somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজউদ্দিন জীবন-সংগ্রাম

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প পরিবার আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজউদ্দিন জীবন-সংগ্রাম শুরু করেছিলেন কলকাতার রাস্তায় ফেরিওয়ালা হিসেবে। তাঁর মুখে শোনা কাহিনীটা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :

আমার আদি বাড়ি খুলনা জেলার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে। বাবা ক্ষুদে ব্যবসায়ী শেখ মফিজউদ্দিন, মা মতিনা বেগম। বাবার ব্যবসা বলতে ধান, চাল আর নারকেল বেচা-কেনা। চারপাশের মানুষের তীব্র দারিদ্র্য আর অস্বচ্ছলতা বাল্যকালেই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, জীবন সংগ্রাম কত কঠিন!

১৯৪২ সাল বাবার কাছ থেকে মাত্র ১৬ টাকা নিয়ে বাড়ি ছাড়ি। গন্তব্য কাছাকাছি মহানগর কলকাতা। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলাম শিয়ালদহ রেলস্টেশনে। সারাদিন ঘুরিফিরি, কাজের সন্ধান করি আর রাত হলে স্টেশনের এক কোণে কাগজ বিছিয়ে শুয়ে পড়ি। সারাদিনের খাবার ছয় পয়সার ছাতু। এর বেশি খরচ করার সুযোগও ছিল না। কারণ টাকা দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল, কিন্তু উপযুক্ত কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

এর মধ্যে স্থানীয় জাকারিয়া হোটেলের মালিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। সহৃদয় এই ভদ্রলোক আমাকে তাঁর হোটেলের এক পাশে আশ্রয় দেন। আমিও চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসার চিন্তা করতে থাকি। কিন্তু পুঁজির অভাবে তাও সম্ভব হচ্ছিল না।

অনেক ভেবে-চিন্তে কমলা লেবু বিক্রির ব্যবসা শুরু করলাম। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ। পাইকারি দরে কমলা লেবু কিনে হাওড়া ব্রিজের আশেপাশে ফেরি করে খুচরা বিক্রি করি। এজন্য পুলিশকে দুই টাকা ঘুষও দিতে হতো!

এর মধ্যে আরেকটা সুবিধাজনক ব্যবসার সন্ধান পেয়ে যাই। ভ্রাম্যমান মুদির দোকান। সমস্যা হলো, অন্য দোকানদাররা ছোট ছোট মজার হিন্দি ছড়া কেটে পণ্য বিক্রি করতো। আর আমি একদমই হিন্দি জানতাম না। বাধ্য হয়ে ব্যবসার প্রয়োজনে হিন্দি শিখতে শুরু করলাম। অল্পদিনে বেশ রপ্তও হয়ে গেল।

মুদির ব্যবসা যখন বেশ জমজমাট, তখন ঘটলো আরেক বিপদ। হঠাৎ একদিন পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। বিচারে তিন দিনের জেল ও জরিমানা হলো। সেটা ছিল আমার জীবন-সংগ্রামের উপর বড় রকমের আঘাত। জেল থেকে বের হয়ে এসে রাগে অভিমানে কোনোকিছু বিবেচনা না করে পুরো দোকানটি বিক্রি করে দিলাম!

আবার সেই অনিশ্চিত যাত্রা; তবে খুব বেশি দিন নয়। পরিচয় হলো এক পেশোয়ারী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাঁর হাত ধরে পাড়ি জমালাম পেশোয়ারে। দোকান বিক্রির টাকাগুলো হাতে ছিল; তাই দিয়ে আবার ফলের ব্যবসা শুরু করলাম। ব্যবসার স্বার্থে পশতু ভাষা রপ্ত করে নিলাম। এভাবেই কেটে গেল আরো দুই বছর।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকাল। মোটামুটি ১০ হাজার টাকা পুঁজি হলে বাবা-মায়ের কাছে থাকবো বলে বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু সুখ বেশি দিন কপালে সইলো না। অল্প দিনের ব্যবধানে বাবা-মা দু’জনেই মারা গেলেন। তখন আমি সবে ১৯ বছরের তরুণ।

ঠিক করলাম, এবারে যা-ই করি, নিজ এলাকায় করবো। কিন্তু কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময়ের বিখ্যাত বিধু বিড়ির মালিক বিধুভূষণ-এর ছেলে আমার বন্ধু। সেই সুবাদে বিড়ি তৈরি করে বিক্রি করার ধারণাটি মাথায় আসে।

১৯৫২ সালে আমি প্রথম বিড়ির ব্যবসা শুরু করি। আরো দুইজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বিড়ি তৈরির কাজে নেমে পড়ি। অল্পদিনের মধ্যে লাভের দেখা পাই। একইসঙ্গে বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে একটি মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা করি।

১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে আমার দোকানে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। হঠাৎ এক রাতে আগুন লেগে পুরো দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে আমি আবার পথের ফকির হয়ে গেলাম! কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও মনোবল হারাইনি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, আবার শূন্য থেকে শুরু করবো, উপরওয়ালা নিশ্চয় সদয় হবেন।

পরিচিতজনদের সহযোগিতায় আমি আবার নতুন দোকান প্রতিষ্ঠা করলাম। সততা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার ফলে আমার ঘুরে দাঁড়াতেও সময় লাগেনি। কিছুদিনের মধ্যেই আমি লাখখানেক টাকার মালিক হয়ে গেলাম।

এবারে শুরু করলাম ধান, পাট, চাল, গুড় আর ডালের ব্যবসা। সবক্ষেত্রেই আমার মূলধন ছিল বিশ্বস্ততা। সবাই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতো আমাকে ।
ষাট-এর দশকে আমি যশোরের সীমান্তবর্তী নাভারন পুরাতন বাজারে চলে আসি।

এ সময় স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোজাহার বিশ্বাস আমাকে বেশ সহযোগিতা করেন। এখানে এসে নতুন করে বিড়ির ব্যবসা শুরু করি; গড়ে ওঠে আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি। আস্তে আস্তে অন্যান্য ব্যবসাতেও মনোনিবেশ করি।

একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় আকিজ তামাক ফ্যাক্টরি, আকিজ নেভিগেশন, আকিজ জুট মিল, আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি, আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। পাশাপাশি কিছু সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছি। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার কর্মী আমার বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

ছোটবেলায় দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অসহায় অবস্থা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই সুযোগ পেলেই আমার এলাকার সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। সত্যি বলতে কি, আমার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর অধ্যবসায় আর সততাই আমাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।

-----আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজউদ্দিন
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×