(১)
ব্যাপারটা হয়তোবা এভাবে ঘটার কথা ছিলো না। ধ্বংসদেবের সাইরেনে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো বেখেয়ালে হতচকিত হয়ে কক্ষচ্যূত হবে, পৃথিবীতে নেমে আসবে অদ্ভুত আঁধার কিংবা অসহনীয় উত্তাপ, তারপর আমরা সবাই বিশাল এক মাঠে সমবেত হয়ে যার যার ওজন অনুযায়ী মিঠাই-চিরতা বুঝে নিয়ে সূচসেতু পার হয়ে চলে যাব নতুন গন্তব্যে, তবেই না বুঝতাম যে কিছু একটা হয়েছে! কিন্তু কী যে হল! বৃহত্তম পরাশক্তি নিজেদের শক্তি যাচাই করতে গিয়ে সব ভন্ডুল করে দিল কী না, অথবা ধরিত্রী জননী স্বয়ং তার সর্বংসহা গুণাবলী বিসর্জন দিয়ে সুইসাইড এ্যাটেমপ্ট নিয়েছিলো কী না, কে জানে! যাই হোক, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে ঘোরতর এবং মানুষ মরেছে বেঘোরে। রাস্তায় মুখ থুবরে পড়ে আছে মানুষ। চলাফেরার সময় পায়ে ঠেকে গিয়ে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সেই ধ্বংস সময়ের স্মৃতি আমার মনে নেই একদম। মনে করতে পারবোও না। কারণ তখন আমি আমার এক সুন্দরী প্রতিবেশিনীর প্রেমে বুঁদ হয়ে এবং আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জবাবে তার তাচ্ছিল্যে অবশ্যম্ভাবী বিফলতার কথা আঁচ করতে পেরে দুঃখ ভোলার জন্যে একগাদা ঘুমের ওষুধে মজে থাকতাম। কবে কখন এসব প্রলয়কান্ড ঘটে গেলো, কারা করল এ বিষয়ে কিছুই মনে করতে পারছি না। মনে করার কোন দরকারও দেখছি না অবশ্য। পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ মারা গেলেও আমি এবং জেনি বেঁচে আছি। জেনি, আমার রূপকথার রাজকন্যে। আরো বেশ কিছু মানুষজন বেঁচে আছে, তবে তারা সব বিগড়ে গেছে একেবারে। মানুষ মারা গেলেও, মানুষের রচিত স্থবির সংগীত- আর্কিটেকচারাল স্ট্রাকচারগুলো দিব্যি রয়ে গেছে। খাবারেরও অভাব নেই। সুপারশপগুলোতে থরে থরে পড়ে রয়েছে। চাকুরি দরকার? যাও, নিকটস্থ বিশাল কর্পোরেট অফিসের সবচেয়ে বড় চেয়ারটায় গ্যাঁট হয়ে বোসো। রাস্তায় পড়ে থাকা লাশের পকেট থেকে এটিএম কার্ড বের করে নিয়ে বুথে গিয়ে ভাঙাও। বারণ করার কেউ নেই। তবে ঝামেলাটা মূলত করছে কিছু জোম্বি। সিনেমায় যেমন দেখায় ঠিক তেমন। কদাকার, বোধশক্তিহীন, গলা দিয়ে ঘরঘর শব্দ আর মুখ থেকে লালা ঝরিয়ে চলে অবিরত। দেখতেই ঘেন্না লাগে। এগুলো এলো কোথা থেকে? সম্ভবত কোনো জীবাণু সংক্রমনের ফল। বৃহত্তম পরাশক্তির তো শুধু পারমাণবিক বোমা নিয়ে খেলাধুলা, হুমকি-ধামকি দিয়ে চললে হবে না, অন্যান্য ব্রহ্মাস্ত্রগুলোও একটু বাজিয়ে দেখতে হবে বৈ কি! তো সেটা তারা করতেই পারে! আমি দোষ দেবার কে? আমার জন্যে বরং ভালোই হয়েছে। প্রায় মানুষশূন্য পৃথিবীতে আমি আর সে, একা এবং সুস্থ। বাকি মানুষগুলো যেমন ক্ষ্যাপাটে হয়ে মানব-জম্বি লড়াই করে নিজেদের বিনাশের প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তাতে খুব শিঘ্রই আমরা পুরোপুরি একা হতে পারবো। আমরা হব নতুন সভ্যতার আদি পিতা-মাতা! ব্যাপারটা একই সাথে ভীষণ রোমান্টিক এবং ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আরো একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, আমাদের নতুন সভ্যতার ঊষালগ্নে মোটেও কোন সংগ্রাম করতে হবে না। চকমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বালানো শিখতে হবে না, বনে বাঁদাড়ে সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে দু-একটা খরগোশ বা খ্যাকশিয়াল ধরে আনার ঝক্কি পোহাতে হবে না। সভ্যতার চূড়ান্তবিন্দু বলে কিছু নেই, তবে এই মুহূর্তে আমরা চূড়ায়ই আছি বলা যায়। আমরা টিভিতে পুরাতন অনুষ্ঠান দেখব আর সুপারশপ থেকে কিনে আনা ফাস্টফুড খাব। আমাদের প্রচুর ছেলেপিলে হবে আশা করা যায়, যেহেতু নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মেয়েরা অধিকতর উর্বরা হয়ে থাকে। তারপর ছেলেমেয়েরা, নাতিপুতিরা টেনে নিয়ে যাবে আমাদের সভ্যতাশকট। সাময়িক জড়তা কেটে সামরিক ভঙ্গিমায় মার্চপাস্ট করে এগুতে থাকবে সভ্যতা। এখন সমস্যা হল একটাই। পৃথিবীর নতুন প্রজন্মের আদি মাতা হবার ব্যাপারে জেনির খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সে পড়ে আছে তার প্রিয় টিভি সিরিয়াল নিয়ে। শালার টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কতদিনের জন্যে প্রোগ্রাম বানিয়ে রেখে গেছে কে জানে! 'মেগা' শব্দটার ব্যাপকতা বুঝতে পারছি এখন তার সাথে 'সিরিয়াল' দিয়ে গুণ দেবার ফলে।
জেনির সাথে অবশ্য আমার নিয়মিতই কথা হয়। দেখা সাক্ষাৎ হয়। আমি সারাক্ষণ তার ড্রয়িংরুমেই পড়ে থাকি। সে টুকটাক কথাবার্তা বলে। ভদ্রতা করে চা-বিস্কুট খাবার আহবান জানায়। এর বেশি কিছু না। সভ্যতার অসাধারণ উপহার তাকে একদম অসার করে দিয়েছে। তা দিক, তবে কী, সে যখন সিরিয়ালের ক্লাইমেক্সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আক্ষরিক অর্থেই মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ, তখনও তাকে দেখতে ভালো লাগে। মুখ হা করে থাকা অবস্থায় যে মেয়েকে পরমা সুন্দরী মনে হয়, তার জন্যে এই জরাগ্রস্থ পৃথিবীর ঘ্যানঘ্যানে গলায় "সর্বাঙ্গে ব্যথা" জাতীয় অভিযোগ, আর জোম্বি এ্যাপোকালিপ্টো নির্দ্বিধায় অগ্রাহ্য করা যায়।
মেগা সিরিয়াল চলাকালীন সম্মোহিত সময়ে মাঝেমধ্যে পাড়ার ছেলেপুলেরা আশেপাশে জোম্বিদের সাথে মারামারি করতে থাকলে সে একটু ভ্রুকুটি করে তাকায়। তবে সহিংসতার বিচরণস্থল এখন অনেক বিশাল, তারা একে অপরকে মনের সুখে তাড়িয়ে চলে। বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকেও না। তাই জেনিও ওসব নিয়ে ভ্রূক্ষেপ করে না। জেনির সাথে থাকতে আমার কখনও একঘেয়ে লাগে না, তবে আমি তো তার মত বিষয়-বিবেচনাহীন না, যে সারাক্ষণ হা করে সিরিয়াল গিলবো! পৃথিবীর ভবিষ্যত নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়। পৃথিবী এবং মানবজাতির সাম্প্রতিক দুর্দশায় আমার দুর্দম প্রেমের সাথে মহান দায়িত্বশীলতার বীজ প্রোথিত হয়েছে। তাই এই দায়িত্ব পালনে কেউ যেন ব্যাঘাৎ না ঘটায়, সে ব্যাপারে কতদূর অগ্রগতি হল দেখতে আমি টহল দিই মাঝেমধ্যে শহরময়।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে জীবিত মানুষেরা কেন যেন এ এলাকাতেই সমবেত হয়েছে। তার মাঝে আমাদের শহরের একজনও আছে। দুদিন আগেও একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতো সে। এখন নিজেই নিজেকে চাকুরি দিয়েছে একটা টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির সিইও পদে। তার বর্তমান রুটিন এরকম, সকাল নটার মধ্যেই কোন একটা ফ্যাশান হাউজ থেকে সবচেয়ে ভালো কিছু পোষাক নিয়ে পরে অফিসে যাওয়া। তারপর মিনিট পাঁচেক থেকে হই হই রই রই করে বেড়িয়ে এসে মিলিত হওয়া তার নতুন পাওয়া বন্ধুদের সাথে। জোম্বিনিধনের মত সুখ নাকি আর কিছুতে নেই, সে আমাকে বলেছে।
-আরে জানিস, এইগুলা কোথা থেকে যে আইছে হালার পো রা মরে না! চাক্কু দিয়া খোঁচাই, বাঁশ দিয়া গুতাই, পাথর ছুড়ি, গুলি করি কিন্তু কিছুতেই তারা মরবে না। গলা দিয়া এমন ঘরঘর শব্দ করে যেন এই মনে হয় গেল! কিন্তু তারপরেও তারা আগাইতেই থাকে।
বলার সময় তার ভেতরকার নির্মল আনন্দটা আমি টের পাই।
-হু! এদেরকে যত তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলা যায় ততই ভালো। একদিন না একদিন তো মরবেই!
-না মরলেও অসুবিধা নাই। আমার অফিসে অনেকগুলা পদ খালি আছে। এদেরকে নিয়োগ দিয়া দিমু নে।
তার এই পরিকল্পনা শুনে আমি প্রমাদ গুনি। আরে ব্যাটারা তাড়াতাড়ি শেষ হ না একে অপরকে মাইরা! তা না, শুরু করছে যত ধানাই পানাই! কোনদিন আবার এসব জোম্বিনিধনে আনন্দ খুঁজে না পেয়ে জেনির দিকে হাত বাড়ায়, কোন বিশ্বাস নাই।
-সেটা করা ঠিক হবে না। তোর অফিসের এতসব জটিল টেকনিক্যাল কাজ ওরা করতে পারবে নাকি? কী যে বলিস!
এবার সে কন্ঠে এমন একটা কর্তৃপক্ষসুলভ গাম্ভীর্য এবং সৌকর্য আনে যে আমি অবাক হয়ে যাই!
-শোন, মনোযোগ দিয়ে। আমার অফিসের কাজ করতে হৃদয় লাগে না। প্রাণও লাগে না। লাগে আনুগত্য আর অপরিসীম পরিশ্রম করার ক্ষমতা। সেটা ওদের বেশ আছে। আরে ওদের অকারণে পিটাচ্ছি নাকি? এর পেছনে উদ্দেশ্য তো এটাই। পিটিয়ে বুঝিয়ে দেয়া, হু ইজ দ্যা বস! নব্য দাসপ্রথাও বলতে পারো। নতুন সভ্যতার সূচনালগ্নে কিছু পুরাতন থাকুক না স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে!
আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই আবারও। এই তাহলে ওদের উদ্দেশ্য!
নব্য দাসপ্রথা বিষয়ক মহাপরিকল্পনার উদ্ভাবকেরা তাদের দায়িত্ব বেশ সাফল্যের সাথেই পালন করে যাচ্ছেন। তাদের উল্লাসযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে একটি অস্ত্রাগার আবিষ্কারের ফলে। সেখান থেকে ইচ্ছেমত অস্ত্র নিয়ে গুলি করে ঝাঝরা করে দিচ্ছে জোম্বিগুলোকে। দূর থেকে বিভিন্ন ভাষায় তাদের জয়ধ্বনি শোনা যায়। শুনতে অবশ্য একইরকম লাগে। মানুষের পাশবিক উল্লাস প্রকাশের জন্যে আলাদা ভাষার প্রয়োজন নেই। ইদানিং তারা নিজেদের বোঝার জন্যে একটা জগাখিচুড়ি টাইপ ভাষা তৈরি করেছে, যা আমিও দিব্যি বুঝতে পারি। ওদের তো আর খুব বেশি ভাব বিনিময়ের প্রয়োজন হয় না, শুধু কিছু জান্তব আনন্দ। ওদের এই আনন্দ করতে করতেই যাবে। দাসপ্রথার প্রচলনের মাধ্যমে সভ্যতার চাকা ঘোরানোর পুরোনো সেই রীতি আর কাজ করবে না। তাছাড়া ওরা তো জোম্বি না, ওরা নশ্বর শরীরের মানুষ। নিধন আনন্দের ধকলটা শরীরের ওপর একটু বেশিই যাচ্ছে। ফলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মারাও গেছে বেশ কজন।
মাস ছয়েকের মধ্যেই তাদের সংখ্যা শ'খানেক থেকে কমে জনাবিশেক হয়ে যায়। জেনি তখনও নিমগ্ন চিত্তে টিভি সিরিয়াল দেখেই যাচ্ছে। আর আমি উদ্বেলিত চিত্তে অপেক্ষা করছি, আমার প্রণয় উপাখ্যানের শুরু হল বলে! টিভি চ্যানেলগুলো অটোমটিভ উপায়ে আর কদ্দিন চলবে? রক্তপিপাসু কর্পোরেট বস সাজা হাস্যকর দস্যুর দল আর কতদিন দুর্বৃত্তপনা চালাবে?
(২)
এক জোড়া জোম্বির পেছনে সভ্যতার নতুন কান্ডারীরা প্রাণ দিতে দিতে নেমে এসেছে চারে। আমাদের শহরের সেই প্রাক্তন বখাটে বেকার, বর্তমান নেতা ছোকড়াটাও আছে। তার তেজ এখনও কমেনি! তবে কমে আসবে শীঘ্রই। এদিকে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, টিভিতে আজকেই শেষ এপিসোড প্রচারিত হবে মেগাসিরিয়ালের। এরপর আর তারা বানাতে পারেনি কিছু। এখনই সেই হিরন্ময় মুহূর্ত জেনিকে প্রেম নিবেদনের। বেশ টেনশন অনুভব করছি। তবে এটাও জানি টেনশনের তেমন কিছু নেই। শহরের সব মানুষ মারা গেলে থাকবো কেবল আমি আর জেনি। সব টিভি সিরিয়াল বন্ধ হয়ে গেলে সে অনুভব করবে তার এতদিনের চেপে রাখা জৈবিক তাড়না। আমার কাছে তাকে আসতেই হবে। তবে জৈবিক তাড়নার বশে সে আসুক তা আমি চাইনা মোটেও। আমি চাই সিনেমার নায়কদের মত তার কাছে হাঁটু মুড়ে আবেগকম্পিত গলায় প্রেম নিবেদন করব,
"জেনি, তুমি কি আমার হবে?"
এসব ভাবনায় ছেদ পড়ল প্রবল হল্লায়। আমাদের শহরের দাসরাজ্য প্রণেতা ববি ছোকড়াটা আজ খুব ক্ষেপে গিয়েছে। জোম্বিগুলোর আজকে কিছু একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে!
-হাউয়ার পুতেরা! তোদের এতদিন ধইরা শান্টিং দিলাম কিন্তু লাইনে আইলি না। বুঝছি তোগো দিয়া আমার কাজ চলব না। মইরা যা! মাইরা ফালা!
সে উন্মাদের মত চিৎকার করতে থাকে। তার সাঙ্গপাঙ্গরাও এতে যোগ দেয়। এদিকে টিভিতে প্রচারিত সিরিয়ালে একটা বিশাল যতিবোধক মেলোড্রামাটিক মিউজিক শেষে সবার নাম দেখাতে থাকে। এতসব গোলমালের মধ্যে আমার মাথা ঠিকমত কাজ করে না। কেমন অস্থির লাগে। ঝুঁকির আন্দাজটা পরিমাপ করে নিয়ে গভীর আবেগে জেনিকে বলেই ফেলি,
"জেনি, তুমি কি আমার হবে?"
-না.........................!
এরকম চিলকন্ঠে চিৎকার করে প্রত্যাখ্যানের কী হল! জেনি ছুটে যায় বাইরে টিভি বন্ধ করে দিয়ে। ওদিকে ববিরা তখন জোম্বিজোড়ার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করছে। জেনি বাইরে বেরুনোর পর তার না-বোধক চিৎকারের কারণ বুঝতে পারি আমি।
-ববি! তোরা এসব কি করছিস? এরা যে আমার হারিয়ে যাওয়া বাবা মা! বাবা! মা! কোথায় ছিলে তোমরা এতদিন?
ক্ষোভের সাথে দুঃখ যোগ হওয়াতে সে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে।
-আরে রাখ তোর বাপ-মা! এইগুলা জোম্বি। আমাদের শত্রু। এদেরকে পুড়ায়া না মারলে মরব না।
তাদের পেট্রোলমথিত শরীরে ববি দুটো গুলি করে। বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সব শেষ!
-তোরা আমার বাবা-মা'কে মেরে ফেলেছিস তোদের আমি ছাড়বো না!
-এহ! বাবা-মা! এতদিন ধরে যে এদেরকে টর্চার করলাম, কই তখন তো আসিস নাই একবারও? এখন প্রয়োজন পড়ল কেন? টিভি বন্ধ হয়ে গেছে বলে?
-আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। এর প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে!
একটা কোঁদাল হাতে নিয়ে সে আমাকে আরেকটা নেয়ার ইংগিত করে বলে,
-এসো, মেরে ফেলি ওদের!
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে অতি ক্ষীপ্রতার সাথে ববিসহ দুজনকে কুপিয়ে মেরে ফেলে। আমার বিলম্বিত বোধোদয়েও বাকি দুজনের পেছনে ছুটে তাদেরকে পেড়ে ফেলতে খুব একটু বেগ পেতে হয়নি।
(৩)
অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনটি এল! একটা পুরো পৃথিবী, অরণ্য, নদী, সমুদ্র, সুপারশপ, ইন্টারনেট, ইলেক্ট্রিসিটি সবই আছে। শুধু নেই কোন মানুষ, নেই জীবাণু সংক্রমণে পরিণত হওয়া জোম্বি। আছি আমরা দুজন কেবল। আমি আর জেনি। জেনিকে এইবার মনে হয় বলতে আর বাধা নেই কোন।
-জেনি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমার হবে?
-ছি! তোমার মন কী পাথর দিয়ে গড়া? দেখছো না আমার বাবা মা মারা গেছে? এই অবস্থায় প্রেমের কথা বল কী করে? তুমি যাও তো, এক দৌড়ে দুইটা শোকবার্তা সম্বলিত কার্ড, কিছু ফুল আর একটা মেকাপ বক্স নিয়ে এসো।
যথাযথভাবে কর্মগুলি সম্পাদন করার পরে জেনি তার জোম্বি পিতামাতার শরীরে ফুল আর কার্ড রেখে এক দৌড়ে চলে এল তাদের বাসার ড্রেসিং টেবিলটার সামনে। মুখে কী সব মাখতে শুরু করল। আমার কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রস্তাব পাবার আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চায় আর কী! মেয়েটা বড় অদ্ভুত।
বড্ড বেশি সময় নিয়ে ফেলছে সে। তাকে যেন মেকাপ করার নেশায় পেয়ে বসেছে। প্রথম বাক্সটা শেষ হবার পরে আমাকে আরো দুবার বলেছিলো নতুন মেকাপ বক্স আনতে। পরে আর আমাকে বলেনি। যতবার শেষ হয়েছে ততবার নিজেই ছুটে গেছে মেকাপ স্টোরে। বুঝেছি, আজকে আর বলা হবে না। কী পাগলাটে মেয়েরে বাবা! একেক সময় একেক বাতিকে পেয়ে বসে। আমি সোফায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ তার রূপচর্চা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম ভাঙে কীসের যেন গুঁতোয়।
(৪)
জেনি আমাকে চামচ দিয়ে গুতোচ্ছে। ছোট্ট একটা চা-চামচ। ব্যথা লাগছে না, কিন্তু খুব অস্বস্তিকর।
-আহ জেনি, কী করছ!
ঘুমজড়িত কন্ঠে মৃদু অনুযোগ প্রকাশ করি আমি অনুরাগের ভাষায়।
-এই, ঘুমায় পড়স কেন? খাবা না? ওঠ! ওঠ!
অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়ে নি। সকাল হয়ে গেছে। নাস্তার টেবিল ঠিকঠাক করছে জেনি, আমি দেখতে পাই। মেক-আপ মেখে এ কী বিদঘুটে চেহারা করেছে সে! নীলরঙা মুখ, তাতে ফুলকি দিচ্ছে লালচে ফোঁটা। কী ভয়াবহ! যাকগে, নানারকম স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে গেছে, মাথায় কী না কী বাঁই উঠেছিলো, ওসব ধরতে নেই। আর এই রৌদ্রজ্জ্বল সকালে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলার কোন তাড়াহুড়ো নেই। এখন তো অঢেল সময়! রাতের বেলা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করে সে সময় বলা যাবে। জেনি আমাকে আবার গুঁতোতে থাকে চামচ দিয়ে। এবার বেশ জোরেসোরেই। কী সব পাগলামী করছে!
-আসছি, দাঁড়াও।
-তোরে আসতে কইছে কে? তুই ভাগ এইখান থিকা। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ অনেক করছস, লাভ নাই। ভাগ! ভাগ! রান ফর ইয়োর লাইফ নিগা!
-মানে? এসব কি বলছ!
-শুনবা না আমার কথা? তাহলে আমি কিন্তু খুব রেগে যাব। আর ভয়ংকর একটা কান্ড করব।
ইনিয়েবিনিয়ে নাকিসুরে বলল সে।
-কী করবা?
-এখন যা করছি! দেখছো না আমার হাতে ভয়ানক একটা অস্ত্র? এটা দিয়ে তোমাকে খোঁচাব, গুঁতোব।
-তুমি এই চামচটার কথা বলছ?
-হ্যাঁ, এনি প্রবলেম?
-ওহ স্টপ কিডিং বেইবি!
-আমার কথা বিশ্বাস হয় না? আচ্ছা দাঁড়াও ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলি। এই যে আমার হাতে একটা মহা অস্ত্র চামচ+মুখে কৃত্রিম কড়া রঙ+ আমার জোম্বি বাবা মার মৃতদেহ + ববির পিস্তল= কী?
-মানে! কী সব বলছ অর্থহীন!
-হ্যাঁ ডিয়ার, অর্থহীন। তোমার ভালোবাসার আঁচলে শায়িত নতুন সভ্যতা, নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন দেখাটাও তেমনই অর্থহীন। সভ্যতা, স্বপ্ন, উন্নয়ন, ভালোবাসা সবকিছু যোগ করলে মেক-আপ বক্সের সবগুলো রঙের সম্মিলনে উদ্ভট কদাকার একটা কিছুই পাওয়া যায়। তোমাকে এসব কিছু থেকে যেকোন একটা কিছু বাদ দিতে হবে। তাহলে সমীকরণটা সাম্যাবস্থায় আসবে। বল কী বাদ দিতে চাও? সভ্যতা? স্বপ্ন? ভালোবাসা? উন্নয়ন?
আমি কী বলব ভেবে পাই না। আমতা আমতা করতে থাকি।
-হু হু! ওসব আরাম আয়েশ করে শুয়ে বসে ভালোবেসে আগত প্রজন্মের আদিপিতা হতে চাও? অত সহজ না! এখন দৌড়াও দৌড়াও! নাহলে চামচ দিয়ে বাড়ি দেব।
কী হাস্যকর কথা! সামান্য একটা চা-চামচ দিয়ে বাড়ি দেবার হুমকি দিচ্ছে। কোন মানে হয়! অর্থহীন। অর্থহীন হলেও সে ব্যাপারটা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে এবং তার খোঁচাখুঁচির পরিমাণ ক্রমবর্ধমান হতে থাকলে আমাকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু আমার চলে যাওয়ার ভঙ্গিটা তার পছন্দ হয় না। সে চিৎকার করে চলে,
-রান বিচ! দৌড়া! তোকে সারাজীবন দৌড়ের ওপর রাখবো!
বিপত্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচতে আমাকে বাধ্য হয়ে দৌড়ুতে হয়।
(৫)
ব্যাপারটা যত সামান্য ভেবেছিলাম মোটেও তা না। জেনি তার চামচ নিয়ে যেখানে সেখানে যখন তখন উপস্থিত হয়। হয়তোবা সাগরতীরে উদাসমুখে রৌদ্রস্নান করছি, ঢেউয়ের সাথে উপস্থিত হবে জেনি। হয়তোবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা পরিপাটি করার চেষ্টা করছি, পেছন থেকে এসে সজোরে কাঁধে চামচ গেঁথে দেবার চেষ্টা করবে জেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে পারা যায় না। সে আমাকে ঠিক ঠিক খুঁজে বের করে। আক্ষরিক অর্থেই সে আমাকে দৌড়ের ওপর রেখেছে। দৌড়ুতে দৌড়ুতে আমাদের প্রিয় শহর ছেড়ে কোন এক অজপাড়াগাঁতে চলে এসেছি! যেখানে সভ্যতার নিদর্শনগুলো সব অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
আমি দৌড়ুতে থাকি পেরিয়ে যাই মাঠ-ঘাট, বনাঞ্চল, মরুভূমি, ক্যাসিনো, তাজমহল, আমাজন। লাস ভেগাসের পরিত্যক্ত ক্যাসিনোর পোকার টেবিলে লুকিয়ে থাকা আমাকে ঘাড় ধরে বের করে তাড়া করে জেনি। আমাজনের সবুজ বৃক্ষে কিছুদিন শান্তিমত একটা ঘর পেতেছিলাম, সেখানেও আমাকে খুঁজে বের করে বনছাড়া করেছিল জেনি। আমার দেহে এখন অজস্র দাগ আঘাতের। দৌড়ুতে দৌড়ুতে শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু জেনির প্রাণপ্রাচুর্যে কোন ঘাটতি দেখা যায় না।
সে কি তবে ওই জোম্বিগুলোর কাছ থেকে জীবাণু সংক্রামিত হয়েছে? তার মুখের বিদঘুটে রঙ দিনকে দিন বদখত হয়ে যাচ্ছে আরো।
আর পারছি না জেনি! আমাকে বাঁচাও! আমি মারা যাব। একটা ধূসর ঊষর প্রান্তরে পৌঁছে যেখানে সভ্যতার কোন চিহ্ন নেই, নেই কোন সবুজ, নেই প্রাণের চিহ্ন, আমি ক্ষান্ত দিই। চামচ খেলা সে খেলতে থাকুক। আমাকে মেরেই ফেলুক। মৃত্যুবরণের জন্যে জায়গাটা ঠিক পছন্দ হয় না আমার। কিন্তু কী আর করা! টানা ছয় ঘন্টা ধরে শুয়ে আছি সমর্পণের ভঙ্গিতে। জানি সে ঠিকই আসবে।
আরো দু ঘন্টা পরে জেনি আসে তার কদাকার মুখ, কদর্য হাসি আর অব্যর্থ মারণাস্ত্র নিয়ে। তার চামচটা কেমন যেন বেঁকে গিয়েছে মনে হচ্ছে। এতদিনেও যে ভাঙেনি সেটাই আশ্চর্য! চামচের কারিগর বেশ দক্ষ ছিলো বলতেই হয়। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে আমার দিকে। মুখে আসন্ন আঘাতের পূর্ববর্তী ক্রুর হাসি!
আমি যা ভেবেছিলাম তাই হল! এবারের আঘাত আর সহ্য করতে পারলো না চামচটা। ভেঙে গেল। ভেঙে গিয়ে জেনির হাত থেকে পড়ে উত্তাল বাতাসে হারিয়ে গেল। অনেক বাতাস এখানে। হালকা বৃষ্টিও পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা তুমুল বর্ষণে রূপ নেবার সম্ভাবনা।
বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। জেনির মুখ থেকে বিদঘুটে মেক-আপ উঠে যাচ্ছে। সুন্দর লাগছে জেনিকে, অনেক সুন্দর! ওই ভূতাবিষ্ট চামচটাই যত নষ্টের গোড়া ছিল, জানি তো! জেনি ঠান্ডায় কাঁপছে। একটু উষ্ণতার জন্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে। ভালোবাসা, সভ্যতা, উন্নয়ন ইত্যাদির জটিল সমীকরণে একটা মাত্র চলক- চুম্বন যোগ করার ফলে পুরো সমীকরণটাই পাল্টে যায়। অংকটা খুব সহজ লাগে এখন। এখন আর বলতে কোন বাধা নেই,
-জেনি, তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমার হবে?
ঠোঁটে ঠোঁট আবিষ্ট থাকার ফলে এসব কথা বলা এখন কঠিন। তবে এসব আর বলার দরকারও নেই এখন। সব কথা বলার দরকার পড়ে না। বৃষ্টি আর বাতাস থেমে গেলে জেনি হ্যাচকা টান দিয়ে আমার কাপড় টেনে ছিড়ে ফেলে। এই সুপ্রাচীন আহবানে ধ্বনিত হয় নতুন সভ্যতার ঘোষণা। আমিও টান দিয়ে তার পোষাক ছিড়ে ফেলি।
ঝন-ঝন-ঝনাৎ শব্দে অনেকগুলো চামচ পতিত হয় এখানকার পাথুরে জমিনে। তার দূরভিসন্ধি ধরা পড়ে যাওয়ায় সে কিছুক্ষণের জন্যে অপ্রতিভ হয়। আর আমিও কেমন যেন বোকাটে মুখ করে বলে ফেলি,
-জেনি, তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমার হবে?
জেনি চোখে কামনার দৃষ্টি নিয়ে ঢলে পড়ে আমার কোলে।
দ্রুত সঙ্গম শেষ করেই আমাকে দৌড়ুতে হয় আবার। কাটখোট্টা রোদে, পাথুরে মাটিতে কষ্টকর দৌড়। জেনি ক্ষেপে গিয়েছে!
-রান বিচ রান! রান ফর ইয়োর লাইফ!
রোদে পুড়ে জেনির মুখটা বিকৃতরঙা হয় উঠেছে আবারো। দৌড়ুতে দৌড়ুতে আমি হিসেব করতে থাকি, জেনির পোষাকের আড়ালে কয়টা চামচ ছিল যেন, একেকটা চামচ দিয়ে কয়দিন যায়, তাহলে সবগুলো চামচের কর্মক্ষমতা...
জেনি খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। এখন ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। পরবর্তী চামচ না ভাঙা পর্যন্ত দৌড়ুতেই হবে। এখন অবশ্য পৃথিবীর পথঘাট অনেক চেনা হয়ে গেছে আমার। যেন পরিচিত ট্র্যাক ধরে এ্যাথলেটের দৌড়। পৃথিবীর প্রাচীন নিদর্শন, উন্নয়ন, ধ্বংসের কারণ এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে হয়তো জেনির চামচম্যানিয়া নিয়ে একটা সন্তোষজনক সমাধানে উপনীত হতে পারি! মুছে দিতে পারি তার মুখের ওপর পরতে পরতে জমে থাকা বিদঘুটে রঙ!
#গল্পটি লেখার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে দুটো শর্টফিল্ম। I Love Sarah Jane এবং The Horribly Slow Murderer with the Extremely Inefficient Weapon
প্রথমটির ইউটিউব লিংক- https://www.youtube.com/watch?v=gYxs7Y7ulrM
দ্বিতীয়টির- http://www.youtube.com/watch?v=9VDvgL58h_Y
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:০২