somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

লেখা নিয়ে লেখালেখি

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একটু গুমোট দিন; মেঘলা আকাশ; সূর্য ডোবার আগেই দিনের আলো ছাতার মতো বন্ধ হয়ে আসছে। ব্যস্ত শহরের জনাকীর্ণ ফুটপাথে মেয়েটি বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে; গড়পড়তা বাঙ্গালী মেয়েদের উচ্চতা; কালচে নীল টাইট জিন্সের প্যান্টের ওপরে হালকা হলুদ ফতুয়া। ফতুয়ার ওপরের ঝাপসা নীলচে সবুজ ডোরাকাটার সাথে মিলিয়ে গলার দুপাশে ঝুলছে সবজে নীল কুচানো স্কার্ফ। মেয়েটার শরীরের বাঁক মোহময় হলেও চোখ আটকে যায় মেয়েটার মুখের আদলে; চোখে একটু দিশেহারা ভাব; মধ্যকুঁড়ি পেরোলেও এই তরুণীর সৌন্দর্যে কৈশোর বাঁধা পড়েছে।

তারপরেও কি যেন নেই...কিসের অভাবে যেন এই ছবিটা সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে না!! হঠাৎ এক পশলা দমকা বাতাস এসে মেয়েটার কব্জিছোয়া চুলের রাশি উড়িয়ে দিলো; শুধু কিছু মুহূর্তের জন্য মেয়েটার কিশোরী মুখের দু’পাশে উড়ন্ত চুলেরা ফনা মেললো। আর...আর ছবিটা সম্পূর্ণ সুন্দর হলো।

লেখালেখির ব্যাপারটা আমার জন্য ঠিক তেমনই। প্রাত্যহিক, ঘষটানো, কালসিটে পড়া, পুরোনো, খুব চেনা, দৈনন্দিন শব্দদের এলোমেলো করে সাজানো; খুব চেনা গল্পের শরীরে হঠাৎ করেই দমকা হাওয়া দেয়া। তবে ঐ হাওয়া দেয়ার কাজটা কঠিন; বাতাসে কাঁপন ধরে তখনই যখন কোন কথা, কোন মানুষ, কোন দৃশ্য আমাকে নাড়া দেয়; তারপরে হাওয়ার তান্ডব কখনো ওঠে, কখনো ওঠে না। যারা নন্দিত লেখক তারা যখন তখনই শব্দের বাগানে ঝড় তুলতে পারেন। আমি সবসময় পারি না; হাওয়ার হাল এখনো ঠিকমতো রপ্ত করতে পারিনি। কখনো কখনো হাওয়ারা দিকভ্রান্ত হয়।

শব্দ নিয়ে খেলার জন্যই লিখতে ভালো লাগে। একটা শব্দের পরে কোন শব্দটা বসবে? শব্দের পুরোনো শরীরে আচমকা কো্ন নতুন শব্দ, কোন সুন্দর শব্দ। সব মিলিয়ে সর্বাঙ্গ সুন্দর; আলাদা করে প্রত্যেককে সাজতে হয় না, সাজাতে হয় না। ঠিক যেমনটা কপালে রক্তলাল টিপ দেবার সাথে সাথেই একজন রমনীর সৌন্দর্য বদলে যায়; আটপৌরে কেউ হয়ে ওঠে অনন্যা।

প্রতিটা শব্দই একেকটা বাঁক; একটা মোচড়, যার রয়েছে আগে এবং পরে। প্রতিটা বাঁকেই আছে শুরুর আনন্দ, ফুরানোর ক্লান্তি, আর ছেড়ে আসার কষ্ট। শব্দদের কাজ পাঠককে সঠিক বাঁকে দাঁড় করানো; সঠিক মোড়ে ছেড়ে যাওয়া। কম্পোজিশন, পারস্পেকটিভ; সঠিক মোড়ে দাঁড় করিয়ে সঠিক পারস্পেকটিভ চোখের সামনে খুলে দেয়া। সোজাসুজি কিছু না বলেও সবকিছু বলে দেয়া। কবিতা এটা পারে; কখনো কখনো সিনেমাও। আমি চাই আমার গল্পরা ঠিক এমনটাই হোক।

কখনো কখনো কোন বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সানাইয়ের করুন সুর শোনা যায়। সব নীরবতা সত্ত্বেও দুপুরের ঝলমলে রোদে মাদলের শব্দ বেজে উঠে বা বৃষ্টির শব্দে জলতরঙ্গের আওয়াজ বা মেঘলা আকাশে কারো চাঁপা কান্নার শব্দ। জগতের সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধেই এমনটা ঘটে; সম্ভব হয় এক ইন্দ্রিয় দিয়ে আরেক ইন্দ্রিয়ের বিষয়কে অনুধাবন করা। শ্রবন দিয়ে রুপকে অনুভব; দৃষ্টি দিয়ে শব্দকে; শব্দ দিয়ে স্বাদ, আর গন্ধ, আর বর্ণ, আর স্পর্শ। আমি চাই আমার শব্দেরা ঠিক এমনটাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হোক।

লেখক হিসাবে আমার তেমনটাই হওয়ার কথা পাঠক হিসেবে আমি যেমন। লেখার বা লেখকের ক্ষেত্রে তেমন বাছবিচার নেই আমার; আবেগ তৈরী করে তেমন যে কোন লেখাই আমার কাছে গ্রহনযোগ্য বা প্রিয়। লেখার পদ্ধতি শেখার জন্য আমি কখনোই কোন লেখা পড়িনি; অনুভবের জন্য পড়েছি।

লেখালেখি আমার মতে জীবন্ত কিছু; অনুভবের বিষয়; যান্ত্রিক কোন পদ্ধতি নয়। কোন গল্প, উপন্যাস বা কবিতা সুন্দরী কোন রমনীর মতো; তাকে দু’আঙ্গুলে ঘাটাঘাটি করে, সাড়াশী কাচির ব্যবহারে ব্যবচ্ছেদ করাটা কখনোই মঙ্গলজনক হয়নি; বরং অশ্লীলতা হয়েছে। জোছনার মতোই সৌন্দর্য ধরা যায় না; তাকে শুধু অনুভব করা যায়।

তারপরেও কিন্তু গল্প কবিতাকে টুকরো টুকরো করে খুলে আবার জোড়া দিয়ে কবি সাহিত্যিক সমালোচকেরা আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন শিল্পকে। আসলেই কি এতোটা যান্ত্রিক পদ্ধতিটা? তাহলেতো সার বেঁধে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা আচারের বোতলের মতো প্রোডাকশন লাইন থেকে গল্প কবিতা বেরিয়ে আসতো। যে কোন লেখকের জন্য যা হরর ফিল্মের দৃশের মতো।

কিন্তু ওই যে বললাম শব্দের সংস্থাপন, কোন এক বাতাসের ঝটকায় নিরীহ শব্দরা অসামান্য সুন্দর। সেই বাতাসে শব্দের পাল তোলা শেখার জন্যই নন্দিত লেখকদের লেখা পড়া। প্রতিটি লেখা নতুন বলেই শাদা কাগজেরা আকুল হয়। নতুন সৃষ্টির আগে বা পরে কোন পূর্ব নির্ধারিত ছক থাকে না; থাকা উচিতও না। সেটা শিল্পের প্রতি অসম্মানজনক!!

আমি আবেগতাড়িত লেখক এবং অন্তর্মুখী; লেখালেখির শুরুই নিজেকে খোঁজার জন্য। বছর তিনেক আগে যখন লেখা শুরু করেছিলাম কখনো ভাবিনি যে এখনো লিখবো। যখন কোন গল্পের প্রথম বাক্যটা লিখি টের পাই বাবা শুনছেন; আকাশবাড়িতে থাকা বাবার সাথে কথা বলার আর কোন উপায় আমার জানা নেই। কখনো কখনো স্বর্গ থেকে ছুটি নিয়ে বাবা আমার স্বপ্নে আসেন; আঙ্গুলগুলো আমার কপাল ছোঁয়।

ছোট্ট বেলায় যেমন মার্বেল সাজিয়ে খেলতাম ঠিক তেমনি শব্দদের নিয়ে খেলতে খেলতে অপেক্ষা করি বাবা ডাকবেন “বুড়ি!! আয় কবিতা পড়ি...” সম্ভব অসম্ভবের মাঝামাঝি কোথাও একটা ঝাপসা জগত আছে; প্রতিটা লেখার সময়েই অপেক্ষা করি কোন একদিন ঠিক ঠিক তার ডাক শোনা যাবে।

© শিখা রহমান

বিঃদ্রঃ উপরে কথিত সকল মতবাদ লেখকের নিজস্ব এবং নিজের লেখার বিষয়ে প্রযোজ্য।

যারা হৃদয়বান পাঠক তাদেরকে বলতে চাই “কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে,/ তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়।/ এমন সে কোন শব্দ নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে_/ তুমি কি দেখেছো তাকে হৃদয়েশ্বরের আয়নায়?”। তাদেরকে ধন্যবাদ হৃদয়েশ্বরের আয়নায় আমার গল্পদের পড়ার জন্য।

“দেয়ালের গায়ে আমি শ্যাওলা হয়ে থাকি বহুকাল/ আমাকে পিছল ভেবে সতর্ক থেকেছে পাঠকেরা”...সেইসব পাঠকদেরও ধন্যবাদ আমার সাধ্যের আর আয়েশের সীমানার বাইরে আমাকে ঠেলে পাঠানোর জন্য।

আর যারা ধন্যবাদ আর ভালোবাসার বাইরে কঠিন চোখে ভাবছেন যে আমি আমার আবোল তাবোল লেখা গ্রহনযোগ্য করার জন্য এইসব তত্ত্ব ফেঁদেছি তাদের বলছি “ছোট মাপের লেখক হওয়ার এইতো সুবিধা!! নিজের আনন্দের জন্যেই লেখালেখি করা যায়।”
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৩
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×