একজন খোকন সাহা, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে নিজ বাসার সিঁড়িতে মুত্যুবরণ করেন। স্বপরিবারে সেই বাসার চতুর্থ তলায় তিনি বসবাস করতেন। অসুস্থতা অনুভূত হলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। তার সাথে তার প্রিয়তমা স্ত্রী ও ছোট মেয়েও ছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলা অতিক্রম করার সময় শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে সামনে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি সেখানেই সিঁড়িতে বসে পড়েন। প্রচণ্ড পিপিসা অনুভব করায় বার বার পানি খেতে চান। তার প্রিয়তমা কন্যা তাদেরই প্রতিবেশী সিঁড়ি লাগোয়া পাশের বাসার দরজায় পানির জন্য নক করেন, কিন্তু বাসার বাসিন্দা তার শরীরে করোনার লক্ষণ রয়েছে এ কথা জানতে পেরে পানি দেয়া তো দূরের কথা, মেয়েটির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন। এর কিছুক্ষেণের মধ্যে খোকন সাহা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ জগতের কারো কাছে আর কখনো পানি চাওয়া লাগবে না তার। তিনি এখন মহাজাগতের বালুকাবেলায় হেটে বেড়াচ্ছেন এবং হয়তো স্বর্গের অমিয় সুধা পান করছেন।
নোবেল করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে নোয়াখালীর এক যুবক ঢাকায় মারা যান। তার পরিবার দাফনের জন্য তার লাশ নোয়াখালী নিয়ে আসেন, কিন্তু নিজ গ্রামের জনগণ তাকে গ্রামে কবর না দেয়ার জন্য বিক্ষোভ শুরু করে। তাকে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে বারণ করে। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তারা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহায়তায় লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে সক্ষম হন।
এটা শুধু এই যুবকের বেলায় না, করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রায় সকলের বেলায় তাদের প্রতিবেশীদের দ্বারা সমরূপ আচরণের শিকার হতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ সম্পন্ন হয়েছে স্ব-স্ব প্রতিবেশীদের দ্বারা।
এদিকে এক বাড়ীওয়ালী হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী একজন চিকিৎসককে যত দ্রুত সম্ভব ভাড়া বাসা ত্যাগ করার নোটিশ প্রদান করেন। চিকিৎসক তার কথা গ্রাহ্য না করায় বাড়ীওয়ালী জোরপূর্বক বাসা খালি করে। আরো অনেক চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী এবং নার্সের সাথে একই রকম আচরণ করা হয়।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর বাসায় ইট-পাথর নিক্ষেপের মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি আমরা। তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার স্থলে করা হচ্ছে রূঢ় ও কঠিন আচরণ। তারা হচ্ছে অবজ্ঞা ও অবহেলার পাত্র। এমনকি পরিবারের সদস্যদের দ্বারা শবদেহ পরিত্যাগ করার মতো ঘটনাও ঘটছে! তাদের পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মীয়তার সম্পর্ক গোপন করা হচ্ছে
ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভার সাতুতি গ্রামের আব্দুল হাই (৬৫) শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে আসলে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনে আব্দুল হাইয়ের আপন ভাই, চাচাতো-জেঠাতো ভাই, ভাতিজা প্রতিবেশীরা বেরিয়ে আসে। তারা কেউ লাশ নামাতে আসেনি। এসেছে অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামাতে বা গ্রামে দাফন করতে বাধা প্রদান করতে। করোনার গুজবের পাশাপাশি যোগ হয় পারিবারিক ও জমিসংক্রান্ত বিরোধ। লাশ নামাতে উদ্যত হলে হাইয়ের স্ত্রী ও ছেলের ওপর উপস্থিত লোকজন চড়াও হয়। মার-পিটও করে। আব্দুল হাইয়ের স্ত্রী ফিরোজার আকুতি, গ্রামের কবরস্থানে জায়গা না হলে নিজের ভিটেমাটিতে স্বামীকে কবর দেবেন। এই ‘বীরপুরুষের’ দল গ্রাম রক্ষা করতে চায়। সাফ জানিয়ে দেয়, মরদেহ এখানে দাফন করতে দেয়া হবে না! একটি ভ্যানগাড়ি জোগাড় করে আব্দুল হাইয়ের ছেলে শাহজাহান অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাবার লাশ নামিয়ে ভ্যানে করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন। এমতবস্থায় বিষয়টি নজরে আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এসো গৌরীপুর গড়ি’র। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সেঁজুতি ধর এবং পুলিশ টিম। অবশেষে ফজরের নামাজের পর ভোরে দাফনকাজ সম্পন্ন হয়।
সাতুতি গ্রামের ঐ নরপশু, জানোয়ারগুলো কি মরবে না কখনো? তাদের লাশের সাথে যদি এমন বর্বর আচরণ করা হয়, কেমন লাগবে তাদের স্বজনদের।
এগুলো সবই পাশবিকতা ও পশুত্বের বাস্তব উদাহরণ, কিন্তু শুনতে খারাপ লাগলেও এগুলো সংঘঠিত হচ্ছে সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব মানুষ দ্বারা।
কেন এমন পাশবিকতা, নির্মমতা, অমানবিকতা?কেন মানুষের প্রতি মানুষের, প্রতিবেশীর প্রতিবেশীর, পরিবারের সদস্য দ্বারা অন্য সদস্যের প্রতি এই রূঢ় ও পাশবিক আচরণ?
মৃতদেহের প্রতি কেনো এই বর্বরতা?
আমার মনে হচ্ছে আতঙ্ক ও উদ্বেগ থেকে এমনটি হচ্ছে। মানুষ মিডিয়ায় সম্প্রচারিতে অত্যাধিক নেতিবাচক সংবাদের কারণে ভীত ও আতঙ্কিত। সাধারণ জনগণ অত্যাধিক বিধি-নিষেধ, অতিরিক্ত কড়াকাড়ি এবং ফেসবুকে প্রচারিত গুজবের কারণে আতঙ্কগ্রস্থ। এসব নেতিবাচক গুজব সমাজে সংঘটিত ও প্রচারিত হচ্ছে, যা থেকে মানুষ আতঙ্কিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত হওয়া মানেই যে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ নয়, সাধারণ জনগণকে সেটা অনুধাবন করাতে আমরা অক্ষম।
আমরা মোটা দাগের টাকা আয় করছি। অতঃপর উদরপূর্তি করে খানা-পিনা করছি। আরামছে ঘুমাচ্ছি। স্বাধীনভাবে ঘোরা-ফেরা করছি আর দেশ ও জাতির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছি। কিন্তু বিবেক, সচেতনতা ও ঔচিত্যবোধকে লালন করছি না। কখনো যাচাই করি না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, কোনটা পালনীয় আর কোনটা বর্জনীয়। কখনো নিজের মস্তিষ্ককে পুরোপুরি খাটাই না।
এসবের পরিণামে আমরা ক্রমান্বয়ে পাশবিক হচ্ছি। কিন্তু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে এসব কিছুকে পশুর চেয়েও অনেক বেশি নিকৃষ্ট বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
আমরা সবাই জানি, আমাদের সকলকে মৃত্যুর স্বাদ আচ্ছাধন করতে হবে, সেটা আজ হোক বা কাল হোক, করোনার দ্বারা হোক বা না হোক। কিন্তু আমরা যদিওবা কখনো সমরূপ আচরণের প্রত্যাশা বা অপেক্ষা না করি, তথাপি এরূপ রূঢ় আচরণ আমাদের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে চুপিসারে বা প্রকাশ্যে ফিরে ফিরে আসে।
Man proposes, God disposes.
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২০ রাত ৮:৪৫