আমি নিজেকে কর্পোরেট কাঠঠোকরা বলি। এটা নিয়ে লেখা আছে, কবিতাও আছে। এটাও বলেছি কর্পোরেট কাঠঠোকরার নিজস্ব জগত আছে। কর্পোরেট ডেস্কে কাজ করতে করতে, নিরেট অনুভূতিহীন কম্পিউটারের চোখ রাখতে রাখতে আমি মাঝে মধ্যে ইতিউতি চাই ঠিক কাঠঠোকরার মত।
ঐযে বললাম কর্পোরেট কাঠঠোকরার জগত আছে নিজের। ঐ জগতে আমি ভাবি। মাঝে মাঝে এক্সেল শীট , আউটলুকে মেইল আদান প্রদান করতে করতে ভাবনাটা ইন্টারনেটের লাইন ছাড়া বহুদুরের অগ্রসর হয়।
আজ কর্পোরেট লাইফে ঘাড় গুজে পিসি টিপাটিপি করছি , চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকছি ডেস্কটপে কিন্তু ২০ বছর আগেও মজে থাকতাম গেমসে। শুধু আমার কথা বলবো না , বলতে হবে আমরা।
তখন এতো হাইডেফিনেশনস গ্রাফিক্স ছিল না। নেই হাইস্পিড ইন্টারনেট। ভালো কোয়ালিটির ডিসপ্লে। পেটমোটা বেঢপ সাইজের সিআরটি মনিটর, বড় জোড় ৬৪ এমবির এজিপি কার্ড, কিবোর্ড আর মাউস সাথে নিয়েই মেতে উঠলাম কমান্ডারজ, এইজ অফ এম্পায়ার, সিভিলাইজেশনের মত মনমাতানো দূর্দান্ত গেইমসে। তখনো ধারণাই করিনি পরবর্তীতে কতটা পরিবর্তন হতে পারে টেকনোলজি আর গেইমে। আমাদের তখন গ্রাফিক্স নিয়ে মাথা ঘামানোর মত টাইম ছিল না। গেইমসের গল্প আর খেলার মজায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম।
২০০২-০৩ সালের দিকে গেইম পরিবেশক রকস্টার নিয়ে এলো থার্ড-পারসন শ্যুটার ভিডিও গেম ম্যাক্স পেইন ২ : ফল অব ম্যাক্স পেইন। এটি ম্যাক্স পেইনের সিক্যুয়াল এবং ম্যাক্স পেইন সিরিজের দ্বিতীয় গেম। আমাদের কাছে ম্যাক্স পেইন ততটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো না। কারণ তখন আমরা এইজ অফ এম্পায়ার এতটাই মজে ছিলাম। কিন্তু ম্যাক্স পেইন টু : ফল অব ম্যাক্স পেইন এসে দৃশ্যপট কিছুটা পাল্টে দিলো।
কুয়েন্টিন টারান্টিনোর পাল্প ফিকশন, ফ্রম ডাস্ক টিল ডন , রিজার্ভয়ার ডগস মুভির মত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে আটকে দিলো ম্যাক্স পেইন টু : ফল অব ম্যাক্স পেইন। ম্যাক্স পেইন টুও তেমনি খেলতে বসলে নাওয়া - খাওয়া ভুলে যেতাম । কোক আর সিগারেট যথেষ্ট ছিল।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ডাকসাইটে ডিটেকটিভ ম্যাক্স পেইন। মাদকচক্রের পেছনে লাগলে সন্ত্রাসীরা খুন করে তার স্ত্রী-কন্যাকে। এরপর ডিটেকটিভ পেইন সেই খুনের প্রতিশোধ নেন। এই ছিল প্রথম পর্বের গল্প।
গল্পের শেষ এখানেই হবার কথা কিন্তু লেখক স্যাম লেইক যেন গল্পের শুরু নিয়ে হাজির হন , ছিল দারুন চমক।
প্রিয়জন খুন হবার তীব্র মানসিক অবসাদ ডিটেকটিভ ম্যাক্স পেইনকে গ্রাস করে। মানসিক অবসাদ আর মাথার যন্ত্রণা প্রশমনে ম্যাক্স পেইনকে নিতে হচ্ছে একের পর এক পেইন কিলার। এ যেন এক বিপর্যস্থ এক হেরে যাওয়া সৈনিক।
গল্পে মোড় ঘরে যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে সাবেক সোর্স ভ্লাদিমিরের আস্তানায় এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা তদন্তে যায় ম্যাক্স পেইন। সেই তদন্তের প্রেক্ষিতে একসময় মোনা স্যাক্স নামের এক রহস্যময়ী এবং আবেদনময়ী নারী চরিত্রের আগমন ঘটে।
মোনাকে প্রথম পর্বে এক মাফিয়া সর্দারের স্ত্রীর যমজ বোন হিসেবে দেখছিলাম। সেই মাফিয়া সর্দারকে খুন করে মোনা। বোনের ওপর ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছিল সে। মোনা আসলেই রহস্যময়ী ! পরবর্তীতে জানা যায় , সে ভাড়াটে খুনি। ঝানু স্নাইপার , বন্দুক-পিস্তলে পেশাদার। আমার কাছে এঞ্জেলিনা জোলির আদলে এক নারীর মতন লাগতো।
মোনা সাথে ম্যাক্সের এক অমোঘ আকর্ষণ জটিল এক সম্পর্কের রসায়ন তৈরি করেছিল। কিন্তু একজন আইনের লোক আরেকজন অপরাধী , এক বিপরীতমুখী অবস্থান হয়তো দূরত্ব তৈরী করেছিল।
সেই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার তদন্তে একসময় ম্যাক্স ‘ক্লিনার্স’নামের নতুন এক অপরাধী সংগঠনেই খোঁজ পাই। শহরে তারা বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অপরাধ সংঘটিত করছে ম্যাক্সের পুরোনো শত্রু 'ভিনসেন্ট গগনিটি ' ।
নিউ ইয়র্কের সেই সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের পিছু নেয় ডিটেকটিভ ম্যাক্স পেইন। সাথে ছায়ার মত রহস্যময়ী মোনা স্যাক্স। ছায়ায় বলতে হবে। কারণ তার উদ্দেশ্য ছায়ার মতই ধাঁধার ।
অপরাধচক্র উৎখাতে ম্যাক্স মাঠে নামলেও মনোজগতে উঁকি দেয়া সেই দুঃসহ স্মৃতির সাথেও লড়তে হয় তাকে আর একটার পর একটা পেইন কিলার। ঠিক যেন নিজের সাথে নিজের লড়াই।
শেষ পর্যন্ত কি হবে , জিততে পারবে তো ম্যাক্স সেই অপরাধচক্র উৎখাতে আর মনোজগত তাকে বাধা দেবে কতটুকু , কিংবা মোনা স্যাক্স?
এটা গেলো মোটামুটি গল্প। এর বাইরেও গেমসে আকর্ষণ করার মত আরো কিছু আছে। ম্যাক্সের হাতে ৯ মিমি পিস্তল থেকে মলোটভ ককটেল স্নাইপার রাইফেল, শর্টগান , এম-১৬। দুহাতে দুই পিস্তল আর মেশিন পিস্তল ব্যবহার করার অসাম্য দক্ষতা।
মনে আছে , আলোচিত সিনেমা দ্য মেট্রিকস তখন রিলিজ পেয়েছে। মুভি দুনিয়া তখন মেট্রিকসে বুঁদ ! মেট্রিকসের কিছু মোশন তখন নজর করেছিল। ‘বুলেট টাইম’ দারুন একটা ব্যাপার ছিল। সময় কে স্থবির করে শত্রুর বুকে শুট করার মজাটা ম্যাক্স পেইনকে দিয়েছিল অন্য রকম এক মাত্রা। তাছাড়া গুলি করতে করতে স্লো মোশানে পিলারের আড়ালে বা অন্য কোথাও প্রয়োজনে ঝাঁপ পড়াতে দারুন মজা ছিল।
এ ছাড়া গেইমের গল্পে কমিক স্ট্রিপের মতো ছবি সংলাপের ব্যবহার করা হয়েছিল । যা ছিল অভিনব এবং মনোমুদ্ধকরা !
গেমসের বাড়তি পাওনা ছিল স্যাম লেকের লেখা , পোয়েটস অব দ্য ফল এর Late Goodbye গানটা।
শীতের রাতে নিউ ইয়র্কের ফাঁকা রাস্তা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি অথবা তুষারের ভেতর ওভারকোট পরা ম্যাক্স পেইনের হেঁটে চলা ছিল যেন শৈল্পিকতা , সেই সাথে ঠান্ডা কণ্ঠে ম্যাক্সের মনোলগ সব মিলিয়ে অপূর্ব এক মোহে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
সেই আচ্ছন্নতা হয়তো এখনো কাটেনি তাই সুযোগ পেলেই আবেগতাড়িত হই , স্মৃতিচারণ করি। প্রেমে পড়ি মোনা স্যাক্সের আর নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াই রাতের নিউয়র্কের ফাঁকা রাস্তায়...একাকী !
** এটা কোন রিভিউ নয়। স্মৃতিচারণ মূলক পোস্ট। লেখার আইডিয়া বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে সংগ্রহ করা হয়েছে। ছবি নিয়েছি ইন্টারনেট থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:১৬