১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট এর সকালটা স্বর্গছেড়ায় শুরু হয়েছিল বন্দে মাতরম ধ্বনি দিয়ে সমগ্র স্বর্গছেড়ার আকাশটা প্রকম্পিত করে। সেই বন্দে মাতরম ধ্বনি এক কিশোরের নবীন মনে প্রচণ্ড ছাপ ফেলে। সে অনুভব করে দেশের জন্য এক প্রচণ্ড টান,তাঁর হাত দিয়েই উত্তোলিত হয় স্বাধীন ভারতের পতাকা স্বর্গছেড়ার আকাশে। " ওই যে পতাকাটা উড়ছে ওটাকে আমার আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে হবে, আর ওটাকে উঁচুতে নিতে হলে আমাকে ওই পতাকার সমান উঁচু হতে হবে।" স্বদেশপ্রেম জন্ম নেয় এইভাবেই দেশের প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব আর কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়েই। দেশ সম্মানিত হয় তখনি যখন নিজের সম্মানপ্রাপ্তি ঘটে। সেই ১৫ই আগস্ট তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলির একটি।
অনিমেষের এর দাদু সরিৎশেখর চাচ্ছিলেন উনার ফেয়ারওয়েল হোক ১৫ই আগস্ট, ব্রিটিশরা ওইদিন সমগ্র ভারতকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিবে সেইসাথে তাঁর চা বাগানের ব্রিটিশ মালিকগুলো তাকেও অবসরের স্বাধীনতা দিবে। সরিৎশেখর উনার পুঞ্জিভূত করা সমস্ত সম্পদ দিয়ে জলপাইগুড়িতে বাসা বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যেদিন স্বর্গছেড়া ছাড়লেন সেদিন পেলেন প্রকৃত ফেয়ারওয়েল। সরিৎশেখর উনার নাতি অনিমেষ আর মেয়ে হেমলতাকে নিয়ে যখন বাসা থেকে বের হয়ে জিপে উঠবেন ঠিক সেই মুহূর্তে সমস্ত চা বাগানের শ্রমিকরা তাঁর সম্মানে একটি কাপড় তুলে ধরে যে যা পারে তাই দিতে লাগল। যখন জিপটি চলতে শুরু করল সেই মুহূর্তে তারাও জিপটির পিছু নিল। সমস্ত স্বর্গছেড়া যেন আজ ওই জিপটার পিছনেই। সরিৎশেখর ড্রাইভারকে জোরে চালাতে বলার পর তারাও এইবার জোরে দৌড়াতে শুরু করল। বাধ্য হয়ে জিপটিকে আস্তে চালাতে হল। সরিতৎশেখর জিপের সামনের ফাকা অংশের সামনে দাঁড়ায়ে বললেন-
"তোরা আমাকে ফেয়ারওয়েল দিতে চেয়েছিলি, এর চেয়ে ভাল ফেয়ারওয়েল কে কবে কোথায় পেয়েছে?" আর তিনি তাঁর জন্য যে টাকাটা উঠানো হয়েছে সেটা তাঁদের দিয়ে দিলেন।বিদায় হল রাজকীয় বিদায়। স্বর্গছেড়া থেকে চূড়ান্ত বিদায় নেয়ার জন্য এর চেয়ে ভাল বিদায় আর হয় না।
উপন্যাসটির নাম উত্তরাধিকার আর সেখানে যাকে ঘিরে আবর্তিত কাহিনী সে তাঁর দাদুর সাথে করে জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছে অথচ সে যে ভুমির উত্তরাধিকার তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্র মাইয়া থাকবেনা তাতো হয় না! সেই কিশোর স্বর্গছেড়ার মাটির গন্ধ না শুকে কিভাবে থাকবে? তাই সে তাঁর একটা ব্যাগে করে একমুষ্টি মাটি নিল। আর কেঁদে উঠল। "মাতরম" এর প্রতি এই যে একটা গভীর ভালোবাসা সবার অন্তরালে উদযাপিত হল অন্তরীক্ষের বিধাতা ছাড়া সেটা আরও একজন দেখলেন।
অনিমেষের দাদু জলপাইগুড়িতে এসে নতুন বাড়ির কাজ শুরু করলেন। নতুন বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর পাকাপাকিভাবে বসবাসের উপযোগী হওয়ার পর সরিৎশেখর একটা পুজার আয়োজন করলেন। সেই উপলক্ষে অনিমেষের মা মাধুরী, বাবা মহীতোষ সবাই এলেন। দীর্ঘদিন পর মাকে কাছে পেল মায়ের কাছে ঘুমাতে পারল, মায়ের বুকের একটা মিষ্টি গন্ধ আরও ভালকরে অনুভব করার জন্য মায়ের বুকে মুখ ঘষল আর মা ঘুমের আড়ষ্টতায় বলল-
" আহ! ঠেসসিস কেন?"
মাকে সে বলল এক মালি আর এক শ্রমিকের মাঝে অবৈধ প্রেমের কথা। যা দেখে তাঁর একটা মেয়ের বুকে কামড়ানোর ইচ্ছে জাগে আর মাকে জিজ্ঞেস করে" মা আমি তোমার বুকে কামড় দিলে তুমি ব্যথা পাবে?" মাধুরী পুরো ঘটনাটা জানতে পেরে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয় অনিমেষকে সব কথা সে মাকে এসে বলবে।সরিৎশেখর তাঁর উত্তরাধিকারের মধ্যে অনিমেষকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। তাই বাড়ির পূজার অনুষ্ঠানে পুরোহিত যখন বললেন আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে আসুন তখন সরিৎশেখর তাঁর নাতিকে নিয়ে এসে বললেন এই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
পুরোহিত ভবিষ্যৎ গণনা করে বললেন এই ছেলে ২০ বছর বয়সে জেলে যাবে। নারীর কারনে সে জিবনে উন্নতি লাভ করবে আবার এই নারীর কারনেই সে অধঃপতিত হবে।
ওই দিনটা ছিল অনিমেষের জন্য একটা কাল দিন। বিকেলে মাধুরী যখন বাসার ছাদে উঠে মহীতোষের সাথে অনিমেষের জেল আর নারী নিয়ে পুরহিতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঠাট্টা করছিল তখন মাধুরী হুট করে মাথা ঘুরে পরে গেল। অনিমেষ বুঝতে পারল না এখানে কি হল আসলে। অনিমেষ যখন শুধু মায়ের শয্যার পাশে আর সবাই ডাক্তার ডাকাডাকিতে ব্যস্ত। বিকাল থেকে শুরু হল প্রচণ্ড বৃষ্টি। অনিমেষ ছাড়া বাকি সবাই বুঝতে পারল মাধুরী অন্তঃসত্ত্বা । বৃষ্টি বারতেই লাগল সেই সাথে তিস্তার বাঁধ ভেঙে তিস্তা নদীর পানি এসে বাড়ির নিচে এসে জমা হল। মহীতোষ ডাক্তার নিয়ে আস্তে গেলেন। অনিমেষ যখন মায়ের সাথে একা তখন সে দেখল মায়ের শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে অনিমেষ বুঝতে পারছে না সে রক্ত কিভাবে বন্ধ করবে? একটা বালকের তো কখনও বুজা সম্ভবনা তাঁর মাের শরীর থেকে কেন রক্তপাত হচ্ছে। জন্ম যে নাড়ির টান ছিঁড়ে হয়? সেই নাড়ির টান ছিঁড়তে মায়ের যে অনেক কষ্ট হয়!
মাধুরী তখন বলল তুই যখন জেলে জাবি আমিও তোর সাথে জেলে যাব। আমি তোর সাথে থাকব। কিন্তু মাধুরী রাতের তারা হয়ে অনিমেষের কাছে থাকবে?
মাধুরীকে যখন চিতায় পোড়ান হবে মুখাগ্নি করার জন্য অনিমেষকে মায়ের শবের সামনে যখন নিয়ে যাওয়া হল তখন পিছন থেকে মহী তোষ কেঁদে উঠলেন। এ যে ছেলের হাঁতে আগুন! মায়ের দেহ থেকে বের হয়ে আসা লাল শুকিয়ে যাওয়া রক্তের হাতেই অনিমেষ মাকে মুখাগ্নি করাল।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:০৩