somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লকডাউন-পঞ্জিকা

০৫ ই জুন, ২০২০ রাত ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি প্রায় ভুলতেই বসেছি এ শহর শুধু আমাদের নয়, মানুষের নয়। হাজার বছরের ইতিহাস পরিক্রমায় আমার এ পেন্টাপোলিস ই চন্দ্ররাজার হাতে চেৎ্-ত-গৌঙ্গ আকিকা করিয়ে আজকের এ পুরান আরাকান প্রদেশ , চাঁটিগা বা চট্টগ্রামে পরিনত। এখন এখানে নেই রাজা-বাদশাহ, পর্তুগীজ নাবিক, ফৌজদার কিংবা লর্ডরা। কিন্তু রয়ে গেছে মানুষের আদিমতম ইচ্ছের সভ্যতম প্রকাশ। হ্যাঁ, আমার শহরের সবাই আর দশটা শহরের মানুষের মতই প্রতিদিন ভাগ্য-অন্বেষনে দিনের শুরু করত। দিনের শেষে সেই অন্বষনের ফলাফল খাতায় টুকে, রাষ্ট্রের ও মানুষের কি দুর্দিন সামনে আসছে তাই ভাবতে ভাবতে নিজের কর্মক্লান্ত দেহের অবসাদ কিছুটা মিটিয়ে নিয়েই শান্ত হত। নয়শ বর্গমাইলের এই নগরীর আনাচে কানাচে একদিন ভরিয়ে তোলা হয়েছিল মানুষে মানুষে। রাস্তায় বেরুলেই আমরা ভাসতাম মানবস্রোতে। রাস্তাগুলো ঢেকে থাকত কফ,থুথু আর আবর্জনায়। বাতাসে ভাসত ধূলা আর ধূলা, সিসা আর সিসা, ধোঁয়া আর ধোয়া। কত রকমের যানবাহন আমার এ শহরে চলছে আর তার সংখ্যা? সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে হয়ত কখনো ছিল না বা নেই। মহাসড়কের বিকট হর্নের শব্দে আমাদের হৃৎ্পিন্ড স্থানচ্যুত হত, রক্তনালী সংকুচিত হয়ে স্নায়ুর সাথে মিশে যেত, স্নায়ুগুলো তাদের কাজ ছেড়ে পরম আগ্রহে শরীরে নকশী কাঁথার বুননে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সবচে আমার মনে পড়ে একজোড়া চোখের কথা। এই একজোড়া চোখ কতই না ব্যস্ত ছিল। কটায় উঠবে, কটায় ঘুমোবে, আজ ক,টা বাসায় যেতে হবে পড়াতে, চাকরিস্থলে কে কিভাবে দেখছে তাকে, তার কাজ কেমন দেখাচ্ছে, পকেটে ক,টা রইল আজ, মাসের শুরুতে বেশ কটা শূন্য সম্বলিত সংখ্যার টেক্সট এর আগমন, গোটা শয়েক ছাত্রছাত্রীর অবোধ্য কাজের, বেনামি সুনাম, রাস্তায় রাস্তায় বহুতল ভবন, আরো কত কিছুতে ব্যস্ত ছিল আমাদের এই চোখ জোড়া। পাথরের এসব দালানকোঠা দেখতে দেখতে একদিন মনে হল শহরের মানুষের চোখ আকাশ ছুঁতে চায়। আকাশ ছোঁওয়ার সাধনায় সবাই মশগুল। দালানাকীর্ণ এই শহরে আমরা আকাশ দেখতে পেতাম না মাটি থেকে। ধীরে ধীরে ভুলে গেলাম চাঁদ আছে, পূর্ণিমা আছে, আছে অমাবস্যার গভীর অন্ধকারে ঢেউ খেলানো নৈঃশব্দ্য। ভুলেছিলাম আছে ছায়াপথ, কালপুরুষ, সন্ধ্যাতারা, ধ্রুবতারা, স্বাতীতারা আর সপ্তর্ষিমন্ডল। শেষ কবে জোনাকি দেখেছি কেউ মনে করতে পারলাম না।

এই শহরে দুর্ঘটনা প্রায়ই লেগেই থাকত। একবার এক বস্তিতে আগুন লেগে অঙ্গার হলো প্রায় ১০০ জনের ও বেশি। ফ্লাইওভার হবে শুনে যখনই মানুষ খুব উৎফুল্ল হলো, তখনই ফ্লাইওভারের সস্তামানের গার্ডার ধসে মরল ৫ জন। আরেকবার শুরু হল মিটিং, মিছিল আর বোমাবাজির মহড়া। প্রতিদিন মানুষ বাড়ছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এসে। দুয়ে-দুয়ে করে একসময় দেখলাম প্রাণকেন্দ্রে মানুষের প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে শ’য়ে শ’য়ে। সেখানে শুরু হল নিত্যনতুন ব্যবসা। এর মধ্যে চলছে ফ্রি-তে খাবার বিতরন, সাহিত্য নিয়ে প্রলাপ, রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ে সাহিত্যের অনাসৃষ্টি সম্পর্কিত পর্যালোচনা আরো কতো কি! প্রতিদিন দেখতাম আর ভাবতাম, কি অসামাজিক আমি। এর কিছুর মধ্যেই নেই কেন আমি? এ শহর কি তাহলে আমাকে আপন করেই নেয় নি? হঠাৎ্ একদিন শহরের সেই প্রাণকেন্দ্রে বিকট আওয়াজে ফুটল বোমা। পরদিন খবর এল ৪ জন নিহত। আরেকদিন এক স্কুলগামী মেয়েকে উদ্দেশ্য করে পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হলো। পরদিন আবার খবর এলো মেয়েটির একটি চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। ফেসবুকে দেখলাম কিছুদিন পর মেয়েটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কিছুটা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে তার ছবি। হাজারে হাজারে শেয়ার হলো সে কথা।
আরেকদিন আমরা এক বিশাল শতবর্ষের উদযাপনে ব্যস্ত সবাই। হঠাৎ্ খবর এলো এক অজ্ঞাত রোগ হানা দিয়েছে আমাদের বিশ্বে। আমার দেশে আর শহরে তার আগমন হলে, মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকা জ্বলে উঠবে আমার এই তিলোত্তমায়। বন্ধ হয়ে গেল সবকিছু, স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা বানিজ্য, সব। বহির্বিশ্বে তখন চলছে মৃত্যুর কুচকাওয়াজ। একশ, দু’শো, পাঁচশ, হাজার করে বেড়েই চলেছে সংখ্যা। খবর এলো আমার এ দেশে আর শহররেও ঢুকে গেছে এ ন্যানো-ভাইরাসের সৃষ্ট অজ্ঞাত-রোগ। বন্ধের ষষ্ঠদিন পৃথিবীর সবকটি দেশ আমার দেশের সঙ্গে স্থল, নৌ ও আকাশ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। অষ্টমদিন সরকার ঘোষনা করল সকল মিল-কারখানা বন্ধ থাকবে। নবমদিন ঘোষনা হলো সাধারন ছুটি। আতঙ্কিত নাগরিক দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করল। এবার গোটা শহরে লকডাউন ঘোষনা হলো। টানা একমাস কেউ ঘর থেকে বিনা প্রয়োজনে বের হতে পারবে না। বেরুলেই দন্ড। কোন যানবাহন চলবে না। মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা খুলবে না।

আমি থাকি শহরের এককোণায় । ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে। বাবা-মা আর আমি। চাকরির সুবাদে কিছুটা নিশ্চিন্ত আছি। মাসখানেকের খাদ্যসামগ্রীর জোগার করে ফেলেছি এরই মধ্যে। চিন্তা নেই। ন্যানো ভাইরাস? সে আর ক’দিন? এই শহরের আমি অনেক বড় বড় অসুখ হতে দেখেছি। দু’দিন পরই সবাই স ভুলে যায়। একমাস সে তো অনেক সময়। বরং ভালোই হলো। এই ছুটিটা অনেক দিন ধরেই চাচ্ছিলাম মনে মনে। বাকিদের সাথে কথা বলে মনে হলো হ্যাঁ, এ তো সবারই মনোষ্কামোনা। এভাবে একমাস গেল। বডিক্লক এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সকাল ১০ টায় ঘুম থেকে উঠি। নাশতা করে গান শুনতে শুনতে ঘরদোর পরিষ্কার করি। দুপুরে ভাত খেয়ে বই নিয়ে বসি। এতদিন মোবাইলে কোন গেমস ছিল না। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমি প্রায় প্রতিনিয়তই একখন অন্তত দু’টা গেমস খেলছি নিয়ম করে। সন্ধ্যায় বারান্দায় গিয়ে বসি। দেখি সূর্যাস্ত। অপার আলোর জগৎ হঠাৎ হারিয়ে যায় সমস্তটা নিয়ে গোধূলীর আড়ালে। অন্ধকার নামে। ঘরে ঢুকি। মুভি দেখি প্রতিদিন। ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’ এরই মধ্যে ৪ বার দেখা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দরজাটা খুলি একটু । ফ্ল্যাটের অনেকেই চলে গেছে ইতিমধ্যেই বাড়ীতে। চারিদিকে শুধু নৈঃশব্দ। কান খাড়া করে শব্দ খুঁজে যাই। হঠাৎ কোথাও টিভির আওয়াজ শুনতে পাই। বা কোন বাচ্চার কাঁদার । বেশিরভাগ সময়ই মনে হয় শহরটা আস্ত একটা গোরস্থান। কোন মানুষ নেই। কোনকালে ছিলও না। যেন আমিই একাই জ্যান্ত মানুষ। ঘন্টাখানেক এসব ওলটপালট ভাবনা। তারপর আবার মুভি দেখা কিংবা বই পড়ে কাটানো। ঘুমানো দুইটা-তিন্টায়।

প্রথম প্রথম খুব আতঙ্ক নিয়ে সবাই বাসায় ফিরলেও আস্তে আস্তে সবাই বলতে থাকল ‘ধূর কিসের কি করোনা’ অল্পবিস্তর থেকে সংখ্যা বাড়ল বাইরে পদচারনার। সরকার থেকে কঠোর আদেশ প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া। পুলিশ সার্বক্ষনিক পাহারাদারি করছে। এর মধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পুলিশ জনগনকে শায়েস্তা করতে লাঠিপেটার ভিডিও। কিছুদিনের মধ্যে আমার দেশেরও দু’টা একই ভিডিও ভাইরাল হলো। সেনাবাহিনী নামল অবস্থা বেগতিক দেখে। আমার এলাকাতেও দোকানপাট দেখলাম বন্ধ-আধাবন্ধ। সেনাবাহিনীর ভয় এদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত নয়। এরই মধ্যে খবর এল আমার শহরে প্রথম ন্যানো-ভাইরাস আক্রান্ত সনাক্তের খবর। দুটা বিল্ডিং লকডাউন হয়েছে শিল্পকলার ওখানটায়। অতঙ্ক দ্বিগুন হলো।

সেদিন রাতে গ্রাম থেকে এক খালাতো ভাই ফো দিল। জানালো যে মসজিদে মসজিদে ও বাড়িতে বাড়িতে নাকি আজান হাঁকা হচ্ছে। হিন্দুরা নাকি উলুধ্বনি দিচ্ছে। মনে পড়ল শৈশবের স্মৃতি। আশ্বিন-কার্তিকে যখন প্রবল তুফান উঠত, ঘরের চাল উড়ে যায়-যায় দশা, মানুষ নিদারুন বিপন্ন, তখন তারা ঘরের ভেতরে জোরে জোরে আজান হাঁকত, উলু দিত। স্রষ্টার কাছে আশ্রয় চাইত। কিন্তু ঝড়ের হুংকারে সে শব্দ ঘুরপাক খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ত। খোদার কাছে পৌঁছত না বোধহয়। পরদিন সকালে মৃৎ জীব-জানোয়ারের গন্ধে উৎকট হয়ে পড়ত বাতাস। বাতাসে মিশে যেত তান্ডবের কটু স্বাদ। বড় বড় গাছ উপড়ে শেকড় বের করে দেখাতো কতটা অসহায় তারা। প্রলয়কারী ঝড়ের সময় দেখতাম আমার মা মশলা বাটার শিলটা ছুঁড়ে মারতেন উঠানে। এতে নাকি ঝড়ের গতি কমে যায়। এটা লোকবিশ্বাস। লোকবিশ্বাস লোকসংষ্কৃতিরই একটা উপাদান। এর উৎপত্তি কোথায়, কবে, আমার জানা নেই। হয়তো অনেক আদিকালেই এর উৎপত্তি। মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল, অজ্ঞ ছিল বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে, হয়ত তখন তারা ঝড়কে অপদেবতা ভাবত। শিল ছুড়ে মারলে সে দেবতা আহত হয়ে লেজ গুটিয়ে ফিরে যাবেন।

ন্যানো-ভাইরাসের এই দুর্যোগে হয়ত বাঁচতে চাইছে অসহায় মানুষ, কিংবা স্রেফ বিশ্বাস থেকে, অথবা না জেনেই আযান, উলু দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই আমার ভেতরও এক বিশ্বাস জন্মালো , ‘না, এবার এ ভাইরস আর বেশিদিন নেই।‘

কিন্তু আমার ধারনাকে ভুল প্রমান করে রাত ২টায় ফেসবুকে এক পোষ্ট চোখের সামনে নাচতে থাকল। ফেসবুকের সমস্ত কিছুই আজকাল স্রোতের মত প্রবাহিত। এক পোষ্টের মাধ্যমে জানা গেল, চট্টগ্রামের সমুদ্রবর্তী গ্রাম চরদুর্গায় নাকি এমন এক শিশু জন্ম নিয়েছে , যে কি না জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় কথা বলেছে। বলেছে মুসলমান হলে আজান দাও, হিন্দু হলে উলু দাও। ন্যানো ভাইরাস পালাবে। বলা বাহুল্য, অন্য ধর্মালম্বীদের জন্য কোন ইন্সট্রাকশন নেই। তারা বোধকরি কিছুটা হতাশই হলেন। গুজব ছড়ালে মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। যাচাই-বাছাই না করেই তাই মধ্যরাতে তারা আজান , উলু দিয়ে দিল।
ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম আরেকটি পোষ্ট। সেখানে বলছে বাচ্চাটী চরদুর্গায় নয়, জন্মেছে মেঘনার গ্রাম ইছাপুরে। আরেক জায়গায় দেখলাম তারা বলছে চাঁদপুরের। এভাবে সবাই বাচ্চাটির জন্মস্থান নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে গেল। নতুনত্ব আনতে আরেক পোষ্টে বলা হলো, বাচ্চাটি শুধু আজান আর উলু দিতেই বলেনি, বলেছে দুধ-চিনি ছাড়া আদা-চা খেতে। এটাই ন্যানো ভাইরাসের ঔষধ। মধ্যরাতে আজান দিতে লাগল আর দফায় দফায় আদা-চা খেতে লাগলো মানুষ।

আমি ব্রাউজাসক্ত হয়ে পড়ি। মজা নিতে নয়। অবাক আর নির্বিকারের মাঝামাঝি পর্যায়ে ইথারগ্রস্থ হতে। আরেকটি পোষ্ট সামনে আসে। শ্রীমঙ্গলের কোন একগ্রামে গুজব রটে যে, দেবরাজ শিবের ত্রিশূল নাকি ঢুকে পড়েছে মাটির গভীরে। রাত বারোটায় এই ত্রিশূল ব্লাস্ট হবে। কেঁপে উঠবে পৃথিবী। শুরু হবে ভয়াবহ ভূমিকম্প।

হঠাৎ আমার কাল নিয়ে প্রশ্ন জাগে মনে । আমি কোন কালে বাস করছি? আমার আশে পাশে কি সেই সিন্ধু-হরপ্পার উত্তরসূরিরা কেউ নেই? আমি কি কোন সালে আছি? কত শতকে? একুশ? না এগারো? না তারো আগের? প্রযুক্তির ডানায় ভর করেই তো এ শতকের কালজয়ী যাত্রা। যাকে বলে ডিজিটাল যাত্রা। ভেবেছিলাম এদেশ এবার মুক্তি পাবে। জেগে উঠবে বৈশ্বিকতা। মুক্ত হবে অশিক্ষার অমনিশা থেকে। সবকটি জানালাই খুলে দেওয়া হয়েছে এবার। আর নেই কোন বাধা। কিন্তু না। তা হলো । কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রযুক্তির প্রদীপ ঢেকে গেল হাজার বছরের অন্ধকারে। প্রযুক্তির স্নায়ু ধরেই অন্ধকার ছড়ালো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফেসবুক, ইউটিউব ছেয়ে গেল অন্ধকারের দাবানলে। পুড়িয়ে দিল শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের হিতাহিত জ্ঞান ও সাধারন বিজ্ঞানমনষ্কতাও। পদ্মাসেতু নিয়ে জলদেবতাকে তুষ্ট করতে মুণ্ড কেটে দেওয়া হচ্ছে পিলারের গোড়ায়। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মরতে লাগল মানুষ। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আরো কত গুজব যে ছড়ানো হলো তার কোনো শুমার নেই। ন্যানো ভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের কালেও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

কেটে গেল পনেরো দিন। সেদিন দুপুরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দক্ষিণা বাতাস আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। একটা কুকুর লকলকে জিব বের করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কুকুরটাকে আমি চিনি। রাতভর এই পাড়া পাহারা হয়তো খাবারের সন্ধানে দূরে কোথাও গিয়েছিল। কোথাও কোনো খাবার না পেয়ে ফিরে এসেছে। শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আমার খুব মায়া হলো। ইচ্ছে হলো কিছু খাবার নিয়ে নিচে নেমে তাকে দিয়ে আসি। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে বের হওয়া কি ঠিক হবে? রাস্তার ময়লা-আবর্জনা থেকে আমিও তো ন্যানো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি। তাছাড়া এ-ভাইরাস নাকি পশুপাখি থেকেও ছড়ায়। আমি সাহস পেলাম না। একটা পলিথিনের ঠোঙায় কিছু ভাত আর কিছু মাংস ছুড়ে দিলাম। কুকুরটা হুমড়ি খেয়ে খেতে শুরু করল। খাচ্ছে আর লেজ নাড়াচ্ছে। খাওয়া শেষ করে আমার দিকে তাকাল। তাকিয়ে রইল। আমি তার করুণ চোখ দুটোর দিকে তাকাই। দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বেঁচে থাকার আনন্দে সে কাঁদছে।

কুকুরটা আমাকে মনে করিয়ে দিলো এই শহরের ছিন্নমূল মানুষদের কথা, যাদের ঠিকানা ফুটপাত, ওভারব্রিজ, স্টেশন, যাত্রীছাউনি। যারা মানুষের দয়ায় বেঁচে থাকে। এখন তো শহরে মানুষ নেই, তারা কীভাবে বেঁচে আছে? সরকার কি খাবারের ব্যবস্থা করছে? করারই তো কথা। হয়তো করেনি। হয়তো উপোস থাকতে থাকতে তারা মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছে। হয়তো তারা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

কেটে গেল পঁচিশ দিন। খবরে শুনতে পাই শহরে লকডাউনের সময়সীমা বাড়িয়েছে সরকার। আরো এক মাস। আমি খুশি হই। আরো এক মাস অফিসে যেতে হবে না। ভালোই হলো। যেসব সিনেমা দেখব দেখব করেও দেখা হচ্ছিল না, যেসব বই পড়ব পড়ব করেও পড়া হচ্ছিল না, এই অখণ্ড অবসরে সব দেখে ফেলব, সব পড়ে ফেলব। জেমস আইভরি, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, স্টিফেন স্পিলবার্গ ও জাঁ-লুক গদারের কিছু ছবি ডাউনলোড করে রেখেছি, সেগুলো দেখে ফেলব। কয়েকজন আবার ইনবক্সে মানি হেইস্ট দেখেন, প্রফেসরের ডায়লগ পাঠাতে লাগল। মাঝে ‘প্ল্যাটফর্ম’ দেখে বোকা বনে গেলাম। এমন এবসার্ডিটি এখনকার সময়ে খুব দেখা যায় না। কারণ বাজারে খায় না। তবুও কিছু মানুষ উপোস থেকে হলেও স্বপ্ন দেখে ফেলার অপরাধ করে ফেলে।

এক মাস পর, একদিন ভোরে কাকের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। জানালার ফাঁকে তাকিয়ে দেখে শত শত কাক ভিড় করেছে পাশের ভবনের ছাদে। এত কাক একসঙ্গে কখনো দেখিনি। ভোরের লাল সূর্য দেখে আমার ভেতরে হাহাকার জাগল। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল এক গভীর শূন্যতা। ইচ্ছে হলো বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। এই বন্দিদশা আর ভালো লাগছে না, অসহ্য হয়ে উঠেছে। এভাবে কি মানুষ বাঁচতে পারে? অসম্ভব। মানুষ ছাড়া সবকিছুই অর্থহীন। ঠিকই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ : যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ। বুকসেলফের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষন। রবীন্দ্ররচনাবলীর সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে তাঁকে প্রণাম জানালাম। জীবনের কী গভীর সত্যই না তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন!
দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখার জন্য আমি নিউজপোর্টালগুলো দেখি। প্রতিমুহূর্তে দেশের পরিস্থিতির আপডেট দিচ্ছে পোর্টালগুলো। স্বস্তির কথা, সারাদেশে যে গণসংক্রমণের শঙ্কা ছিল তা হয়নি। গরম পড়তে শুরু করেছে, রোদ তেতে উঠছে। চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ন্যানো ভাইরাস টিকতে পারবে না।

মনটা ভরে উঠল অনাবিল আনন্দে। মহামারি চলে গেলে আবার সচল হবে এই শহর। আবার জমে উঠবে ভাঙা হাট। আহা কতদিন হাজির বিরিয়ানি খাই না! কতদিন জামালখানের ফুচকা খেয়ে চোখের পানি ফেলিনি ঝালে। কতদিন মেজ্জানের মাংস স্বাদা হয়নি। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে। আবার গড়াতে শুরু করবে থমকে যাওয়া জীবনের চাকা।
এক মাস কুড়ি দিন পর এক মধ্যরাতে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, বিজলি চমকাচ্ছে, বজ্রপাত হচ্ছে। নিজেকে ময়ূর মনে হলো। পেখম মেলে দিতে ইচ্ছে করল। আহা বৃষ্টি! জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নাকে ঝাপটা দিলো ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। জেগে উঠল শৈশবস্মৃতি। এমন ঘনঘোর বৃষ্টিতে কত ভিজেছি! ভিজতে ভিজতে কত শাপলা-শালুক তুলেছি, কত হা-ডু-ডু-ফুটবল খেলেছি। আহা শৈশব! ফেলে আসা শৈশব! স্মৃতিরা আমার মাথায় একসঙ্গে হানা দিলো। মানুষের স্মৃতিই তার যেমন পরম বন্ধু, তেমনি তার সার্বক্ষনিক শত্রু। স্মৃতিকে না ভোলার কষ্টেই মূলত কেঁদে ফেলে মানুষ। আমিও কাঁদলাম প্রাণভরে। হৃদয় ভিজে যেন পবিত্র হলো কিছুটা।

একদিন কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আজ ঘুমোলেই আর ওঠা হবেনা। জেগে রইলাম। পায়চারি করতে করতে পা-ব্যাথা শুরু হলো। কানে ‘নো- উইম্যান , নো ক্রাই’ রিপিটে বাজছেই। বাইরে চোখ পড়ল। দেখি সকালের আভা দেখা যাচ্ছে। চট করে মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। হেলমেট টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইকটা ধূলো জমে ধূসর হয়ে গেছে। একটা ঝাড়া দিয়েই উঠে পড়লাম। মনে হতে থাকল একমূহুর্ত অপেক্ষা করলে কেউ একজন আমাকে এক্ষুনি ধরে বাসায় ঢুকিয়ে দেবে আবার। বাইকে ছুট দিয়েই মনে হল বহু বছর পর আমি উড়তে শিখেছি আবার। আমি উড়ে চললাম আধো আলো আধো অন্ধকারময় শুভ্র সকালকে গায়ে মাখতে। আমার রন্দ্রে রন্ধ্রে শহরের পড়ে থাকা শুভ্রতা যেন ঢুকে পড়ল। আমার মনে হলো এ শরীরে আর কোন ন্যানো কেনো, গড-পার্টিকেল-ভাইরাস ও প্রবেশ করতে পারবে না। মনে পড়লো আমার কর্ণফুলির কথা। কত বছর যেন দেখা হয়নি। তীরের মাটিগুলো শুষ্ক হয়ে গেছে আমায় না দেখে- কল্পনায় তাও দেখতে পেলাম যেন। উড়ে গেলাম কর্ণফুলির ধারে। বেশি দূরে নয় আমার আবাস হতে, তবুও যেন এক আলোকবর্ষ লাগলো অপেক্ষার মনে।

বাইক থামিয়ে আমি হাঁটতে থাকি। দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যাই নদীর তীরে। বাতাস আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলাম। কিন্তু নদীটা আমার কাছে অচেনা ঠেকল। এই নদীর এমন রূপ আমি কখনো দেখিনি। টলটলে স্বচ্ছ জল। যেন মিনারেল ওয়াটার। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে। ঘাই মারছে। তীরে কাঁকড়ার দল যেন মেলায় দোকান দিয়ে বসেছে। একটা মরা মাছও চোখে পড়োল না তীরে। ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদীর ঢেউ ধুয়ে দিচ্ছে আমার পা।

একটা যায়গায় জুতো বিছিয়ে বসি। চারপাশটা দেখি। নিস্তব্ধ। নিজেকে সায়েন্স ফিকশনের প্রটাগনিস্ট মনে হতে থাকে। পুরো পৃথিবীতে আমি একাই বেঁচে আছি বোধহয়। মনে মনে একটা কুকুরের অভাব বোধ করতে থাকি। পূব আকাশ রঙিন হলো। অবাক হয়ে দেখছি সে দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ দূর হতে ভেসে আসা গানের আওয়াজ পেলাম। নারী বা পুরুষ কন্ঠ ঠাওর করতে পারলাম না। হয়ত ভাসমান নৌকাগুলোর একটা থেকে হবে । দু’কান ভরে উঠল গানের সুরে অপার সুখে- “এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী...”

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২০ রাত ৩:৪২
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×