somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

মা ছেলের বিষণ্ণ-প্রসন্ন ডায়েরি

১৮ ই মে, ২০২৩ দুপুর ২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছেলেবেলা থেকেই আমার অন্যান্য ভাইয়ের তুলনায় মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো অন্যরকম। আমি আমার মায়ের সান্নিধ্য পাগলের মতো উপভোগ করতাম, অন্যদিকে আমার মাও আমার জন্য ব্যাকূল হয়ে থাকতেন। আমার মায়ের ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার সমস্যা ছিলো, অতিরিক্ত গরম-ঠান্ডায় অসুখের মাত্রা বেড়ে যেতো; এ কারণে তিনি বছরের অনেকটা সময় শয্যাশায়ী থাকতেন। যখন তিনি শয্যাশায়ী থাকতেন তখন তার দিন-দুনিয়ার খবর থাকতো না, দিনমান বালিশে মাথা রেখে, হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে উপড় হয়ে শুয়ে থাকতেন; ঘনঘন শ্বাস নিতেন আর উচ্চস্বরে কেশে রাত-দিন এক করে ফেলতেন। কখনো কখনো কাশির মাত্রা এতো বেড়ে যেতো যে, কাশির মাঝখানে শ্বাস নিতে পারতেন না; সে এক বীভৎস দৃশ্য! যা চোখে দেখার মতো ছিলো না। আমি মায়ের পাশে বসে থেকে তার হাতে-পায়ে, বুকে রসুনের সহীত গরম করা সরিষার তেল মালিশ করে দিতাম; আর তার এরকম কষ্ট দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। মাঝেমাঝে মাও আমার গলা জড়িয়ে কান্না করতেন। হয়তো তিনি আমাদের কে ছেড়ে চলে যাবার ভয় পেতেন, হয়তো তিনি ভাবতেন, আমাদের রেখে চলে গেলে আমাদের কী হবে? আমাদের দেখভাল করবে কে ? যখন মা বিছনায় পড়ে থাকতেন তখন আমি কোনো-কিছুতেই মন বসাতে পারতাম না, মনের ভিতর শুধু দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতো। স্কুলে গেলে মন পড়ে থাকতো মায়ের কাছে, স্কুল থেকে এসে বিকেলের খেলা-ধুলা রেখে মায়রে পাশে বসে থাকতাম, রাতেও হোম-ওয়ার্ক শেষ করে মায়ের পাশে বসে ঝিমাতাম। মাও চাইতেন আমি যেনো তার পাশেই বসে থাকি। এভাবেই আমি আমার মন খারাপের আর মা তার অসুখের দিন পাড় করতেন।

মা যখন সুস্থ হয়ে যেতেন তখন আমাদের মনের আকাশ থেকে মেঘ উড়ে গিয়ে, হাস্যোজ্জ্ব ঝলমলে এক সূর্যের আবির্ভাব ঘটতো; দীর্ঘ তিমির রাত শেষে আমরা পেতাম এক রাঙ্গা সকাল। মা সুস্থ হয়েই ঘরদোর সাফাই করার কাজে লেগে যেতেন, তিনি একদম অপরিচ্ছন্নতা দেখতে পারতেন না; অতিশয় অসুস্থ থাকতেন বলেই সেই সময় মন চাইলেও দেহ সায় না দেয়ায় সব চুপচাপ দেখে যেতেন। ঘরদোর সাফাই হয়ে গেলে, হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে আমাদের জন্য নানান পদ রান্না করায় ব্যস্ত হয়ে যেতেন। আমি মা কে বারংবার না করতাম এতো সব ধকল না নিতে; কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে তার নিজের মতো করেই কাজ করে যেতেন। মা সুস্থ হয়ে যাবার পর আমি আর মা বিকেলে নদীর পাড়ে গিয়ে বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করতাম, সন্ধ্যায় মশলা চায়ের কাপ হাতে অদ্ভুত সব অখাদ্য জোকস বলে হা-হা হি-হি এবং জ্যোৎস্না রাতে দুজন-দুজনার হাত ধরে যানবাহন বিহীন রাস্তায় হেঁটে খালামনির বাসায় চলে যেতাম। এসব ছিলো আমাদের নিত্য দিনের রুটিন। মা ছিলেন আমার পরম বন্ধু, মাকে ছাড়া আমি কিছুই চিন্তা করতে পারতাম না। আমার বন্ধুরা যখন কেনাকাটা আর বাইরে খাবারের সময় বন্ধু কিংবা বান্ধবীদের প্রত্যাশা করতো তখন এসবেও আমি আমার মাকে ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করতে পারতাম না; যদিও মায়ের অসুস্থতার কারণে আমার সকল চিন্তারা সবসময় সফলতার মুখ দেখতে পেতো না তবুও আমার চিন্তা করতে ভালো লাগতো।

আমাদের সাথে যে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ আর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো তা কিন্তু নয়, আমাদের মধ্যে মান-অভিমান ও চলতো। চাকরি এবং চাকরি সংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য আমাকে ঢাকা থাকতো হতো, মা থাকতেন আমাদের হোম-টাউনে। ঢাকা থাকা অবস্থায় যদি নিয়মিত মায়ের সাথে ফোনকলে কথা না হতো তাহলে তিনি বাচ্চাদের মতো অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে রাখতেন, ফোন ধরতেন না, কথা বলতেন না। আবার যখন মান অভিমানের পালা শেষে আমাদের কথা হতো, তখন বলতে না পারা রাজ্যের সকল খবর দিতে থাকতেন; এসব খবর থেকে পোষা লাল এবং কালো রঙের মুরগি কতগুলো ডিম দিয়েছে সেগুলোও বাদ পড়তো না, বাদ পড়তো না সবজির মাচায় কতগুলো চালকুমড়া ধরেছে, টবের কোন গাছে কি রঙের ফুল ফুটেছে সহ আরও কত কি! আমাকে যখন তার খুব দেখতে ইচ্ছে করতো তখন বারবার কল করে কবে বাড়ি যাব জানতে চাইতেন। কখনো তারিখ দিয়ে সেই তারিখে যেতে না পারলে কল করে বলতেন, 'তোকে আর আসতে হবেনা তুই ঢাকায়ই পড়ে থাক'। যেদিন আমি ঢাকা থেকে বাসায় যেতাম, সেদিন মা না খেয়ে আমার জন্য বসে থাকতেন। আমি বাসার যাবার পর দুজনে একসাথে বসে খাবার খেতাম। হোক সেটা দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে, আমরা সন্ধ্যেতেই দুপুরের খাবার খেতাম। বাড়িতে থাকলেও রাতে সবার খাওয়া শেষে আমরা মধ্যরাতে রাতের খাবার খেতাম। মা আমার জন্যই মধ্যরাতে খাবার খেতেন কারণ; আমার রাতে দেরি করে খাওয়ার অভ্যাস ছিলো। মার সাথে আমার এতো এতো স্মৃতি যে লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে; তবু স্মৃতি শেষ হবেনা।

যেবার শেষবারের মতো মা অসুস্থ হলেন সেবার আর ওষুধ-পত্র, ডাক্তার-কবিরাজ কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিলেন না। আমি সেই আগের মতোই দিনরাত মায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে রইলাম। দিনদিন যখন তার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছিলো; তখন আমরা তাকে স্থানীয় একটা ক্লিনিকে ভর্তি করালাম। সেখানেও আমি; ওষুধ-পত্র কিনে আনা, খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া সহ অন্যান্য সকল কাজ আমি নিজেই করতাম আর রাতে দুজনে হাসপাতালের বেডে শুয়ে নানান গল্প করতাম। আধো ঘুমে টের পেতাম, মা আমার শরীরে কাঁথা টেনে দিচ্ছেন, শরীরের এদিক সেদিক হাত বুলিয়ে দেখছেন মশা কামড়াচ্ছে কিনা। দিন কয়েকের মধ্যে মার স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলে, রোযার কয়েকদিন আগে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। মার আর আমার রুম মুখোমুখি হওয়ায়, আমার রুমের বিছানা থেকে মার রুমের বিছানা দেখা যেতো; আমি রাতে ক্ষণে ক্ষণে উঠে মার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা নিশ্চিত হয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতাম; কিন্তু ঘুম কিছুই হতো না। দুশ্চিন্তা আর বাজে স্বপ্নরা আমাকে ঘুমাতে দিতো না। একদিন গভীর রাতে খুব বাজে এক স্বপ্ন দেখে, দৌড়ে মার রুমে গিয়ে তার নাকের কাছে হাত নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছিলাম; অমনি মা উঠে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। তিনি জেগেই ছিলেন, হয়তো প্রতিনিয়ত আমার এসব কার্যকলাপ আঁচ করতেও পারছিলেন তাই আবেগ ধরে রাখতে না পেরে এভাবে কাঁদছিলেন। মা-ছেলে গভীর রাতে এক সঙ্গে কেঁদে বুকের ব্যথা হালকা করে যে যার মতো ঘুমাতে গেলাম।

মা যে আমাকে অন্য ভাইদের তুলনায় খুব কাছের মনে করতেন তার উদাহরণ এই ঘটনাঃ রোযার মধ্যে একদিন যোহরের নামাযের সময় আমি ওজু-গোসল করে নামাযে জন্য তৈরি হয়েছি; এমন সময় মা বললেন, তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে, ওজু করে আসার কারণে আমার সেই মুহুর্তে ওয়াশরুমে ঢুকতে ইচ্ছে করছিলো না, তাই আমি আমার ছোট ভাইকে বললাম মাকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসতে। ও মাকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসলো, আমার নামাযে দেরি হওয়ায়, কিছুক্ষণ পর ও'ই গিয়ে ওয়াশরুম থেকে মাকে নিয়ে আসলো। আমি নামায শেষ করে মার কাছে যেতেই মা আমাকে বললেন, "তুই ওরে দিয়ে কেনো আমাকে ওয়াশরুমে পাঠালি? ও আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো আবার নিয়ে আসলো ওর সামনে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো"। অথচ সেও তার ছেলে, আমিও তার ছেলে। তার চোখে আমি অন্যরকম ছিলাম কারণ; আমি তাকে যেভাবে জড়িয়ে থেকেছি ওরা সেভাবে থাকেনি।

ঈদের দিন দুপুরবেলা আমি আমার রুমে শুয়ে আছি, এমন সময় আমার খালাতো ভাই আমাদের বাড়িতে আসলেন। ভাইয়া মার কাছে গিয়ে কথা বলে আমার কাছে এলেন। এটা সেটা নিয়ে ভাইয়া আমার সাথে কথা বলছিলেন, হঠাৎ আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা ভাইয়া আল্লাহ তাআলা তো সব পারেন, তিনি তো চাইলেই আমার মা কে সুস্থ করেদিতে পারেন। ভাইয়া কিছু সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এবার আর মনে হয় খালা ভালো হবেন না! এটা বলেই ভাইয়া আমার রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমার ভেতরে এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো। আমি ধীরে ধীরে মার রুমে গিয়ে দেখি তিনি বিছানায় বসে আছেন। আমি তার পাশে গিয়ে, তার পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসলাম। আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। মা আমার গালে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলেন, আর বলতে লাগলেন, 'আমি তোদের রেখে কোথায় গিয়ে থাকবো? এই একটা শব্দই বারবার তিনি বলে যাচ্ছিলেন। ঈদের দিন সবাই যখন আনন্দে ভেসে যাচ্ছিলো, আমরা তখন অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছিলাম।

ঈদের দিন রাত থেকে আবার মার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া শুরু করল। ঈদের ছুটি শেষে আবার আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করলাম। প্রাথমিক ডায়াগনোসিস করে ডাক্তার আমাদের নিশ্চিত করলেন, মার প্রেশার ডাউন হয়ে গেছে, দ্রুত স্যালাইন পুশ করতে হবে। মার শরীরে ডোপামিন নামক এক স্যালাইন দেয়া হয়েছে, কচ্ছোপ গতির চেয়েও ধীর গতিতে চলছে সেই স্যালাইন। নার্স কে জিজ্ঞেস করে জানলাম প্রায় ১৮-১৯ ঘন্টা ধরে চলবে এই স্যালাইন। একেক সময় একেক ডাক্তার এসে মাকে দেখছিলেন আর নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। বিষয় টা আমার ঠিক ভালো লাগছিলো না। এমন সময় এক ডাক্তার আমাকে ডেকে বললেন, আপনি রোগীর কি হন? আমি উত্তর করলাম, রোগী আমার মা। এরপর ডাক্তার আমাকে বললেন মানোসীক প্রস্ততুতি নিয়ে রেখেন, আপনার মায়ের অবস্থা ভালো না। তার প্রেশার লেভেল ঠিক করার জন্য এই স্যালাইন দেয়া হয়েছে, যদি প্রেশার আপ করে তবে আলহামদুলিল্লাহ আর না হলে.... ডাক্তারের কথা শুনে আমার ভেতরে ঝড় শুরু হয়ে গেলো; কিন্তু আমি বাইরে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, সেই সাথে এটাও বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলাম যে, মার কিচ্ছু হবেনা, অবশ্যই মার প্রেশার আপ হবে।

আমি মার মাথার কাছে বসে আছি, মা মিনিটে মিনিটে পানি খাচ্ছে আর সাথে সাথে বমি করে ফেলে দিচ্ছে। আমি এক হাতে মাকে পানি খাওয়াচ্ছি অন্য হাতে বালতি ধরে বসে আছি, মা বমি করতে গেলেই সেটা তার মুখের কাছে ধরছি। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এর ফাঁকে ফাঁকে আমি নার্সদের দিয়ে মার প্রেশার মেপে দেখছিলাম উন্নতি হচ্ছে কিনা। সন্ধ্যার পর থেকে মা একটু একটু কথা বলছিলেন আমার সাথে। রাত প্রায় ১২ টা, মার প্রেশার কিছুটা আপ করেছে। আমি আর খালামনি মার পাশে বসে আছি আর মা আমার হাত ধরে শুয়ে আছেন। হসপিটালের পাশেই আমার ফুপুর বাসা, ফুপাতো ভাই আমাকে নিতে এসেছে যাতে রাতে ওদের বাসায় গিয়ে গোসল করে রেস্ট নিতে পারি। ফুপু জানতেন আমার বেশ ধকল যাচ্ছে, তাই ওকে পাঠিয়েছেন আমাকে নেওয়ার জন্য; কিন্তু মার হাত ছাড়িয়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছিলো না। খালামনি আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, 'তুই যা আমি আছি, সারাদিন অনেক ধকল গেছে, গিয়ে একটু রেস্ট করে আয়। মা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, 'যাও সকালে চলে এসো'। কিন্তু আমার মন মানছিলো না। আমি বেশ কয়েকবার সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে আবার মার কাছে ফিরে আসছিলাম। শেষবার মার কপালে চুমু খেয়ে বেড়িয়ে আসছিলা আর মনে মনে আল্লাহ কে বলছিলাম, আমি না থাকা অবস্থায় যেনো কিছু না হয়, তাহলে আমি সহ্য করতে পারব না।

সকালবেলা খালামনির কলে ঘুম ভাঙ্গলো, কল রিসিভ করতেই খালামনি বললেন, 'তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়, তোর মা তোকে দেখতে চাচ্ছে। আমি দ্রুত বিছানা থেকে উঠে, রিক্সা নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে মা বললেন, আমাকে তুলে বসাও। আমি বিছানায় উঠে মা কে তুলে বসালাম; কিন্তু মা বসে থাকতে পারছিলেন না। তাই আবার তাকে শুইয়ে দিলাম। এখন আর মা কথা বলছেন না, তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আমি পাগলের মতো দৌড়ে ডাক্তার খুঁজছিলাম; কিছু সময়ের মধ্যে একজন ডাক্তার এসে ইসিজি করিয়ে মার মৃত্যু নিশ্চিত করলেন। আমার খালামনি গগন বিদারী চিৎকার করে কান্না করছেন, আশেপাশে লোক এসে ভীড় করেছে। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিনা; কারণ আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা যে মা মারা গেছেন। আমি খুব শান্তভাবে মার হাত থেকে ক্যানুলা খুলছি, আস্তে আস্তে টেনে স্কচটেপ খুলছি যাতে মা ব্যথা না পায়। উৎসুক জনতা আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে, আমি তাদের সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আর মাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।

অ্যাম্বুলেন্স চলছে, আমি মায়ের খাটিয়ার পাশে মুখ গেড়ে বসে আছি, ফুপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এতো বছরের পরিচিত রাস্তা আজ বড্ড অচেনা লাগছে, গাড়ি স্বাভাবিক গতিতেই চলছে কিন্তু রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছেনা। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে যখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তার কিছু মুহুর্ত পরেই আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছালাম। মাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে উঠানে গাছের ছায়ার নিচে রাখা হয়েছে, আমিও মায়ের পাশে বসে আছি; কিন্তু আমার বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা, ইচ্ছে করছে মায়ের পাশে শুয়ে থাকতে কিন্তু কেনো যেনো শুতে পারলাম না। হয়তো চারপাশে অনেক লোকের ভীড় ছিলো তাই।

আমি মার পাশ থেকে উঠে এসে, ধীরে ধীরে তার রুমের দিকে যাচ্ছিলাম, পিছনে পিছনে আমার ফুপু আসছিলেন। আমি রুমের ভিতরে ঢুকে যখন দেখলাম বিছানা পড়ে আছে; কিন্তু সেখনে মা নেই! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। এবার আমি বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছি, সাথে আমার ফুপুও আমাকে ধরে কাঁদছেন। মা কে কবরস্থ করার জন্য প্রস্তুস করে রাখা হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের বড় ভাইয়ার জন্য, তিনি আসলেই জানাযার নামায হবে। তখন অনেক রাত! আমাদের স্থানীয় স্কুলের মাঠে মার খাটিয়া রাখা। আকাশ ভেঙ্গে জ্যোৎস্না উঠেছে, এরকম অনেক জ্যোৎস্না রাতে আমি আর মা ঘুরে বেড়িয়েছি; কিন্তু আজ মার ঘুরে বেড়াবার শক্তি নেই। তার নিথর দেহ জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ভাইয়া আসলেন, জানাযা শেষে মাকে কবরস্থ করা হল। আমি নিজে হাতে মাকে কবরে শুইয়ে, মাটি দিয়ে ঢেকে দিলাম চিরকালের জন্য।

মার দেহ মাটির নিচে ঢাকা পড়ে গেলেও তার স্মৃতি ঢাকা পড়ে যায় নি। এমন কোনো রাত বা দিন নেই যে রাতে বা দিনে মাকে স্বরণ হয়ে, আমারর চোখের পাতা ভিজে যায় না। ওদিকে মাও প্রতিনিয়ত আমার সাথে স্বপ্নে দেখা করেন। আমরা স্বপ্নে গল্প করি, ঘুরে বেড়াই। এইতো কিছুদিন আগে মা এসে আমাকে বলছেন,' চল ঘুরে আসি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? মা বললেন, আগে আয় তারপর দেখবি। আমি আর মা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার এক গুহার ভিতরে ঢুকে গেলাম। আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাকে বললাম, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। মা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার পিছনে পিছনে আয়। আমি মার কন্ঠ শুনে শুনে তার পিছনে পিছনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। হঠাৎ তীব্র এক সাদা আলো এসে আমার চোখে লাগলো, আলোর তীব্রতায় আমি তাকাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে দেখি, আলোকিত বিস্তীর্ণ এক সবুজ প্রান্তর। যতোদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। আমি আর মা সেই সবুজ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি, মৃদু-মন্দ বাতাসে আমাদের চুল উড়ছে.....

ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২৩ রাত ১১:৩৭
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×