কালিদাস রায় (২২ জুন ১৮৮৯ – ২৫ অক্টোবর ১৯৭৫) ছিলেন রবীন্দ্রযুগের বিশিষ্ট রবীন্দ্রানুসারী কবি, প্রাবন্ধিক ও পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা। তিনি রবীন্দ্র-ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে কাব্যচর্চা করেছিলেন। আজ কবির ১৩০তম জন্মদিনে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর কিছু পংক্তি এখানে তুলে ধরলাম।
পরিণতি
ইঁদুর বলে বয়স হলে
আমি-ই হব হাতি,
দূর্বা বলে বংশ হব
আমি তো তার নাতি।
রুই কাতলা যা হোক হব
কয় পুঁঠি মাছ হেঁকে,
গুগলি বলে শঙ্খ হব
হুগলী গাঙেই থেকে।
ছাত্রধারা
এ জীবন ভেঙে-গড়ে শ্যামল-সরস করে
ছাত্রধারা বয়ে চলে যায়,
ফেনিলতা-উচ্ছলতা হয়ে যায় তুচ্ছ কথা,
উত্তালতা সকলি মিলায়
স্বচ্ছতায় শুধু হেরি আমার জীবন ঘেরি
ভাসে শুধু ম্লান মুখগুলি ;
ভুলে যাই হট্টগোল অট্টহাসি-কলরোল,
ম্লান মুখ কখনো না ভুলি।
আর সবি গেছি ভুলি, ভুলিনি এ মুখগুলি,
একবার মুদিলে নয়ন
আঁখিপাতা ভারি-ভারি, ম্লান মুখ সারি-সারি
আকুল করিয়া তোলে মন।
দিদিমার বিদায় আশীর্বাদ
এমনি করে সবার ভবলীলার অবসান
দুদিন আগে দুদিন পিছে থোবাই ব্যবধান।
এমনি করে বিদায় নিয়ে যায় দুনিয়ায় সবে
অমর হয়ে রয়েছে আর কেবা কোথায় কবে?
কাঁদিসনাকো উঠে বসার শক্তি আমার নাই
আয় বাছাধন কাছে সরে একটা চুমো খাই।
বিলাস
মানুষে মানুষে কোন ছিল না তফাৎ
হাসিমুখে পরষ্পরে মিলাইত হাত।
বিলাস আসিয়া ভেদ করিল সৃজন
পর হয়ে গেল হায় যে ছিল আপন।
মরণের পরে
জীবনের দিন শেষ হয়ে এল, আজও নাহি জানিলাম,
মরণের পরে কোথা যায় লোক, কি তাহার পরিণাম!
একটিও লোক পরলোক হতে আজও আসিলানা ফিরে,
কারে জিজ্ঞাসি? বৃথাই শুধাই সাধু দরবেশ পীরে।
নেশাখোরের অভিধান
গাঁজা খেলে 'গেঁজেল' যদি, মদ খেলে হয় 'মাতাল',
নস্যি নিলে 'নেসেল' তবে,–চা-খোরেরা 'চাতাল'।
ফুরুক-ফুরুক গুডুক তবে, টানলে পরে 'গুরখা' হবে,
চুরুট খেলে 'চোরঠা' বুঝি গুলি খেলে 'গুলাল'।
প্রশান্তি
ফুলের মধ্যে শিমুল তুমি, ফলের মধ্যে মাকাল,
গাছের মধ্যে ভুতো শেওড়া মাছের মধ্যে পাঁকাল।
চালের মধ্যে আউশ তুমি ডালের মধ্যে খেসারি,
পাড়ার লোকের কানের জ্বালা জাতের মধ্যে খাঁসারি।
চারিটি উপমা
হাসিহীন মুখ যেন শশিহীন স-ঘন গগন,
গানহীন কন্ঠ যেন মুক-ম্লান কারার জীবন।
অশ্রুহীন দৃষ্টি যেন বৃষ্টিহীন ধুসব নিদাঘ,
দীর্ঘশ্বাসশূন্য হৃদি চিররুদ্ধ পঙ্কিল তড়াগ।
অপূর্ব প্রতিশোধ
তারপর চেয়ে আসমান পানে বৃদ্ধ কহিল - "বাপ
শত্রুরে তোর তলোয়ার তলে পেয়েও করিনু মাফ।
এতদিন পরে তোর হত্যার লইলাম প্রতিশোধ,
খুনের নেশায় আর করিব না আখেরের পথরোধ।"
কবিতার দিন
সেই দেহ নাই, সেই গেহ নাই, সেই প্রিয়া নাই আর,
সেই হিয়া নাই–থেমে গেছে গান, শুনি শুধু হাহাকার।
প্রকৃতির ধন সবি পুরাতন আর নাহি মন হরে,
অন্নদা ধরা জরতীর বেশে শুধুই ছলনা করে।
সেই আঁখি নাই, সৃষ্টি মলিন, দৃষ্টি হয়েছে ক্ষীণ,
ফুরায়ে গিয়েছে মোর কবিতার দিন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৯