somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আদমশুমারী এবং সাম্প্রদায়িক বিতর্ক

০৯ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সদ্য সমাপ্ত আদমশুমারীতে দেখা গেছে দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার বেড়েছে, বিপরীতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী হার কমেছে। এর কারণ হিসেবে অনেকেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে দায়ী করতে চাচ্ছে। তারা কি বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেখছে না? যেখানে বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে একটা মুসলিম দেশে মুসলিম জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু?

এটা ঠিক যে দেশে মাঝেমধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ সমস্যা কেবল বাংলাদেশে নয়, উপমহাদেশের সবগুলো দেশেই আছে। তবে এটা অবশ্যই নিন্দনীয়। আমি মনেকরি দেশে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা গণনাযোগ্য। কারণ এমন কোন ঘটনা নাই যেটা মিডিয়ায় আসেনি। মোটামুটি প্রতিটা ঘটনাই মিডিয়ায় বেশ ভালো ভাবে ফোকাস পেয়েছে।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় দেশ ত্যাগের কারণেই যদি অন্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর হার কমে থাকে, তবে এতদিনে অনেক মিডিয়াই খুঁজে খুঁজে নাম ঠিকানা এবং দেশ ত্যাগের কারণ প্রমাণ সহ লিস্ট করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতো। কিন্তু এমন কিছু কি আছে?

পৃথিবীর সবচেয়ে কট্টর সাম্প্রদায়িক দেশ হচ্ছে অবৈধ ইসরায়েল, যেটি একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র। ১৯৪৯ সালে সে দেশে ইহুদি ছিল ৮৬.৪%, মুসলিম ৯.৫%, এবং খৃষ্টান ২.৯%। ২০২১ সালে সে দেশে ইহুদি ৭৩.৯%, মুসলিম ১৮%, এবং খৃষ্টান ১.৯% এ এসে দাড়িয়েছে। তথ্যসূত্র

দেখা যাচ্ছে সৃষ্টির পর হতে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের মতো দেশে শুধু ইহুদিই নয় খৃষ্টান জনগোষ্ঠীর হারও কমেছে। বিপরীতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার দ্বিগুণ হয়েছে। এখন এটার মানে কি ইসরায়েলে ইহুদি-খৃষ্টানদের নির্যাতন করা হয়েছে?

'World population growth statistics' লিখে সার্চ করলে দেখা যায়, উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ১৯০০ সালে বিশ্বে খৃষ্টান ৩৪.৪৭%, সনাতন ১২.৫৩%, মুসলিম ১২.৩৭%। ২০২০ সালে এসে খৃষ্টান ৩১.১১%, মুসলিম ২৪.৯০%, সনাতন ১৫.১৬%।

উক্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গত ১০০ বছরে বিশ্বে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার দ্বিগুণ হয়েছে। এখানে কী বলেবেন? মুসলিমরা বিশ্বের সবাইকে নির্যাতন করেছে?

অথচ গত ১০০ বছরে মুসলিমরাই বেশি নির্যাতিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের অগ্রগতি থামাতে নামমাত্র টিকে থাকা ওসমানী খিলাফত ধ্বংস করা হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙে চূর্ণ করে তাদের ভূমি ফ্রান্স এবং ব্রিটেন ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। আফ্রিকার বৃহত্তর রাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্র সুদান হতে দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করে জাতিসংঘের তত্বাবধানে স্বাধীন করা হয়েছে (যদিও মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরকে আজও জাতিসংঘের তত্বাবধানে স্বাধীন করা হয়নি)। জাতিসংঘের দ্বারা অযৌক্তিক ভাবে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে মুসলিমদের ভূমি ইহুদিদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমারা মনগড়া বক্তব্য ছড়িয়ে সন্ত্রাস দমনের নামে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধন করেছে। বসনিয়া, চেচনিয়া উইঘুর, রোহিঙ্গা, সবখানেই মুসলমানদের নির্যাতন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিপরীতে মুসলিমরা যখনই এই নির্যাতনের পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে, তখনই টেরোরিস্ট ট্যাগ লাগিয়ে রাজনৈতিক ভাবে তাদের চেপে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের কোনঠাসাও করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'Pew Research Centre' ২০১৫ সালে "The Future of World Religions: Population Growth Projections, 2010-2050" নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে দেখানো হয় ২০৫০ সাল পর্যন্ত ইহুদী এবং খৃষ্টান জনগোষ্ঠীর হার স্থির থাকবে, এবং সনাতন, বৌদ্ধ সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর হার কমে যাবে। শুধুমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর হারই ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পাবে। তথ্যসূত্র



একই রিপোর্টে ২০৫০ এর পর কি হবে সে-সম্পর্কে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা যদি অব্যহত থাকে তবে ২০৭০ সালে বিশ্বে মুসলিম এবং খৃষ্টান জনগোষ্ঠী সমান সমান হবে। এবং ২১০০ সালে ৩৪.৯% জনগোষ্ঠী নিয়ে মুসলমানরা হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী। দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে খৃষ্টান জনগোষ্ঠী হবে শতকরা ৩৩.৩৪%।



এবার ভারতের অবস্থা দেখা যাক। Pew Research Centre ২০২১ সালে "Religious Composition of India" নামে আরো একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে ১৯৫১ হতে ২০১১ পর্যন্ত ভারতে ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার হার উল্লেখ করা হয়। উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৫১ হতে ২০১১ পর্যন্ত স্বয়ং ভারতে সনাতন ধর্মাবলম্বী ৮৪.১% হতে কমে হয়েছে ৭৯.৮% । বিপরীতে মুসলিম জনগোষ্ঠী ৯.৮% হতে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.২% হয়েছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থা হলো, খৃষ্টান ২.৩% ছিল, এখনো ২.৩% আছে। শিখ ১.৯% হতে নেমে হয়েছে ১.৭%। বৌদ্ধ ০.৭% ছিল, এখনো ০.৭% আছে। জৈন ০.৫% হতে নেমে ০.৪% হয়েছে। অন্যান্য ০.৪% হতে ০.৯% হয়েছে। তথ্যসূত্র



২০২১ সালে 'The Times of India' একটি রিপোর্ট করে যার শিরোনাম ছিল 'Rate of Muslim population rise fell more than Hindus’ in 20 years'। উক্ত রিপোর্টেও দেখানো হয় ১৯৯১ হতে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে মুসলিমরা সবচেয়ে এগিয়ে। তথ্যসূত্র



আমার দেখা তিনটা ঘটনা শেয়ার করি।

১. কিছুদিন আগে কলেজ লাইফের সনাতন ধর্মাবলম্বী এক সহপাঠীর সাথে কথা হচ্ছিল, ওর কথা শুনে আমি অবাক! জিজ্ঞেস করলাম কিরে এভাবে কলিকাতায় মানুষদের মতো কথা বলছিস কেন? ও বললো আমি তো ভারতে বিয়ে করে সেটেল্ড হয়েছি এবং এখন ভারতের নাগরিক।

২. খুলনা থাকতে আমি যে সেলুনে চুলদাড়ি কাটাতাম, এবার গিয়ে দেখি সেটা নেই। কয়েক দোকান পরে আরেকটা সেলুনে চুল কাটাতে কাটাতেই জিজ্ঞেস করলাম, রতনদের দেখছি না যে, কোথায় গেল ওরা? উত্তরে জানতে পারলাম তারা সবাই নাকি ইন্ডিয়া চলে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম কেন? বললো, বিভিন্ন জায়গা হতে সুদে টাকা নিয়ে সেগুলো ফেরৎ দিতে না পেরে দেশ ত্যাগ করেছে।

৩. বেশ আগে অফিসের কাজে সিলেটের গোয়াইনঘাট গিয়েছিলাম (জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল জলাবন, পান্থমই ঝর্ণা, লালাখাল, সবগুলোই গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত)।
সেখানে কথা বলতে বলতেই সনাতন ধর্মাবলম্বী একজন বলছিল, তিনি ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানালো, ভারতীয় পাসপোর্ট দিয়ে বিভিন্ন দেশে সহজে এবং বেশ ভালো বেতনে যাওয়া যায়।

না, উপরোক্ত তিনটি ঘটনাকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধি এবং অন্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর হার হ্রাসের কারণ হিসেবে উদাহরণ দিতে চাই না। এর আসল কারণ হচ্ছে ফার্টিলিটি রেট।

Pew Research Centre কর্তৃক "Why Muslims are the world’s fastest-growing religious group" শিরোনামে আরেকটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। যেখানে ২০১৫ হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত নারীদের ফার্টিলিটি রেট উল্লেখ করা হয়। সেখানে দেখানো হয় বিশ্বে মুসলিম নারীদের ফার্টিলিটি রেট সবচেয়ে বেশি। নন-মুসলিম নারীরা যেখানে গড়ে ২.২ জন সন্তান নেয়, মুসলিম নারীরা সেখানে গড় ২.৯ জন সন্তান নেয়। তথ্যসূত্র



এছাড়া Pew Research Centre এর "Religious Composition of India" শিরোনামে প্রকাশিত ঐ একই রিপোর্টে "National Family Health Survey, India" এর সূত্র ধরে বলা হয়, ভারতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নারীদের ফার্টিলিটি হার কমছে, তবে অন্যদের তুলনায় মুসলিম নারীদের ফার্টিলিটির হার বেশি। মূলত এ কারণেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্যসূত্র



গানিতিক নিয়ম হচ্ছে একাধিক চলক বিশিষ্ট কোন রাশির মান যখন স্থির, তখন যেকোন একটি চলকের মান বৃদ্ধি পেলে অন্য চলকের মান কমে যাবে। সুতরাং গানিতিক নিয়মে শতকরা হিসেবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধি পেলে অন্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর হার কমে যাবে, অতি সিম্পল বিষয়ে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, কোন জনগোষ্ঠীর হার কমে যাওয়া মানে সংখ্যা কমে যাওয়া নয়।

পরিশেষে শুধু একটা কথাই বলতে চাই সামপ্রদায়িক সহিংসতা ধ্বংস হোক। মানুষের বোধহয় হোক, গড়ে উঠুক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অটুট বন্ধন।


সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:৪১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×