ইউরোপে মুসলমানরা তুলনামূলক সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়। সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশ। তবে কিছু দেশে, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং সুইডেনে মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আসন্ন দশকগুলিতে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Pew Research Center এর মতে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই ইউরোপে মুসলমানদের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
জনসংখ্যার এই পরিবর্তনের ফলে বহু ইউরোপীয় দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটছে, বিশেষ করে লক্ষ লক্ষ আশ্রয় প্রার্থীদের আগমনের ফলে, যাদের মধ্যে অনেকেই মুসলমান। ফ্রান্স এবং জার্মানির সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে অভিবাসন বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসন শীর্ষ বিষয় ছিলো। Pew Research Center এর সাম্প্রতিক জনসংখ্যা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান ব্যবহার করে নিচে ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যার আকার এবং বিন্যাস নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো।
1. ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স এবং জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে। 2016 সালের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সে 5.7 মিলিয়ন মুসলমান (দেশের মোট জনসংখ্যার 8.8%) এবং জার্মানিতে 5 মিলিয়ন মুসলমান (মোট জনসংখ্যার 6.1%) মুসলমান বসবাস করতো। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সাইপ্রাসে মোট জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ হলো মুসলমান; দ্বীপটিতে 300,000 মুসলমান বসবাস করে যা তার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ (25.4%)। এদের বেশিরভাগই তুর্কি অভিবাসী (সাম্প্রতিক নয়) যাদের শিকড় সাইপ্রাসের অনেক গভীরে প্রোথিত রয়েছে।
2. ইউরোপের মোট জনসংখ্যার মুসলিম অংশ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী কয়েক দশকে এটি আরো বৃদ্ধি পাবে। 2010 সালের মাঝামাঝি সময় থেকে 2016 সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইউরোপে মুসলমানদের সংখ্যা 3.8% থেকে 4.9% (19.5 মিলিয়ন থেকে 25.8 মিলিয়ন) পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। 2050 সালের মধ্যে, এই জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে, যা 11.2% বা তার বেশি হতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে ইউরোপে কত সংখ্যক মুসলমানের অভিবাসন অনুমোদন দেওয়া হয় তার উপর। তবে ভবিষ্যতে ইউরোপে অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত হয়ে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা থাকলেও, ইউরোপের বর্তমান মুসলিম বাসিন্দাদের তুলনামূলক যুব সংখ্যা এবং উচ্চ প্রজনন হারের কারণে মুসলিম জনসংখ্যা 7.4% পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে।
3. ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে তরুনদের সংখ্যাই বেশি এবং তাদের শিশুদের সংখ্যাও অন্যান্য ইউরোপীয়ানদের থেকে বেশি। জনসংখ্যার বয়স কাঠামোতে মুসলমানদের মধ্যবর্তী জনসংখ্যার গড় বয়স 30.4 যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয়দের মধ্যবর্তী জনসংখ্যার গড় বয়স 43.8। এটাকে অন্যভাবে বলা যায়, ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে 50% এরই বয়স 30 বছরের নীচে যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয়দের মাত্র 32% এর বয়স 30 বছরের নীচে। অধিকন্তু, গড়ে প্রায় প্রত্যেক মুসলিম মহিলাদের 2.6 টি করে পূর্ণ শিশু আছে যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় নারীদের শিশু সংখ্যা মাত্র 1.6 টি।
4. 2010 সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অভিবাসন। আনুমানিক 2.5 মিলিয়ন মুসলমান শুধুমাত্র আশ্রয়ের জন্য নিজ এলাকা ত্যাগ করে ইউরোপে আগমন করে যেখানে কর্মসংস্থান বা শিক্ষা গ্রহণের জন্য আগমন করে তারচেয়ে অনেক কম জনসংখ্যা। এসব অভিবাসী মুসলমানদের মধ্যে প্রায় 1.3 মিলিয়নেরও অধিক মুসলমানকে ইউরোপে শরনার্থী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাদেরকে ইউরোপে থাকার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। ইউরোপে মুসলমানদের বৃদ্ধির দ্বিতীয় চলকটি হলো প্রাকৃতিক বৃদ্ধি। 2010 সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় মুসলমানদের মধ্যে মৃত্যুর চেয়ে 2.9 মিলিয়ন বেশি জন্ম হয়েছিলো। ধর্ম পরিবর্তনকেও মুসলিম জনসংখ্যা পরিবর্তনের একটি ছোটো ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সময়ে ইউরোপে অন্যান্য ধর্ম থেকে মানুষ যেমন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তেমনি অনেক মানুষ বিশ্বাসের পরিবর্তে ইসলাম থেকে দূরেও সরে গেছে।
5. ইউরোপীয় দেশগুলোতে বর্তমানে মুসলমানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। Pew Research Center কর্তৃক ইউরোপের 10টি দেশের উপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল। তবে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডের অধিবাসীরা মুসলমানদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। তাদের এই প্রদানকৃত দৃষ্টিভঙ্গি মূলত মুসলমানদের মতাদর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ যারা মুসলমানদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তারা মূলত মুসলমানদের মতাদর্শকেই নেতিবাচকভাবে দেখে। জার্মানরা মুসলমানদের মতাদর্শের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও 47% ডানপন্থী জার্মান মুসলমানদের প্রতিকূল রেটিং প্রদান করে যেখানে মাত্র 17% বামপন্থী এই কাজটি করে। বাম ও ডানপন্থীদের এই ব্যবধান ইতালি এবং গ্রীসে প্রায় 30 শতাংশ।
তথ্যসূত্রঃ
১। 5 facts about the Muslim population in Europe BY CONRAD HACKETT (Click This Link)
২। Islam in Europe, From Wikipedia (https://en.wikipedia.org/wiki/Islam_in_Europe)
৩। List of cities in the European Union by Muslim population From Wikipedia (Click This Link)
৪। European Countries With The Largest Muslim Populations (Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১:৫৪