ছবি-গুগুল
পথ চলতে চলতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । বার বার মরেও কিভাবে বেঁচে আছি সত্যিই ভাবায় আমায়। অদ্ভুত সব ঘটনা গুলো ঘটছিল একের পর এক। ভাঙ্গা গড়া খেলার পুতুল হয়ে গেছি। নিস্তব্ধ আমি, বার বার শুধু মচকাই ভাঙ্গি না কখনো। একদিন হয়ত ভেঙেই যাব, আর খুঁজে পাবেনা কেউই।
দুপুরের নির্জনতা ভেঙ্গে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ কি মাথায় চাপল হ্যান্ড পার্স আর ছাতা হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আপাতত জানা নেই। বাইরে বের হওয়ার পর অটোগুলো ডাকছিল- আফা আসেন, কই যাইবেন? আমার নিরস উত্তর – যাবোনারে ভাই । কিছুক্ষণ হাঁটার পর বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম অনেকটাই। সামনেই একটা শপিং মল। ঢুকে গেলাম শপিং মলে। এটা সেটা দেখছিলাম। আম্মা কে একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে। আম্মা মুখ ফুটেই চেয়েছিলেন , হাত খালি থাকাতে গতমাসে দিতে পারিনি। আম্মার শাড়ি পছন্দ করতে করতেই হটাৎ চোখে আটকে গেল নেভিব্লু পাঞ্জাবীটা। বুকের ভেতরে কেমন যেন ধাক্কা খেলাম। মনে হচ্ছে পাঞ্জাবীটা আমার দিকেই চেয়ে আছে। নেভিব্লু রঙের পাঞ্জাবী তার খুব পছন্দের ছিল। শাড়ি আর পাঞ্জাবীটা নিয়েই বের হয়ে আসলাম। এতক্ষনে বৃষ্টি কমে গিয়েছে।
আম্মা শাড়ি পেয়ে বেশ খুশি হয়েছে। পছন্দ হয়েছে তার। আর আমি পাঞ্জাবীটা লুকিয়ে চুপি চুপি রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে গেলাম। কেমন যেন চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে। বুক ফেটেই কান্না আসছে। এর মাঝেই আম্মা ডাকতে লাগল- নীলু কাপড় চেঞ্জ করে নে মা, ভিজে গেছিসত। জ্বর আসবে। আম্মার কথায় হাসি পেল। মনে মনে শুধু আম্মাকে বললাম জ্বর এলে তাতে কি আসে যায়? বুকের ভেতর যে বড় বড় গর্ত হয়েছে তা কি আম্মা আপনি দেখতে পাচ্ছেন? আমি যে আর বইতে পারছিনা।
চারশ পঁয়ষট্টি দিন ছিল তার সাথে কাটানো জীবনের সবচেয়ে রঙ্গিন মুহুর্তগুলো । চারশ ছেষট্টি আর সাতষট্টি এই দুইদিনেই অপরিচিত হয়ে গেল সে। অদ্ভুত না? ঠিক যেন আকশের মতন। এই রৌদ্দুর আবার পরক্ষণেই মেঘলা। মুছে হয়ত দিয়েছে আমার সব স্মৃতি কিন্তু এই মন থেকে কি পেরেছে মুছে দিতে সবকিছু? আমি সত্য ছিলাম আছি। ছেড়ে যেয়োনা বলে নিজেই ছেড়ে গিয়েছে। ভুলে যেয়োনা বলে নিজেই ভুলে গিয়েছে।
সে যখন খুব অপরিচত হল ঠিক সেদিন রাতেই খবর এল গ্রাম থেকে বাসায় ফেরার পথে আব্বা এক্সিডেন্ট করেছে। আব্বার লাশের দিকে নিস্পলক চোখে চেয়েছিলাম। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায় কেন?
দেখতে দেখতেই এক বছর চলে গেল। কোন কিছুতেই যেন আর ভালো লাগেনা। সবকিছুই নিরস, প্রাণহীন মনে হয়। আকাশের বুকে চাঁদ উঠে আগের মতই কিন্তু কেন যেন আমাকে আর টানে না। রোজ রোজ একইভাবে কেটে যায় ।
বড় আপা আজ ওয়ারড্রব গুছাতে গিয়ে আবিস্কার করল পাঞ্জাবীটা। জিজ্ঞেস করেছিল এটা কার। ভারী গলায় বলেছিলাম –যেখানে আছে সেখানেই রেখে দাও। প্রশ্ন না করলেই খুশি হবো। আপা বুঝে গিয়েছিল সব কিছুই। কারন আপা সবই জানত। রাতে খেতে বসে আপা আমাকে বলল কেউ তোমাকে ফোন দিবে। ভদ্র ভাবে কথা বলো। অনেক হয়েছে পাগলামি করোনা । আম্মার বয়স হয়েছে। তোমাকে নিয়ে চিন্তা করে করে অসুস্থ থাকে। আশা করি তুমি এসবই বুঝবে। সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম আর কথা না বাড়িয়ে শুধু মাথা নাড়ালাম।
আজ নিয়ে চার দিন কথা হল লোকটার সাথে । তার নাম সবুজ। সবুজ মানুষের কিভাবে নাম হয় বুঝিনা, এটাত একটা রঙের নাম। অদ্ভুত নাম! তাকে বলেছিলাম এই কথা তাই শুনে সে অট্ট হাসি দিয়ে বলল – আপনার নাম যে নিলু, নীল থেকে নিশ্চয় নীলু হয়েছে বলেই হো হো করে হাসতে লাগল আবার। আমার মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল। বললাম- দেখুন আমার নাম নীলুফা, আদর করে সবাই নীলু ডাকে।
- ও আচ্ছা তাই বলুন। আমিত ভেবেছিলাম...।
- আমি ফোনটা রাখব।
- প্লিজ রাগ করবেন না, আরেকটু কথা বলুন না নীলু? এমন করছেন কেন? প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
- আচ্ছা বলুন, শুনছি।
- অভয় দিলে একটা কথা বলার ছিল।
- অভয় দিব মানে? আমি কি বাঘিনী নাকি? আজব!
- সরি আমি কিন্তু তা বলিনি । নীলু আগামিকাল আসুন না দেখা করি। সামনা সামনি বসে গল্প করা যাবে। প্লিজ না করবেন না।
- আচ্ছা কোথায় আসতে হবে জানিয়ে দিয়েন। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু টাইম মেইন্টেইন করি, এক মিনিট দেরি হলে কিন্তু চলে আসব।
- বাবাহ! আচ্ছা ঠিকাছে ম্যাডাম। আমাকে ঠিক করতে আপনিই পারবেন। হাহাহা।
- কি , কি বললেন?
- না না কিছু বলিনিত। আচ্ছা আপনি ছেলেদের কি পোশাক পছন্দ করেন?
- মুখ ফসকেই বেড়িয়ে গেল পাঞ্জাবী।
- আচ্ছা , ধন্যবাদ।
- ধন্যবাদ কেন?
- না এমনি। আচ্ছা আপনি কিন্তু শাড়ি পড়ে আসবেন এটা আমার অনুরোধ।
- আর কত অনুরোধ করবেন শুনি?
- যত ইচ্ছে ততবার অনুরোধ করব। আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ুন দেখা হবে কাল।
ফোন রাখার পর তার কন্ঠস্বর, তার হাসি কেন জানি কানের কাছে বার বার বাজতে লাগল। আমি কি তার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি নাকি? অসহ্য! কিসব ভাবছি আমি। সবকিছু কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিনা। বিয়ের জন্য সবাই খালি পীড়াপীড়ি করছে। আপা অনেক বলার পর এই ছেলেটার সাথে বাধ্য মেয়ের মত কথা বলছি। আমি কি একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছি? সবুজকে কি আমার ভালো লেগে গেছে? উফ! মাথা ঘুরাচ্ছে আমার।
ম্যাজেসে জানিয়ে দিল সবুজ বিকেল চারটায় একটা রেস্টুরেন্ট এ অপেক্ষা করবে। অস্বস্থি লাগছে আমার। অনেকদিন পর শাড়ি পড়লাম। সময় মত পৌছে গেলাম আমি। হঠাৎ মনে হল আমি তাকে চিনব কিভাবে? আপা অনেকবার বলেছিল ছবিটা দেখতে কিন্তু আমিত না দেখেই ছবি রেখে দিয়েছিলাম। উফ! বিরক্ত লাগছে এখন। ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করার পর সে বলছিল সামনের দিকে তাকান ম্যাডাম। দূর থেকেই একনজর তাকে দেখে নিলাম। সময়মতই এসেছে।
কিন্তু কি অদ্ভুত কান্ড! সে মেরুন কালার পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে। আমিও মেরুন কালার শাড়ি পড়েছি একদম ম্যাচিং হয়ে গিয়েছে। কেমন যেন লজ্জা লাগছে। সামনা সামনি বসলাম দুজন। বলল টাইমলি আসছি কিন্তু। আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারছিলাম না। কি খাবো জিজ্ঞেস করল। এটা সেটা বলার পর বলল আমাকে- আমি মেরুন কালার পাঞ্জাবী পড়ে আসব বলেই কি মেরুন কালারের শাড়ি পড়ে এসেছেন?
- মানে ?
- নীলু আপনি কিভাবে জানেন আমি মেরুন কালার পছন্দ করি?
- আমি জানি নাকি আশ্চর্য যে আপনি মেরুন কালারের পাঞ্জাবী পড়ে আসবেন? মেরুনত আমার পছন্দের কালার।
- আরে এটাত আমারো প্রিয় কালার। আমিও কি জানি নাকি যে আপনি মেরুন কালারের শাড়ি পরে আসবেন? অদ্ভুত না? দুজনের প্রিয় কালার একটাই।
কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলাম দুজনেই। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। সবুজ নীরবতা ভেঙ্গে বলল।
- মেরুন পাঞ্জাবীওলাকে পছন্দ হয়েছে? আমার কিন্তু মেরুন শাড়িওয়ালীকে ভীষন পছন্দ আগে থেকেই। শুধু আপনি হ্যাঁ বললেই আমার বাড়িতে আপনাকে নিয়ে আসতে পারি সারাজীবনের জন্য।
- সবুজ এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে ফিক করেই হেসে দিলাম। কেন জানি আমি নিজেকে গম্ভীর করে রাখতে পারিনি। সবুজ খুব মজা করেই কথা বলে, ভালো লাগে। মাথা নিচু করেই অনেকক্ষণ হাসলাম।
সবুজ আমার হাত ধরে বলল –ছাড়ব না কিন্তু হাত। আমি উত্তর পেয়ে গিয়েছি.........।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৫