অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর,বিশিষ্ট সমাজসেবক, জনদরদি,গরীব দুঃখী মেহনতি মানুষের বন্ধু, তোমার আমার আপনজন এতো গেলো একজন জনগণের খাদেমের জন্য জনগণের শ্লোগান। আবার পারিবারক, সামজিক ও রাষ্ট্রিয়ভাবে কিছু সার্বজনীন শ্লোগান আছে,- গাছ লাগান,পরিবেশ বাঁচান, ছেলে হোক মেয়ে হোক, দু'টি সন্তানই যথেষ্ট, আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশি তাকে দেবো এইরকম অনেক। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি দল জাতিকে সময়োপযোগী নানাবিধ শ্লোগানে প্রতিনিয়ত উদ্ভুদ্ধ করে চলছে.
যার কয়েকটি হলো-
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম - পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশেটির জন্মলগ্ন থেকে এখন পযর্ন্ত সফল ও সার্থক শ্লোগান-ই হলো এটি। রাজনীতির কবি মঞ্চে এলেন এবং উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান করলেন, মুক্তিকামী বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে হায়েনা-দুর্বৃত্তদের মোকাবেলা করে আর মুক্তির ঝান্ডা উড়িয়ে তবেই ঘরে ফেরে। কিন্তু এই ঐক্যবদ্ধ,আন্তরিকতা ও একে অন্যের বন্ধুত্বা ও দেশপ্রেম বেশি দিন স্হায়ী হয়নি। বাংলার মাটিতে সুবিধাবাদী, হীনচরিত্রেরও কূটকৌশলীধারীদের জয় হয়। তলাবিহীন ঝুড়ি নিয়ে বেশিদূরের পথ যেতে না যেতে শেষ হয় মুক্তির শ্লোগানের মহাকাব্য।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ -
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামজিক মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে দেশ গড়ার জন্য শুরু হলো স্বনির্ভর বাংলাদেশের পথচলা। নদী ও খালবিল শোধনী, খালকাটা, বহি বিশ্বের সাথে সর্বোত্তম সম্পর্ক, ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন সংস্থায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলে বাংলাদেশের নামক ক্ষুদ্র একটি দেশের পথচলা। স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি তার অন্যতম কারণ ছিলো নতুন দেশটির প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা এবং দেশজ উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে না পারা । ফলশ্রুতিতে খাল কেটে কুমির এনে শেষ হয় নির্ভরতার আশ্বাস।
আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে- কৃষকের উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে ব্যাপক হারে কৃষি খামারের উপর জোর দিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। কিন্তু গ্রামীণ জনপদের পারতপক্ষে তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। সীমিত আকারে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্রীজ, কালভার্টে,বাঁধ নির্মাণ, বিদ্যুৎতিক সংযোগ হলেও কৃষকের নানামুখী প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের কার্যত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি ফলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা ও ফসলি জমি আবাদের উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণের অভাবে গ্রাম বাঁচনি বরং গাছপালা কেটে যত্রতত্র আবাস গড়ে ওঠার ফলশ্রুতিতে গ্রামাঞ্চলগুলো শ্রীহীন ও অনেকটা বিলীন হয়ে যায়। নগরের মধ্যে অফিস আদালত সীমিত রাখার ফলে শহরমুখী প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামগুলি বাঁচতে পারে নি। স্বৈরতন্ত্রের শবযাত্রায় শেষ হয় শ্লোগানের শ্লোকবাক্য।
সন্ত্রাস ও দূর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ -
জাতিসংঘের মানব সূচকের ক্রমাগত অবনতির ফলে হ্যাট্রিক দূর্নীতিবাজ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান হওয়াতে সরকার এবার সকল ধরনের টেন্ডারবাজি, কালো কারবারি, অসাধু ব্যবসায়ী, চোরাচালানকারী ও গডফাদারদের দৌরাত্ম নির্মূল করার লক্ষ্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করে এবং তার জন্য বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে এরজন্য নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে সক্ষম হলেও আইনের অপব্যবহার ও ক্ষমতাধর ব্যাক্তিদের বাহাদুরিতে সন্ত্রাস ও দূর্নীতির কক্ষপথ তেমন একটা বদলায়নি। শ্লোগানের রাজপথ ছেড়ে কোনভাবে নির্মল শ্বাস টেনে বাঁচাটাই দায় হয়ে দাঁড়ায়।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ -
বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক কোনভাবেই যেন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। দু'বেলা পেটপুরে খেয়েদেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারে এমন মহতি শ্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার আনাচে কানাচে। একটি দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত ক্ষুদ্র ও ভারী শিল্পের উন্নয়নের বদলে কিছু নিদিষ্ট গোষ্ঠীর উন্নয়ন হয়। দারিদ্র্য আরো দারিদ্র্য হয় আর ধনীরা ফুলেফেঁপে ওঠে। নিম্নবিত্তের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি দেখা যায়নি কোন ব্যতিক্রম .. হয়নি দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। রাষ্ট্রের কর্তা ব্যাক্তি যখন বলে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ক্ষুদ্রার্থ মানুষ পাওয়া যাবে না। তার চোখের সামনে বড় পর্দা থাকাতে সে দেখেনি তার ঠিক সম্মুখে অভুক্ত এক মা উন্মুখ হয়ে আছে তার সন্তানকে একমুঠো ভাতের ও নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য। শ্লোগানের এমন শোকোচ্ছ্বাসে আমজনতার ভেসে যাওয়া ছাড়া কিই'বা করার আছে !
ডিজিটাল বাংলাদেশ -
সবার হাতে স্মার্টফোন, তথ্য প্রযুক্তি অবাধ ব্যবহারে পুঁজিবাদি অর্থনীতির চাকা সচল করার লক্ষ্য সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে যতটা সাফল্য অর্জন করতে পারেছে তার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা তামায় রুপান্তর, রিজার্ভ চুরির মতো ডিজিটাল চুরি ডিজিটালের কপালে শোকের তিলক নিয়ে আসে। সুফিয়ার মতো রোবটকে কোটি টাকা খবচ করে দেশে নিয়ে প্রদশর্ন না করে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট করা বা ইকো পার্ক স্হাপন করা হলে আমাদের তরুণরা বরং বেশি লাভবান হতো। ডিজিটালের এই হালচাল সাদাসিধা নাকি রঙিন তা জনগণের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে বড় বড় কোম্পানির প্রায় সব কল সেন্টার ইন্ডিয়া থেকে পরিচালিত হয় কিন্তু বাংলাদেশ কি কোন বড় কোম্পানিকে কাছে টানতে পারছে?ডিজিটাল চুরেরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে?সম্পদশালী কি ডিজিটালের সুবিধা নিয়ে আরো বেশি সম্পদের অধিকারী হবে? শিশুদের পর্ণো গ্রাফি, প্রোগ্রামিং এগুলো কি নিয়ন্ত্রিত থাকবে? নাকি শ্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে......
শোষনের আইন, নাকি আইনের শাসন।
একজন নারীর বাড়ির আশেপাশে পাড়ার বখাটে ছেলেদের আড্ডা দেওয়ায় মেয়েটির বাবা ঐসব ছেলেদেরকে আকুতি মিনতি করে বিরক্ত না করতে বলে। তারপরদিন মেয়েটির বাবাকে হত্যা করা হলো। বাববর হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পরের সপ্তাহে মেয়েটির ভাইকে হত্যা ও তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হলো। নালিশ জানাতে নিকটস্থ থানায় গিয়ে হাজিরা হতে সেখানে থানার অফিসার কতৃক আবারো ধর্ষিত হলো। প্রতিকার চাইতে গিয়ে সংবাদিক সম্মেলন করলে মিডিয়া কতৃক আবারো ধর্ষিত হলো। সবশেষে আদালতের দারস্থ হওয়াতে আদালত এইসবের পেছনে প্রেম ঘটিত কারণ "সন্দেহজনক" মনে করে মেয়েটিকে আবারও ধর্ষণ করলো। আইনের কাজ হলো সাক্ষী, তথ্য -উপাত্ত যাচাই বাছাই সিদ্ধান্ত নেয়া এবং Beyond reasonable doubt কোন মোটিভ "সন্দেহাতীত" ভাবে প্রমাণিত না হলে কাউকে শাস্তি দেয়া বা দোষী বলা যাবে না আর বললে সেটাই হবে বড় অপরাধ। সমাজের একজন ব্যাক্তিও যেন বিনা অপরাধে শাস্তি না পায় তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সকলবিভাগের ও সকল মানুষের কর্তব্য ও আপামর জনসাধারণের জন্য মঙ্গলজনক।
মোদ্দা কথা হলো,
সব শ্লোগান-ই- অথৈজলে সাঁতার কাটবে যদি না দেশে আইনের শাসন না থাকে। গত সপ্তাহে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণাকে অবৈধ হিসাবে আলাদত কতৃক রায় দেয়া হয়। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসাবে তা জনগণের জয় হিসাবে দেখা হয়। আদালতের কার্যক্রমে আইনের উর্ধে যে স্বয়ং প্রধাণমন্ত্রী নয় এই সবুজ সংকেত দেয়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতা কতৃক ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধা বোধ না থাকাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বিচারবিভাগের পৃথককরণ ও স্বায়ত্তশাসন আজও আলোচনার টেবিলে ফাইল বন্দি আছে। আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা না থাকলে শুধু শ্লোগানের জয়গানে মুখরিত হবে চারপাশ আর সংকল্পের বিস্তৃতি কেবল সংকুচিত হতে হতে শূন্যে নেমে আসবে।
মাগো ভাবনা কেনো!! আমরা তোমার শান্তিকামী শান্ত ছেলে, কভু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি..আমরা হারবো না হারবো না.........
তোমার ভয় নেই মা.... আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। আমরা কতটা প্রতিবাদি?
প্রশ্ন থেকেই যায়, আমাদের এই জনপদে এইসব শ্লোগানের সংকল্পের বাস্তবায়নের জন্য জাতিকে আর কতকাল তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হবে...........
রহমান লতিফ, লন্ডন, ০৫ ই অক্টোবর ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:৪০