somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ এত অসহিষ্ণু হলো কেন

১২ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক কথাই লিখতে মন চায়। আমার কোন লেখাই বিতর্কের জন্য না। কেউ মানলে মানতে পারেন। না মানলেও আপনার। আপনার কথা লিখে রেখে যেতে পারেন। এখন মানুষ খুব অসহিষ্ণু হয়ে গেছে। নয়তো বয়াতী তার নামেও কী মামলা করে দিতে হয়! উনি না কী ইসলাম বিকৃত করেছেন। পরে আমি শুনেছি তার ভিডিও। তার বক্তব্য বাস্তবতার সাথে মিল নেই। এখন এর সমাধান মামলা হলে কী হবে-সেটাই আমি এ লেখায় উল্লেখ করবো। ধৈর্য থাকলে আমার পুরা লেখাটা পড়ে যাবেন।

বাংলা সাহিত্যে বিষাদ সিন্ধু অনেক পুরাতন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এটি ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয়। মানুষ তখন এই উপন্যাস পড়ে কাঁদতো। আমি নিজে পুঁথি পড়তে দেখেছি। পুঁথি পড়ে লোকজনকে কাঁদতে দেখেছি। ফকির গরীবুল্লাহ এবং সৈয়দ হামজা যার পুঁথির কথাই বলেন না কেন এসব পুঁথির মূল বিষয়বস্তু ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন কাহিনী। পুরাটাই মুল ঘটনার বিকৃতি ও কাল্পনিক। বাংলাপিডিয়ায় বিষাদ সিন্ধু সম্পর্কে কী বলা হয়েছে দেখেন, বিষাদ সিন্ধু "ঘটনা বর্ণনায় ও চরিত্র সৃষ্টিতে কাল্পনিক। এই গ্রন্থে কিছু উপকাহিনী আছে, যেগুলো যথার্থ ঐতিহাসিক নয়। গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখক মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন- ‘পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া বিষাদ-সিন্ধু বিরচিত হইল।’ লক্ষণীয় বিষয়, মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ-সিন্ধু গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাসমূহ কোন কোন আরবি এবং ফারসি গ্রন্থ হতে সংগ্রহ করেছেন তার নাম উল্লেখ করেননি।" এবার দেখেন, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার সাথে মুসলমানদের আবেগ মিশ্রিত রয়েছে, সে ঘটনাকে বিকৃত করা হয়েছে। এখন কী করা যায়! এই উপন্যাসের লেখক মীর মশাররফ হোসেনের নামে কী মামলা করে দেবেন? আরো একশত বছর আগে মওদুদীও আসেন নি। ওহাবীবাদও ছিলনা। তখনকার সবাই সুফি আলেম ছিলেন। তাদের কী ইসলামের জন্য দরদ ছিলনা! তারা কী মীর মোশাররফ হোসেনের নামে মামলা করে দিয়েছেন। মানুষ যেভাবে ক্রেজি হচ্ছে- বইটির লেখকের বংশধরদের নামে কে কবে মামলা করে দেয়- সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।

এবার আসি- জারি সারি ইত্যাদি নিয়ে। জারি সারির লেখক ও গায়করা কেউ লালন কেউ সুফিবাদে স্বশিক্ষিত ওস্তাদের কাছে সুরে সুরে শিক্ষা নিয়েছেন। কারোরই তেমন পুঁথিগত বিদ্যা নেই। ব্যতিক্রম বাদে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও তারা শিক্ষিত নন। তবে তারা মুখে মুখে ছড়া বাঁধতে পারেন। সুর বাঁধতে পারেন। তারা কাহিনী বললে, মানুষ চোখের পানি ছেড়ে দেয়। এমন প্রতিভা সবার হয়না। আপনার দৃষ্টিতে তারা কম শিক্ষিত হতে পারেন, তবে তাদের উপর পিএইচডি ডিগ্রি করছেন অনেকে। আপনি আমি মাস্টার্স পাস করে পিএইচডি করলেও তাদের মতো সারারাত মানুষ ধরে রাখার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই প্রতিভা আল্লাহ প্রদত্ত।

এখন কথা হলো- প্রতিভা আছে বলে- তারা যা ইচ্ছা ধর্ম নিয়ে তা বলে যাবেন? জারি সারি গান মানুষের ধর্মীয় জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করে? মোটেও না। দেশের ধর্মীয় জীবনে তাদের কোন প্রভাব নেই। তবে সংস্কৃতিতে আছে। বিনোদনে আছে। মানুষ বিনোদন নেয়ার জন্য এসব শুনে। কান্নাকাটি করে। আবার সকালে গিয়ে নামাজ পড়ে। ভুলে যায়। শুধু বলে অমুক বয়াতি কী যুক্তি দেয়। এরা শিল্পী হিসেবে নাম করে। এদেশে শত শত বছর ধরে এরা এমনি উদ্ভট কিছু প্রশ্ন আর গল্প বলে আসছে বাস্তবের সাথে তার মিল নেই। আধুনিককালে অনৈকেই ছোটকালে জারি সারি শুনেননি। হঠাৎ এর ভিডিও দেখে আসমান থেকে পড়েন। কী বলছে এসব! তারপর সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলার চিন্তা করেন। কিন্তু শতশত বছর ধরে এমন ভাবনাটা ছিলনা। থাকলে তো জারি সারি বলতে কিছু থাকতো কী না সন্দেহ।

আপনার ভালো লাগেনা, শুনবেন না। তাহলেই তো হয়। ওয়াজ শুনবেন। তবে সংক্ষুব্ধ হলে তো সেখানেও হবেন। কারণ এক হুজুর ওয়াজ করবেন, আল্লাহর নবী মাটির তৈরি আরেকজন বলবেন না তিনি নুরের তৈরি। কেউ বলবেন, মিলাদ যায়েজ নাই। কেই বলবেন, এটা পড়া দরকার। কেউ একদিন আগে সৌদির সাথে মিলিয়ে রোজা রাখেন। অন্যরা যখন রোজা রাখেন তখন তারা ঈদ করেন। কেউ বিড়ি খাওয়া হারাম মনে করেন, কেউ মুবাহ। কেউ মাজার জেয়ারত জায়েজ বলেন, কেউ মাজারে যেতে নিষেধ করেন। এবার দেখেন সংক্ষুব্ধ হলে তো এদেশের সব আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। একদল আরেক দলের হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা করবে। এটা কোন সমাধান নয়। এক হুুুজুর বলেছেন এককথা, তার কথা ভালো না লাগলে আপনি আপনার হুজুরের কথা শুনেন। ঝামেলা না করলেই তো হয়। আপনার বয়াতির কথা বিকৃত মনে হয়েছে, আপনি সঠিকটা প্রচার করেন। সমস্যা কী! এটাও না পারলে তাকে দাওয়াত দেন। দিয়ে কিতাব খুলে তাকে দেখিয়ে দেন। বলেন, আপনারা তো বহু জায়গায় জারি সারি গেয়ে এগুলো বলেন, আসল বিষয়টা এমন। এটার বদলে এটা বলতে পারেন। সমস্যার সমাধান হতো। মামলার প্রয়োজন হতোনা। নাপিতের ফোড়া অপারেশনের গল্প আমরা জানি। ওই বয়াতি গল্পের নাপিতের মতো হয়ে যেতো।

১৮৭৯ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিলো নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক যোহান ইবসেনের এ ডলস হাউজ নাটকটি। নাটকের মুল চরিত্র একজন নারী। নাম নোরা। নিজের আত্মপরিচয় তথা নারীর আত্মপরিচয় জানার তীব্র আকাঙ্খা থেকে নোরা স্বামী সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। সেটা মেনে নিতে পারেনি পুরুষ শাসিত সমাজ। নাটকের শেষাঙ্ক বদলানোর জন্য ইবসেনকে চাপ পর্যন্ত দেয়া হয়েছিলো। তিনি বদলাননি। পরে যুগ যুগ ধরে এই নাটক প্রশংসিত হয়ে আসছে। সামাজিক মূল্যবোধের বিভিন্ন উপাদানকে সমালোচকের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে নাটক তৈরি করা হয়। এখন ধরুন, এ নাটকটি বা এধরণের নাটক যদি আমাদের দেশে মঞ্চস্থ করা হয়, আর কোন কারণে যদি বহুল প্রচার হয়, সমাজের জন্য মায়াকান্নার লোকের অভাব থাকবেনা। গালাগালিতে নাট্যকার দেশে থাকতে পারবেন কী না কে জানে। এতে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিতে পারেন। বলবেন, আমাদের সংস্কৃতিতে নারী কখনো সংসার ছেড়ে যায়না। তারা সংসার আকড়ে ধরে রাখে। এটা অসামাজিক নাটক। তাহলে হবে কী! সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়ে যাবে। মননশীলতা হারিয়ে যাবে।

আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা বলার দরকার। তা হলো 'পারফর্মিং আর্ট' ফ্রম পোর্টফোলিও অফ ডগডনেস। এটি সম্পূর্ণ পশ্চিমা ধারণা। মঞ্চের বাইরে জনসমাগম স্থানে রাস্তায় এই নাটক করা হয়। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই পারফর্মিং আর্ট অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার প্রথম দেখা যায় । ভ্যালি এক্সপোর্ট ও পিটার উইবেল এই পারফর্মিং আর্টে অংশ নেন। একজন আরেকজনের গলায় রশি দিয়ে কুকুরের মতো টেনে নিয়ে যান। সে সময় যত শোরগোল হয়নি তার চেয়ে বেশি শোরগোল হয়েছে ঢাকায়। অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। তারা একটা নাটক মঞ্চস্থ করেছে। বাস্তবতাও এরকমের। এদেশে নারীরা যেমন নির্যাতিত, তেমনি নারী দ্বারা পুরুষের নির্যাতন কম নয়। লজ্জায় কেউ প্রকাশ করেনা। এরা স্বামীর গলায় আসলেই বেল্ট পড়িয়ে টেনে নিয়ে যায়। একটু উচ্চবিত্ত পরিবারে এটা বেশি দেখা যায়। সরকারি বড় কর্মকর্তাদের অনেকের ওয়াইফদেরকেও এমন দেখেছি। এজন্য আবদুল গণি হাজারী আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী শীর্ষক কবিতাও লিখেছেন। যাই হোক লোকজনের যে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখেছি, পরে পুলিশ তাদের ডাকতে বাধ্য হয়েছে। যেটা সমাজে রয়েছে, সেটা নাটকে দেখালে সমস্যা কোথায়। আমি বুতে পারিনা। ভিডিওতে দেখেছি, মানুষ তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু যখনি সোস্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ পেয়েছে, তখনি বড় আকার নিয়েছে। সোষ্যাল মিডিয়াটা এখন এমনই একটা অস্ত্র হয়ে গেছে।

যাই হোক- আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হলো- শতফুল ফুটতে দিন। সভ্যতার পেছনে যে বিষয়টির সবচেয়ে বড় অবদান সেটা হচ্ছে অন্যদের মতের প্রতি শ্রদ্ধা। আমরা এত অসহিষ্ণু হলে তো আমাদের মধ্যে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক আর গুণী মানুষের জন্ম হবেনা। এর আগেও একটা লেখায় বলেছি, ইউরোপের যে রেঁনেসা তার পেছনে ছিল মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান। অথচ তাদেরকে ধর্মের নামে নির্যাতন করে থামিয়ে দেয়া হয়। ফলাফল হয়, মুসলমানদের মধ্যে এ ধরণের মানুষের জন্ম বন্ধ হয়ে যায়। ইউরোপ আলোকিত হয়। আর মুসলমানরা অন্ধাকারে নিমজ্জিত হয়। আমরা এসব জানার পরেও কেন অন্ধকারের দিকে হাটছি, সেটা আমাকে অনেক ভাবায়।


কাজী সায়েমুজ্জামান
দক্ষিণ কোরিয়া
১২ জানুয়ারি ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:১৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×