আগ্নেয়গিরির শহরে এসে আগ্নেয়গিরি না দেখে ফিরে যাবে, তাও আবার জীবন্ত আগ্নেয়গিরি– এমন উজবুক এই দুনিয়ায় অদ্যবধি পয়দা হয়েছে বলে মনে হয়না। আর আমারতো এই আগ্নেয়গিরি দেখার জন্যেই গোমা শহরে আগমন। শুরুতেই বলে নেয়া ভাল, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি শুনলেই চোখের সামনে ধ্বংসাত্নক অগ্ন্যুৎপাত আর ঘন ধোয়ায় ঢেকে যাওয়া শহরের ছবি ভেসে উঠতে পারে। তবে মাউন্ট নিরাগঙ্গো’র (Mount Nyiragongo) আগ্নেয়গিরি দিয়ে সর্বশেষ ২০০২ সালে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। তখন এর লাভার নহর পৌঁছে গিয়েছিল গোমা শহর পর্যন্ত; আর ছাই দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল পুরো শহরসহ চারপাশের সব কিছু। শহরের রাস্তার পাশে এখনো শক্ত জমাট বাধা কুচকুচে কালো লাভা পাথরগুলো আগন্তকদের জানিয়ে দেয় যে, এখানে এক সময় উত্তপ্ত লাভার ঢল বয়ে গিয়েছিল, যা সরিয়েই এই রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
কঙ্গো আর রুয়ান্ডা’র সীমান্তবর্তী লেক কিভু’র তীরে গড়ে উঠা গোমা শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি উত্তরে ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের মাঝেই অবস্থিত মাউন্ট নিরাগঙ্গো (Mount Nyiragongo) আগ্নেয়গিরি। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে লাভার ঢল এই লেকের পানিতে এসে মিশে যাওয়াতে, এই পানির তলদেশে এখন প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড আর মিথেন গ্যাস জমে রয়েছে। ফলে যে কোন সময় মারাত্নক দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পুরো শহরবাসী। তাসত্ত্বেও এই লেকের তীর ঘেঁষেই পাশাপাশি গড়ে উঠেছে দুইটি শহর; কঙ্গোতে গোমা, আর সাথেই রুয়ান্ডার গিসেনী শহর। বর্ডার ফরমালিটিস না থাকলে, টুরিস্টরা বুঝতেই পারত না যে, এখানে শুধু দুইটা শহরই নয়, বরং দুই দুইটা আলাদা দেশও রয়েছে।
তাবৎ দুনিয়ার হাজার হাজার গবেষক আর টুরিস্টদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই মাউন্ট নিরাগঙ্গো আগ্নেয়গিরি। আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কারণ হল, এখানেই দেখতে পাওয়া যায় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লাভা লেক; আর আগ্নেয়গিরির প্রায় মুখে পৌছে অগ্ন্যুৎপাতের ভয়াবহতা অনুধাবন করার এমন নিরাপদ সুযোগ দ্বিতীয়টি কোথাও নেই।
ভোরে ট্যুর কোম্পানির গাড়ি আমাদেরকে হোটেল থেকে কঙ্গো রেঞ্জার্স এর বেইজ ক্যাম্পে নিয়ে এল, যেখান থেকে আমাদের দুই দিনের এই ট্রিপ শুরু করতে হবে। এটাকে ক্যাম্প না বলে, বরং যারা হাইকিং এর জন্যে আসে, মূলত তাদের রেজিস্ট্রেশন পয়েন্ট বলাই শ্রেয় বলে মনে করি। বেইজ ক্যাম্পটি ১৯৮৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, গন্তব্যস্থল ৩৪৭০ মিটার উঁচুতে যেখানে পৌঁছুতে প্রায় প্রায় ৮ কিঃমিঃ হাটতে হবে। এখানে আসার আগেই অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন এবং পেমেন্টের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা কমপ্লিট করা ছিল। এরপরেও আই ডি কার্ড দেখিয়ে রেজিস্ট্রারে নাম-ধাম লিখতে লিখতে আমদের সাথে যোগ দিল আরো চারজন; উরুগুয়ের একজন, লেবানিজ আমেরিকান একজন আর অস্ট্রলিয়ার দুই তরুণী। করিম মাওয়াদ নামের এই লেবানিজ আমেরিকানের ছবি তোলার অসাধারণ দক্ষতা টের পেতে দেরী হয়নি, যা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পাশাপাশি, রেঞ্জার্সদের সাথে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলার সময় সে দোভাষী হিসেবে যথেষ্ট হেল্প করেছিল।
২।ছবিঃ বেইজ ক্যাম্প বা হাইকিং শুরুর স্থান। বোর্ডের ছিদ্রগুলো বুলেটের ছিদ্র।
অন্যদের দেখাদেখি, ব্যাগপ্যাক বহন করার স্থানীয় কঙ্গোলিজ পোর্টার ভাড়া করে ফেল্লাম, না হলে নিজেরটা নিজেকেই বহন করতে হবে; পরে বুঝেছি এটা কত বিশাল একটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। খাড়া পথে লাভা পাথরে হাঁটার সময় ব্যালান্স রাখার জন্যে একটা করে লাঠিও কিনে নিলাম আমরা সবাই; এটাও খুব কাজে দিয়েছিল। একটু পরেই যাত্রা শুরু হলো, আমাদের পুরো টিমের এক্কেবারে সামনে আর পিছনে গুলি ভর্তি কয়েকটা করে অতিরিক্ত ম্যাগাজিনসহ একে-৪৭ নিয়ে দুইজন কঙ্গোলিজ রেঞ্জার্স যোগ দিল। ভয় পেয়েছি দেখে তারা আমাদেরকে বোঝালো যে, বুনো হাতির উপদ্রব আছে বলেই এমন সতর্কতা। তবে রাতে এক পোর্টার জানিয়েছিল যে, কয়েকদিন আগে পর্যটকদের একটা দলকে অপহরণ করার পর থেকেই অস্ত্রধারী এই গার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৩। ছবিঃ সামনের কঙ্গোলিজ রেঞ্জার্স পিছনে ফিরে দেখছে আমরা কত পিছিয়ে আছি।
পথের শুরুতে বেশ জঙ্গল, গাছগুলো মাথার উপরে প্রাকৃতিক ছায়া দিয়ে যাচ্ছিল। বেস ক্যাম্পে ব্রিফিং এ জানিয়েছিল যে , আমরা মোট চারবার বিরতি নিব; প্রতি ‘রেস্ট পয়েন্টে’ ২০ মিনিটের বিরতি। প্রথম রেস্ট পয়েন্টে আসা পর্যন্ত পথ প্রায় সমতল ছিল। হাতের লাঠি দুই দিকে বাতাসে দোলাতে দোলাতে ভাবছিলাম, বেহুদা ডলার খরচ করে এটা কিনেছি।
৪। ছবিঃ প্রথম দিকের পথ, নিচে ছড়িয়ে থাকা কালো লাভা পাথর।
গাছ পালার ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও আমরা ছায়া পাচ্ছিলাম। তেমন গরমও অনুভব করছিলাম না। যদিও শেষের দিকে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ঘনত্ব কমতে শুরু করল। একটু পরেই যে হারে গাছ পালা অদৃশ্য হতে লাগল, প্রায় একই হারে পথও খাড়া হতে শুরু করল। ইতোমধ্যেই আমাদের পোর্টার কোত্থেকে যেন একটা গিরগিটি ধরে এনে খালিদের হাতে তুলে দিয়েছে; এটা আবার পারিপার্শ্বিকতার সাথে গায়ের রং মিলিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। এই গাছপালার মধ্যে এমন পাখিও আছে; পোর্টার না দেখালে তেমনি একটা পাখি কখনই আমরা পাথরের মধ্যে থেকে আলাদা করতে পারতাম না।
৫। ছবিঃ গিরগিটির সাথে একজন সহযাত্রী ।
দ্বিতীয় রেস্ট পয়েন্টের পর হতে দৃশ্যপট অতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করল। মাথার উপরে কোন গাছ নেই। আশে পাশে গাছের ঘনত্ব যেমন কমছে, তেমনি কমছে তাদের উচ্চতা। পথ এখন খাড়া হতে শুরু করেছে। বিপদ কখনো একা আসে না – এই কথাটি প্রমাণ করতেই কিনা কে জানে, চারপাশে আলগা লাভা পাথরের ছড়াছড়ি আমাদেরকে আরো সতর্ক হয়ে পা ফেলতে বাধ্য করছে। উচ্চতার প্রভাব টের পেতে শুরু করছি ইতোমধ্যেই, শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। তৃতীয় ‘রেস্ট পয়েন্টে’ পৌঁছে আমি রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম – কিছুটা ভয় ঢুকে গেছে মনের মধ্যে, পারবো তো, শেষ পর্যন্ত যেতে!
তৃতীয় পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে পরের রেস্ট পয়েন্টে আসার আগেই পথে কয়েকবার থেমে ছোট বিরতি নিতে হল আমাদের। থামামাত্রই যে যেখানে পারল বসে একটু করে জিরিয়ে নিল। যাত্রা বিরতি দিলেই কোন রকম বাছ বিছার না করেই আমি লাভা পাথরের উপর বসে পড়ছিলাম, অন্যদের অবস্থা প্রায় একই। তবে পোর্টারদের দেখে মনে হয়নি যে তারা ক্লান্ত, অথচ আমাদের ব্যাগপ্যাক তাদের পিঠে। আমরা শুধু একটা লাঠি নিয়ে হাটছি। স্বাভাবিক ভাবেই মনে হচ্ছিল, এই অংশের দুরত্ব অনেক বেশি। ইতোমধ্যে উচ্চতার প্রভাব কয়েকজনকে প্রায় কাবু করে ফেলেছে। তবে সবাই কম বেশি হাপাচ্ছে এখন। এই নিরস খটখটে পাথুরে জায়গাতেও সুন্দর সুন্দর বুনো ফুল দেখে বিস্মিত হতে হচ্ছিল, কিছুক্ষণ পর পরই।
৬। ছবিঃ পথের পাশে ছড়িয়ে থাকা বুনো ফুল।
চতুর্থ রেস্ট পয়েন্টে এসে বেশ ভাল লাগল; বেশ উজ্জীবিত অনুভব করছি, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কারণ এখান থেকে চুড়ার কেবিনগুলো দেখা যাচ্ছে। বলতে গেলে এটাই হল বিশ্রাম নেয়ার মত একটা আদর্শ স্থান। এখানে একটা কেবিনও আছে। এর আগের রেস্ট পয়েন্টগুলোতে বসার জন্যে কয়েকটা কাঠের তক্তা ফেলে রাখা হয়েছিল, যেগুলো অনেকটা বেঞ্চের কাজ করে। এর পরে তাপমাত্রা অনেক কমে যাবে বলে এখানে এসে গরম কাপড় পরতে হয়। আমি একটা টিশার্ট গায়ে দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা মনে করিনি। যদিও শেষের দিকে ঠাণ্ডা লাগছিল, তাই, গায়ে কিছু গরম কাপড় জড়িয়ে নিলাম। অন্যরাও যার যার মত করে গরম কাপড় পরে নিল। ততক্ষণে বুঝে গেছি, এখানে কেবিনের ব্যবস্থা করার রহস্য।
৭। ছবিঃ চুড়ার কেবিন, এই দৃশ্য পরের পথ টুকু শেষ করার সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল।
শেষ ধাপের দুরত্ব সবচেয়ে কম। আর, পথ সবচেয়ে খাঁড়া। ঠাণ্ডা লাগবে এটা অপ্রত্যশিত ছিল না, তবে ঠান্ডার তীব্রতা হঠাৎ করে এত বেড়ে যাবে, সেটা আন্দাজের বাইরে ছিল। মরার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মত লাভা পাথরগুলো পায়ের নিচ থেকে প্রায় প্রতিটি কদমে কদমেই সরে গিয়ে উপরে উঠাকে আরো বেশি বিপদজনক করে ফেলছিল। সর্বশেষ ৫০০ মিটার এত খাঁড়া ছিল যে, দেখে মনে হল যে, এই পথে উপরে উঠা অসম্ভব। এখান থেকে ফিরতে হলে পুরো পথই রাতের আধারে হেটে নামতে হবে; এই ভয়ের বিপরীতে চুড়ার উপরের কেবিনের উষ্ণতার কাল্পনিক সুখচ্ছবি মনে এক অদম্য সাহস এনে দিল। শেষ পর্যন্ত, চুড়ায় পা রাখলাম। কিন্তু ততক্ষণে এক পাল শেয়ালের ধাওয়া খাওয়া একলা এক কুকুরের মত হাঁপাচ্ছিলাম। অবশ্য, আমি একা না; প্রায় সবার দশাই একই রকম ছিল।
উপরে উঠেই গিয়ে বসে পড়লাম বিশাল লাভা ক্রেটারের এক পাশে। যা দেখলাম তা ভাষায় বর্ণনা করার সামর্থ্য আমার নেই। এমনকি ছবি দেখেও এর সৌন্দর্য কল্পনা করা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো এক টুরিস্ট তার ব্লগে লিখেছিল যে, চুড়ার যে ছবি তোলা হয়, বাস্তবের চুড়া তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি নান্দনিক আর সুন্দর। কেন বলেছিল, তা উপলব্ধি করতে আমার এক মুহূর্ত দেরী হলোনা। ইতোমধ্যেই আমাদের উত্তেজনা আর আনন্দের নির্মল পাগলামি প্রকাশ পেতে শুরু করেছে গলা ফাটানো উল্লসিত চিৎকার আর বিচিত্র অঙ্গভঙ্গীতে ছবি তোলার মাধ্যমে।
৮। ছবিঃ আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং লাভা লেক।
আগ্নেয়গিরির গুহামুখ বিশাল, প্রায় ২ কিমি চওড়া। এই গুহামুখের ভিতরে পরিষ্কার দুইটা ধাপ রয়েছে। সবচেয়ে নিচের ধাপ বা ক্রেটারের তলদেশে অসংখ্য স্থান থেকে বুদবুদ উঠছে এবং লাভা উদ্গীরন হচ্ছে; তবে গড়িয়ে পরছে টগবগে ফুটন্ত লাভার উপরেই। আর লাভার স্রোত বয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ধারায়। এখান থেকে আরো কয়েকশ মিটার উপরে পরের ধাপ। নিচের ধাপের লাভা উপরের ধাপ পর্যন্ত আসছে না। উপরের ধাপটি জমাট বাধা এবং সমতল।
দিনের আলো কমতে শুরু করার সাথে সাথে দৃশ্যপট অতি দ্রুত আর ব্যাপকভাবে বদলে যেতে শুরু করল। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ প্রায় আধারের আগমনের সাথে সাথে গায়েব হয়ে গেল। আর চোখের সামনে কমলা রঙের লাভার উজ্জ্বলতা ক্রমেই বাড়তে লাগল। শরীরের ক্লান্তি এমনি ছিল, যেন সারাদিন দৈহিক নির্যাতনের অবশ্যম্ভাবী ফলাফলস্বরুপ শরীর অবশ হয়ে গেছে। তেমনি এক ক্লান্ত শরীরে উঁচু পর্বতের চুড়ার প্রায় জমে যাওয়ার মত ঠান্ডার পাশাপাশি ফুটন্ত লাভার উত্তাপ এসে লাগছিল।
৯। ছবিঃ আধার ঘনিয়ে আসছে।
বহু রুপের সংমিশ্রন বোঝাতে যদি ‘বহুরূপী’ শব্দ ব্যবহার করা যায়, তাহলে অনেকগুলো বিপরীতধর্মী ও ভিন্ন ভিন্ন অনুভুতির সংমিশ্রণকে এক শব্দে কি বলে প্রকাশ করা যায় – আমার জানা নেই। ভিন্ন ভিন্ন অনুভুতির যে সংমিশ্রনকে ভাষায় প্রকাশ করার সামর্থ্য আমার নেই, তখনকার অনুভূতি ছিল তেমনি। টগবগ করে ফুটতে থাকা লাভার শব্দ প্রায় ২৫০০ ফুট উপরে থেকেও শুনতে পাচ্ছিলাম, পরিস্কারভাবে। আবার প্রায় বরফ শীতল ঠান্ডায়, লাভার উত্তাপ মুখে এসে হানা দিচ্ছিল যখনই লাভার দিকে তাকাচ্ছিলাম। মুখ ফিরিয়ে নিলেই মনে হচ্ছিল কে যেন মুখে বরফের ঝাপটা দিয়ে গেল। দোজখের আগুন আমি দেখিনি। তবে আফ্রিকার এক পর্বত চুড়ায় বসে রাতের আধারে উজ্জ্বল কমলা রঙের ফুটন্ত লাভার দিকে তাকিয়ে দোজখের ভয়াবহতা আমার মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল; যেন দোজখের খোলা দরজা দেখতে পাচ্ছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল, এই দৃশ্য এই দুনিয়ার হতে পারে না, অন্য দুনিয়ার; মানুষের অনুধাবনের আত্নিক ক্ষমতার বাইরে।
১০। ছবিঃ রাতের অপার্থিব দৃশ্য।
কেবিনের ভিতরে শুধু একটা করে ম্যাট্রেস দেয়া আছে। আমাদের ব্যাগপ্যাকে স্লিপিং ব্যাগ, লাইট এবং শুকনো খাবার নিয়ে এসেছিলাম। কেবিনে বসে চা খেতে খেতে পোর্টারের কাছ থেকে গল্প শুনছিলাম, সে জানালো যে অনেক সময় কুয়াশায় পুরো লেক ঢাকা থাকে, তখন আর নিচের কিছু দেখা যায় না। এমন হলে, সারা রাত পালাক্রমে একজন একজন করে ডিউটি করে, কুয়াশা পরিষ্কার হওয়ার আশায়। যদি কুয়াশা কেটে যায়, তখন সে অন্যদের ডেকে দিবে, এই অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যে। আমাদের কপাল ভাল ছিল যে, আকাশ পরিষ্কার থাকায় লাভা লেকের কমলা রঙয়ের উজ্জ্বল লাভার অপার্থিব দৃশ্য দেখার সোভাগ্য হতে বঞ্চিত হতে হয়নি। এই ঠান্ডায় আমাদের কাউকে এই দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়নি ভেবেই মনে আলাদা একটা আনন্দ বয়ে গেল। আর এত কষ্ট করে, এখানে উঠে, রাত কাটিয়েও যদি লাভা লেকের রাতের সৌন্দর্য দেখতে না পারতাম, তাহলে আফসোস কোন লেভেলের হতে পারতে সেটা ভেবে আরেক দফা প্রশান্তি অনুভব করলাম।
অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসলে, স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে কেবিনের বাইরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম, দৃষ্টি লাভার দিকে। উজ্জ্বল লাভার দিকে এক নজরে তাকিয়ে ছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা, অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মত। প্রায় রাত ১১ টার দিকে ক্ষান্ত হলাম; মুলত ঠাণ্ডার কাছে হার মেনে। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়লাম কেবিনের ভিতরে।
রাতে বরফ জমা ঠাণ্ডা ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। কয়েকবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে, শুধু ঠাণ্ডার কারণে। তবে মাউন্ট নিরাগঙ্গোর চুড়ায় রাত্রি যাপনের সবচেয়ে ভয়াবহ আবার একই সাথে বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছিল টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে। রাতের অন্ধকারে টয়লেটের রাস্তায় নামতে গিয়ে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলাম কখন না লাভা পাথরে পা হড়কে নিচে পরে যাই। এর পরে টয়লেটে বসে খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে রাতের আকাশের তারকামন্ডলীর মনভুলানো দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো অসম্ভব হয়ে পরছিল। বলা হয়নি, টয়লেটে কোন দরজা নেই, এমনভাবে বানানো যে অন্য সকল কেবিন পিছনে থাকবে, তাই প্রাইভেসিও নষ্ট হবে না। আশ্চর্যজনক হল, টয়লেটগুলো শুধুমাত্র কাঠের উপরে প্যান বসানো হলেও, পরিষ্কার ছিল।
ভোরে উঠে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের অপর পাশ দিয়ে সূর্যোদয় দেখে মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয় বোধ হয় এখানেই দেখা যায়। লাভা লেক আর জ্বালা মুখের চারপাশ যখন ধীরে ধীরে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল, আমার হৃদয়ও ক্রমান্বয়ে সমস্ত কিছু প্রাপ্তির এক দুর্লভ অনুভূতিতে ভরে যাচ্ছিল। এই অনুভূতি অর্জন আর সাফল্যের এক অদ্ভুত মিশ্রণের, যা জীবনে কখনো ভুলার উপায় নেই।
নামতে শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝে ফেললাম যে, খাঁড়া পথে নামার চেয়ে উঠা সহজ । আলগা লাভা পাথরে পা পিছলে যাওয়াতে, নিচে নেমে আসাটা আরো কঠিন মনে হচ্ছিল। এছাড়া, গত দিনের শারীরিক ধকলের প্রভাব তো রয়েছেই। এত কিছুর পরেও গত রাতের অপার্থিব দৃশ্যের এক ধরনের ঘোরের মধ্যেই নিচে নেমে আসি। অবশ্য, আমার পোর্টার কয়েকবার নিজে হাতে না ধরলে কি হত, ভাবলেই এখনো গাঁ শিউরে উঠে। নামার পথে বলার মত উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি, সুস্থভাবে নেমে এসেছিলাম আমরা সবাই। তবে স্মৃতির মানসপটে এই অপার্থিব অনুভূতি চিরস্থায়ী হয়ে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পুরো ট্রিপে আমার একমাত্র আফসোস – আমার কাছে ভালো কোন ক্যামেরা ছিল না।
(দ্রস্টব্যঃ প্রায় সব ছবি, সহযাত্রী খালিদের কাছ থেকে সংগৃহীত। তবে, কিছু ছবি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪৫