কয়েকদিন আগেও সুইডেনের আকাশ ছিল কুয়াশার চাদরে ঢাকা, চাতক পাখির মত অপেক্ষা করেও সূর্য মামার দেখা পাওয়া ছিল দুষ্কর । প্রকৃতি ছিল প্রানহীন ফ্যাকাসে I রাস্তার ধারে জীর্ণ -শীর্ণ পাতাহীন গাছ গাছালি দেখে বিস্বাস করা কঠিন ছিল এগুলোতে নতুন প্রানের সঞ্চার হবে। আবার পাখ পাখালির কলকাকলিতে গুন্জরিত হবে চারিদিক।
বৈচিত্রময় প্রকৃতির হাত ধরেই এপ্রিল শুরু হতে না হতেই সুইডেনের মেঘমুক্ত আকাশে চকচকে সোনালী রোদ্দুর !সূর্যের সোনালী ঝলমল আলোতে কত দ্রতই না সেই জীর্ণশীর্ণ গাছগুলো ভরে যাচ্ছে সবুজ সতেজ কচি পল্লবে আর নানা রংগের ফুল কলিতে। সেই সবুজ গাছের ডালে, পাতার আড়ালে পাখিরাও মনের আনন্দে গান গাইতে শুরু করেছে । প্রকৃতির এই পরিবর্তনে বুঝা যায় সুইডেনে বসন্ত শুরু হয়েছে –' আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। প্রকৃতি এমন করেই তার আপন গতিতেই চলতে থাকবে, ঋতুর পর ঋতু আসবে চক্রাকারে।
প্রকৃতির এই পরিচিত চলার পথে করোনা কোন বাধার সৃষ্টি করতে না পারলেও মানুষের জীবন চলার গতিতে ঘটাচ্ছে বিড়াট ছন্দপতন ! সারা বিশ্ব আজ করোনা আতঙ্কে স্থবির হয়ে আছে I করোনা আমাদের জীবনের গতিকে আটকে দিতে চাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ আমরাই জয়ী হব তবু কেন যেন মনে হচ্ছে করোনা আমাদের অনেকটাই পিছিয়ে দিবে । সুইডেনে জীবন যাত্রা এখনো স্বাভাবিক থাকলেও সুইডেন তো পৃথিবীর বাহিরে নয়। সুইডিশদের জীবনেও তাই এখন ভয়, আশংকা।আরো বড় কোনো ছন্দপতনের অনিশ্চয়তা!করোনার এই ভয়,আশংকা আর এই অনিশ্চয়তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বেশ কয়েক বছর আগের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে হলো ।
আমার বয়স যখন ছয় বা সাত তখন আমাকে কোরআন পড়াবার জন্য একজন শিক্ষক রাখা হয় । আমি উনাকে হুজুর বলতাম । এখানে আসার আগ পর্যন্ত প্রায় তিন বছরে উনি আমাকে কোরআন খতমসহ আরো অনেক কিছুই শিখিয়েছেন l উনি আমাকে শিখিয়ে ছিলেন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে হাত ধুয়ে অন্য কাজ শুরু করতে । হুজুর বলেছিলেন এটা একটা হাদিস যে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে হাত ধুতে হবে । উনি বলেছিলেন, রাতের বেলা ঘুমের মাঝে আমারা হাত দিয়ে নাক, কান চুলকাতে পারি এতে আমাদের হাতে ময়লা লাগে আর আমরা যদি হাত না ধুয়ে খাবার খাই, হাত মুখে দেই হাতের ময়লা আমাদের পেটে যেয়ে নানা রকম অসুখ হবে আমাদের।
উনি খুব সুন্দর আর আদর করে কথা বলতেন তাই উনাকে আমি খুব পছন্দ করতাম ও উনার প্রতিটা কথা মেনে চলার চেষ্টা করতাম । সেদিনের পর থেকে কখনো সকালে উঠে ধোয়া ধোয়া ভুলিনি, তার যখন নামাজ পড়া শুরু করলাম তখন তো এটা অজুর সাথে সাথেই হাত ধোয়া হয়ে যায়। সুইডেন আসার বেশ কয়েক বছর পরই হবে তখন আমি সুইডিশ বেশ ভালো বুঝতে পারি I একদিন একটাবিলবোর্ডে চোখ আটকে গেল, RENA HANDER RÄDDER LIV ( পরিস্কার হাত জীবন বাঁচায় ) আমার হুজুরের বলা হাদীস আর এটা তো একই কথা।
ভ্যাকসিন বিহীন করোনা ভাইরাসে স্টকহোমের রাস্তায় দেখা সেই বিলবোর্ডের কথা গুলো রেডিও টিভিতে এত বেশী প্রচার হচ্ছে শুনে অনেক দিন আগে হুজুরের শেখানো কথা গুলো বারবার মনে পড়ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সুস্থ্য জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।আমাদের শরীরে অনেক রোগই ব্যাকটেরিয়া থেকে জন্মায়I যার অন্যতম আর কিছুক্ষেত্রে একমাত্র কারণ হাত না ধোয়া। তাই সুস্থ থাকতে প্রথমেই যেটা প্রয়োজন সাবান বাএন্টিসেপটিক দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়া।
বিশ্বব্যাপী সবাইকে ইনফেকশনের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রতি বছর ১৫অক্টোবর ” গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে” হিসাবে পালন করা হয়। ২০০৮ সালে সুইডেনের স্টকহোমেই এটা প্রথম শুরু হয়, পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রতিবছর ১৫অক্টোবর দিনটি উদযাপনের বিষয়টি অনুমোদিত হয়।এরউদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে হাত পরিস্কার রাখার ব্যাপারে সচেতনকরা। করোনা ভাইরাসের এই দুঃসময়ে হাদিসে বলা ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিছন্নতার বিষয়গুলোই আমাদের জীবন রক্ষারও বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে । করোনা ভাইরাস হাতের মাধ্যমেই আমাদের ,চোখে,নাকে, মুখে প্রবেশ করে, অথবা আক্রান্ত ব্যাক্তির খুব কাছে থাকলে তার হাঁচি,কাশিরসাথে বের হওয়া ভাইরাস সরাসরি আমাদের নাকে,মুখে বা চোখে প্রবেশ করে আমাদের আক্রান্ত করবে। তাই অবশ্যই আমাদের হাত পরিস্কার রাখতে হবে আর মানুষের থেকে ছয়ফুট( পারলে আট ফুট) দুরত্ব রেখে চলতে হবে । কভিড-১৯ করোনা ভ্যাইরাসের ভ্যাকসিন আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এইসচেতনতাই একমাত্র আমাদের রক্ষা করতে পারে। সুইডেন লকডাউন করেনি সত্য তবে এই দুটো ব্যাপার খুবই গুরুত্বেরসাথে নিয়ে জনগনকে সচেতন করছে।
করোনাকে প্রতিহত করতে, আরো একবার স্বরন করিয়ে দিচ্ছি, RENA HANDER RÄDDER LIV (পরিস্কার হাত জীবন বাচায়।) ও ডিসটেন্স বজায় রেখে চলাচল করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:৫৮