হঠাৎ খুব পিপাসা পাওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ।...
উত্তর দিকের বারান্দা থেকে কাদের যেন চাপা কণ্ঠস্বর কানে এলো ।...
অশেষের গলা পেলাম , বিশ্বাস কর , সেই প্রায় ষোল-সতের বছর আগে সদরঘাটে বরিশালের স্টীমারের সামনে দাড়িয়ে তোমার কাছে প্রথম শুনলাম , তুমি আমাকে ভালবাসো ।....
শিখা বলে -- এই শান্তি
এই মধুরতা দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দু:খ দৈন্য- অতৃপ্তি'র পর
করুন কোমল আভা গভীর সুন্দর ।
ওদের দুজনের কবিতা আবৃত্তি শুনতে শুনতে আমিও যেন কোন অচিন দেশে ভেসে যাই । যাব না ? ....
সভ্য মানুষ সেই আদিমকাল থেকে শুধু রহস্যের উদ্ঘাটন করে চলেছে । জীবনকে সুন্দরতর করার জন্য প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে সে কত কি আবিষ্কার করেছে । মানুষের সৃষ্টি ঐশ্বর্য আর সম্পদে ভরে গেছে এই পৃথিবী । কিন্তু সব সম্পদ-ঐশ্বর্যকে ম্লান করে দিয়েছে ভালবাসা । চিরদিনের চিরকালের এই পরম সম্পদ নিয়েই মানুষ মানুষকে দেবতা করে তুলেছে , রচনা করেছে কালজয়ী কাব্য-সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত ।
আশ্চর্য এই সম্পদ ভালবাসা ! বাহুবলে সব সম্পদ , ঐশ্বর্য হরন করা যায় , কিন্তু আলেকজান্ডার-নেপোলিয়নের মিলিত শক্তির দ্বারাও এক অসহায় নারীহৃদয় জয় করা সম্ভব নয় । ভালবাসার ক্ষয় নেই , মৃত্যু নেই ; নেই সময়-অসময় , জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিচার ।...
শিখা বলে যায় , আমি জানি তোমার স্ত্রী সত্যি ভাল মেয়ে । তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন দ্বন্দ সংঘাত নেই । বাইরের পৃথিবীর মানুষ যাকে সুখের সংসার বলে , তোমরা দুজনে সেই সুখের সংসারই গড়ে তুলেছো ।অশেষ প্রতিবাদও করে না , সমর্থনও জানায় না ।
শিখা প্রায় এক নি:শ্বাসে বলে যায় , মন-প্রান দিয়ে কর্তব্য করলেই যে কোন মানুষকে খুশী করা যায় , সুখীও করা যায় কিন্তু সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ভালবাসলে যেভাবে প্রিয়জনকে ভরিয়ে তোলা যায় , তা অন্যের দ্বারা কখনোই সম্ভব হতে পারে না ।
সে তো একশ' বার । এতক্ষন পর অশেষ প্রথম কথা বলে ।
তুমি যেভাবে বাছবিচার না করে পরের উপকার করতে , তা আমি কোনদিন করিনি কিন্তু সবার অজান্তে আমি নিজেকে তোমার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলাম । ঝিনুক , লক্ষ্মীটি এসব কথা বলে আমাকে আর দু:খ দিও না । আজকের মত রাত হয়তো আর কোনদিন আমাদের জীবনে আসবে না ...
বলতে পারো , কি করে আমি এই রাত্রির কথা ভুলব ?
কথাগুলো শেষ করে শিখা কাঁদে । আমি শুক্লা পঞ্চমীর আবছা আলোয় দেখি , অশেষ তাড়াতাড়ি ওকে কাছে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে , ছি: ঝিনুক , অমন করে চোখের জল ফেলতে নেই । শঙ্করের মত স্বামী পাওয়া কি কম ভাগ্যের ?
শিখা মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে , সত্যি ওর মত স্বামী পাওয়া ভাগ্যের কথা ।... শিখা মূহুর্তের জন্য থামে । অশেষ মুখ নীচু করে পাশের চেয়ারে বসে থাকে ।
আর আমি ? মানুষের জীবন-নাট্যের এক অপ্রত্যাশিত অঙ্ক চোখের সামনে অভিনীত হতে দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাড়িয়ে থাকি ।
... কিছুক্ষন পর অশেষ আস্তে আস্তে বলল , কত বছর হলো তোমার বিয়ে হয়েছে , কত বছর হলো আমাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই । তুমি জীবনে কত কি দেখেছো , তবুও তুমি আমাকে ভুলতে পারলে না ।
শিখা একটু জোরেই হেসে উঠল । তারপর বলল , মেয়েরা বড় হিসেবী , বড় কৃপণ । সহজে তারা কাউকে ভালবাসে না , ভালবাসতে পারে না কিন্তু সত্যি একবার ভালবাসলে , সারা জীবনেও তারা এর থেকে মুক্তি পায় না । ও অশেষের একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল ,
' রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে '।
...সেদিন বগুড়ার মালতীনগরের বড় বাড়ির উত্তরের বারান্দায় শুক্লা পঞ্চমীর আবছা চাঁদের আলোয় প্রকৃতি আর পুরুষের যে ভাস্বর মূর্তি দেখেছিলাম , তা আমার মানস-চক্ষে চির অম্লান হয়ে থাকবে ।
...শিখার চোখের দীপ্তি , দেহের কান্তি ও মাধুর্য আজও বহু পুরুষকে মোহাবিষ্ট করতে বাধ্য । আর অশেষ ? ওর মত রূপ ও গুন ক'জনের আছে ?এর উপর দু'জনের ভালবাসা ও নির্জন নি:স্তব্ধ রাত্রিতে মোহময় পরিবেশ ! সে রাত্রে ওরা যেন ভালবাসার মানস সরোবরে অবগাহন করে সব বাসনা-কামনা-লালসা ভুলে গিয়েছিল ।
আমার মত ঝিনুকের মধ্যে তুমি কোন মুক্তা খুঁজে পাবে কিনা জানিনা কিন্তু তোমার মধ্যে গভীরতা ও ব্যপ্তি পেয়েছি...
হাতের কাছে পেয়েও আমি তোমাকে হারালাম ।
অশেষ আস্তে আস্তে উঠে শিখার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে নীচু হয়ে ওর মাথার উপর থুতনি রাখল । দুটি হাত দিয়ে ওর দুটি হাত জড়িয়ে ধরল । বলল , না ঝিনুক , তুমি আমাকে হারাও নি ; বরং আমিই তোমার মধ্যে হারিয়ে গেছি । আমার ধানমন্ডীর বাড়ির জানালার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকালেই সেই পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যায় ।
সে কথা তুমি এখনও ভুলতে পারো নি ?
তুমি ভুলেছো ?
শিখা একটু হেসে বলল , আমাদের বাড়িটা না থাকলেও ঐ গাছটা এখনো আছে ।
জানি ।
তুমি কি ওদিকে যাও ?
হ্যাঁ , যাই ।
ওদিকে কার কাছে যাও ?
মাঝে মাঝে ঐ গাছটাকেই দেখতে যাই ।
শিখা আর বসে থাকে না । উঠে দাড়িয়ে বিমুগ্ধ নয়নে অশেষকে দেখে । অশেষও অপলক নেত্রে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে । কয়েকটা অবিস্মরনীয় মূহুর্ত । তারপর অশেষ আলতো করে ওকে দু'হাত দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নেয় ।
কয়েক মিনিট গ্রীক ভাস্কর্যের যুগল-মূর্তির মত থাকার পর শিখা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ওকে একটা প্রনাম করল । তারপর হঠাৎ ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল , রাতের অন্ধকারে চোরের মত ভালবেসে কি মন ভরে ? এই পৃথিবীর কেউ জানল না আমাদের ভালবাসার কথা ; কাউকে বলতে পারলাম না , হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি অশেষকে ভালবাসি । শুধু শঙ্করকে না , অশেষের কল্যাণের জন্যেও সিঁথিতে সিঁদুর পরি , এ দু:খ কী কোনদিন ঘুচবে ?
অনেকক্ষন দাড়িয়ে ওদের কথা শুনেছি ...
আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না ।
... পরের দিন সকালে... হঠাৎ গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে শিখা এক কাপ চা নিয়ে আমার বিছানার পাশে দাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল , এর আগে তিনবার চা নিয়ে ফিরে গেছি ।
আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখি কিন্তু মুখে কিছু বলি না ।
বলে , হঠাৎ আমাকে অমন করে দেখার কারন কি ঘটল ?
....বলি , তোমার চোখে-মুখে এমন খুশীর ভাব বোধহয় আর কোনদিন দেখিনি । সত্যি বলছি , আজ তোমাকে এত সুন্দর লাগছে যে তা বলে বোঝাতে পারব না ।
ও মূহুর্তের জন্য দৃষ্টিটা একবার উত্তরের বারান্দার দিকে বিলিয়ে দিয়ে বলল , সত্যি দাদা , আজ আমার খুব ভাল লাগছে । .....
বিয়ের কিছুদিন পর অতি সাধারন মেয়েরাও রূপশ্রী হয়ে ওঠে কিন্তু প্রানের পুরুষের নিবিড় সান্নিধ্যে তারা যেমন উজ্জ্বল , ভাস্বর , শ্রীমন্ডিত দেবীমূর্তি হয়ে ওঠে , তার তুলনা নেই ।সেদিন সকালে শিখাকে দেখে মনে হয়েছিল , চিরদিনের জন্য না হলেও অন্তত: ঐ একদিনের জন্য সে অনন্যা অসামান্যা হয়েছিল । আমি জানি না , সে রাত্রে চোখের জলের বিনিময়ে শিখা কি পেয়েছিল , কি হারিয়েছিল কিন্তু এইটুকু বুঝেছিলাম , ঐ অবিস্মরনীয় স্মৃতি , মাধুর্যের স্বাদ ও কোনদিন ভুলবে না , ভুলতে পারে না । সমস্ত পৃথিবীর অজান্তে শিখা তার শূন্য দেউলে জীবন দেবতার প্রতিষ্ঠা করে যে অনন্ত ঐশ্বর্যের স্বাদ মনে মনে উপভোগ করেছে , যে পূর্ণতার অধিকারিনী হয়েছে , তার রূপ আমি দূর থেকে দেখেই বিমগ্ধ হয়ে গেলাম ।
... পৃথিবীতে কোন দ্বন্দ্ব , কোন সংঘাতই চিরস্থায়ী হয়নি , হতে পারে না । যা চিরদিনের , চিরকালের তা হচ্ছে মানুষ । পৃথিবীর বুকে যতদিন মানুষ থাকবে , ততদিন প্রেম-প্রীতি স্নেহ-ভালবাসাও থাকবে । কোন পাসপোর্ট , কোন ভিসার শাসনে তাকে বন্দী করা যাবে না , যায় না ।
( নিমাই ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'সদরঘাট' এর সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত অংশবিশেষ )