“গান-বাজনা হারাম কোরানের কোথাও বলা হয় নাই। কেউ যদি হারাম প্রমাণ দিতে পারে তবে তাকে আমি ৫০ লাখ টাকা দিব এবং জীবনের জন্য কবিগান ছেড়ে দেব” এক মিডিয়া বলে এই চেলেঞ্জের কারণে আবার অন্য মিডিয়া বলে পালা গানের একটি অনুষ্ঠানে ইসলাম নিয়ে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগে ডিজিটাল আইনের এক মামলায় শরিয়ত সরকার নামে এক বয়াতিকে গ্রেফতার করে তিন দিনের রিমাণ্ডে নেয়া হয়েছে।
ان من الشعر لحكمة ۔۔۔الحديث
ইন্না মিনাশ শিয়রি লাহিকমাহ (নিশ্চয়ই কিছু কাব্য হয়ে থাকে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপূর্ণ।)। __আল হাদিস। আমাদের দেশে 'ইসলামি বিনোদন' বলে কোন কিছু নেই। অথচ ইসলাম প্রত্যেক মুমিনকে জায়েজ তরিকায় বিনোদন উপভোগের জন্য পথ বাতলে দিয়েছে। সম্ভবত ইসমাইল শহীদ (র)র কোন এক গ্রন্থে এসম্পর্কে স্বল্পক আলোচনা এসেছে। বইটি অনেক বছর পূর্বে পড়েছিলাম তাই এর নাম ভুলে গেছি। ইসলামের পন্ডিত দাবীদারেরা জায়েজ তরিকায় বিনোদন দিতে না পারায় ইসলামের যে কতটুকু ক্ষতি করছেন তা তারা স্বীকার করার উল্টো ইসলামি বিনোদনের বিরুধীতাই করেন।
আমরা মুসলিমরা প্রায়ই দু'আর মধ্যে বলে থাকি, 'রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুন'য়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানা' এখানে আমরা হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মহান রবের কাছে প্রথমে দুনিয়ার সৌন্দর্য কামনা করি, অতপর আখেরাতের। কিন্তু বড় অফসোসের কথা হচ্ছে, বাস্তব জীবনে আমরা এরকম খোঁজলেও পোষাকের দৌড়ঝাঁপে আমাদের মধ্যকার সম্মানিত আলেম সমাজের কিছু সংখ্যাক জ্ঞানীগুণী জনেরা য়ার উল্টো কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যান। যা সত্যিকার অর্থেই আমাদের সবার জন্য দুঃখের।
একটা বাস্তব ঘটনা বলি, আফগানিস্তানের প্রধান শাসক মোল্লা উমরের সরকারকে পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বেই মোল্লা উমর বিশ্ব মুসলিমের নিকট খুব প্রশংসার পাত্র হয়ে উঠেন। তার শাসিত এলাকাকে অনেক ইসলামি স্কলারবৃন্দ ' সঠিক ইসলামি স্টেট' বলেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তো সেই সময়কার ধার্মীকদের মধ্যে প্রায় সবাই মোল্লা উমরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। অতপর ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ সামরিক আক্রমণ শুরু হয়। ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসীদের মতে এটা ইসলামী স্টেট ধ্বংসের পাশাপাশি খনিজ সম্পদ দখলের ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। যেহেতু আজকের লেখাটি ধর্মীয় একটি বিষয় নিয়ে তাই ধর্মকে প্রধান্য দিয়েই বলি। তো সেইসময় তালেবানরা যখন যুদ্ধ শেষে ক্যাম্পে ফিরতেন তখন তারা বিনোদনের জন্য নাশিদ আবৃতি করতেন, এমনি বিশাল হৈ-হুল্লোড়ের মাধ্যমেও করতেন যা একপ্রকার গানেরই মত শুনাতো। কিন্তু এই গানকে তাদের আমীরেরা অবৈধ ঘোষণা করতেন না অথচ তারা ছিলেন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানী (তখনকার ইসলাম পন্থীদের বিশ্বাস মতে)। তারা ক্লান্তি দূর করার জন্য এই গানের বিনোদনটি সবাইকে উপভোগ করতে দিতেন।
উপরের ঘটনাকে অবশ্যই দলীল হিসেবে ধরা যাবে না। আযহারী সাহেবের মত বলবো না, 'দলিল আগে নয়, যুক্তি আগে' । যাই হোক, ইসামের প্রত্যেকটি দলিলই যৌক্তিক। সুতরাং 'দলীল আগে না, বরং যুক্তি আগে' বলে মার্কেট পাওয়ার ধান্ধা আপাত আমার নাই তাছাড়া এইসব বলে তো আর মার্কেট পাওন যাইবো না । তো আসুন এবার একটু দলিল দেখা যাক, তারপর না হয় যে যার মত যুক্তি নিয়ে খেলায় নামলাম।
কুরআনের ভাষ্য : আল্লাহ তাআলা সূরা লুকমানে আখেরাত-প্রত্যাশী মুমিনদের প্রশংসা করার পর দুনিয়া-প্রত্যাশীদের ব্যাপারে বলছেন,
আর একশ্রেণীর লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত খেল-তামাশার বস্তু ক্রয় করে বান্দাকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার জন্য।-সূরা লুকমান : ৬
উক্ত আয়াতের শানে নুযূলে বলা হয়েছে যে, নযর ইবনে হারিস বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী খরিদ করে এনে তাকে গান-বাজনায় নিয়োজিত করল। কেউ কুরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে গায়িকাকে আদেশ করত এবং বলত মুহাম্মদ তোমাদেরকে কুরআন শুনিয়ে নামায, রোযা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা বলে। এতে শুধু কষ্টই কষ্ট। তার চেয়ে বরং গান শোন এবং জীবনকে উপভোগ কর।-মাআরিফুল কুরআন ৭/৪
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন।
এই ব্যাপারে সাহাবী ও তাবেয়ীদের ব্যাখ্যাঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে উক্ত আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদীস’-এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তা হল গান।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. একই কথা বলেন। তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে যুবাইর থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেন, উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যা বান্দাকে কুরআন থেকে গাফেল করে দেয়।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৪৪১
কুরআন মজীদের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজী পেশ করলে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে বললেন,
'তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস পদস্খলিত কর।' -সূরা ইসরা : ৬৪
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তাই ইবলিসের আওয়াজ। বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন, ইবলিসের আওয়াজ বলতে এখানে গান ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তার মধ্যে গান-বাদ্যই সেরা। এজন্যই একে ইবলিসের আওয়াজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৯
সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী বহু গুনাহর সমষ্টি হল গান ও বাদ্যযন্ত্র। যথা :
ক) নিফাক এর উৎস
খ) ব্যভিচারের প্রেরণা জাগ্রতকারী
গ) মস্তিষ্কের উপর আবরণ
ঘ) কুরআনের প্রতি অনিহা সৃষ্টিকারী
ঙ) আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী
চ) গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও
ছ) জিহাদী চেতনা বিনষ্টকারী।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭
বস্তুত গান বাজনার ক্ষতিকর প্রভাব এত বেশি যে, তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো দলীল খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বহু হাদীসের মাধ্যমে তা প্রমাণিত।
হাদীসের ভাষ্যঃ
গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় কর না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রেখ, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১২৮২; ইবনে মাজাহ হাদীস : ২১৬৮
বর্তমানে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে যাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এর সকল উপার্জন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দিবেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস : ৪০২০; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৬৭৫৮
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২
উপরোক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক সৃষ্টি হয়েছে যে, সাহাবীদের ইসলামকে এ যুগে অচল মনে করা হচ্ছে এবং গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের মেলামেশা ইত্যাদিকে হালাল মনে করা হচ্ছে। সহীহ বুখারীতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ৫৫৯০ মুসনাদে আহমদের হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
আল্লাহ তাআলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা বিলোপসাধনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন গানবাজনার সাথে বিনোদনের পার্থক্য কোথায় আশাকরি তা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।
এখন বাউয়াতি শরিয়ত সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
যদি বায়াতি শরিয়ত সরকারকে গান বাজনার পক্ষে চেলেঞ্জ দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করে তিন দিনের রিমাণ্ডে নেওয়া হয়ে থাকে তবে এটা সম্পূর্ণ ইনসাফের খেলাফ। তার এই শাস্তির জন্য প্রথম দায়ী বাদী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আহমদ (কারণ, চেলেঞ্জের প্রতিবাদে মামলার পক্ষে ইসলাম কখনো সমর্থন দেয় না)। তারপর পুলিশ অতপর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আকরাম হোসেন।
আর যদি সময় নিউজ টিভির প্রতিবেদন মতে মহানবীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের কারণে গ্রেফতার পরবর্তী রিমান্ড দেওয়া হয়ে থাকে তবে তা যে সঠিক তাও কিন্তু নয়। কারণ কারো দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত থাকে শাস্তির সম্মুখীন করা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। সুতরাং তার দোষ যদি প্রমাণ না হয়, তবে থাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। আর দোষ প্রমাণিত হলে তো সঠিক বিচারই হওয়ার কথা; রিমান্ড নয়। অবশ্যই একজন সুনাগরিক হিসেবে আমরা কেউ চাই না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে নওশাবার মত আরেকজন শেষ হয়ে যাক।
ছবি ও তথ্যাদি বিভিন্ন ওয়েব থেকে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:৩৫