ড. হুমায়ুন আজাদের শিক্ষক ছিলেন নূর উল হোসেন। আমরা তাঁকে হুসেন স্যার বলতাম। রাঢ়ীখাল স্যার জগদীশচন্দ্র স্কুল ছেড়ে তিনি ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল স্কুলে চলে আসেন শিক্ষকতা করতে। ভাগ্যকুল হরেন্দ্র লাল উচ্চ বিদ্যালয়ে সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতা শেষে নিরবে তার বিদায় নেয়াকে আমাদের ভাল লাগে নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দিতে রাজি হল না। তাই আমরা কয়েকজন তাঁকে সংবর্ধনা দিতে চাইলাম। প্রধান অতিথি কাকে করব? হুসেন স্যারকে বলাতে তিনি তার প্রাক্তন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের নাম বললেন। আমি ও সাইফুল যাই ফোলার রোডে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে। তিনি খুশি হন এবং রাজি হন।
১৯৯৪ সালে হুমায়ুন আজাদের সাথে এভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় ঘটে। আমরা তাঁর কাছ থেকে সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পাঠ নিতে থাকি। তিনি আমাদের সক্রেটিস হয়ে উঠেন। তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীরতর হয়। প্রধান অতিথি হিসাবে তাঁর বক্তৃতা আমাদের বিমুগ্ধ করে। আমাদের কাছে এ ভাষা ছিল নতুন এবং আকর্ষণীয়। আমাদের ভিতরে লালিত চেতনা একটা আশ্রয় লাভ করে। আমার তাঁর ভক্ত হয়ে উঠি। আস্তে আস্তে ভাগ্যকুলের এক ঝাক তরুণ তাঁর অনুরাগী হয়ে উঠে। তাঁর প্রবন্ধের বই ‘নারী’ নিষিদ্ধ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আমি ও সাইফুল অংশগ্রহণ করি। সেখানে শামসুর রাহমান, আহমেদ ছফা, ফরহাদ মাজহারসহ অনেক বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বইটি নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে একটি পত্রিকায় লেখা আমার একটি চিঠি তিনি দেখেছেন বলে জানান।
আমাদের আয়োজিত বর্ষবরণ, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত আসতে থাকেন। ভাগ্যকুল হরেন্দ্র লাল উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি পাঠাগার তৈরিতে তিনি সহায়তা করেন এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আলী আজম জুয়েল ভাই ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। অনুষ্ঠানে মৌলবাদীদের আনাগোলা দেখে আমরা কিছুটা শংকিত হই। আমরা প্রস্তুত থাকি, তাঁর উপর যে কোন ধরনের হামলার চেষ্টা হলে প্রতিহত করার। তিনি বক্তৃতায় বলেন, যারা বেহেস্তে যেতে চায় যাবে, কিন্তু আমি কারো বেহেস্তে যেতে চাওয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করছি না। তাঁর বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ। বক্তব্য শেষে কয়েকজন মৌলবাদী তাঁর বক্তৃতার অনেক বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন, আমরা আপনার কোন বই পড়িনি কিন্তু লোকমুখে আপনার সম্পর্কে ভুল শুনেছি। আপনি যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে সত্য বলেছেন।
১৯৯৪ সাল থেকেই তিনি প্রায়ই ভাগ্যকুলে আসতেন। তাঁর গ্রামে আসতে মন চইলেই ভাগ্যকুলে চলে আসতেন। সাইফুলকে ফোন করে বলতেন, আমি ভাগ্যকুলে তোমরা পদ্মার তীরে চলে আস। তিনি জোৎস্নামাখা নদী, উত্তপ্ত নদীর চর, স্নিগ্ধ সূর্যাস্ত, দুপুরের সোনাগলা রোদ দেখতে পছন্দ করতেন। আমাদের চোখে দেখা গ্রামকে তাঁর কাছে তুলে ধরতাম। তিনি বলতেন, তোমাদের মতো এতো সচেতন তরুণ সমাজ দেখি না। আমরাও ছিলাম কুসংস্কারমুক্ত।
তার বই বেরুলেই আমাদের উপহার দিতেন। তাঁর বই নিয়ে আলোচনা করতাম। তিনি পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভাগ্যকুলে আমার একদল অনুরাগী তরুণ রয়েছে ওরা বই পড়ে, আধুনিক চিন্তা করতে চায়, মানুষের উপকার করতে চেষ্টা করে।
ভাগ্যকুলে তিনি সবচেয়ে ভালবাসতেন সাইফুল ইসলাম টিপুকে। টিপুও স্যারকে এতোটাই ভালবাসতেন যে প্রথম মোবাইল কিনে যাতে, স্যার গ্রামে আসলেই, তাঁকে খুঁজে পায়। সাইফুলের দুটি কিন্ডার গার্টেন ছিল। একটি ভাগ্যকুলে এবং অন্যটি কামারগাঁয়ে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও তাঁর অনুরাগী হয়ে উঠে। এদের মধ্যে শ্যামল সাহা, রতন দাস ও মিন্টু দাস, আলম অন্যতম। আমিও ১৯৯৪ সাল থেকে তাঁর স্নেহভাজন ছিলাম। অনেকবার তাঁর সাথে বিতর্ক করেছি, সাম্প্রতিক সাহিত্য ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছি, বিশ্বসাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্য তুলনা নিয়ে আলোচনা করেছি। তাঁর বই নিয়েও অনেক আলোচনা করেছি। মৌলবাদ আমাদের আলোচনার একটি প্রিয় বিষয় ছিল। ভাগ্যকুলে স্যারের আগমনের প্রধান হোস্ট হতো সাইফুল। ওয়াপদার গেস্ট হাউজে অনেকবারই রাতে থেকেছেন তিনি। ওখানেই ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁর সাথে ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’ বইটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। রাঢ়ীখালের সোহেল রিয়াজুল স্যারের খুবই অনুরাগী ছিলেন। তিনি হুমায়ুন আজাদের সমাধী সৌধের নকশা করেন। নাহিদ হাসান সজিব স্যারের অনুরাগী ছিল। সেলিম ও আলিম দুই ভাইই স্যারের অত্যন্ত অনুরাগী ছিল। সেলিম ও সময় কিন্ডারগার্টেনের অংকন শিক্ষক ছিল। সেলিমদের বাড়িতে আমরা কয়েক বার দুপুরের খাবার খেয়েছি স্যারের সাথে, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ। ভাগ্যকুল হরেন্দ্র লাল হাই স্কুলের শিক্ষক সাইফুর জামান মানিক, মৃত্যুঞ্জয় বর্মন ও শুভ্র সরকার হুমায়ুন আজাদের খুব অনুরাগী ছিলেন। আলী আক্কাস নাদিম ভাই ও শাহজাহান শিকদার ভাই, আবুল কালাম রিপনেরও অনুরাগ ছিল স্যারের প্রতি। অসীম কুমার বর্মনও স্যারের অনুরাগী ছিল। স্যার আক্রান্ত হলে শ্রীনগরে গড়ে উঠে বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল দত্ত, সাংগঠনিক সম্পাদক তাপস দাস, সহসভাপতি সুমন্ত রায়, সান্দ্র মোহন্ত, ইকবাল হুসাইন বাবুল স্যারের একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন। এই সংগঠনের সহসভাপতি ফেরদাউসী কুঈন ও তার ছোট বোন মুনমুন মোনায়েম স্যারের খুবই অনুরাগী ছিলেন। হুমায়ুন আজাদ ওদের বাড়িতেও কয়েকবার গিয়েছেন। সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরাও হুমায়ুন আজাদের অনুরাগী ছিলেন। এই সংগঠনটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। আমরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছি তাঁকে স্মরণ করে। রাড়িখালের সাইদুজ্জামান খান, প্রয়াত আমানুল্লাহ আমান এবং কিবরিয়া ভাইও স্যারের অনুরাগী ছিলেন।
স্যার ভাগ্যকুলে আসলেই আমাদের মধ্যে একটি সাড়া পড়ে যেত, স্যার এসেছেন। আমরা টেক্সাস কিন্ডারগার্টেনেই বেশি বসতাম। তিনি গোবিন্দ মিস্টান্ন ভান্ডারেও আমাদের নিয়ে বসতেন, বালুশা বা অন্য কোন মিষ্টি খেতেন। অনুরাগীদের নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন পদ্মা নদীতে বা পদ্মার চরে। ওয়াপদা রেস্ট হাউজেও অনুরাগীদের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন। ভাগ্যকুলের আকাশলীন এডুকেশন আয়োজিত কয়েকটি অনুষ্ঠানেও তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। এই অনুরাগীদের টানেই তিনি বারবার গ্রামে ছুটে আসতেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৪৬