বইটি হাতে পেতে সময় লাগলো। ইচ্ছে ছিল কিন্তু প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিলে হাতের কাছে পাচ্ছিলাম না। প্রকাশের সাথে সাথে হঠাৎই ঝড় উঠে। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা তীব্র প্রতিবাদ করে। বাংলাদেশপ্রতিদিন পত্রিকাটি ধারাবাহিকভাবে ছাপাতে গিয়েও সেই প্রতিবাদে থেমে যেতে বাধ্য হয়। তারা প্রতিবাদকারীদের বক্তব্যই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকে। লেখাগুলো নিয়মিতই পড়েছিলাম। সেই চাপে মাওলা ব্রাদার্স বইটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ে লেখা অনেকগুলো বইই বিতর্কিত হয়েছে। একে খন্দকারের ১৯৭১ ভিতরে বাইরে বইটি প্রকাশ করেছিল প্রথমা। বিতর্কের মুখে লেখক সংবাদ সম্মেলন করে বইটিতে ভুল থাকার কথা স্বীকার করে বঙ্গবন্ধু ও দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রর্থাণাও করেছিলেন। তবুও তিনি বিপদমুক্ত হতে পারেননি। প্রকাশনী সংস্থা বিতর্কের মুখে বইটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। বইটিতে লেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে বলেছিলেন, জয় পাকিস্তান! (বইটি হাতের কাছে নেই পাকিস্তান জিন্দাবাদও হতে পারে)। সিরাজুল আলম খান তার বইটিতে জানিয়েছেন- বঙ্গবন্ধু জয়বাংলা বলেই বক্তব্য শেষ করেন। একই বছর প্রকাশিত শারমিন আহমদ এর ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইটি নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। বইটিতে তাঁর পিতা ও পরিবারকে প্রাধান্য দিয়েই লিখেছিলেন। তবুও স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে তাজউদ্দীনকে বের করা দেয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয় এবং লেখক চাপে পড়েন। মতিউর রহমান রেন্টুর ‘আমার ফাঁসি চাই’ ছিল বহুল সমালোচিত বই। লেখক তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। তার স্ত্রীও ওই বাসায় থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। বইটি ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বিএনপির সময় বইমেলায় একটি স্টলও বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল যেখানে সবসময় কয়েকজন পুলিশ প্রহরায় থাকতো। তিনি সুদীর্ঘকাল আওয়ামীলীগের সুবিধা নিয়ে কেনই এমন তীব্র বিদ্বেষমূলক বই লিখলেন তা বোধগম্য হওয়া কঠিনই। বই তিনটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। রাজনীতি নিয়ে অনেকগুলো বই পড়েছি।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। খুবই প্রত্যাশা ছিল তিনি একটি বই লিখবেন এবং সেখানে তার কর্মকাণ্ডগুলোর সত্য বর্ণনা উঠে আসবে। বইটি সামান্যই প্রত্যাশা পূরণ করেছে। বইটি সুলিখিত নয়। ধারাবাহিকভাবে উঠে আসেনি বক্তব্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অনেকটাই বাইপাস করেছেন। শামসুদ্দিন পেয়ারার নাম প্রচ্ছদে যেভাবে আছে তাতে তাকেই লেখক মনে হয়। তবে বস'ত তিনি অনুলেখক বা সম্পাদক। বইতে নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ নিয়ে যতটা লিখেছেন তার বিপরীতে তার দেখা ওই সময়ের রাজনীতির আরো অনেক বিষয়ই উঠে আসেনি। এ কারণেই বইটিতে আত্মপ্রচারের অভিযোগ উঠেছে। নিউক্লিয়াসকে তিনি যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্য কেউই নিউক্লিয়াসকে সেভাবে গুরুত্ব দেন নি। বইটি পড়ে মনে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল রূপকারই তিনি এবং নিউক্লিয়াস/বিএলএফ। তবুও বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানকে রহস্যপুরুষ হিসেবে রেখে দিলেও তার গুরুত্ব ও ভূমিকার কথা কেউ বলেনি। আসলে দেশে ক্ষমতায় না থাকলে তার কথা বলার নজিরও নেই। এবার তিনি নিজেই নিজের কথা বলেছেন। অনেক অজানা তথ্যও উঠে এসেছে। যেমন আমার জাতীয় পতাকা নিয়ে অনেক তথ্যই অজানা ছিল। জানতাম শিব নারায়ণ দাস ডিজাইন করেন। কে শিব নারায়ণ দাস? এখন অনেক তথ্যই বাইরে আসলো। জয়বাংলা বাহিনী কর্তক বঙ্গবন্ধুকে ব্যাটালিয়ন ফ্লাগ প্রদান করবে। কাজী আরেফ আহমেদকে পতাকা তৈরি দায়িত্ব দেয়া হয়। মার্শাল মনি ও আসম আবদুর রব প্রস্তাব করলেন পতাকার জমিন হবে বটলগ্রীণ। শাহজাহান শিকদার বলরেন, লাল রঙের কিছু একটা থাকা দরকার। নকশা করেন কাজী আরেফ। নকশার অনুমোদন দেন সিরাজুল আলম খান। কাজী আরেফ প্রস্তাব করেন লাল সূর্যের মধ্যে মানচিত্র দেয়ার যাতে ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল নিয়ে সরকারি প্রচার বন্ধ করা যায়। পতাকা সেলাই করেছিল অবাঙালি দর্জি আব্দুল খালেক ও তার সহযোগী মোহাম্মদ নাসিরউল্লাহ। কুমিল্লার নিউক্লিাস সদস্য শিব নারায়ণ দাসকে আনা হয় বৃত্তের মধ্যে মানচিত্র আঁকতে। তিনি জানান, তিনি মানচিত্র আঁকতে পারেন না- রঙ করতে পারবেন। ট্রেসিং পেপার থেকে দেশলাইর কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে তিনি আঁকলেন মানচিত্র। পতাকাটার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি তৈরির দাবি অন্য কেউ অন্যকোনভাবেতো করেননি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ৭:৪৪