দেশে বাসে খুব যাতায়াত করিনি, যতটুকু মনে পরে বাসে উঠলে আমার মাথা ঘুরাত ও খুব বমি হত এই ভয়েই বাসে কোথাও যেতে ভয় পেতাম।
এখানে আসার পর প্রথমদিন ভয়ে ভয়েই বাসে উঠেছি কিন্ত মাথাও ঘুরায়নি বমিও হয়নি বরং ভাল লেগেছে, শুধু ভালো না, এতটাই ভালো লেগেছে বাস থেকে নামতেই ইচ্ছা করছিল না। বাসার কাছেই আমি স্কুল পেয়েছিলাম, একমাস পরই বাসা পরিবর্তন করায় স্কুলটা দুর হয়ে যায়, আমাকে প্রায় ২০মিনিট বাসে যেতে হবে। স্কুলটা ভাল তাই ভাইয়া,ভাবী চাচ্ছে না স্কুলটা পরিবর্তন করতে আর এতে আমি খুশীই প্রতিদিন বাসে উঠতে পারব আবার যাতায়াতের জন্য বাসকার্ড স্কুল থেকেই দিবে। ( এখানে বাসা যদি স্কুল থেকে ছয় কিলোমিটারের বেশী দুরে হয় তাহলে বাসে বা মেট্রোতে যাতায়াতের কার্ড স্কুল থেকে দিবে তবে এটা শুধু স্কুল টাইমে, সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চলে, এর পরে বা ছুটির দিনে এই কার্ড চলে না)।প্রতিদিন বাসে যাই আমি একটা সিটও পছন্দ করে ফেল্লাম।ফেস টু ফেস চারটা সিট । বাসে খুব বেশী লোক জন থাকে না চার সিট দখল করে আরামসে আসা যাওয়া করি।
এই সিট সম্পর্কে তখনো জানি না , একদিন স্কুল থেকে বাসে উঠেছি চারসিটের তিন টাতে তিনজন বৃদ্ধ মতন লোক বসে আছে মনে মনে একটু রাগই লাগল পুরোবাসই তো খালি বুড়োগুলো এখানে বসেছে কেন !! তবু তাদের পাশেই বসেছি । বাস এক স্টপেজ সামনে থামলে এক বৃদ্ধ মহিলা সরাসরি আমার সামনে এসে “ এই মেয়ে উঠ এখনে আমি বসব “
আমি অবাক হয়ে কেন আরো অনেক সিট তো খালি আছে তুমি তার কোন একটাতে বসতে পার।
না, আমি এখানেই বসব তুমি উঠ ।
আমি কেন ? বলতেই,
বৃদ্ধা মহিলা হেসে হাত দিয়ে সিটির পাশে একটা ছবি দেখিয়ে বলেন, তুমি জানো না? এই সিট গুলো বৃদ্ধদের জন্য।
এবার একটু লজ্জা পেয়ে সরি, বলে উঠে আসলাম।
এর পর সিট চেঞ্জ করে একেবারে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা শুরু করলাম এখানে বসতে আরো বেশী ভাল লাগা শুরু হল এই সিটটা একটু উঁচু ও সামনে বড় জানালা দিয়ে বাহিরে দেখতে বেশ চ ভালো লাগে ।বাসে উঠার জন্য যখন লাইনে দাঁড়াতাম মনে মনে বলতাম আল্লাহ আমার সিটটাতে যেন কেউ না বসে।আমি জানি না এই সিটটাতে মানুষ কেন যেন বসতে চায় না তাই বেশীর ভাগ দিন পেতাম কোনদিন না পেলে আমার খুব মন খারাপ হত।
এই বাসায় আসার পর আমরা অনেক ভালো একটা প্রতিবেশী পেয়েছিলাম এলোনা ও ক্লারেন্স দম্পত্তি ।উনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল ও উনাদের ছেলে মেয়েগুলো বড় হয়ে যাওয়াতে কেউই তাদের সাথে থাকত না, সেই কারনে উনারা আমাকে একটু বেশীই স্নেহ করতেন। যে কোন সময় আমি উনাদের বাসায় যেতে পারতাম। এলোনার শশুর, শাশুরী মানে ক্লারেন্সের বাবা,মা মোটামুটি কাছেই আলাদা বাসায় থাকত । তাদের বয়স ছিল পঁচাশি/ সাতাশি বছর। উনারা মাঝে মাঝেই এলোনাদের বাসায় আসতেন সেই হিসাবে আমাদের সাথে পরিচয় ও আমাদের বেশ পছন্দ করতেন , আমি অবশ্য এলোনার সাথে কয়েকবার তাদের বাসায় গিয়েছি। একদিন ডিনারে উনারা আমাদের দাওয়াত করলেন । আমরা যাওয়ার পর দেখি,সে তার বান্ধবী ইসভিয়াকেও দাওয়াত করেছে, সে একই বিল্ডিং এর তৃতীয় ফ্লোরে থাকে । আমরা যাওয়ার পর মারগীত খুব সুন্দর ভাবেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তার বান্ধবী ইসভিয়া বয়স ৯০ বছর ।
মারগীত অনেক কিছু রান্না করেছে, স্টার্টার,মেইনডিস ও ডেজার্ট তিন পর্ব খাওয়ার পর বেশ অনেকগুলো গ্লাস, প্লেট, ডিসব্যাংকে জমা হয়েছে ।
নব্বই বছর বয়সের বৃদ্ধা ইসভিয়া বলে,
-আমি এগুলো ধুয়ে ফেলি ।
- মারগীত না, না এগুলো আমি এখন ধুরো না পরে ধুবো ।
- ওকে, বলে ইসভিয়া থেমে যায়।
ভাইয়া, ভাবী এলোনা, ক্লারেন্স তার বাবা, মারগীত ও ইসভিয়া সবাই বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করছিল এক ফাঁকে মারগীত উঠে গ্লাস, প্লেটগুলে ধুয়া শুরু করে এটা দেখে ইসভিয়া নাস্তে নাস্তে আমি তাহলে এগুলো মুছে ফেলি ।
সেদিন খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম নব্বই বছরের বৃদ্ধার এনার্জি দেখে । তার চেয়ে বেশী অবাক হয়েছি গত বছর সামারে একদিন বিকালে আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে বাসার কাছেই পার্কে গিয়েছি,সেদিনটা ছিল আলোকউজ্বল সুন্দর একটাদিন, কিন্ত গরম ছিল না, না ছিল ঠান্ডা, বাচ্চারা খেলছিল আমি বেঞ্চে বসে বই পড়ছিলাম।
আমার বেঞ্চের পাশের একটা হুইল চেয়ার এসে থামল। আমি তাকিয়ে দেখি হুইল চেয়ারে একজন বৃদ্ধলোক তার সাথে ছিল তার আসিস্টান্ট, যে হুইল চেয়ারটা পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে আসছিল। সে ছিল অনেক বয়স্ক তার কথা কিছুটা জরিয়ে যায় ও তার ভাষায় অনেক বেশী পুরোনো সুইডিশ ওয়ার্ড ছিল যেগুলো আমি বুঝতে পারছিলাম না, কারন সেসব ওয়ার্ড এখন আর প্রচলিত না। কিছুটা তার আসিস্টান্টের সাহায্য নিয়ে যতটুকু বুঝেছি তাই আপনাদের জন্য উপস্থাপন করলাম।
আমি তার দিকে তাকিয়ে হেই বলতেই সেও হেই বল্ল। এরপর নাম ধাম জানার পর বল্ল তার বয়স প্রায় ১০৮ বছর। তার কথা শুনে আমি উচ্ছ্বেসিত হয়ে ১০৮ বছর!! তাহলে তো তুমি অনেক কিছু দেখেছ জীবনে?
-তাতে দেখেছি, ১০০ বছর আগের সুইডেন আর এখনকার সুইডেন অনেক পার্থক্য।
- আরে তুমিতো 2nd World War দেখেছ?
- শুধু তাই নয় আমি 1st World war এও পৃথিবীতে ছিলাম তবে ছোট ছিলাম আর ২য় 2nd World War এ আমি ছিলাম ইয়ং। তখন আমার দুই সন্তান ছোট ছিল।
- আচ্ছা তুমি কি আমাকে 2nd World War সম্পর্কে বলতে পারো।
সে বক বক করে এখানে অনেক কিছু বলেছে আমি কিছু বুঝিনি শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছি, এই যুদ্ধের সময় কিভাবে প্রতিরক্ষা পাওয়া যাবে এগুলোর উপর বিভিন্ন লিফলেট তৈরী করেছিল, তারা এগুলো বাড়ি বাড়ি যেয়ে বিলি করে মানুষকে সচেতন করত।
-আচ্ছা আমি কি তোমাকে আর একটা প্রশ্ন করতে পারি ?
- হ্যা পারো ।
- তোমার এই লম্বা জীবনের কারন কি বলে তোমার মনে হয়?
- লোকটা হেসে, আমি ২০ বছর বয়স থেকে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত জীম করেছি আর একটা জিনিস আমি করেছি আমার শত কাজের মাঝেও একঘন্টার জন্য আমি গ্রামের যেখানে ঘন সবুজ কখনো বা খোলা জায়গায় যেয়ে ফ্রেশ বাতাসে নি:স্বাস নিতাম।
-আমি আশা করি তুমি আরো অনেক বছর বেঁচে থাকবে।
- লাস (উনার নাম) হেসে- অনেক বয়স হয়েছে, আমার স্ত্রী অনেক আগে মারা গিয়েছে, আমার ছেলে মেয়েও বুরো হয়ে গিয়েছে এমন কি নাতি নাতনী কেউ কেউ পেনশনে গিয়েছে , কেউ কেউ পেনশনের অপেক্ষায় এক সময় জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল কত স্বপ্ন ছিল, এখন কিছুই নেই তবু মরতে ইচ্ছা করে না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২০