বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনার অলঙ্কার, সোনার বার পরিবর্তিত হয়েছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে৷ এ নিয়ে ফেসবুকের নিউজ ফিড সরগরম হয়ে উঠেছে৷
সরকারের দামি বস্তু হেফাজতে রাখার দুইটি স্থান অাছে৷ একটা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ট্রেজারি৷ অন্যটি ব্যাংকের ভল্ট৷ অামি ট্রেজারি অফিসার ছিলাম৷ এর নিরাপত্তার বিষয়টা জানি৷ ট্রেজারির সামনে সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারায় থাকে৷ একটি রেজিস্টার রাখা হয়৷ সেখানে পুলিশের ডিউটি থেকে শুরু করে সব কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয়৷ ঢুকতে গেলেও সেখানে নাম পদবি লিখতে হয়৷ বের হওয়ার পরেও৷ ডাবল লক৷ দুইটা গেট থাকে৷ একটা তালা খুলতে গেলে দুইটা চাবি দরকার হয়৷ এর একটা চাবি থাকে ট্রেজারি অফিসারের কাছে৷ অন্যটি শাখার কর্মকর্তার কাছে৷ এই ট্রেজারির শুধু চাবি হারিয়েই চাকরি খুইয়েছেন অনেকে৷ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ট্রেজারি এতই সুরক্ষিত থাকে যে মালামাল মিসিং হওয়ার চিন্তাও করা যায়না৷ তারপরেও বছরের শেষে সব খুলে অারেকবার ভেরিফিকেশন হয়৷ পাই পাই করে মেলানো হয়৷ ভারতেরও একই পদ্ধতি৷ এই ট্রেজারির প্রতি মানুষের এত বিশ্বাস যে, কয়েক পর্বে চলা নির্বাচনের ব্যালট ভর্তি ভোট বাক্স এতে ঢুকিয়ে রাখা হয়৷ পরে সুবিধামতো সময়ে গুণে দেখা হয়৷ ফলাফল ঘোষণা করা হয়৷ ভারতের কোন নাগরিককে ট্রেজারিতে বসে ভোট ম্যানিপুলেশনের কোন অভিযোগ করতে দেখিনি৷
যাই হোক ট্রেজারির উদাহরণ এজন্য দিলাম যেখানেই মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ রাখা হয়, সেখানে সিকিউরিটি থাকতে হয় সর্বোচ্চ৷ যতটুকু জানি, বাংলাদেশ ব্যাংকেও সিকিউরিটি অাছে৷ কিন্তু এতবড় জালিয়াতি৷ খুশী হতাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এটা ধরা পড়লে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকে কি বছর শেষে অামানত রাখা মূল্যবান বস্তুর ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা নেই! কি করে সোনা অন্য ধাতু হয়ে যেতে পারে৷ ক্যারেট কমে যেতে পারে৷ অবিশ্বাস্য! এ পর্যন্ত বিমানবন্দরে অাটক মন কে মন সোনার কপালে কি ঘটেছে সেজন্য বড়সড় তদন্ত দরকার৷ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে উদ্বিগ্ন হতেই পারি৷
অামার সবচেয়ে বড় অাশংকা নবাবদের অলঙ্কার নিয়ে৷ কোথায় অাছে দরিয়া ই নূর৷ মূল্যবান এ হীরার অলঙ্কারটি নাকি রাজধানীর সদরঘাটের সোনালি ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত অাছে৷ কিন্তু কেউ কোনদিন খুলে দেখেনি৷ এর অাগে ২০১৬ সালে ‘দরিয়া-ই নূর’ কোথায় খতিয়ে দেখার তাগিদ দেয়া হয়েছিল৷ ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়েছিল। ক্যাবিনেট সচিব স্যারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা পরিদর্শনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী অগ্রগতি সম্পর্কে পত্রিকায় অার কোন সংবাদ প্রকাশিত হয়নি৷
জানা যায়, একজন অাইসিএস অফিসার একটি প্যাকেটে করে সোনালী ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় এটি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই প্যাকেটের মধ্যে কী আছে তা অাজও অজানা৷ ফলে অনেকের মতো অামার কাছেও ঢাকার নবাবি আমলের মহামূল্যবান হীরার অলঙ্কার ‘দরিয়া-ই নূর’ ঘিরে সৃষ্ট রহস্যের উম্মোচন হয়নি। আসল হীরার অলঙ্কারটি সোনালী ব্যাংক সদরঘাট শাখার ভল্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে বলে দাবি উঠেছিল নানা মহল থেকে।
২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে অালোচনা করা হয় বলে সংবাদপত্রে পড়েছি৷ বৈঠকে জানানো হয়েছিল, দরিয়া-ই-নূর আলোর নদী বা আলোর সাগর বিশ্বের অন্যতম বড় হীরকখণ্ড, যার ওজন প্রায় ১৮২ ক্যারেট। এটির রঙ গোলাপি আভাযুক্ত, এ বৈশিষ্ট্য হীরার মধ্যে খুবই দুর্লভ। বিশ্বে বড় আকৃতির দুটি হীরকখণ্ড সবচেয়ে মূল্যবান ও ঐতিহাসিক। এর একটি কোহিনূর, অন্যটি দরিয়া-ই-নূর। কোহিনূর আছে ব্রিটেনের রানির কাছে এবং দরিয়া-ই-নূর ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের ভল্টে৷
সপ্তদশ শতাব্দীতে দরিয়া-ই-নূর অন্ধ্রপ্রদেশের গোলকুন্ডা দুর্গ এলাকায় পাওয়া যায়৷ ওই দুর্গটি দেখার সৌভাগ্য অামার হয়েছে৷ হায়দরাবাদের একজন নিজাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় কিনে নেন৷ তখন এদেশে টাকায় অাটমন চাল পাওয়া যেতো৷ বিভিন্ন হাত ঘুরে অবশেষে এটি পাঞ্জাবের শিখ মহারাজ রণজিৎ সিংহের হাতে পৌঁছে। তার বংশধর শের সিংহ ও নেল সিংহের হাতে এটি ছিল। ১৮৫০ সালে পাঞ্জাব দখলের পর ইংরেজরা কোহিনূরের সঙ্গে দরিয়া-ই-নূরও দখল করে। ১৮৫০ সালে প্রদর্শনীর জন্য কোহিনূর ও দরিয়া-ই-নূর ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। হীরকখণ্ড দুটি রাণী ভিক্টোরিয়াকে উপহার হিসেবে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরে রাণী কোহিনূর নিজের কাছে রাখলেও দরিয়া-ই-নূর বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন এটি বিক্রির জন্য ভারতে ফেরত আনা হয়। ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার ১৮৫২ সালে দরিয়া-ই-নূর নিলামে তুললে ঢাকার জমিদার খাজা আলিমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় কিনে ঢাকায় নিয়ে অাসেন।
দরিয়া-ই-নূর ঢাকার নবাবরা সাধারণত আনুষ্ঠানিক পোশাকের সাথে বাজুবন্দ হিসেবে ব্যবহার করতেন। একপর্যায়ে নবাব সলিমুল্লাহ এর মালিক হন। এক সময় আর্থিক সংকটে পড়েন নবাব সলিমুল্লাহ। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ৪১৪২ নং দলিলমূলে ৩ শতাংশ সুদে ৩০ বছরের মধ্যে পরিশোধের শর্তে ১৪ লাখ রুপি ঋণ নিয়েছিলেন। বিপরীতে অনেক অলঙ্কার জামানত রাখেন৷ ঋণ পরিশোধের জন্য অলঙ্কারটি বিক্রির উদ্যোগ নেন। কলকাতার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানির কাছে বিক্রির জন্য প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আশানরূপ দাম পাওয়া যায়নি। কোম্পানির হেফাজতে ছিল এটি। আর প্রতি বছর ফি বাবদ ২৫০ টাকা দিতে হতো নবাবদের। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিভাগীয় কমিশনার এবং রাজস্ব বোর্ডের অনুমতিক্রমে নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নসুরুল্লাহর সঙ্গে এস্টেটের ডেপুটি ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন কলকাতার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে ১৯৪৯ সালে দরিয়া-ই-নূর ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ঢাকা শাখায় রাখা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর ঢাকা ইম্পেরিয়াল ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। তখন দরিয়া-ই-নূর রাখা বাক্সটি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সদরঘাট শাখায় গচ্ছিত রাখা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাংকটির নতুন নামকরণ হয় সোনালী ব্যাংক। এই হীরার অলঙ্কারসহ ঢাকার নবাবদের অন্যান্য অলঙ্কার ও মূল্যবান সামগ্রী সোনালী ব্যাংকেই রক্ষিত আছে।
এই অলঙ্কারটির বর্তমান বাজার মূল্য কয়েকশ কোটি টাকা৷ অামি দেশের নাগরিক হিসেবে এই অলঙ্কারের রহস্য উম্মোচনের অনুরোধ করবো৷ অলঙ্কারটি সোনালী ব্যাংকের সদরঘাট থেকে উদ্ধার করে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ট্রেজারিতে রাখার জন্যও অনুরোধ করবো৷ অন্তত দরিয়াই নূরের ক্ষেত্রে সবার অাশংকা যাতে সত্যি না হয়৷
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১১:১৬