somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহেলীকে , যার ভাবনার আকাশ অপূর্ব দীপ্তিময় ।

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ খুব পিপাসা পাওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ।...

উত্তর দিকের বারান্দা থেকে কাদের যেন চাপা কণ্ঠস্বর কানে এলো ।...
অশেষের গলা পেলাম , বিশ্বাস কর , সেই প্রায় ষোল-সতের বছর আগে সদরঘাটে বরিশালের স্টীমারের সামনে দাড়িয়ে তোমার কাছে প্রথম শুনলাম , তুমি আমাকে ভালবাসো ।....
শিখা বলে -- এই শান্তি
এই মধুরতা দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দু:খ দৈন্য- অতৃপ্তি'র পর
করুন কোমল আভা গভীর সুন্দর ।


ওদের দুজনের কবিতা আবৃত্তি শুনতে শুনতে আমিও যেন কোন অচিন দেশে ভেসে যাই । যাব না ? ....
সভ্য মানুষ সেই আদিমকাল থেকে শুধু রহস্যের উদ্ঘাটন করে চলেছে । জীবনকে সুন্দরতর করার জন্য প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে সে কত কি আবিষ্কার করেছে । মানুষের সৃষ্টি ঐশ্বর্য আর সম্পদে ভরে গেছে এই পৃথিবী । কিন্তু সব সম্পদ-ঐশ্বর্যকে ম্লান করে দিয়েছে ভালবাসা । চিরদিনের চিরকালের এই পরম সম্পদ নিয়েই মানুষ মানুষকে দেবতা করে তুলেছে , রচনা করেছে কালজয়ী কাব্য-সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত ।
আশ্চর্য এই সম্পদ ভালবাসা ! বাহুবলে সব সম্পদ , ঐশ্বর্য হরন করা যায় , কিন্তু আলেকজান্ডার-নেপোলিয়নের মিলিত শক্তির দ্বারাও এক অসহায় নারীহৃদয় জয় করা সম্ভব নয় । ভালবাসার ক্ষয় নেই , মৃত্যু নেই ; নেই সময়-অসময় , জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিচার ।...

শিখা বলে যায় , আমি জানি তোমার স্ত্রী সত্যি ভাল মেয়ে । তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন দ্বন্দ সংঘাত নেই । বাইরের পৃথিবীর মানুষ যাকে সুখের সংসার বলে , তোমরা দুজনে সেই সুখের সংসারই গড়ে তুলেছো ।অশেষ প্রতিবাদও করে না , সমর্থনও জানায় না ।

শিখা প্রায় এক নি:শ্বাসে বলে যায় , মন-প্রান দিয়ে কর্তব্য করলেই যে কোন মানুষকে খুশী করা যায় , সুখীও করা যায় কিন্তু সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ভালবাসলে যেভাবে প্রিয়জনকে ভরিয়ে তোলা যায় , তা অন্যের দ্বারা কখনোই সম্ভব হতে পারে না ।
সে তো একশ' বার । এতক্ষন পর অশেষ প্রথম কথা বলে ।
তুমি যেভাবে বাছবিচার না করে পরের উপকার করতে , তা আমি কোনদিন করিনি কিন্তু সবার অজান্তে আমি নিজেকে তোমার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলাম । ঝিনুক , লক্ষ্মীটি এসব কথা বলে আমাকে আর দু:খ দিও না । আজকের মত রাত হয়তো আর কোনদিন আমাদের জীবনে আসবে না ...
বলতে পারো , কি করে আমি এই রাত্রির কথা ভুলব ?
কথাগুলো শেষ করে শিখা কাঁদে । আমি শুক্লা পঞ্চমীর আবছা আলোয় দেখি , অশেষ তাড়াতাড়ি ওকে কাছে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে , ছি: ঝিনুক , অমন করে চোখের জল ফেলতে নেই । শঙ্করের মত স্বামী পাওয়া কি কম ভাগ্যের ?
শিখা মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে , সত্যি ওর মত স্বামী পাওয়া ভাগ্যের কথা ।... শিখা মূহুর্তের জন্য থামে । অশেষ মুখ নীচু করে পাশের চেয়ারে বসে থাকে ।

আর আমি ? মানুষের জীবন-নাট্যের এক অপ্রত্যাশিত অঙ্ক চোখের সামনে অভিনীত হতে দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাড়িয়ে থাকি ।

... কিছুক্ষন পর অশেষ আস্তে আস্তে বলল , কত বছর হলো তোমার বিয়ে হয়েছে , কত বছর হলো আমাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই । তুমি জীবনে কত কি দেখেছো , তবুও তুমি আমাকে ভুলতে পারলে না ।
শিখা একটু জোরেই হেসে উঠল । তারপর বলল , মেয়েরা বড় হিসেবী , বড় কৃপণ । সহজে তারা কাউকে ভালবাসে না , ভালবাসতে পারে না কিন্তু সত্যি একবার ভালবাসলে , সারা জীবনেও তারা এর থেকে মুক্তি পায় না । ও অশেষের একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল ,
' রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে '।


...সেদিন বগুড়ার মালতীনগরের বড় বাড়ির উত্তরের বারান্দায় শুক্লা পঞ্চমীর আবছা চাঁদের আলোয় প্রকৃতি আর পুরুষের যে ভাস্বর মূর্তি দেখেছিলাম , তা আমার মানস-চক্ষে চির অম্লান হয়ে থাকবে ।
...শিখার চোখের দীপ্তি , দেহের কান্তি ও মাধুর্য আজও বহু পুরুষকে মোহাবিষ্ট করতে বাধ্য । আর অশেষ ? ওর মত রূপ ও গুন ক'জনের আছে ?এর উপর দু'জনের ভালবাসা ও নির্জন নি:স্তব্ধ রাত্রিতে মোহময় পরিবেশ ! সে রাত্রে ওরা যেন ভালবাসার মানস সরোবরে অবগাহন করে সব বাসনা-কামনা-লালসা ভুলে গিয়েছিল ।

আমার মত ঝিনুকের মধ্যে তুমি কোন মুক্তা খুঁজে পাবে কিনা জানিনা কিন্তু তোমার মধ্যে গভীরতা ও ব্যপ্তি পেয়েছি...
হাতের কাছে পেয়েও আমি তোমাকে হারালাম ।

অশেষ আস্তে আস্তে উঠে শিখার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে নীচু হয়ে ওর মাথার উপর থুতনি রাখল । দুটি হাত দিয়ে ওর দুটি হাত জড়িয়ে ধরল । বলল , না ঝিনুক , তুমি আমাকে হারাও নি ; বরং আমিই তোমার মধ্যে হারিয়ে গেছি । আমার ধানমন্ডীর বাড়ির জানালার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকালেই সেই পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যায় ।

সে কথা তুমি এখনও ভুলতে পারো নি ?

তুমি ভুলেছো ?

শিখা একটু হেসে বলল , আমাদের বাড়িটা না থাকলেও ঐ গাছটা এখনো আছে ।

জানি ।

তুমি কি ওদিকে যাও ?

হ্যাঁ , যাই ।

ওদিকে কার কাছে যাও ?

মাঝে মাঝে ঐ গাছটাকেই দেখতে যাই ।
শিখা আর বসে থাকে না । উঠে দাড়িয়ে বিমুগ্ধ নয়নে অশেষকে দেখে । অশেষও অপলক নেত্রে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে । কয়েকটা অবিস্মরনীয় মূহুর্ত । তারপর অশেষ আলতো করে ওকে দু'হাত দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নেয় ।
কয়েক মিনিট গ্রীক ভাস্কর্যের যুগল-মূর্তির মত থাকার পর শিখা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ওকে একটা প্রনাম করল । তারপর হঠাৎ ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল , রাতের অন্ধকারে চোরের মত ভালবেসে কি মন ভরে ? এই পৃথিবীর কেউ জানল না আমাদের ভালবাসার কথা ; কাউকে বলতে পারলাম না , হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি অশেষকে ভালবাসি । শুধু শঙ্করকে না , অশেষের কল্যাণের জন্যেও সিঁথিতে সিঁদুর পরি , এ দু:খ কী কোনদিন ঘুচবে ?

অনেকক্ষন দাড়িয়ে ওদের কথা শুনেছি ...
আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না ।
... পরের দিন সকালে... হঠাৎ গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে শিখা এক কাপ চা নিয়ে আমার বিছানার পাশে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল , এর আগে তিনবার চা নিয়ে ফিরে গেছি ।
আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখি কিন্তু মুখে কিছু বলি না ।
বলে , হঠাৎ আমাকে অমন করে দেখার কারন কি ঘটল ?
....বলি , তোমার চোখে-মুখে এমন খুশীর ভাব বোধহয় আর কোনদিন দেখিনি । সত্যি বলছি , আজ তোমাকে এত সুন্দর লাগছে যে তা বলে বোঝাতে পারব না ।
ও মূহুর্তের জন্য দৃষ্টিটা একবার উত্তরের বারান্দার দিকে বিলিয়ে দিয়ে বলল , সত্যি দাদা , আজ আমার খুব ভাল লাগছে । .....

বিয়ের কিছুদিন পর অতি সাধারন মেয়েরাও রূপশ্রী হয়ে ওঠে কিন্তু প্রানের পুরুষের নিবিড় সান্নিধ্যে তারা যেমন উজ্জ্বল , ভাস্বর , শ্রীমন্ডিত দেবীমূর্তি হয়ে ওঠে , তার তুলনা নেই ।সেদিন সকালে শিখাকে দেখে মনে হয়েছিল , চিরদিনের জন্য না হলেও অন্তত: ঐ একদিনের জন্য সে অনন্যা অসামান্যা হয়েছিল । আমি জানি না , সে রাত্রে চোখের জলের বিনিময়ে শিখা কি পেয়েছিল , কি হারিয়েছিল কিন্তু এইটুকু বুঝেছিলাম , ঐ অবিস্মরনীয় স্মৃতি , মাধুর্যের স্বাদ ও কোনদিন ভুলবে না , ভুলতে পারে না । সমস্ত পৃথিবীর অজান্তে শিখা তার শূন্য দেউলে জীবন দেবতার প্রতিষ্ঠা করে যে অনন্ত ঐশ্বর্যের স্বাদ মনে মনে উপভোগ করেছে , যে পূর্ণতার অধিকারিনী হয়েছে , তার রূপ আমি দূর থেকে দেখেই বিমগ্ধ হয়ে গেলাম ।
... পৃথিবীতে কোন দ্বন্দ্ব , কোন সংঘাতই চিরস্থায়ী হয়নি , হতে পারে না । যা চিরদিনের , চিরকালের তা হচ্ছে মানুষ । পৃথিবীর বুকে যতদিন মানুষ থাকবে , ততদিন প্রেম-প্রীতি স্নেহ-ভালবাসাও থাকবে । কোন পাসপোর্ট , কোন ভিসার শাসনে তাকে বন্দী করা যাবে না , যায় না ।

( নিমাই ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'সদরঘাট' এর সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত অংশবিশেষ )

৩৫টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×