somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
নিজেকে বোঝার আগেই মনের মধ্যে একটা চেতনা তাড়া করে ফিরতো। এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, একটা বিপ্লব দরকার। কিন্তু কিভাবে?বিপ্লবের হাতিয়ার কি? অনেক ভেবেছি। একদিন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো একটি শব্দ, বিপ্লবের হাতিয়ার 'কলম'।

পেই দে লোয়া’য় Pay des loir চার দিন। পর্ব - ১

১৯ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রীষ্মের ছুটি মূলত ইউরোপিয়ানদের নিকট সারা বছরের এক উৎসব আনন্দের প্রতীক্ষা।ইউরোপ জুড়ে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয় জুলাই থেকে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। কর্মক্ষেত্রগুলোতে চলে কর্মীদের অবকাশে যাপনের উৎসব।সারা বছরের কর্ম ক্লান্তির বিষাদ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নতুন বছরের জন্য কর্মোদ্যমী হবার লক্ষ্যে বায়ু বদলের জন্য স্থান পরিবর্তনের হুলুর পরে যায় এই সময়।দিগুণ বেড়ে যায় দূরবর্তী বিমান, ট্রেন,বাসের টিকেটের দাম ।হোটেলে রেস্তোরাগুলো অতিথিদের সেবায় ক্লান্তিহীন কর্ম ব্যস্ত সময় পার করে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে মিশেল ও জান্নাত বাসায় অবসর সময় পার করছে।ইচ্ছে ছিল ওদের নিয়ে এবার সক্রেটিস, প্লেটোর দেশ গ্রিসের রাজধানী এথেন্স ঘুরতে যাবো।প্রথমত এথেন্সের হোটেল ভাড়া ও রেস্তোরাঁর খাবার খরচ ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম এবং অনেক আগে বিমান টিকেট বুকিং করলে সাশ্রয়ী মূল্যে বিমানে যাতায়াত করা যায়।
আমার ছুটির সময় নিয়ে একটু দ্বিধান্বিত থাকায় বিমানের টিকেট দু মাস পূর্বে বুকিং করার পরিকল্পনা থাকলেও তা আর করা হলো না।যখন ছুটির সময় নিশ্চিত হলাম তখন তাৎক্ষণিক টিকেট কাটতে হবে।ইন্টারনেট ঘেঁটে প্যারিস এথেন্সের যাওয়া আসার বিমানের ভাড়া দেখে হতাশ হলাম। কারণ ভ্রমণ বাজেট শুধু বিমান ভাড়াতেই নিঃশেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম ফ্রান্সের মধ্যে কোন সমুদ্রের নিকটবর্তী শহরে এবারের গ্রীষ্মের ছুটি কাটাবার। ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করে আমাদের ভ্রমণ গন্তব্য নির্ধারণ হলো ফ্রান্সের পেই দে লোয়া (Paye des loir) অঞ্চলের প্রধান শহর শহর নন্তে (Nantes)।ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ আগস্ট ২০১৯ আমাদের যাত্রা, এবং ফেরা ১৩ আগস্ট।
বুকিং ডট কমের মাধ্যমে নন্ত শহরের তেরত এলাকায় চার দিনের জন্য একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া করা হলো।
Oui sncf এর সাইটে গিয়ে ৯ আগস্টের প্যারিস থেকে নন্তের ভ্রমণ মূল্য তালিকা দেখে নিলাম। সকাল ৭,০০ টায় ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের টিকেটের মূল্য সুলভ হওয়ায় ভোরের ট্রেনে আমাদের যাত্রা নিশ্চিত করলাম।ইউরোপের যাত্রী পরিবহন ভাড়া গন্তব্য অনুযায়ী নির্ধারিত নয়, অনেকটা আমাদের দেশের শেয়ার বাজারের মত, একই গন্তব্যস্থলের ভাড়া একই দিনে শুধু সময়ের তারতম্যে দিগুণ হয়ে যায়,আবার অর্ধেকে নেমে আসে।তাই, ইন্টারনেটে ভালো ভাবে অনুসন্ধান করলে যে কোনো পরিবহণের টিকেট সাশ্রয়ী মূল্যে কেনা যায়।

এখানকার ট্রেনগুলো খুব দ্রুতগামী তাই যাত্রা পথের বাইরের দৃশ্য ট্রেন থেকে ভালোভাবে দেখা যায়না, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমদের ফেরাটা হবে বাসে, যদিও ট্রেনের থেকে দুই ঘণ্টা সময় বেশী ব্যয় করতে হবে ফেরার পথে।

আমাদের মেয়ে মিশেল, কিছু দিনের জন্য অন্য কোথাও সময় কাটানো তার প্রিয় শখগুলোর মধ্যে একটি। নতুন জায়গায় তার নিজের বিছানায় শোয়া ,নিজের রুমে ইচ্ছে মত সময় কাটানো খুব উপভোগ করে। ২০১৬ সালে আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম ফ্রান্সের Cean ক শহরে।ছিল দুই দিনের ছোট্ট ভ্রমণ।হোটেলের একটি কামরা ভাড়া করেছিলাম।সেই কামরায় তার জন্য আলাদা ছোট্ট একটি বিছানা ছিল।তার নিজস্ব বিছানা এই ভেবে যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলো, তা দেখে আমি অনেকটাই আশ্চর্য হয়েছিলাম। পাঁচ বছরের এক শিশু,তার নিজের মত কিছু পাওয়ার মধ্যে এতো আনন্দ দেখে আমি ভাবছিলাম, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই নিজের মত করে চাওয়া থাকে, কারো প্রাপ্তি ঘটে, কারো ঘটে না। প্রাপ্তি যদি ধরা দেয় তাহলে উচ্ছ্বাসটা এমনি হয়।সেটা হোক কোন শিশু বা পূর্ণাঙ্গ কোনো মানুষের।

এবার পুরো একটা আধুনিক এপার্টমেন্ট চার দিনের জন্য আমাদের।এপার্টমেন্টের সমস্ত স্পেসের ছবিগুলো বুকিং ডটকমের সাইটে রয়েছে।মিশেলের রুমটি ছবিতে বেশ ছিমছাম দেখাচ্ছে।এপার্টমেন্ট বুকিংয়ের পর থেকে সুযোগ পেলেই মিশেল আমাকে তার রুমের ছবি দেখাতে বলে, ছবি দেখার পর সে কি ভাবে দিন কাটাবে সেই পরিকল্পনা সাজায় আমার সাথে।
এর মধ্যে ট্রেনের টিকেটের শর্ত অনুযায়ী তিনটি নির্ধারিত মাপের আলাদা আলাদা লাগেজ কেনা হয়েছে।মিশেলের ব্যস্ততা শুরু হল তার প্রয়োজনীয় খেলনা সামগ্রী ও কাপড় চোপড় গোছগাছ করতে। যাত্রার পূর্ব দিন পর্যন্ত চলল এই ব্যস্ততা।

আমার চিন্তা বেল্কনি বাগানের ফুল গাছগুলোকে নিয়ে।গ্রীষ্মের সময় প্রতিদিন নিয়ম করে দু বেলা ওদের শরীর ভিজিয়ে না দিলে প্রাণ যায় যায় অবস্থা।এতদিনের যত্নে বেড়ে ওঠা প্রাণগুলো চারদিনের অনাহারে নিঃশেষ হবে, এই ভেবে ভ্রমণ আনন্দ উপর এক কালো ছায়া ছেয়ে আছে।প্যারিসে আমাদের বেশ কিছু পারিবারিক বন্ধু রয়েছে, যেকোনো বিপদে আপদে যখন ডাকি আত্মার টানে পাশে এসে দাঁড়ায়।কিন্তু এবার ফুল গাছগুলোর জীবন রক্ষার্থে কোন বন্ধুর সাহায্য চাইতে দ্বিধান্বিত হলাম।এখানকার ব্যস্ততা একটু ভিন্ন রকম।কারো পেশাগত কাজের ব্যস্ততা, আবার পেশাগত কাজ না থাকলেও সরকারী প্রশাসনিক দৌড়াদৌড়ি লেগেই থাকে। তাছাড়া পরিবারের নিজস্ব কাজকর্ম এখানে নিজেদেরই করতে হয়।ঘড়ির কাঁটায় সময় মেপে আমাদের প্রবাস জীবন।তবুও এরমধ্যেই একে অন্যের প্রয়োজনে ছুটে যেতে হয়।এভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের প্রবাসী বাঙ্গালি সমাজ।আবার তিক্ত অভিজ্ঞতাও কম নয়।প্রবাসে প্রত্যেকেরই নতুন অবস্থায় জীবনেই চরম বাস্তবতা পাড়ি দিয়ে স্থিতি অর্জন করতে হয়।এই দুর্যোগকালীন সময়ে প্রত্যেকের জীবনেই কোন মহৎ হৃদয়ের মানুষের সংশ্রব ঘটে।যাদের পরামর্শ ও সহায়তায় দুঃসময় থেকে সুময়ের তীরে উঠতে সহজতর হয়। সুসময়ের তীরে ওঠার পর অনেকেই মনে রাখে ওই দুঃসময়ের দুঃসহ স্মৃতি।এমন মানুষেরা সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার বাস্তবতা অনুধাবন করে নতুন বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায় হৃদয় দিয়ে।এর বিপরীত মানুসিকতার মানুষের সংখ্যা এই প্রবাসে কম নয়। যারা অন্যের হাত ধরে বিপদ সীমানা পাড়ি দেবার পর বেমালুম ভুলে যায়, তার সেই করুণ সময়ের মুহূর্তগুলো। প্রকাশ ভঙ্গী হয়ে যায়, কখনোই এই প্রবাসে তাকে বিপদ স্পর্শ করেনি।বিশেষ মর্যাদায় তিনি ফ্রান্স সরকারের অতিথি হয়েছেন।অনেকে নিজেদের অনেক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মানুষও ভাবতে থাকেন।এরা নিজেরা খায়দায়, পয়সা জমায়, চার পাশে অন্যের ঝক্কি জামেলা থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে নিরিবিলি জীবন যাপন করে।একমাত্র নিজের বিপদ ছাড়া অন্যের সংস্পর্শে যায়না।এদের জীবন ও জগতের একমাত্র সংগ্রাম শুধু নিজেদের ভালো রাখা।আমার নিজের প্রবাস জীবনে বেশকিছু এমন মানুষের সাথে চলার সুযোগ হয়েছে।এদের মূল চরিত্র বুঝতে না পেরে অনেক সময় সামান্য ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি।এমন আচরণে অপমান বোধ করেছি।কিন্তু এই প্রবাসে এদের জীবনে একটু হলেও আমার অবদান ছিল।সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমার নিজের মধ্যে ভিন্ন এক উপলব্ধি জন্ম নিয়েছে। »প্রবাসের প্রকৃত বন্ধু বলতে এখন বুঝি, প্রবাসে নিজের বসবাসের আইনগত অনুমোদিত কাগজ এবং জীবিকা নির্বাহের পেশাগত কাজ » ।এই দুটি জিনিসই হচ্ছে প্রবাসের বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন।যাইহোক, এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা কারণে এখন নিজের সমস্যাগুলো নীরবে নিজেই সমাধানের চেষ্টা করি।পরিক্ষিত আপন মানুষদের কাছেও সাহায্য চাইতে দ্বিধায় পড়ে যাই।অনেক সময় বিপদকালীন সময় পার করার পর পেছনের গল্প শেয়ার করি।অনেকে অভিমানও করে,কেন তাদেরকে জানানো হলনা।যাইহোক, ফুল গাছগুলোর জীবন রক্ষার জন্য কাছের দুই একজন বন্ধুকে অনুরোধ করতে চাইলাম, দুই দিন যেন আমার বাসায় এসে গাছগুলোকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।কিন্তু দারুণ দ্বিধা চেপে বসায় কাউকেই আর বলা হলনা।
আমাদের ট্রেন ভোরে ,তাই আগের দিন বাসার বড় বড় পাত্রের মধ্যে পানি ঢেলে যতগুলো সম্ভব ফুলের গাছ একত্রিত করে গোড়ার অংশগুলো ডুবিয়ে দিলাম পানির মধ্যে।চার দিনের মধ্যে প্রিয় গাছগুলোর পরিণতি কি হবে তা না ভেবেই উপস্থিত বুদ্ধিতে এমনটাই করতে হল।

আমাদের ট্রেন ছাড়বে প্যারিসের মোঁপারনাস (Montparnasse) স্টেশন থেকে। ০৯ আগস্ট সকালে আমাদের ট্রেন ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট পূর্বে উপস্থিত হলাম প্লাটফর্মে।আমাদের নির্ধারিত ট্রেনের কামরা সহজেই খুঁজে পেলাম।ট্রেনের জানালার পাশের সিটে বসে মিশেল ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাইরের দৃশ্য দেখতে।আমাদের গল্প গুজবে কেটে গেলো তিনঘণ্টা সময়।সকাল দশটায় নন্ত ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেই বৃষ্টির অঝর ধারা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল।চুক্তি অনুযায়ী আমাদের এপার্টমেন্টে ওঠার সময় বিকেল তিনটে।আমার হোটেলে চাকুরীর অভিজ্ঞতা রয়েছে।কোন কক্ষ যদি চুক্তি সময়ের পূর্বে প্রস্তুত থাকে তাহলে হোটেল কর্তৃপক্ষ আগত অতিথিকে আসার সঙ্গে সঙ্গে রুমের চাবি দিয়ে দেয়।সেই চিন্তা করে আমাদের এপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষের দেয়া ফোন নম্বরে কল করে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি এখন এপার্টমেন্টে উঠতে পারব কিনা? উত্তরে বলল, এখনো পূর্বের অতিথিগণ এপার্টমেন্টে অবস্থান করছে তাই নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ফ্লাটে চাবি দেয়া সম্ভব হবে না।মাঝে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগেজ নিয়ে ঘোরাঘুরি বিড়ম্বনার সৃষ্টি করবে ভেবে কর্তৃপক্ষকে আমাদের লাগেজগুলোকে কোথাও রাখার অনুরোধ করলাম। তারা একটি ঠিকানা এস এম এস করে পাঠাল।
এর মধ্যে সবারি পেটে টান অনুভব হচ্ছে।স্টেশন থেকে বের হবার মুখে একটি রুটির দোকান।ক্ষুধার্ত অপেক্ষমাণ ও আগত যাত্রীদের উপচে পড়া ভীর।বসার জায়গা না পেয়ে মিশেল ও জান্নাতকে স্টেশনের বিশ্রাম কক্ষে বসিয়ে রেখে শহরের আশপাশ একটু ঘুরে দেখা এবং কিছু খাবার কেনার জন্য বাইরে বের হলাম।স্টেশন থেকে একটু দূরবর্তী এলাকা বেশ নির্জন।আশেপাশের রাস্তা ও অলিগলি হেঁটে একটাও বুলনজারী (রুটির দোকান) পেলাম না।একটু হতাশ হলাম,পয়সা খরচ করে কোন ভূতুড়ে শহরে এসে পড়লাম কিনা?প্যারিসের বাইরে ফ্রান্সের অন্য শহরগুলোতে যে জনশূন্য ভাব পরিলক্ষিত হয়, সে পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে।রাস্তার মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল, তাই বেশী দূর আর না এগিয়ে আবার ট্রেনষ্টেশনের দিকে ফিরলাম।নন্ত রেলস্টেশনটি বেশ বড় এবং ব্যস্ত, এখান থেকে পেই দে লোয়া অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত ছোট শহর ও ফ্রান্সের অন্যান্য বড় শহরগুলোর উদ্দেশ্যে দ্রুতগামী ট্রেনগুলো ছেড়ে যায়।ফিরে এসে দেখি স্টেশনের রুটির দোকানের কয়েকটি চেয়ার টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে।আমার স্ত্রী জান্নাতকে ফোন করে রুটির দোকানে আসতে বললাম। বাইরে থেমে থেমে প্রবল বৃষ্টি।কিছু কেক ও কফি নিয়ে বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষায় খাবার দোকানটির মধ্যে কাটিয়ে দিলাম প্রায় এক ঘণ্টা সময়।
স্টেশন থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা দূরে বাস স্টেশন।এখান থেকে বড় বড় বাস পেই দে লোয়া অঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটন স্থানের দিকে আগত পর্যটকদের নিয়ে ছুটে যায়।পাশেই রেন্ট এ কারের কাউন্টার,এখানে মটর গাড়ি ভাড়া দেয়া হয়।যাদের ফ্রান্সের অনুমোদিত ড্রাইভিং লাইসেন্সে রয়েছে তারা নির্ধারিত ভাড়া মূল্যে ইচ্ছে অনুযায়ী কয়েক দিনের জন্য এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে পারে।কাউন্টারে বসা এক তরুণীকে বোঁজু(bonjour শুভ সকাল)বলে আমাদের এপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো ঠিকানা দেখিয়ে বললাম,মাদাম কি ভাবে যেতে পারি এই ঠিকানায়, আমরা এই শহরে নতুন কিছুই জানি না। ।ফরাসিরা প্রতিটি ক্ষেত্রে ভদ্রতা সূচক সম্ভাষণ ব্যবহার করে থাকে।যদি সেটা কেউ না করে তাহলে অভদ্রতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।মেয়েটি খুব আন্তরিকতার সহিত আমাদেরকে মেট্রোপলিটন বাস স্টেশনের পথ দেখিয়ে দিলো।প্যারিসে হাতে একটি স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট থাকলে পুর শহরটাই যেন নিজের হাতে, কোথাও যাওয়ার জন্য কাউকে জিজ্ঞাসা না করলেও চলে। গুগল ম্যাপে শুধু গন্তব্যের ঠিকানা লিখে অনুসন্ধান করলেই, কিভাবে,কোন বাস,ট্রাম, কত নম্বর মেট্রো বা ট্রেন ধরতে হবে এবং কোন পথে কতটুকু পথ হাঁটতে হবে সব তথ্য মোবাইলের মনিটরে ভেসে ওঠে।প্যারিসের জীবন যাপনে এভাবেই অভ্যস্ত কিন্তু এখানে এসে একটু হোঁচট খেলাম।গুগল ম্যাপ শুধু দূরত্ব দেখায় কিন্তু কিভাবে যাবো সেই তথ্য দেখায় না।যাই হোক,একটু হেঁটে মেট্রোপলিটন বাস স্টেশন পেলাম, কিন্তু কত নম্বর বাস ধরতে হবে সেই বিড়ম্বনায় পড়তে হল আবার।স্টেশনে অপেক্ষমান এক বাস চালকে আমাদের ঠিকানাটা দেখিয়ে জেনে নিলাম কোন বাস ধরে যেতে হবে।বাসে করে মূল শহরের মধ্যে প্রবেশ করার পর নতুন শহর সম্পর্কে নতুন ধারণা সৃষ্টি হতে লাগলো।আধুনিক শহর কিন্তু জনমানবের তেমন হুড়োহুড়ি নেই। আমরা এই শহরে অচেনা,তাই বাসের ড্রাইভার খুব গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঠিকানা অনুযায়ী কমার্স এলাকার আশে পাশের একটি বাস স্টপেজে নামিয়ে দিলেন।এখান থেকে গুগল ম্যাপের সাহায্যে পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের মধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।আমাদের লাগেজগুলো যেখানে রাখতে এসেছি সেটা মূলত বুকিং ডট কমের মাধ্যমে আমরা যাদের কাছ থেকে এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছি সেই প্রতিষ্ঠানের অফিস।আমাদের পরিচয় দেবার পর কর্মরত এক তরুণী লাগেজগুলো রেখে দিলো।এরা মূলত একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে হোটেল ব্যবসা করে।একটি অফিসের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে অথবা মিডিয়া হয়ে কমিশনের ভিত্তিতে এপার্টমেন্ট মালিকদের বাসা ভাড়া দিয়ে থাকে। সুসজ্জিত এপার্টমেন্টগুলো পর্যটকরা ওঠার সময় একবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দেয়, এবং কোন সমস্যা বা প্রয়োজনে এদের অফিসে ফোন করে সমাধান করতে হয়।এখানে এসে ভিন্ন রকমের এক পর্যটন ব্যবসার সাথে পরিচিত হলাম।আমার ধারণা ছিল আমরা হয়তো কোন ব্যক্তির কাছ থেকে এপার্টমেন্ট ভাড়া করছি এবং এপার্টমেন্ট মালিকের কাছ থেকে চাবি বুঝে নেবো। সেই ধারণা এই অফিসে এসে পরিবর্তন হল।তিনতে বাজতে এখনো অনেক দেরী, দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের সময় হয়ে গিয়েছে।এখান থেকে বেরিয়ে নতুন শহরটি একটু ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা তিনজন।রাস্তার পাশ দিয়ে শৃঙ্খলিত সারি সারি ইউরোপীয় ডিজাইনের ইমারত।রেস্তোরাগুলোতে চলছে ফরাসিদের মধ্যাহ্ন ভোজের আড্ডা। আমাদের পছন্দের রেস্তোরা খুঁজে বের করতে চোখ রাখছি রাস্তার দুই ধারে।ফরাসি রেস্তোরাঁ প্রতিটি শহরেই সহজলভ্য কিন্তু ফরাসি খাবার মেন্যু স্বাস্থ্য সম্মত হলেও আমাদের বাঙালী জিহ্বার পরিপূর্ণ তৃপ্তি মেটাতে অক্ষম এবং দামও বেশী।ইউরোপের কোথাও গেলে আমি প্রথমত খুঁজি তুর্কী গ্রেক স্যান্ডউইচের রেস্তোরা। পোড়ান মাংস,সালাদ এবং বিভিন্ন স্বাদের সস রুটির মধ্যে মুরিয়ে এই স্যান্ডউইচ বানানো হয়।এটি মূলত তুর্কীর খাবার হলেও এই খাবারটির মধ্যে আমি দেশী স্বাদের পরিতৃপ্তি পাই।তা নাহলে, খুঁজি মাকডোণাল্ড, কেএফসি ও অথবা সাবওয়ে চেইন রেস্তোরাঁ।

অচেনা শহরে বুকে এলোমেলো কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে চোখে ধরা দিলো একটি মাকডোণাল্ড রেস্টুরেন্ট।পাশেই দুটি তার্কিশ কাবাবের রেস্তোরা।মিশেলের একটা ব্যবস্থা হল ভেবে স্বস্তি অনুভব করলাম।কারণ মাকডোণাল্ডের বাচ্চাদের মেন্যুর সাথে একটি খেলনা উপহার থাকে,সেই লোভে মাকডোণাল্ডেরের প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক।
মিশেল মাকডোণাল্ডের মেন্যু আর আমরা দুজন আলজেরি সসের স্বাদে তার্কিশ গ্রেক স্যান্ডউইচ দিয়ে দুপরের খাওয়ার পর্ব শেষ করলাম।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে এগুতেই চোখে পড়লো বিশাল এক চত্বর। চত্বরটির মাঝে স্থাপিত বৃহৎ আকারের একটি ভাস্কর্য।ভাস্কর্যের চারিধার দিয়ে উছলে পড়ছে পানির ধারা।ঝর্ণাধারার ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে পুরো চত্বরে জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শত শত ছোট বড় ভাস্কর্য। যেগুলো মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত ভাস্কর্যের কপি।যেমন আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার। এমন সব ভাস্কর্যের সাথে এই চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে পৌরাণিক গ্রিক দেব দেবতা ও রূপকথার নানা কাল্পনিক চরিত্রের মূর্তি।মনে হল,চত্বরটিতে পৃথিবীর সকল বিখ্যাত ভাস্কর্যদের মিলনমেলা চলছে। এই সম্মিলনে অংশগ্রহণ করতে বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলো ছুটে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।


এই স্থানটির নাম প্লাস রয়্যাল, নন্ত শহরের কেন্দ্রস্থল বলা হয়।এই বিশাল চত্বরের মাঝে বৃহৎ গোলাকার একটি ঝরনা স্থাপিত এবং ঝরনার চারপাশ দিয়ে কয়েকটি মূর্তি বসানো। নন্তের স্থপতি মাথুরিন ক্রুসি ১৭৮৬ সালে এটির নকশা করেন এবং ১৭৯০ সালে নির্মিত হয়। এই চত্বরে ফ্রান্সের অনন্যা স্থানের মত বিশেষ কোন রাজার মূর্তি রাখা হয়নি কিন্তু স্থানটির আলাদা এক প্রতীকী মূল্য রয়েছে। স্থানটি এই শহরের উৎসব আনন্দ, আড্ডা, রাজনৈতিক সমাবেশ জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
আমরা চত্বরের মূল ভাস্কর্য বা ঝরনার চারপাশে সুজজ্জিত ভাবে সাজানো শত শত যে ভাস্কর্যগুলো দেখলাম এগুলো মূলত স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শিল্পী স্তেফান ভাগনি’র সৃষ্টি ভাস্কর্য।এগুলো মূলত ২০১৯ সালে পর্যটকদের জন্য প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য এই ঐতিহ্যবাহী চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে।
কিছু কিছু মূর্তির গায়ে লাগান রয়েছে ছোট ছোট কিছু পোস্টার। একটি পোস্টারের লেখা দেখে ভাবনার জন্ম দিলো। পোস্টারে ফরাসি ভাষায় লেখা «.Où est la justice» অর্থাৎ বিচার কোথায়।ফ্রান্স নারী পুরুষের সমঅধিকারের দেশ। ঐতিহ্যকে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিটি মানুষের রাষ্ট্রীয় ভাবে অধিকার সংরক্ষণ করা হয়।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ফরাসি জাতি আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছে।ফরাসি বিপ্লব ফরাসিদের এক অনুপ্রেরণা ও ঐতিহ্য।সেই ইতিহাস অনুসরণ করে কোন ফরাসি জনগণ যদি ভাবে রাষ্ট্রের তরফ থেকে তারা বৈষম্য মূলক আচরণের স্বীকার হচ্ছে, তবে তারা অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে, রাজপথে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরাও মানুষের চাওয়াকে গুরুত্বের সহিত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে, মানুষের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।মূর্তির গায়ে লাগান পোস্টারগুলো সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিলো।এই চত্বরটি যে আন্দোলন সংগ্রাম ও প্রতিবাদ প্রকাশের জায়গা তারই প্রমাণ মিলল সংগ্রামী মানুষদের লাগান পোস্টারে।

এই চত্বরের মূর্তিগুলির সাথে আমাদের ভালো একটা সময় কাটল। ঘড়ির কাঁটায় বেলা দুটো বাজতেই আমরা ছুটে গেলাম আমাদের লাগেজগুলো সংগ্রহ করতে।এপার্টমেন্ট ভাড়া প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের অফিসের কর্মরত তরুণী আমাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন, কিভাবে আমাদের এপার্টমেন্টে পৌঁছুতে হবে।এই শহরে মেট্রো- রেল নেই।।পাবলিক ট্রান্সপোর্ট মধ্যে ট্রাম ও বাস সার্ভিস রয়েছে।তিনটি ট্রাম লাইনের মাধ্যমে শহর ও শহরতলিতে সহজে যাতায়াত করা যায়। জটিলতায় না জরিয়ে আমরা হেঁটে মিডিয়াটেক ট্রামষ্টেশনে এলাম।আমাদের যেতে হবে তেরত নামক স্থানে।স্টেশনে ম্যাপ দেখে ট্রামের আমাদের সঠিক দিক নির্ধারণ করে ট্রামে উঠে পরলাম।আমার ধারনা ছিল, নন্ত শহরের আশে পাশে হবে আমাদের এপার্টমেন্ট। কিন্তু ট্রাম একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল।ট্রামের জানালা দিয়ে দেখছি নতুন শহরের চারিধার।গ্রীষ্মের আলোঝলমল দুপুর,সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে,রাস্তার ধার ও বাড়ীর আঙ্গিনায়গুলোতে ফুলের সমাহার।সুপরিকল্পিত শহর কিন্তু জনমানবের আনাগোনা খুব কম। যতগুলো বিল্ডিং দাঁড়িয়েছে ততগুলো মানুষ চোখে পড়লনা। মনে হচ্ছে একটি ফুল বাগানের মধ্যদিয়ে আমাদের ট্রাম এগিয়ে যাচ্ছে। এতটাই সুপরিকল্পিত শহর।প্রায় ত্রিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম আমাদের গন্তব্যের তেরত স্টেশনে।এক পথচারীকে আমাদের ঠিকানা দেখিয়ে জানতে চাইলাম কিভাবে যেতে হবে।ট্রাম স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ।তাই বাসা খুঁজে পেতে খুব বেশী বেগ পেতে হলনা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এলাকা। আমাদের বাসার বিল্ডিংটিও আধুনির নকসায় গড়া।চুক্তি পত্রে উল্লেখিত বাসায় প্রবেশের কোড ও নির্দেশাবলী অনুসরণ করে বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করলাম কিন্তু আমাদের নির্ধারিত ফ্লাট নম্বরের পাশে এসে একটু বিড়ম্বনায় পরতে হল। ধারনা ছিল কেউ একজন এপার্টমেন্টের চাবি এখানে এসে বুঝিয়ে দেবে।কাউকে না পেয়ে একটু হতাশ হলাম।ফ্লোরের অন্যান্য ফ্লাটে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কারও দেখা মিলল না।ঠিকানা মত চলে এসে এখন বন্ধ দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে তার উপর এতোবেলা বাইরে এলোমেলো ঘোরাঘুরির ধকলে সবার মধ্যে ক্লান্তি চলে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো চেষ্টা করে বাধ্য হয়েই এপার্টমেন্ট ভাড়া প্রদানকারী অফিসে ফোন দিলাম। সমস্যা খুলে বলার পর, ফোনের অপর প্রান্তের দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন, আপনার এপার্টমেন্টের প্রবেশ দরজার ডানপাশের নিচে ছোট্ট একটি বাক্স লাগানো রয়েছে, বাক্সটি আপনার চুক্তিপত্রে উল্লেখিত কোড নম্বর দিয়ে খুলতে হবে, ওই বাক্সটির মধ্যে চাবি রয়েছে।ভদ্রমহিলার কথা মত নিচের দিকে তাকাতেই দেখা মিলল দরজার এক কোণে কোড নম্বর সম্বলিত চিকন ম্যাচ বাক্স আকৃতির ছোট্ট কিছু।উল্লেখিত কোড নম্বর সঠিক ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেলাতেই ছোট্ট বাক্সের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবেশ দরজার চাবি।এমন ব্যতিক্রম পদ্ধতির সাথে জীবনে এই প্রথম সাক্ষাত ঘটলো আমাদের। কোন মানুষ ছাড়াই শুধু পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ব্যবস্যা পরিচালনা।বেশ ভালো লাগলো।
ঘরে প্রবেশ করে দারুণ ভাবে হোঁচট খেতে হল।আমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা পুর এপার্টমেন্ট নোংরা করে রেখেগিয়েছে।সাধারণ ভাবে চুক্তি অনুযায়ী আমাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি এপার্টমেন্ট পাওয়ার কথা।পরিষ্কার বিছানার চাদর ও লেপের কাভার বাইরে প্রবেশ দরজার পাশের তাকে রাখা হয়েছে। ভাবলাম নিজেই রুমগুলো পরিষ্কার করে নেই।কিন্তু বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত মনে করে ফোন দিলাম। কারণ ভাড়া চুক্তির টাকাতো আমাকে সম্পন্নই পরিশোধ করতে হয়েছে। তাহলে তাদের সার্ভিসটাও পরিপূর্ণ দেয়া উচিত।সবকিছু খুলে বলার পর তারা দুঃখ প্রকাশ করলো, বলল দ্রুত একজন Femme de chmbre অর্থাৎ রুম পরিষ্কার কর্মীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি , সে রুমগুলো পরিষ্কার করে দেবে। পনেরো মিনিটের মধ্যে একজন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত তরুণী এলো এপার্টমেন্টে।চারদিন থাকতে হবে, বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি তবুও অনেক কিছু কিনতে হবে। পরিচ্ছন্নকারী তরুণীকে জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর কারফো বা লিদল আছে কিনা। মেয়েটি বলল, এখান থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথে বড় কারফো স্টোর পাবেন। মেয়েটিকে বললাম, আপনি নিজের মত করে কাজ করুন, আমরা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এক ঘণ্টা পর ফিরছি।

রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল, জনমানবের কোলাহল মুক্ত এলাকা। রাস্তার পাশে একটি গ্রেক স্যান্ডুইচের দোকানে কিছু আরবি তরুণ আড্ডা দিচ্ছে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম কারফো সুপার স্টোরে কিভাবে যাবো। খুব সহজ করে রাস্তা দেখিয়ে দিলো। নতুন এলাকা আমরা হেঁটে হেঁটে এগুচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। আসলে প্রতিটি নতুনের এক আলাদা ভালোলাগা রয়েছে। সে জন্যই হয়তো নতুন এলাকা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি।সুবিশাল মার্কেট, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দোকান রয়েছে।আমরা কারফো সুপার স্টোরে ঘুরে ঘুরে চাল, ডাল, সকালের নাস্তার কিছু ফল ও মিশেলের প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী কিনলাম।ফিরে এসে দেখি আমাদের এপার্টমেন্টটি চকচকে তকতকে করে মেয়েটি চলে গিয়েছে। মিশেল তার নিজস্ব রুম পেয়ে খুব খুশি। তার লাগেজ রুমে নিয়ে গেল।নিজস্ব কাপড় চোপরগুলো তার আলামারির মধ্যে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখল। মিশেলর রুমে বিশাল বড় জানালা। জানালর ওপাশের প্রশস্ত আঙ্গিনা। রুমের ভেতর থেকে সুবিশাল আকাশ দেখা যায়।সে অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এলাকার আশপাশ দেখতে লাগলো। আমাকে তার রুম থেকে বের করে দিলো।রুমের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত করলো নিজের মত করে।

আজকে আমরা বাইরে বের হওয়ার কোন কর্মসূচী হাতে রাখলাম না।সবাই গোছল করে ফ্রেস হয়ে নিলাম।নিজেদের কাপড় চোপর গুলো লাগেজ থেকে বের করে আলমারিতে সাজিয়ে রাখলাম। এপার্টমেন্টটি এমনভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যে কেউ হঠাৎ করে এসেই থাকতে পারবে। কিচেন, বাথরুম, ড্রয়িংরুম, বেলকনিতে যা কিছু প্রয়োজনীয় সব সাজিয়েগুছিয়ে রাখা হয়েছে।তবে একটা সমস্যায় পড়তে হল। মিশেল কাটুন দেখার জন্য টিভি চালু করলো কিন্তু কোন চ্যানেল দেখা গেলো না। আমাদেরকে ইন্টারনেটের যে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছে সেটা দিয়ে ইন্টারনেটও চালু করতে পারলাম না। কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলাম, ওরা কিছু নির্দেশনা দিলো কিন্তু সেভাবে চেষ্টা করেও টিভি ও ইন্টারনেট চালু করা গেলনা। মিশেল নতুন বাসা পেয়ে খুব খুশি কিন্তু টিভি দেখতে না পেরে খুবই হতাশ। কিভাবে তার সময় কাটবে। এ বিষয়ে আর সময় ক্ষেপণ না করে আমি চলে গেলাম রান্নার দিকে। রাতের খাবার তৈরি করতে হবে। আমরা আসার সময় রেডিমেড তেহারি মসলা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কারফো মার্কেট থেকে কিনে আনা আসিদ্ধ চাল আর গরুর মাংস দিয়ে তেহারি রান্না করে ফেললাম।সারাদিনের ধকলের পর নিজেদের রান্না করা বাঙ্গালি খাবার দারুণ এক পরিতৃপ্তি দিলো। খাবার পর আবার টিভি’র প্রয়োজনীয়তা অনুভব হল। কিন্তু কোন উপায় নেই …

আমরা তিনজন বারান্দায় গিয়ে বসলাম। রাত দশটা বাজলেও সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগে।চারদিকে বিজলি বাতি জ্বলে উঠলেও প্রকৃতিতে রাতের আবহ এখনো নামেনি। দিনের আলো কিছুটা রয়ে গিয়েছে।বারান্দার সামনে কোন বড় বিল্ডিং নেই। ছোট ছোট পাভিয় বাড়ী। তাই সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাস হু হু করে ছুটে এসে গায়ে লাগছে।আমাদের এপার্টমেন্টটি দ্বিতীয় তলায়। বিল্ডিঙয়ের নিচে গাড়ি পারকিংয়ের প্রশস্ত জায়গা।পারকিংয়ের পাশের একটি বাড়ীর আঙ্গিনায় চলছে উৎসব আনন্দ।হালকা গানের সাথে অনেকে নাচছে, কেউ পান করছে।বারান্দায় গল্প করতে করতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে এলো। আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় রয়েছে প্রথম দিন নন্ত শহর ঘুরে দেখা।তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাড়ায় মধ্যরাতের আড্ডা ভেঙে আমরা চলে গেলাম যার যার রুমে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৩:৩০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×