এর প্রতিবাদ করতে দেখিনি, ব্লগে সোহানী ছাড়া।view this link অথচ বুয়েট ছাত্র আবরারকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যখন ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চলছিল তখন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বুয়েট অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিপুলসংখ্যক অ্যালামনাই নিয়ে সমাবেশ করে হত্যাকান্ডের বিচার দাবিকরেন, ফলে  আবরারের খুনীদের গ্রেপ্তার করা হয়।  প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যার পর এখন তার পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছে... সোহানীকে অনেক বড় একটা ধন্যবাদ তাঁর পোস্টের জন্য।



নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, কিন্তু তিনি সবচাইতে পছন্দ করতেন শিক্ষা দান করতে, তাঁর অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে... কর্মক্ষেত্রে ছাত্রদের সফলতা তাঁকে বিপুল আনন্দ দিত, তাদের সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, তাদের জন্য তার দ্বার থাকতো অবারিত। তাঁর স্মরণে আয়োজিত দুটো ভার্চুয়াল মিটিং আমি দেখেছি, সেখানে দেখেছি তাঁর প্রতি ছাত্রদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা; একজন খুবই কীর্তিমান ছাত্রকে ভগ্ন কন্ঠে বলতে শুনলাম, "আমি অভিভাবক হারিয়ে ফেললাম... আমার পড়াশোনা আর গবেষণা সব উনার পরামর্শ নিয়ে করেছি" শুনে মনে পড়ল স্কুলে পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম, শিক্ষক এরিস্টটলের সম্পর্কে মহামতি আলেকজান্ডারের একটি উক্তি , "To my father, I owe my life; to Aristotle, how to live worthily." তাঁর অনেক ছাত্রই জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী, তাদের কীর্তিমান হবার পেছনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর অবদান অনেকখানি।

২০১০ সালের ২০শে অক্টোবর ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করে। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী যিনি কোন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সম্মান অর্জন করেন। তাঁকে নিয়ে গর্ব অনুভব করি ।
এই তথ্য দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই ডা. এম এ আলীর প্রতি।

এই ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অনেক বক্তাই বলছিলেন সময় ব্যবস্থাপনায় তাঁর আশ্চর্য কুশলতার কথা; এতসব কাজের মাঝেও প্রতিবেশী, আত্মীয়- পরিজনদের আনন্দে- বিপদে ছুটে যেতেন, বিয়ের অনুষ্ঠান যেমন থাকতেন তেমনি ছুটে যেতেন জানাজার নামাজে...

তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন। তারপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে তিনি অনেক গবেষণার সুযোগ পেতেন, খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন, কিন্তু তিনি রয়ে গেলেন নিজের দেশে, মানুষ গড়ার কারিগর এবং দেশের অবকাঠামো নির্মাণের কারিগর হয়ে। তাঁর চাইতে মেধাবী মানুষ এদেশে অনেক পাওয়া যাবে হয়তোবা, কিন্তু দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে এভাবে কাজ করে যাওয়া এমন আরেকজন মানুষ পাওয়া যাবে কি? আমাদের আগামী প্রজন্ম যখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল বা পদ্মা সেতু ধরে ছুটে যাবে, তারা কি জানবে এর প্রতিটার সাথে ডা. জামিলুর রেজা চৌধুরী নামের একজন মানুষের স্বপ্ন আর পরিশ্রম জড়িয়ে আছে!!

২৮ এপ্রিল ডা. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে সামুতে একমাত্র পোস্ট ছিল "জামিল স্যারেরর বৃষ্টিস্নাত বিদায়", লেখক সাজিদ উল হক আবির। তাঁর মৃত্যুর পরদিন (২৯ এপ্রিল) ও তার পরদিন (৩০ এপ্রিল) মারা যান যথাক্রমে বলিউডের অভিনেতা ইরফান খান ও ঋষি কাপুর। তাদের দুজনের মৃত্যুতেই সামুর ব্লগাররা শোকাকুল হয়ে অনেকগুলো পোস্ট দেন। ব্লগার নূর মোহাম্মদ নূরু কতশত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে পোস্ট দিয়ে চলেছেন, কিন্তু অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে তিনি কোন পোস্ট দেননি!!! অবশ্য সামুর কোন ব্লগারই যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে লেখেননি এমন নয়। ব্লগার মুনির হাসান view this linkতাঁর স্মরণে প্রথম আলোয়
 দীর্ঘ লেখা দিয়েছেন, মুনির হাসান সেটা সামুতে পোস্ট করতে পারতেন, যেমনভাবে ব্লগার "এক নিরুদ্দেশ পথিক" প্রথম আলোয় প্রকাশিত তাঁর লেখা সামুতে পোস্ট করেন। কিন্তু না, মুনির হাসান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে লেখা সামুতে দেননি!! এমনকি উনাকে নিয়ে লেখা সাজিদ উল হক আবিরের একমাত্র পোস্টটিও উধাও!! আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর দু সপ্তাহ পর মৃত্যু বরণ করেন আরেকজন জাতীয় অধ্যাপক, ডা. আনিসুজ্জামান, যিনি ছিলেন সামুর একজন ব্লগার। সামুর প্রথম পাতায় তার ছবি প্রায় দুই মাস যাবত থাকতে দেখি, উপরে লেখা "আমরা শোকাহত"। সম্প্রতি এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর পর সেটা পাল্টে এন্ড্রু কিশোরের ছবি দেয়া হয়েছে, (তিনি সামুর ব্লগার ছিলেন এমন তথ্য পাইনি)!! কিন্তু অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে সামু একদিনের জন্যও শোক প্রকাশ করেনি!! তাহলে কি সামুতে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এমন কেউ যাকে নিয়ে লেখা যাবে না, বলা যাবে না কথা??

এমন হলে আমার এই পোস্টও হয়ত সাজিদ উল হক আবিরের পোস্টের মত উধাও হয়ে যাবে... এমন হলে আমিও সামু থেকে উধাও হয়ে যাব। তার আগে নাহয় এই বিশাল পোস্ট, সামুতে আমার লেখা সবচেয়ে বড় পোস্ট দিয়ে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে গেলাম।

 সবার জন্য শুভকামনা।

উনাকে নিয়ে নির্মিত ভিডিও: স্মরণ

















সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:২৮
৪৭টি মন্তব্য ৪৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×