আমি তখন গলাচিপা উপজেলায় এসিল্যান্ড। আমার এডিসি রেভিনিউ জনাব দেলোয়ার হোসেন মাতুব্বর স্যার আসলেন অফিস পরিদর্শনে। পরিশর্দন শেষে তিনি বললেন, আশপাশে কোন আবাসন থাকলে দেখে যাবো। আমি তখন নূতন যোগদান করেছি মাত্র। কানুনগো বললেন, খেয়াঘাটের পাশেই একটা আবাসন আছে। সেটা পরিদর্শন করা যায়। স্যার গিয়ে দেখলেন, বরাদ্দ গ্রহীতা বহু আগেই তার নামের ঘর বিক্রি করেছেন। প্রথমবার কিনেছেন গোয়ালখালীর একজন ইউপি মেম্বার। তার নামটা মনে নাই। তিনি আবার বিক্রি করে দেন। সর্বশেষ কিনেছেন হোটেল মালিক নজরুল। নজরুল আবার সেই ঘরের সামনে আরেকটা ঘর তুলে মাছের আড়ত তৈরি করেছেন। এডিসি স্যার আমাকে একদিনের মধ্যে আবাসনের মধ্যে মাছের আড়ত ভেঙ্গে দিয়ে রিপোর্ট দিতে বললেন।
আমি পরদিন নিজের টাকা খরচ করে লোকজন নিয়ে ঘরটা ভেঙ্গে দিলাম। পরবর্তীতে কী হয়েছিলো কাহিনীগুলো শুনুন।
১। সাংবাদিক: কয়েকদিন পর পটুয়াখালীর যুগান্তরের প্রতিবেদক নিউজ করলেন, গলাচিপায় আবাসনের ঘর ভাঙ্গলেন এসিল্যান্ড। রিপোর্টে আমার বক্তব্যও দেয়া আছে। আকাশ থেকে পড়লাম। আমার সাথে কথা বললো কখন? সম্ভবত স্বপ্নে। আমি ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কীভাবে লিখলেন, আবাসনের ঘর ভাঙ্গছি। সরকারি ঘর আমি ভাঙ্গতে যাবো কেন? তিনি বললেন, আসলে গরীব মানুষ এসে হাতে পায়ে ধরেছে, সেজন্য নিউজটা করেছি। আমি বললাম, সে তো গলাচিপা ছেড়েছে দশ বছরের বেশি সময় আগে। সেটা না হয় মানা গেল, আমার সাথে কথা বললেন কখন! আর কোন জবাব পাইনি। এরপর বহু সাংবাদিক এসেছিলেন, ওই উপলক্ষে। কথাবার্তা বলার শেষে বেশিরভাগ খাস জমি চাইলেন।
২। অ্যাডভোকেট: তিনি পটুয়াখালীর। তিনি খবর পাঠালেন, আপনার নামে মামলা হবে। আমার অফিসে যে লোকটা এ বিষয়ে কথা বলতে ঢুকেছিল, ধরতে গেছিলাম, জোরেসোরে দৌড় দিয়ে পালালেন। তবে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটের কাছে আমার জানার ইচ্ছা, অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মচারির বিরুদ্ধে বাই নেমে মামলা কীভেবে করলেন৷ মজার বিষয় হলো- উচ্ছেদের পর তার একটা উকিল নোটিশ পেয়েছিলাম সেখানে তার মক্কেল ঘরের মালিকানা কীভাবে পেয়েছেন সেটা উল্লেখ করেছেন৷ তিনিই আবার মামলা করেছেন মুল বরাদ্দ গ্রহীতার নামে৷ সেখানে হস্তান্তরের বিষয়টা বেমালুম চেপে গেছেন৷ তবে তিনি সফল৷ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করে তা দুদকে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন৷
৩। বিজ্ঞ বিচারক: আমার নামে মামলা নিলেন, সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা নিলেন, ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনমুতি ছাড়াই। মামলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন আইনে। অভিযোগে বলা হয়, সরকারি জমিতে ঘর তুলেছি বলে এসিল্যান্ড তার অফিসের কয়েকজনের মারফত পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছেন। সেটা না দেয়ায় তিনি ঘর ভেঙ্গে দিয়ে দুর্নীতি করেছেন। ঘুষ নেয় নি। চেয়েছে মাত্র। এমন একটি সিলি অভিযোগ। বিজ্ঞ বিচারক, দুর্নীতি দমন কমিশনের পুটয়াখালীর অফিসকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে দিয়ে দিলেন। কোন ব্যক্তিও এদেশে দুর্নীতির মামলা করতে পারে। হাহাহা। আর বিচারক সেটা তদন্তে দেন৷ কোন ব্যক্তি দুর্নীতির মামলা কী করতে পারেন? করতে পারলে কোন আইনে- জানার খুব ইচ্ছা ছিল।
৪। রাজনীতিবিদ: কয়েকজন অফিসে আসলেন। বললেন, নজরুলের একজন আত্মীয় দুর্নীতি দমন কমিশনে চাকরি করেন। আপনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সে যেভাবেই হোক আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়াবে। এর আগেও উপজেলা পরিষদের ভেতরে সে একটা ঘর তুলেছিলো। সেটা আরেকজন ইউএনও ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। এজন্য তার নামে মামলা করেছিল নজরুল। পরে তাকে আবাসনের পাশে খাসজমি দেয়ার পর সে মামলা তুলে নিয়েছিল। আপনিও তাকে ওই জমিটা ভোগ দখল করতে দেন। সে মামলা তুলে নেবে।
৫। দুর্নীতি দমন কমিশন: আমার সাবেক কলিগ নিউ এইজের সাংবাদিক আহমদ ফয়েজ একদিন ফোন করে জানালেন, আপনার নামে যে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটা দুদকের একটা সভায় খারিজ করে নথিজাত করা হয়েছে। আমার কাছে ওই সভার রেজুলেশন আছে। লাগলে বলবেন কপি দেবা। আমি ভাবলাম যাক বাঁচা গেল। কিছুদিন পরে শুনি খারিজ করা অভিযোগের তদন্ত করতে চিঠি এসেছে পটুয়াখালীতে। বাতিল বিষয়ের তদন্ত কীভাবে হয় আল্লাহ মালুম। আর মালুম দুদকে চাকরি করা নজরুলের সেই আত্মীয়।
৬। মসজিদের ইমাম: আমার বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করবে। সেজন্য সাংবাদিকরা আবার তৎপর। একজন এবার ক্যামেরা নিয়ে গেলেন আবাসনে। আবাসনে একটা মসজিদ আছে। সেই মসজিদের ইমামকে আবাসনের লোকজনের পছন্দ নয়। তাকে রাখতে চায়না। আমি সদর তহশিলদারকে মসজিদের সভাপতি বানিয়ে বলে দিলাম, গুরুতর অভিযোগ না থাকলে গরীব ইমামকে যেন বের করে না দেয়া হয়। সেই ইমাম ক্যামেরা দেখে সাক্ষ্য দিলেন, এসি ল্যান্ড ঘুষ খেয়েছে।
৭। আবাসনের সভাপতি: আবাসনের সভাপতি আবুল কালামের নামে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। প্রতিদিন আমার অফিসের সামনে এসে বসে থাকেন। আমাকে বলেন আপনি তো ডাকবাংলোতে থাকেন। আপনার পাশেই ম্যাজিস্ট্রেট থাকে। দয়া করে তাকে একটু বলে দেন। আমরা আবাসনে যারা থাকি আপনি তাদের ঘর দিয়েছেন। আমরা আপনার খাস লোক। পাশের একজন আবাসনের জমি দখল করতে আসছে, আমি তাকে বাঁধা দিয়েছি। এজন্য সে মামলা করেছে। আমি বললাম, দেখবো। পরে ম্যাজিস্ট্রেটকে আসল ঘটনা বলি। তিনি মেয়রকে বিষয়টি তদন্ত করার দায়িত্ব দেন। মেয়রকে বলে দেই, আবাসনের এরা সরকারের আশ্রিত লোক। এদের দেখবেন। উনি সেভাবে রিপোর্ট দিয়েছেন। মামলা খারিজ। একদিন আবাসনের সভাপতি বলেন, নজরুল এক হাজার টাকা দিয়েছে। বলছে, আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। আমি বলি আপনার যা খুশী করেন। তিনি বলেন, জীবন গেলেও আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবোনা। পরে পটুয়াখালীর দুদক কার্যালয়ে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ঘটনা সত্য। এসি ল্যান্ড ঘুষ চেয়েছে।
৮। দুদক পটুয়াখালী জেলা কর্মকর্তা: আমি যতদিন ছিলাম, ততদিন দুদক পুটয়াখালীর কর্মকতা তদন্তের জন্য আমাকে ডাকেন নি। ঘটনাস্থলেও যাননি। ফাইল চাপা দিয়ে রেখেছেন। আমি বদলি হয়ে আসতেই তার ফাইল সচল হয়। ডাক পড়ে, আমার কানুনগোর। তিনি গিয়ে বলে আসেন, আপনি যার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছেন, তিনি ঘুষ তো চাইবেন দূরের কথা, তার সময়ে অফিসের কেউ ঘুষ নিতে পারেনি। চ্যালেঞ্জ দিলাম। কর্মকর্তা তাকে বলেন, তার বিরুদ্ধে তো আবাসনের সভাপতিও বলে গেলেন। কানুনগো তাকে বলেন, আগে ঘটনাস্থলে যান। তারপর দেখে আসেন। উনি গলাচিপা এসে দেখলেন, আসলে ব্যাপারটা ভিন্ন। যাওয়ার আগে সবার সামনে বলে গেলেন, এরকম এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে মামলা হবে এটা মানা যায়না। তিনি কানুনগোকে অফিসে ডাকলেন। কানুনগো অফিসে গেলেন। দুদকের কর্মকর্তা বললেন, মানলাম মিথ্যা মামলা। আমি মিথ্যা রিপোর্টই দেবো। তবে অফিসের খরচ চালাতে হয়। এসি ল্যান্ড না হয় না খেয়েছেন আপনারা তো গলাচিপায় ভালো টাকা কামাচ্ছেন। পরের তারিখে কানুনগো ওমর আলী দশ হাজার টাকা নিয়ে গেলেন। দুদকের কর্মকর্তা বলেন, সামনে ঈদ। এ কয়টা সামান্য টাকা দিয়ে কী হবে। তাছাড়া সার্ভেয়ারের নামও অভিযোগে আছে। উনি টাকা নিয়ে ফেরত আসলেন। আমি তখন ফরিদপুর ডিসি অফিসে। কানুনগোকে বললাম, প্লিজ একটু রেকর্ড করে আমাকে দেন। তিনি বললেন, স্যার, ঝামেলা যেভাবেই হোক মেটাতে হবে। এটা রেখে লাভ নেই।
পরে তিনি আবার গিয়ে বিশ হাজার টাকা দিয়ে দফারফা করেছেন। আমি আর খবর নেই নাই। মামলার কী হয়েছে জানিনা। হাসি পায়, আবার কষ্টও লাগে।
পুনশ্চ: আমি মনে করতাম আমার বিপদ হলে সাদা কাপড়েও রঙ উঠে। আমি অনেক পজেটিভ মানুষ। কোন কিছু কেয়ার করিনা। তারপরেও কথা থেকে যায়। এমন একটা মিথ্যা বিষয়ে এতগুলো শ্রেণি পেশার মানুষ কীভাবে এক হলো! ভাবতেও পারিনা। কতটা নিচে, কতটা অধপতনে গেলে একটা সমাজের এমন হতে পারে! এ নিয়ে আসলে গবেষণা দরকার। এটা বাংলাদেশেই সম্ভব। পৃথিবীর তাবৎ বিস্ময় এখানে। তবে আশার কথা হলো- কিছুদিন পরে পত্রিকায় সংবাদে নজর আটকে যায়। খবরের শিরোণাম ছিল- পটুয়াখালীর দুদকের কর্মকর্তা বরখাস্ত।
দক্ষিণ কোরিয়া
৪/১০/২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ১১:৩১