‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে’, ‘একদিন তোর
হইব রে মরণ রে হাসন রাজা’ ‘মাটির পিঞ্জিরার
মাঝে বন্দি হইয়ারে কান্দে হাসন রাজা মন মনিয়া
রে’, ‘প্রেমের বান্ধন বান্ধরে দিলের
জিঞ্জির দিয়া’, ‘রঙের বাড়ই রঙের বাড়ই রে’,
‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে’, ‘লোকে
বলে ঘরবাড়ি ভালানা আমার’, আগুণ লাগাইয়া দিলও
কুনে হাসন রাজার মনে,’ ‘গুড্ডি উড়াইল
মোরে, মৌলার হাতের ডুরি’, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া
দেখ রূপ রে, সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের
রচয়িতা দেওয়ান হাসন রাজার ১৬৪তম জন্মদিন ছিলো ২১ ডিসেম্বর। ১৮৫৪ সালের
২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সুনামগঞ্জ
শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে
লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে তিনি
জন্মগ্রহণ করেন। হাসন রাজা জমিদার পরিবারের
সন্তান। তাঁর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী
ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর
তৃতীয় পুত্র। মাতার নাম ছিল হুরমত বিবি।
হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের
উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ
পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। অতঃপর তাঁরা
দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে
সিলেতে এসে থিতু হন। তাঁর দাদা
বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায়
চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করেন। হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ
এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন।
১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর
চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা
যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে
মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারীতে
অভিষিক্ত হন।
সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রামপাশা, লক্ষণশ্রী
আর সিলেটের একাংশ নিয়ে পাঁচ লাখ বিঘার বিশাল
অঞ্চলের জমিদার ছিলেন মরমী গীতিকবি
হাসন রাজা। পিতা ও মাতা উভয়ের কাছ থেকে
পাওয়া বিশাল জমিদারীর মালিকানা চলে আসে
কিশোর বয়সে। বেহিসাবী সম্পদ আর
ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া জীবন যাপনে
অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। জাগতিক লোভ
লালসা, ক্ষমতায়ন, জবরদখল করেও প্রতিপত্তি
বাড়ানোর কাজে প্রবৃত্ত ছিলেন। কিন্তু এক
সময় তার ভেতরের ভ্রান্তি ঘুচে যায়। মধ্য
পঞ্চাশে এসে তিনি ভিন্ন এক মানুষে পরিণত
হয়ে যান। তাঁর বোধ হয় যে এজগত সংসারের
সব অনাচারের মূলে আছে অতিরিক্ত সম্পদ।
কিছু দিনের জন্য অতিথি হয়ে আসা মানুষেরা
আসলে মহাশক্তির কাছে একেবারে নশ্বর।
আর এর মধ্যে খুঁজতে থাকেন সেই মহা
পরাক্রমশীলকে। সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে
খুঁজতে এক সময় আবিষ্কার করেন, তাঁর
নিজের মধ্যেই তাঁর বাস। হাসন রাজার গানের
মাঝেও অন্তর্নিহিত রয়েছে নশ্বর জীবন,
¯্রষ্টা এবং নিজের কৃতকর্মের প্রতি
অপরাধবোধের কথা। কে জানতো সেই
অত্যাচারী, ভোগবিলাসী জমিদারই হবেন
পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রজাদরদি এবং
দরবেশ জমিদার!
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত ২০৬ টি গানের
একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম
ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আরও কিছু গান
‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্ ’ সহ
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হযে ছে। ধারণা
করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-
সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে
আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ
করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর
মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। তাঁর
এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পূর্বেই নিজে
প্রস্তত করেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:০৪