somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাহে রামাদান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা

০১ লা মার্চ, ২০২১ সকাল ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাহে রামাদান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা

আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (বাকারাহ : ১৮৩)

রোজা নির্দিষ্ট কিছু দিন। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাহলে পরে একই সংখ্যক দিন পূরণ করবে। আর যাদের জন্য রোজা রাখা ভীষণ কষ্টের, তাদের জন্য উপায় রয়েছে তারা একই সংখ্যক দিন একজন গরিব মানুষকে খাওয়াবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়তি ভালো কাজ করে, সেটা তার জন্যই কল্যাণ হবে। রোজা রাখাটাই তোমাদের জন্যই ভালো, যদি তোমরা জানতে। (বাক্বারাহ : ১৮৪)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, রামাদান সেই মাস যে মাসে নাযিল হয়েছে কুরআন যা মানব জাতির জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং হেদায়েত ও ফুরকান (হক ও বাতিলের মধ্যে প্রার্থকারী) বিষয়ক সুষ্পষ্ট প্রমানাদী স্বরূপ। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে। আর কেউ যদি অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাহলে সে যেন পরে একই সংখ্যক দিন রোজা রেখে পূরণ করে নেয়। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজটাই চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিনটা চান না। তিনি চান তোমরা যেন নির্ধারিত সময় পূরণ করো, তোমাদেরকে পথ দেখানোর জন্য তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। (বাকারাহ : ১৮৫)

আরবি বর্ষপঞ্জির নবম মাস রামাদান। অজ¯্র-অফুরন্ত কল্যাণের এক মহভান্ডার রামাদান মাস। রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহান সওগাত নিয়ে প্রতি বছর এ মাস আমাদরে মাঝে হাজির হয়। রামদানের সিয়াম পালন তথা রোযা আমাদের উপর ফরয এবং ইসলামের পাঁচটি আরকানের মধ্যে এটি অন্যতম একটি রুকন। রামাদান মুলত আল্লাহর পক্ষথেকে বান্দারপ্রতি এক নিয়ামত বিশেষ। সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া, জীবনমান উন্নত করা, আতœগঠন ও উত্তম নৈতিক চরিত্র গঠন করা এ মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে সম্ভব। এ মাস পরিশুদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ লাভের মাস। একজন মানুষকে গুনাহ মুক্ত করে মুত্তাকী তথা খোদাভীরু-পরহেযগার ও আল্লাহর ওলী বানানোর জন্যই আগমন এ রামাদান মাসের। রামাদান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের মাস। এ কারণেই বলা হয়, পবিত্র রামাদান মাস হচ্ছে ইবাদাত, পবিত্র কুরআন তিলায়াত, যিকর, শোকর ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুমের মাস। কুরআন কারীমের অনেক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে এই মাসের গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা বর্ণিত আছে। আলকুরআনে আল্লাহ বলেছেন : ‘‘রামাদান মাস, যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে’’। (বাকারাহ : ১৮৫) কুরআন কারীমসহ অন্যান্য আসমানী কিতাব আল্লাহ তা’আলা এই রামাদান মাসে নাযিল করে এই মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। রামাদান মাসের ফযিলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘রামাদান- বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস রোযা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃংখলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল মহা কল্যাণ হতে’’। (তিরমিযি : ৬৮৩) স্বয়ং রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব ও শা’বান তথা রামাদানের দুই মাস আগে থেকে রামাদান পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করতেন। “আল্লাহহুম্মা বারেক লানা ফি রাজাব ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লেগনা রামাদান”। অর্থ : হে আল্লাহ আমাকে রাজাব ও শাবান মাসের রবকত দান করুন এবং রামাদান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। রামাদানের সাওম ও রোযা জান্নাত লাভের একটি মাধ্যম; যেমন হাদীসে এসেছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল, সিয়াম পালন করল রামাদান মাসে, আল্লাহ তা’আলার কর্তব্য হলো তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো। (সহীহ আল বুখারী) একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহে রমজানের প্রাক্কালে বলেন, ‘রামাদান মাস আগতপ্রায়, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, আল্লাহ তা’আলা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং খাস রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন ও দোয়া কবুল করেন।’ রোযাদারের মর্যাদা উল্লেখ করে হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘রোযাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য, তার চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য ইবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়। ঈমান ও এহতেসাবের সঙ্গে যে ব্যক্তি রোযা রাখে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ আর রোযাদারের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষ যত প্রকার নেক কাজ করে আমি তার সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ বৃদ্ধি করে দিই। কিন্তু রোযা এই নিয়মের বাইরে। রোযার সওয়াব একই নিয়মে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। রোযার সওয়াবের পুরস্কার স্বয়ং আমি প্রদান করব। অথবা আমি নিজেই রোযার সওয়াবের পুরস্কার।’ এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো নফল কাজ করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজই আদায় করল। আর যে এ মাসে কোনো ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যারা রামাদান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোযা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।’
এ মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যেগুলো পালন করার মাধ্যমে আমরা জান্নাতে যেতে পারি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি। নিম্নে রামাদান মাসের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। তবে এ আমলগুলো করার জন্য শর্ত হলো :
এক : ইখলাস অর্থাৎ ‘‘একনিষ্ঠতার সাথে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যে আমল করা। আমল হতে হবে শেরকমুক্ত নির্বেঝাল। সুতরাং যে আমল হবে টাকা উপার্জনের জন্য, নেতৃত্ব অর্জনের জন্য ও সুনাম-খ্যাতি অর্জনের জন্যে সে আমলে ইখলাস থাকবে না অর্থাৎ এসব ইবাদাত বা নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না বরং তা ছোট শির্কে রূপান্তরিত হতে পারে। আল-কুরআনে এসেছে : “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে”। (বাইয়্যেনাহ : ৫)
দুই : সুন্নাতে অনু¯œরণ অর্থাৎ ইবাদাতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা। সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সকল ইবাদাতের কথা উল্লেখ আছে সেগুলো পরিপূর্ণ অনু¯œরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ নেই। কারণ, ইবাদাত হচ্ছে তাই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়ে দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে : ‘এবং রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও’। (হাশর : ৭)
এ বিষয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে’’। (সহীহ মুসলিম : ৪৫৯০)
রামাদান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো নিম্মরূপ :
১. রামাদান মাসে সিয়াম পালন করা :
ইসলামের পাঁচটি রুকনের একটি রুকন হল সিয়াম। আর রামাদান মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ। সেজন্য রামাদান মাসের প্রধান আমল হলো সুন্নাহ মোতাবেক সিয়াম পালন করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (বাকারাহ : ১৮৩) মহান আল্লাহ বলেন: “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে, মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে”। (বাকারাহ : ১৮৫)
সিয়াম পালনের ফযিলাত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ইখলাস নিয়ে অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য রমাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’’। (সহীহ বুখারী : ২০১৪)
ইবনে হিব্বানে বর্ণিত আছে হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসূল আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। রাসূলুল¬াহ সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়া সাল¬াম বলেন : তুমি রোযা রাখ। রোযা তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অতি উত্তম কোনো নেক আমলের নির্দেশ দিন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি রোজা রাখো। কারণ এর সমমর্যাদার আর কোনো আমল নেই।’ (সুনানে নাসাঈ : ২৫৩৪)
‘‘যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সিয়াম পালন করবে, তাদ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন’’। (সহীহ মুসলিম : ২৭৬৭)
হাদীসে এসেছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল, সিয়াম পালন করল রামাদান মাসে, আল্লাহ তা’আলার কর্তব্য হলো তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো। (সহীহ আল বুখারী)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যারা রামাদান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোযা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।’
২. কিয়ামু রামাদান বা রামাদানের তারাবীহ পড়া :
সালাতুত তারাবীহ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবীহ পড়ার সময় তার হক আদায় করতে হবে। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশা নিয়ে রামাদানের রাতে কিয়াম (রাত জেগে ইবাদাত করা ও তারাবীহ আদা করা ইত্যাদি) পালন করল তার বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী : ২০০৯ ও সহীহ মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন, আর আমি কিয়ামুল লাইল অর্থাৎ তারাবীহ’র নামাযকে সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম ও কিয়াম আদায় করবে, সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন সে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসনাদে আহমদ : ১৬৬০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৭৭৮৭, মুসনাদে বাযযার : ১০৪৮, সহীহ ইবনে খুযাইমা : ২২০১, সুনানে নাসায়ী : ২৫১৮)
তারাবীহ এর সালাত তার হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবীহ জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদীসে এভাবে ইরশাদ করেছেন : যখন কোন ব্যক্তি ইমামের সাথে ইমাম তার নামায শেষ করা পর্যন্ত নামায আদায় করবে তার জন্য তা সারা রাত জেগে ইবাদত করা হিসেবে গণ্য হবে। (সুনান আবূ দাউদ : ১৩৭৭, সহীহ)
৩. সাহরী খাওয়া :
সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে : ‘‘সাহরী হল বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন’’। (মুসনাদ আহমাদ : ১১১০১)
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সেহরি খাও। কেননা, সাহরীতে বরকত রয়েছে। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাহরী খাওয়া বরকতময় কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সেহরি কর। কারণ যারা সাহরী খায় আল্লাহ তা’আলা তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, ইবনে হিব্বান)
হযরত আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আহলে কিতাবদের রোজা এবং আমাদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহারী খাওয়া ও না খাওয়া।’ (মুসলিম : ৫৫৮)
৪. রামাদান মাসে রোযাদারকে খাওয়ানো :
রামাদান মাসে লোকদের খাওয়ানো, বিশেষ করে সিয়াম পালনকারী গরীব, অসহায়কে খাদ্য খাওয়ানো বিরাট সওয়াবের কাজ। কুরআনে এসেছে : তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্তে¡ও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। (আদ-দাহর : ৮)
এ বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে : হযরত সালমান ফারর্সী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : এ মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পেট পুরে খাওয়াবে, আল্লাহ আমার হাউজ থেকে এমনভাবে সিক্ত করবে, জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে কখনো তার তৃঞ্চা পাবে না। (সুনানে বায়হাকী)
আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া। (সহীহ আল-বুখারী : ১২)
অপর বর্ণনায় বর্ণিত আছে যে :‘‘ যে কোনো মুমিন কোনো ক্ষুধার্ত মুমিনকে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। (বাইহাকী, শু‘আবুল ইমান : ৩০৯৮, হাসান)
৫. ইফতার করা :
সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোন বিলম্ব না করে ইফতার করা সুন্নত এবং সূর্যাস্তের আগে ইফতারি সামনে নিয়ে বসে থাকা মোস্তাহাব।
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের আগে ইফতার করতেন কয়েকটি টাটকা খেজুর দিয়ে। যদি তিনি টাটকা খেজুর না পেতেন তাহলে শুকনা খেজুর (খুরমা) দিয়ে ইফতার করতেন। আর তাও যদি না পেতেন, তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন। কেন না পানি হলো অধিক পবিত্র। (আবু দাউদ : ২৩৫৭, তিরমিজি)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্ল¬াহ তা’য়ালা বলেন, আমার বান্দাদের মধ্যে আমার কাছে অধিকতর প্রিয় তারাই, যারা আগেভাগে ইফতার করে। (তিরমিযী নং ১ম খন্ড, ৮৮ পৃঃ, মেশকাত ১৭৫ পৃঃ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : লোকেরা ততক্ষণ কল্যাণে থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার জলদি করবে। (বুখারী, মুসলিম ১ খন্ড-৩২১ পৃঃ, মিশকাত ১৭৫ পৃঃ)
সাহল ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ কল্যাণের সঙ্গে থাকবে তত কাল, যত কাল তারা শিগগির ইফতার করবে।’ (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ফরমান, দ্বীন জয়ী থাকবে তত দিন, যত দিন লোক শিগগির ইফতার করবে। কেননা ইহুদি খ্রিষ্টানরা ইফতার করে দেরিতে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজা শরিফ)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন : “পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।” (সুনান আবূ-দাউদ: ২৩৫৯, সহীহ)
অপর বর্ণনায় যে এসেছে- “হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।” (সুনান আবু দাউদ : ২৩৫৮)
৬. রোযাদারকে ইফতার করানো :
অপরকে ইফতার করানো একটি বিরাট সওয়াবের কাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে একজনকে ইফতার করানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা হাদীসে এসেছে : ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তাদের উভয়ের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না’’ (সুনান ইবন মাজাহ : ১৭৪৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত রোযাদারের সওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (সুনান তিরমিযী : ৮০৭)
হযরত সালমান ফারর্সী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (স্:া) বলেন : এ মাসে কোন ব্যক্তি রোযদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহসমূহ মোচন করা হবে এবং দোযখের আগুন থেক মুক্তি দেয়া হবে। রোযাদার যে পরিমান সওয়াব পাবে সেও সে পরিমান সওয়াব পাবে। এ কারণে রোযাদারের সওয়াবের কোন ঘাটতি হবেনা।
হযরত সালমান ফারর্সী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলেছেন: যে লোক কোন রোযাদারকে কিছু হালাল জিনিষ খাওয়ায়ে ও পান করায়ে ইফতার করায় ফিরিশতাগণ রামাদান মাসের সমস্ত সময় ধরে তার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং জিবরাঈল (আ:) ক্বদর রাত্রিতে তার জন্য রহমাতের দোয়া করেন। (সহীহ আল বুখারী; সহীহ মুসলিম ও তাবরানী ইবনে হাব্বান)
৭. রামাদানের শেষ দশকের ইবাদাত :
শবেক্বদর লাভ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হল শেষ দশকে ই’তিকাফ করা। রামাদানের শেষ দশদিন ই’তিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। ই‘তিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইস্তেগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রামাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত : ‘‘প্রত্যেক রামাদানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রামাদানে তিনি ই’তিকাফ করেছিলেন বিশ দিন’’। দশ দিন ই‘তেকাফ করা সুন্নাত। (সহীহ আল বুখারী : ২০৪৪)
হযরত আলী বিন হোসাইন নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছে : যে ব্যক্তি রামাদানের শেষ দশ দিনের ইতেকাফ করে সে দুই হজ্জ ও দুই ওমরাহ করার সমান সওয়াব পায়।
হাদীস শরীফে এসেছে যে ব্যক্তি বিশ্বাসসহকারে ও সোয়াবের আশা নিয়ে ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তা’আলা তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।
হাদীস শরীফে এসেছে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশে একদিন ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তা’আলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (শুআবুল ঈমান : ৩৯৬৫)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর সšু‘ষ্টি লাভের আশায় একদিন এতেকাফ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিনটি গহবর সৃষ্টি করবেন-যার দূরুত্ব আসমান ও যমীনের দূরত্বের চেয়েও অধিক হবে।
৮. লাইলাতুল ক্বদরের ন্যায় বরকতময় রজনী তালাশ করা :
এ মাসে লাইলাতুল ক্বদর নামে একটি রাত্র রয়েছে যার ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে লাইলাতুল ক্বদর হাজর মাসের চেয়েও উত্তম। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : আমরা লাইলাতুল ক্বদরে তা (কুরআন) নাযিল করেছি, আপনি কি জানেন লাইলাতুল কাদর কি? লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, এতে ফিরেশতাকূল ও জিবরিল তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সকল বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত ইহা শান্তিময়। (ক্বদর ঃ ১-৫)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমান সহকারে সওয়াবের আশায় নিয়ে লাইলাতুল ক্বদরের কিয়াম (রাতে জেগে ইবাদাত) পালন করে তার বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী, মুসলিম : ৭৬০; মুসনাদে আহমদ : ৪০৮)
হযরত ওবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ক্বদরের রাত্রের অন্বেষণে সেই রাত নামায পড়ে এবং তা পেয়ে যায়। তার অতীতের ও ভবিষ্যতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট রামাদান মাস উপস্থিত। এটা এক অত্যন্ত বারাকাতময় মাস। আল্লাহ তা’আলা এ মাসে তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় শয়তানগুলোকে আটক রাখা হয়। আল্লাহর জন্যে এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহা কল্যাণলাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি। (সুনানে নাসায়ী : ২১০৬)
এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন : ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রামাদানের শেষ দশ দিনে অধিক হারে পরিশ্রম করতেন’’ (সহীহ মুসলিম : ১১৭৫)
লাইলাতুল কদরের দোয়া : হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর নবী! যদি আমি লাইলাতুল ক্বদর পেয়ে যাই তবে কি বলব ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বলবে ঃ ‘‘হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’’ (সুনান আত-তিরমিযী : ৩৫১৩)
৯. গোলামের কাজের বোঝা হালকা করা :
রামাদান এমন একটি মাস যার প্রথম অংশে আল্লাহর রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত এবং তৃতীয়াংশে দোযখ হতে মুক্তি দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে আপন গোলাম/শ্রমিকের কাজের বোঝা হালকা করে দেয় আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং দোযখের আগুন হতে নাজাত দান করবেন। (সুনানে বায়হাকী)

১০. সামর্থ্যবানদের রামাদান মাসে ওমরাহ আদায় করা :
রামাদান মাসে ওমরাহ করার অনেক ফযীলত রয়েছে। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ বিষয়ে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন- এ মাসে একটি ওমরাহ করলে একটি হজ্জ আদায়ের সোয়াব হয় এবং তা রাসূলূল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হজ্জ আদায়ের মর্যাদা রাখে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘রামাদান মাসে উমরা করা আমার সাথে হজ্জ আদায় করার সমতুল্য’’। (সহীহ বুখারী : ১৮৬৩; সহীহ মুসলিম : ১২৫৬)
উম্মে মা’কাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রামাদান মাসে ওমরাহ করা একটি হজ্জের সমান। (জামে আত-তিরমিযি : ৮৬১)
১১. এ মাসের রোযা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোযা রাখার সমান :
সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান। সুতরাং এ হলো এক বছরের রোজা।’ (নাসায়ি : ২/১৬২)
১২. সময় মত সালাত আদায় করা :
সিয়াম পালনের সাথে সাথে সময় মত নামায আদায় করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। জামায়াতে নামাজ আদায় করার তাগিদ দিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো।’ (বাকারা : ৪৩)
কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে : ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’ (নিসা : ১০৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, সময় মত নামায আদায় করা। (সহীহ মুসলিম : ২৬৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী একাকী নামাজ পড়া অপেক্ষা ২৭ গুণ বেশি মর্যাদার অধিকারী।’ (বুখারী : ৬৪৫, মুসলিম : ৬৫০)
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন জামায়াতের সঙ্গেই নামাজ আদায় করেছেন। এমনকি ইন্তিকালপূর্ব অসুস্থতার সময়ও জামায়াত ছাড়েননি। সাহাবায়ে কেরামের পুরো জীবনও সেভাবে অতিবাহিত হয়েছে। (সহীহ বুখারী : ৬২৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সকালে বা সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেন, যতবার সে সকালে বা সন্ধ্যায় গমন করে ততবারই। (বুখারী ও মুসলিম : ৬২২)
হযরত আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজ গৃহ থেকে পবিত্র হয়ে ফরয সালাতের জন্য বের হয়, তার সওয়াব একজন হজ পালনকারীর ছওয়াবের সমান। (আবু দাউদ : ৪৭১)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা ছায়া দান করবেন ঐ দিন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হল ঐ ব্যক্তি যার হৃদয় মসজিদের সাথে লাগানো থাকে। অর্থাৎ সালাত ও জামায়াতের প্রতি আন্তরিকভাবে আগ্রহী। (বুখারী ও মুসলিম : ৬২০)
১৩. রামাদান হলো কুরআন নাযিলের মাস :
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘রামাদান মাস, এতে নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।’ (বাকারা : ১৮৫) রামাদান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কুরআন একবারে নাযিল হয়েছে। সেখান থেকে আবার রামাদান মাসে অল্প অল্প করে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নাযিল হয়েছে। এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাযিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রামাদান মাসে জিবরাইল (আ:) রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দুই বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামাতের দিন কুরআনের পাটককে বলা হবে, তুমি তা পাঠ করতে থাক এবং উপরে চড়তে (উঠতে) থাক। তুমি তাকে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে থাক, যেরূপ তুমি দুনিয়াতে পাঠ করতে। কেননা তোমার সর্বশেষ বসবাসের স্থান (জান্নাতে) ঐটিই যেখানে তোমার কুরআনের আয়াত শেষ হবে। (কিতাবুস সালাত : ১৪৬৪)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং কুরআনে অভিজ্ঞও সে অতি সম্মানিত ফেরেশতাদের অর্ন্তভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠের সময় আটকে যায় এবং কষ্ট করে পড়ে তার জন্য দু’টি বিনিময় অবধারিত। (কিতাবসু সালাত : ১৪৫৪)
১৪. সহীহভাবে কুরআন শেখা :
রামাদান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ মাসের অন্যতম আমল হলো সহীহভাবে কুরআন শেখা। আর কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে :‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’’। (আলাক : ১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শেখার নির্দেশ দিয়ে বলেন:‘‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’’ (মুসনাদ আলজামি : ৯৮৯০)
১৫. কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা :
কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এ দায়িত্ব মূলত বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানোর মাধ্যমেই সম্পাদন করেন। কুরআনে এসেছে : ‘‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’। (হিজর : ৯)
যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘‘কুরআনের ধারক-বাহককে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হবে”। (সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪)
১৬. অপরকে কুরআন পড়া শেখানো :
রামাদান মাস অপরকে কুরআন শেখানোর উত্তম সময়। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’’ (সহীহ আল-বুখারী : ৫০২৭)
‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দিবে, যত তিলাওয়াত হবে তার সাওয়াব সে পাবে’ (সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবুবিয়্যাহ : ০৭)
ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে : জিবরাইল আলাইহিস সালাম রামাদানের প্রতি রাতে রামাদানের শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল তাকে কুরআন শোনাতেন। (সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২)
ইবনে হাজার রাহেমাহুল্লাহ্ বলেন : জিবরাইল প্রতি বছর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এক রামাদান হতে অন্য রামাদান অবধি যা নাযিল হয়েছে, তা শোনাতেন এবং শুনতেন। যে বছর রাসূলের অন্তর্ধান হয়, সে বছর তিনি দু বার শোনান ও শোনেন ।
১৭. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা :
এটি কুরআনের মাস। তাই এ মাসে অন্যতম কাজ হলো বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলের সাথে কুরআন পাঠ করতেন। তার সীরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা, বুঝা এবং আমল করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’’ (সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১০, সহীহ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদান ব্যতীত কোন মাসে এত বেশি তিলাওয়াত করতেন না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘‘রামাদান ব্যতীত অন্য কোনো রাত্রিতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোযা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখি নি’’ (সহীহ মুসলিম : ১৭৭৩)
ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “জিবরীল রামাদানের প্রতি রাতে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন”। (সহীহ বুখারী : ৩০৪৮)
১৮. কুরআন বুঝা ও আমল করা:
কুরআনের এ মাসে কুরআন বুঝা ও আমল করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা।
এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে : ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’। (আ‘রাফ : ৩)
কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : ‘আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম’। (শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০)
১৯. রামাদান মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় :
এ মাসে জান্নাতে দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। আর এ কাজগুলো রামাদানের প্রতিরাতেই সংঘটিত হয় এবং শেষ রামাদান পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রামাদান মাস এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।’ (সহীহ বুখারী : ১৮০০; সহীহ মুসলিম)
২০. দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা :
রামাদান মাস হচ্ছে দ্বীনের দাওয়াতের সর্বোত্তম মাস। আর মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকাও উত্তম কাজ। এজন্য এ মাসে মানুষকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসার জন্য আলোচনা করা, কুরআন ও হাদীসের দারস প্রদান, বই বিতরণ, কুরআন বিতরণ ইত্যাদি কাজ বেশি বেশি করা।
আলকুরআনের ঘোষণা : ‘‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি একজন মুসলিম’’। (হা-মীম সাজদাহ : ৩৩)
আল্লাহ তা‘আলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ততঃ তারাই হল সফলকাম’। (ইমরান : ১০৪)
আল্লাহ বলেন, ‘যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনান। আর যিনি তোমাদের পবিত্র করেন এবং তোমাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না’। (বাক্বারাহ : ১৫১)
পবিত্র কুরআনের অমিয় বাণী,‘হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। যদি না দাও, তাহলে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলে না’। (মায়েদাহ : ৬৭)
হাদীসে এসেছে : ‘‘ভাল কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’। (সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি (দাওয়াতের মাধ্যমে) ইসলামের একটি উত্তম সুন্নাত চালু করবে সে তার নেকী পাবে এবং ঐ সুন্নাতের প্রতি মানুষ আমল করে যত নেকী পাবে, তাদের সমপরিমাণ নেকী তার আমলনামায় লেখা হবে। তবে তাদের কারো নেকী কম করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ আমল চালু করবে, সেজন্য তার পাপ রয়েছে। আর ঐ মন্দ আমল করে যত লোক যে পরিমাণ পাপ অর্জন করবে সবার সমপরিমাণ পাপ তার আমলনামায় লেখা হবে। তবে তাদের কারো পাপ এতটুকুও কম করা হবে না’। (মুসলিম, মিশকাত : ২১০ ‘ইলম’ অধ্যায়)
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে আহবান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তিদের সমপরিমাণ নেকী রয়েছে। কিন্তু তাদের নেকী থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস করা হবে না। অপরদিকে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তিদের সমপরিমাণ পাপ রয়েছে। কিন্তু তাদের পাপ থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস করা হবে না’। (মুসলিম : ৬৯৮০; মিশকাত : ১৫৮)
২১. এ মাস দোয়া কবুলের মাস :
রামাদানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পুর্ণ সদ্ব্যবহার করা দোয়া, যিকির ও ইস্তেগফরের মাধ্যমে। কেননা রামাদান মাস দোয়া কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়। তাই রোযাদার ব্যক্তির বেশি বেশি দোয়া করা। কারণ, রোযাদার ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়ার বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রামাদানের প্রতি দিন ও রাতে জাহান্নাম থেকে আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে (যা সে রামাদান মাসে করে থাকে)।’ (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৭৪৫০)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ইফতারের সময় দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। তাই ইফতারের সময় সকলেরই উচিত অধিক পরিমান দোয়া করা। (ইবনে মাজাহ : ১৭৫৩)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয়না (১) রোযাদারের দোয়া ইফতার করা পর্যন্ত, (২) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের দোয়া, (৩) মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তা’য়ালা দোয়া মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসামানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আল্লাহতা’য়ালা বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই ক্বদরে সাহায্যে করব। (মুসনাদে আহামাদ : ৯৭৪৩,জামে আত-তিরমিযি : ৩৫৯৮, ইবনে হিব্বান : ৩৪২৮ ও ইবনে মাজাহ : ১৭৫২)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে তখন আল্লাহ তা’য়ালা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন কে আমাকে ডাকছ আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে প্রার্থনা করছ আমি তাকে দান করব। কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (সহীহ বুখারী : ১১৪৫, সহীহ মুসলিম : ৭৫৮)
২২. এ মাস সবর বা সহিষ্ণুতার মাস :
আল্লাহ বলেন, ‘ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও; নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (বাকারা : ১৫৩)
হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও’। (ইমরান : ২০০)
নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম নিশ্চয় তারাই হল সফলকাম’ (মুমিনূন : ১১১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এ হাদীসে রামাদান মাসকে সবরের মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : "সবরের মাসে রোযা রাখা, প্রত্যেক মাসে তিনদিন রোযা রাখা ও সাপ্তাহে সোমাবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখা অন্তরের অস্থিরতা দূর করে থাকে।" (আলবানী বলেন হাসান : ১৭০৩৩)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুমিনকে যেকোনো বিপদই স্পর্শ করুক না কেন আল্লাহ তার বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি (চলতি পথে) পায়ে যে কাঁটা বিদ্ধ হয় (তার বিনিময়েও গুনাহ মাফ করা হয়)’। (বুখারী ও মুসলিম)।
ইমাম জায়নুল আবেদীন (রহ.) ধৈর্যশীলদের মর্যাদা ও ফযিলত সম্পর্কে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে কাসির তার তাফসিরে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। ‘কেয়ামতের দিন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, ধৈর্যশীলরা কোথায়! আপনারা বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যান। ঘোষণা শুনে একদল লোক বেহেশতের পথে রওনা করবে। ফেরেশতারা বলবে, আপনারা কারা? কোথায় যাচ্ছেন? তারা বলবে, আমরা ধৈর্যশীল বান্দা; জান্নাতে যাচ্ছি। ফেরেশতারা বলবে, এখনো তো হিসাব-নিকাশ হয়নি। ধৈর্যশীল বান্দারা বলবে, আমাদের হিসাবের আগেই জান্নাতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এবার ফেরেশতারা বলবে, তাহলে আপনারা তো খুবই মর্যাদাবান ও আমলদার বান্দা। আপনাদের সেই আমল সম্পর্কে বলুন যার বিনিময়ে এ গৌরবময় ফলাফল অর্জন করেছেন। তারা বলবে, দুনিয়ার জীবনে আমরা সবরের জীবনযাপন করেছি। আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে ও আল্লাহর বিধান মানতে গিয়ে অনেক ধরনের ত্যাগ ও বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। এর বিনিময়ে আমরা কখনো অভাব-অভিযোগ করিনি। সবসময় ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। এসব শুনে ফেরেশতারা বলবে, মারহাবা! আপনাদের আমলের যথার্থ প্রতিদানই আপনারা পেয়েছেন।’ এদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘ধৈর্যশীলদের তাদের প্রতিদান বিনা হিসাবে দেওয়া হবে।’ (জুমার : ১০)।
২৩. মিসওয়াক করা :
মেসওয়াকের মাধ্যমে দাঁত পরিস্কার করা আল্লাহ তা’আলার নিকট অত্যান্ত পছন্দনীয় কাজ। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিশেষ যতœবান ছিলেন এবং উম্মতকে অনেক তাকিদ দিয়েছেন।
এ প্রসংগে হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এমনটি কখনো হয়নি যে, জিবরাইল (আ:) আমার নিকট এসেছেন আর আমাকে মেসওয়াকের আদেশ দেননি। এতে আমার আশংকা হচ্ছিল যে, (মেসওয়াকের কারণে) আমার মুখের অগ্রভাগ ছিলে না ফেলি। (আল মুযামুল কাবীর লিত তবারানী : ৭৮৪৭, মুসনাদে আহমদ : ২২২৬৯)
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি যদি উম্মতের উপর (কষ্ট হবার) আশংকা না করতাম তাহলে প্রত্যেক নামাজেই মেসওয়াক করার আদেশ দিতাম। (বুখারী : ৮৮৭, মুসলিম : ২৫২)
এব্যপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মেসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায় (নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ৫)
অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মেসওয়াক করে যে নামাজ আদায় করা হয়, সে নামাজে মেসওয়াকবিহীন নামাজের তুলনায় সত্তরগুন বেশী ফযীলত রয়েছে। (শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী : ২৫১৯)
হাদীসে এসেছে : অর্থাৎ মেসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী, এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রেখেও মেসওয়াক করতেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। (সহীহ ইবন খুযাইমাহ : ১৩৫)

২৪. শুকরিয়া আদায় করা :
রামাদান মাস পাওয়া এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। সেজন্য আল্লাহ তা‘আলার বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা এবং আগামী রামাদান পাওয়ার জন্য তাওফীক কামনা করা। রামাদান সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে : ‘‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’’ (বাকারাহ : ১৮৫)
‘‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন’। (ইবরাহীম : ৭)
যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (ইবরাহিম : ৭)
আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজ কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। (লোকমান : ১২)
অতএব, আল্লাহ তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র বস্তু দিয়েছেন, তা তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাতকারী হয়ে থাকো। (নাহল : ১১৪)
সুতরাং এ কথা স্মরণযোগ্য যে, বান্দা যদি আল্লাহর নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করে এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকে তবে আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি নিয়ামাত আরো বাড়িয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট্ট একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়, ‘যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাওফিক প্রাপ্ত হয়, সে ব্যক্তি আল্লাহর নিয়ামাত ও বরকত বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয় না।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করে বলতেন অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য (সুনান আত-তিরমিযী : ২৭৩৮)
২৫. কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা :
এ মাসটিতে একটি ভাল কাজ অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। সেজন্য যথাসম্ভব বেশি বেশি ভাল কাজ করতে হবে। নেক আমল, কল্যাণকর কাজ ও সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়া, প্রতিযোগিতা করা মহান আল্লাহর একটি নির্দেশ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘সুতরাং তোমরা কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা কর।’ (বাকারা : ১৪৮)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন : ‘আর তোমরা দ্রæত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’ (ইমরান : ১৩৩)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন : “তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছ না? অথচ আসমানসমূহ ও পৃথিবীর উত্তরাধিকারতো আল্লাহরই? তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আর তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত”। (হাদীদ : ১০)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তা’য়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’’। (তিরমিযী : ৬৮৪)
২৬. সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া :
রামাদান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রামাদানের কারণে আরো বেশি ফযিলত রয়েছে। যেহেতু সাহরী খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রামাদান মাসে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে। হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’। (সহীহ মুসলিম : ২৮১২)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে বলতে শুনেছি ফরয নামাযের পরে সর্বোত্তম নামায হলো রাতের নামায। (অর্থৎ তাহাজ্জুদ) সহীহ মুসিলম : ১১৬৩, মুসনাদে আহমদ : ৮৫৩৪ ও জামে আত-তিরমিযি : ৪৩৮)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : রামাদানের প্রথম রাতে বেহেশতের সকল দরজা উম্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং রামাদান শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। যদি কোন মোমনে পুরুষ বা মহিলা এই রাতে নামায পড়ে তবে প্রত্যেক সেজদাহর পরিবর্তে এক হাজার সাতশত পূণ্য দান করা হয়। আর তার জন্য লাল ইয়াকুত দ্বারা বেহেশতে প্রাসাদ তৈরী করা হবে। প্রত্যেক প্রাসাদের স্বর্ণের তৈরী সত্তর হাজার দরজা থাকবে। দরজাগুলো ইয়াকুত দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে।
২৭. আল্লাহর রাস্তায় বেশী বেশী দান ও সদকা করা :
আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সব সময় যাতে সামর্থবান ব্যক্তিবর্গ এ ইবাদাত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম। আর রামাদান মাসে এ ইবাদাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন।
আল কুরআনে এভাবে বিবৃত হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজ দানার মতো, যা সাতটি শীষ উৎপন্ন করল, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশত দানা, অবশ্যই আল্লাহপাক যাকে চান তার জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহপাক প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ। (বাকারাহ : ২৬১)।
মহান রাব্বুল আলামীন সতর্ক করে আল কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করো এবং নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না। আর তোমরা সৎকর্ম করো। নিশ্চয়ই আল্লাহপাক সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। (বাকারাহ : ১৯৫)।
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উহুদ পরিমাণ স্বর্ণও যদি আমার নিকট থাকে তাহলে তিন রাত অতিবাহিত হওয়ার পরও তার সামান্য কিছু আমার অবশিষ্ট থাকুক, তা আমি পছন্দ করি না। তবে হ্যাঁ, দেনা পরিশোধের জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু রেখে বাকিটুকু আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেবে।’ (সহীহ বুখারী : ৮/৬৪৪৫)।
ইমাম বুখারী ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রামাদান মাসে যখন জিবরীল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন.....। জিবরীলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন”। (সহীহ বুখারী : ৩০৪৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার মানুষ অপেক্ষা অধিক দাতা ছিলেন। রামাদানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত। (সহীহ আল বুখারী : ১৯০২)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি জিনিস দান করবে তাকে জান্নাতের দরজা থেকে এই বলে ডাকা হবে : হে আল্লাহর বান্দা! এই যে এই দরজাটি তোমার জন্য ভালো। কাজেই নামাযীদেরকে নামাযের দরজা হতে ডাকা হবে। মুজাহিদদেরকে ডাকা হবে জিহাদের দরজা হতে। রোযাদারকে ডাক হবে রাইয়্যান নামক দরজা হতে। দাতাদেরকে ডাকা হবে সদাকার দরজা হতে। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! আমার বাপ মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, কোন ব্যক্তিকে কি এ সবগুলো দরজা থেকে ডাকা হবে..? যদিও এর কোন প্রয়োজন নেই। জবাব দিলেন হ্যাঁ। আর আমি আশা করি তুমি সবগুলোতে অনর্তভুক্ত হবে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
২৮. উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা :
দ্বীন ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর খাঁটি বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলা। ইবাদত বন্দেগী একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত করা এবং তার পাশাপাশি উত্তম আচার ব্যবহার অবলম্বনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমরা নামায রোযার ন্যায় উত্তম চরিত্র ও আচার ব্যবহারকেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল হিসেবে তেমন গুরুত্ব দেই না। সময় পেলে আমরা একটু নফল ইবাদতের চেষ্টা চালালেও উত্তম আচার ব্যবহার অর্জনের চেষ্টায় তেমন তৎপর নই। দুর্ব্যবহার ও অশালীন আচরণ দূর করে ভদ্রতা-ন¤্রতা অর্জনের চেষ্ট করি না। অথচ আমাদের নেকির পাল্লা ভারী করতে উত্তম আচরণ খুবই প্রয়োজন। আর উত্তম আচরণ শিখার জন্য আমাদের মাঝে আল্লাহ তা’আলা তার প্রিয় নবীকে প্রেরণ করেছেন। রামাদান মাস নিজকে গঠনের মাস। এ মাসে এমন প্রশিক্ষণ নিতে হবে যার মাধ্যমে বাকি মাসগুলো এভাবেই পরিচালিত হয়। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও তার উম্মতের প্রতি উত্তম আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর আমাদের প্রিয় নবী ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-‘নিশ্চয়ই আপনি উত্তম নৈতিক চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’। (আল-ক্বালাম : ৮)
কথাবার্তা ও মৌখিক আচরণে একজন মু’মিনকে কিভাবে শালীন হতে হবে সে ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-‘মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথাবার্তা বলো।’ (বাকারা : ৮৩)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলের আখলাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, কুরআন মাজিদই হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক। (বুখারী : ১২৬) অর্থাৎ রাসূলের গোটা জীবন ছিল কুরআন মাজিদের ব্যবহারিক তাফসীর।
নবী করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-‘তোমার ভাইয়ের সাথে মুচকি হাসির বিনিময় করাও সাদকার সওয়াব হয়ে যায়’। (তিরমিযী)।
নবী করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-‘সবচেয়ে ঈমানদার হচ্ছে ঐ লোক যার চরিত্র সর্বোত্তম। আর তোমাদের মধ্যে সে লোক সর্বোত্তম যে তাদের স্ত্রী-পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণে অভ্যস্ত’। (আহমদ/তিরমিযী)
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো কোন আমল মানুষকে বেশি বেশি করে জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন-‘আল্লাহ ভীতি ও উত্তম চরিত্র’। আবার তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো-কোন আমল মানুষকে বেশি বেশি করে জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন-‘মুখ (বচন) ও গোপন অঙ্গ (যিনা/ব্যভিচার)’। (তিরমিযী)
শুধু তাই নয়, উত্তম চরিত্র ও আচার ব্যবহার এত উত্তম আমল যে, চরিত্রবান মু’মিনরাই পরকালে নবী করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একান্ত সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পাবেন। তিনি এরশাদ করেন-‘তোমাদের মধ্যে ঐসব লোকেরাই আমার কাছে সবচেযে বেশি প্রিয় এবং ক্বিয়ামতের দিন আমার অতি নিকটে আসন পাবে, যাদের চরিত্র ও আচার ব্যবহার উত্তম’। (তিরমিযী)
আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা লোকমানে উত্তম চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে লোকমান (আ:) তার সন্তানকে উত্তম আচরণ করতে আদেশ করেছেন। গর্ব ও অহংকার করে জমিনে বিচরণ করতে নিষেধ করেছেন।
উত্তম চরিত্র ও আচার-আচরণ অর্জনের জন্য আল্লাহ তা’য়ালার কাছে দোয়া করতেন স্বয়ং আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি যে দোয়া করতেন তার মর্মার্থ হচ্ছে-‘হে আমার প্রভু! আমাকে উত্তম চরিত্রের পথে ধাবিত করুন। আপনি ছাড়া আর কেউ সেদিকে ধাবিত করার নেই। আর আমাকে অসৎ চরিত্র ও আচরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। আপনি ছাড়া তা থেকে দূরে সরানোর আর কেউ নেই।’


২৯. আল্লাহর যিকর করা :
মানসিক প্রশান্তির জন্য জিকির এক মহৌষধ। জিকির ছেড়ে দিয়ে দুনিয়ার জীবনে ভাল থাকা যায় না। শয়তানের ধোকা থেকে বাচার রক্ষামন্ত্র হল এই জিকির। জিকির ছেড়ে দিলে বান্দা আল্লাহর জিম্মাদারী থেকে বেড়িয়ে যায়। যার কলবে আল্লাহর জিকির জারি থাকে সেখানে শয়তান থাকতে পারেনা। জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় আর জিকির বিমূখতায় আল্লাহর সাথে বান্দার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আল্লাহর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া মানব জীবনের বড় ব্যার্থতা। নিজেকে এমনভাবে জিকিরে অভ্যস্ত করা উচিত যাতে মৃত্যুর সময় জবানে জিকির জারি থাকে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন-সকাল-সন্ধ্যায় আপন মনে তোমার রবের জিকির করো বিনয় ও ভয় নিয়ে, অনুচ্চ আওয়াজে এবং গাফেল হয়ে থেক না (আরাফ : ২০৫)।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর যাতে তোমরা সফল হতে পার।’ (আনফাল : ৪৫)
আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।’ (রাআদ : ২৮)।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।’ (ত্বহা : ১২৪)।
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সহচর।’ (জুখরুফ : ৩৬)।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত।’ (মুনাফিকূন : ৯)।
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (বুখারী : ৬০৪৪)।
সাহাবিদের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন উত্তম আমলের কথা বলে দিব না? যা তোমাদের প্রভুর নিকট অত্যন্ত পবিত্র, যা সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন, এবং স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যয় করা অপেক্ষা উত্তম আর শক্রর মোকাবিলায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের ঘাড়ে আঘাত করা আর তারা তোমাদের ঘাড়ে আঘাত করার চেয়েও উত্তম? সাহাবাগণ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, ‘তা হলো আল্লাহ তা’য়ালার জিকির।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৭৯০)।
একবার হযরত মুআজ বিন জাবাল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসুল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ‘মৃর্ত্যুর সময় যেন তোমার জিহŸা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত থাকে।’ (মুজামুল কাবীর : ১৮১)।
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।’ বলবে, সে দশটি গোলাম আযাদ করার সমান সাওয়াব লাভ করবে। আর তার নামে লেখা হবে ১০০ টি সাওয়াব এবং তার আমল থেকে ১০০ টি গুনাহ মুছে ফেলা হবে। আর সে সেদিন সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত শয়তানের ধোকা থেকে মুক্ত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন কেউ তার চেয়ে ভালো আমল আনতে পারবে না, একমাত্র সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে তার থেকে বেশি নেক আমল করেছে।’ (বুখারী : ৬০৪০)।
প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘শয়তান আদম সন্তানের কলবে জেঁকে বসে থাকে যখনই আল্লাহর যিকির করে ছিটকে পড়ে এবং যখনই কলবের জিকির বন্ধ থাকে সে কুমন্ত্রনা দেয়।’ (মুসান্নাফে আবি শায়বাহ : ৩৫৯১৯)।
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার ‘আল হামদুলিল্লাহ’ ৩৩ বার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়ে এবং ১০০ বার পূর্ণ করার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ দাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ পড়ে, তার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনাপুঞ্জের সমতুল্য হয়। (মুসলিম : ১৩৮০)।
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘আল্লাহ তা’আলা চারটি বাক্যকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন, তাহলো যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে পড়বে, তার জন্য ত্রিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়’’। (মুসনাদ আহমাদ : ১১৩৪৫, সহীহ মুসলিম) বাক্য চারটি হলো-
১। সুবহানাল্লাহ - আল্লাহ পবিত্র।
২। আল হামদুলিল্লাহ- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
৩। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই।
৪। আল্লাহু আকবর- আল্লাহ মহান।
৩০. বেশি বেশি দোয়া ও কান্নাকাটি করা :
দো‘আ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এজন্য এ মাসে বেশি বেশি দোয়া করা ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করা। (হে নবী) তুমি বল, তোমরা একে (কোরআনকে) বিশ্বাস কর আর নাই কর, নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে (আসমানি কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে যখনই তাদের সামনে এটি পড়া হয় তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। তখন তারা বলে : ‘আমাদের প্রভু পূত-পবিত্র মহান, অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ হবে।’ আর তারা ক্রন্দন করতে করতে নত মস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে; (মূলত এ কোরআন) তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি করে।”(বনি ইসরাঈল : ১০৭-১০৯)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে সে দোযখে প্রবেশ করবে না যে পর্যন্ত দুধ স্তনে ফিরে না আসে। আর আল্লাহর পথে জিহাদের ধুলোবালি এবং দোযখের ধোঁয়া কখনো একত্রিত হবে না। (বুখারী ও মুসলিম )
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ৭ শ্রেণীর লোকদের মহান আল্লাহ সেদিন তাঁর সুশীতল ছায়াতলে স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর ছাড়া অন্য কোন ছায়াই থাকবে না। তাঁরা হলেন-
১. ন্যায়বিচারক শাসক বা নেতা।
২. মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল যুবক।
৩. মসজিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি।
৪. যে দুজন লোক একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব করে এবং এ জন্যেই আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৫. এরুপ ব্যক্তি যাকে কোনো অভিজাত পরিবারের সুন্দরী নারী খারাপ কাজে আহবান করেছে, কিন্তু সে বলে দিল, আমি আল্লাহকে ভয় করি।
৬. যে ব্যক্তি এতো গোপনভাবে দান-খয়রাত করে যে, তার ডান হাত কি দান করলো, বাঁ হাতেও তা জানতে পারলো না।
৭. এরুপ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকির করে এবং দু’চোখের পানি ফেলে (কাঁদে)। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন শিখরীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে দেখি তিনি নামায পড়ছেন এবং আল্লাহর ভয়ে কাঁদার দরুণ তাঁর পেট থেকে হাঁড়ির মতো আওয়াজ বেরুচ্ছে। (আবু দাউদ)
‘‘ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ রাববুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রামাদানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে’’। (আল জামিউস সাগীর : ৩৯৩৩)
অন্য হাদীসে এসেছে : ‘‘রামাদানের প্রতি দিবসে ও রাতে আল্লাহ তা‘আলা অনেককে মুক্ত করে দেন। প্রতি রাতে ও দিবসে প্রতি মুসলিমের দোয়া কবূল করা হয়’’ (সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ১০০২)
৩১. তাওবাহ ও ইস্তেগফার করা :
তাওবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, গুনাহের কাজ আর না করার সিদ্ধান্ত নেয়া। রামাদানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযিলতময় তাওবাহ করার উত্তম সময়। আর তাওবাহ করলে আল্লাহ খুশী হন। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা-ইসস্তেগফারের মাধ্যমে। আল-কুরআনে এসেছে :
‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাটি তাওবা; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত’’ (আত-তাহরীম : ৮)
মহান আল্লাহ বলেন : হে ঈমাদারগণ তোমরা আল্লাহর নিকট খালেস তাওবা কর নিশ্চয় তোমরা কামিয়াব হবে। (নূর : ৩১)
মহান আল্লাহ বলেন : তাঁরা বলতেন হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি, সুতরাং আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। (ইমরান : ১৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘‘হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর আমি দিনে তাঁর নিকট একশত বারের বেশি তাওবাহ করে থাকি’’। (সহীহ মুসলিম : ৭০৩৪)
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রামাদানের প্রতি দিন ও রাত্রে জাহান্নাম তেকে আল্লাহর কাছে বহুবান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে যা সে রামাদান মাসে করে থাকে (মুসানাদে আহমদ : ৭৪৫০)
তবে তাওবাহ ও ইস্তেগফারের জন্য উত্তম হচ্ছে, মন থেকে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়া, আর তা হচ্ছে ‘‘হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া প্রকৃত এবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার গোলাম আর আমি সাধ্যমত তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকারের উপর অবিচল রয়েছি। আমার কৃত-কর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে যত নেয়ামত দিয়েছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করছি। যত অপরাধ করেছি সেগুলোও স্বীকার করছি। অত:এব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’’
ফযিলাত : ‘‘যে কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলা এই দু‘আটি (সাইয়েদুল ইসতিগফার) পাঠ করবে ঐ দিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে এবং যে কেউ ইয়াকিনের সাথে রাত্রিতে পাঠ করবে ঐ রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে।’’ (সহীহ আল-বুখারী : ৬৩০৬)
সুনানে আবু দাউদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত ইস্তেগফারটি পড়বে তাকে মাফ করে দেওয়া হবে যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে (অর্থাৎ ভয়াবহ কোন গুনাহ করলেও তাকে মাফ করে দেওয়া হবে)। (আবূ দাউদ : ১৫১৯; তিরমিজী : ৩৫৭৭)
ইস্তেগফারটি এই- আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযী লাইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়াতুবু ইলাইহি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পূর্বে ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ হওয়া সত্তেও বেশি বেশি ইস্তেগফার করতেন।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৈনন্দিন একশতের উপরে ইস্তেগফার পড়তেন। (আবু দাউদ)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তকালের পূর্ব মূহূর্তে বেশি বেশি ইস্তেগফার করে পড়তেন : সুবহান্নালিহি ওয়াবেহামদিহি আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া তুবু ইলাইহি। (বুখারী ও মুসলিম)।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অধিক এ দোয়া পড়তে কাউকে দেখিনি : আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়াতুবু ইলাইহি। (নাসায়ী)
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ নামাজের পর তিন বার পড়তেন- আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ এর পর অন্যান্য মাসনূন দোয়া গুলো পড়তেন।
দৈনন্দিন ইস্তেগফার করা এটা আম্বিয়া কেরামগণের পাশাপাশি আল্লাহর ওয়ালি বা যুগে যুগে আসা উম্মাহর রাহবারদেরও সুন্নাত বা তরিকা ছিল।
হযরত হাসান (রহ.) বলেন : তোমরা নামাজকে শেষ রাত্রি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাও অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।
৩২. তাকওয়া অর্জন করা :
তাকওয়া এমন একটি গুণ, যা বান্দাহকে আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করে। আর রামাদান মাস তাকওয়া নামক গুণটি অর্জন করার এক বিশেষ মৌসুম। কুরআনে এসেছে : ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা এর মাধ্যমে তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো’’। (বাকারাহ : ১৮৩)
হ ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে যে, সে আগামী দিনের জন্য কি সামগ্রীর ব্যবস্থা করে রেখেছে। আল্লাহকেই ভয় করতে থাক। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সেসব আমল সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা কর।’ (হাশর : ১৮)
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর, তাকে যেরূপ ভয় করা উচিত। তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (ইমরান : ১০২)
যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। (তালাক : ০২)
“হে লোক সকল তোমরা ইবাদত কর তোমাদের রবের যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা তাক্বওয়াবান হতে পার।” (বাক্বারা : ২১)
আল্লাহ্ বলেন: “যারা ঈমান এনেছে এবং তাওক্বওয়া অর্জন করেছে তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ দুনিয়া এবং আখেরাতে।” (ইউনুস : ৬৩-৬৪)
আল্লাহ্ বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ তাদের সাথে থাকেন, যারা আল্লাহ্কে ভয় করে এবং যারা সৎকর্ম করে।” (নাহাল : ১২৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, “যে বিষয় মানুষকে সবচেয়ে বেশী জান্নাতে নিয়ে যায় তা হল, তাকওয়া এবং উত্তম ব্যবহার; আর যে বিষয় মানুষকে সবচেয়ে বেশী জাহান্নামে নিয়ে যায় তা হল, জিহŸা এবং লজ্জাস্থান।” (তিরমিযী)
তাফসির ইবনে কাছিরে উল্লেখ আছে যে, আতিয়াহ্ আস সাদী হতে বর্ণিত রাসুল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাক্বী হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে, সে সব সন্দেহযুক্ত বিষয় ত্যাগ না করে, যার মাধ্যমে হারামে পতিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।” (ইবনে মাযাহ, তিরমিযী)
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কা’ব (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কখনও কণ্টকময় পথে হেঁটেছেন?” হযরত উমর (রাঃ) হ্যাঁ বললে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি সেই পথ কিভাবে পার হন?” হযরত উমর (রাঃ) উত্তরে বললেন যে তিনি খুব সন্তর্পনে নিজের কাপড় গুটিয়ে সেই রাস্তা পার হন যেন কোন ভাবেই কাঁটার আঘাতে কাপড় ছিঁড়ে না যায় অথবা শরীরে না বিঁধে। হযরত কা’ব উত্তরে বললেন যে, এটাই হল তাকওয়া। দুনিয়ার জীবনে নিজেকে সমস্ত গুনাহ থেকে এভাবে বেঁচে চলাই হল তাকওয়া।
৩৩. ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা :
মানুষের বাস্তব জীবনে সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণ দুনিয়া ও পরকালের সফলতার একমাত্র পথ। ফজরের মাধ্যমে মানুষের দিন শুরু হয়। দিনের শুরুতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামায়াতের সঙ্গে ফজর নামাজ আদায় করতেন। ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করতেন। এটি একটি বিরাট সওয়াবের কাজ।
এ বিষয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,: যে ব্যক্তি ফজর জামাআত আদায় করার পর সূর্য উদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করবে, অতঃপর দুই রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে একটি পরিপূর্ণ (মকবুল) হজ্জ ও একটি উমারাহ করার প্রতিদান পাবে। (সুনান আত-তিরমিযী : ৫৮৬)
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ফজরের নামাজের পরে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে রত কিছু মানুষের সঙ্গে বসে থাকা আমার কাছে ইসমাইল আলাইহি সালামের বংশের ৪ জন ক্রীতদাসকে মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়।
৩৪. ফিতরাহ দেয়া :

এ মাসে সিয়ামের ক্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে ফিতরাহ দেয়া আবশ্যক।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ফিতরার যাকাত রোযাদারকে বেহুদা অবাঞ্ছনীয় ও নির্লজ্জতামূলক কথা বার্তা বা কাজ কর্মের মলিনতা হতে পবিত্র করার এবং গরীব মিসকিনদের (ঈদের দিনের উত্তম) খাদ্যের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে অবশ্য আদায় যোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। যে লোক তা ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করবে, তা ওয়াজিব সাদাকত বা সাদাকাহ হিসাবে আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে। আর যে লোক তা ঈদের নামাযের পর আদায় করবে, তা সাধারণ দান রুপে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাযাহ)
ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাত আদায়ের পুর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী : ১৫০৩)
৩৫. রামাদান মাসে শয়তানকে শৃঙ্খল বন্ধ করা হয় :
রামাদান মাসে আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানী প্রত্যক্ষ করা যায়। তিনি বান্দার রোযা হেফাজত করেন এবং শয়তানদের বন্দি করে রাখেন, যাতে সে এ পবিত্র মাসে বান্দার এবাদাত নষ্ট না করতে পারে।
রমজান মাসে অধিকহারে ইবাদতের কারণে ঈমানদারের সামনে শয়তানের বেশিরভাগ কুমন্ত্রণাই তখন বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। ইবাদাতের মাধ্যমে বহুল আকাঙ্খিত জান্নাত লাভের সহায়কের জন্য শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন রমজান উপস্থিত হয়, জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুষ্ট শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়।’ (মুসলিম : ১০৭৯)
৩৬. সকলপ্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা :
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদান মাসে অন্য মাসের চেয়েও বেশী বেশী ইবাদাত করতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (রহ.) বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ ছিল রামাদান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশী বেশী করা। তিনি ছিলেন সবচেয়ে দানশীল এবং রামাদানে আরো বেশী দানশীল হয়ে যেতেন, কেননা এ সময়ে তিনি সদকা, ইহসান ও কুরআন তেলাওয়াত, নামায, যিকর ও ইতেকাফ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদাত অধিক পরিমাণে করতেন। তিনি রামাদানে এমন বিশেষ ইবাদাত সমূহ পালন করতেন যা অন্য মাসগুলোতে করতেন না। (যাদুল মাআ‘দ : ১/৩২১)
৩৭. আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত করা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তা রক্ষা করাও একটি ইবাদাত। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর শাস্তি শুধু আখেরাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জগতেই শাস্তি পেতে হবে। কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে আল্লাহ তা’য়ালাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘‘আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আরও তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। (নিসা : ১)
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কঠোর শাস্তি সম্পর্কে মহানবী হজরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসে বর্ণনা এসেছে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে মহানবী ঘোষণা দিয়েছেন।
হযরত যুবাইর ইবনে মুতইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহীহ বোখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়াতে যে (দুই) অপরাধের শাস্তি আল্লাহ তা’য়ালা অত্যন্ত দ্রæত কার্যকর করে থাকেন এবং আখেরাতেও এর শাস্তি অব্যাহত থাকবে, সে দু’টি অপরাধ হলো-ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। (জামে তিরমিজি)
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন হযরত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতা’য়ালা বলেন, ‘আমি রহমান। আমি আত্মীয়তার জন্য আমার নাম থেকে একটি নাম বাছাই করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’ (সুনানে আবু দাউদ)
হযরত আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “সালাম বিমিয়ের মাধ্যমে হলেও আতœীয়তার সম্পর্ক তরতাজা রাখ।” (সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবওয়িয়্যাহ : ১৩)
৩৮. রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন :
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, ‘বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দেবো।’ (সহীহ বুখারী : ১৮০৫)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “বান্দার প্রত্যেক আমল দশগুণ হতে সাতশতগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো। কারণ সে আমারই উদ্দেশ্যে তার যৌনাচার এবং পানাহার পরিত্যাগ করে। রোজাদার ব্যক্তির জন্য দুটি খুশি। এক. ইফতারের সময় আর অপরটি হল তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত। রোজার কারণে মুখে যে দুর্গন্ধ হয় তা আল্লাহর নিকট কস্তুরির সুঘ্রাণের তুলনায়ও বেশি উত্তম”। (মুসলিম শরীফ)
৩৯. রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমা লাভের কারণ :
যে ব্যক্তি মাহে রামাদানের একটি রোজাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাখেন তার জন্য জাহান্নামকে অনেক দূরে রাখা হবে। এভাবে প্রত্যেকটি রোজা যদি পালন করা হলে তাহলে তার জন্য ¯্রষ্টার পক্ষ থেকে কত নিয়ামত রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবসহ রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুণাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী : ৩৮, সহীহ মুসলিম : ৭৬০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (সহীহ বুখারী : ১৯১০)
হযরত সালমা ইবনে কায়সার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির জন্য একদিনের রোজা পালন করেছে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে এতদূরে রাখবেন, যেমন একটা কাক (শৈশব থেকে) বুড়া হয়ে মরে যায়।’ (মুসনাদে আবী ইয়ালা, ১ম খন্ড, ৩৮৩ পৃষ্ঠা, হাদীস-৯১৭)
হযরত হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন ওমর (দ্বিতীয় খলিফা) বললেন, ফিতনা সম্পর্কিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসটি কার মুখস্থ আছে? তখন হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, পরিবার, ধন সম্পদ এবং প্রতিবেশিই মানুষের জন্য ফিতনা। আর সালাত, সিয়াম (রোজা) এবং সদকা গুনাহের জন্য কাফফারা হয়ে যায়। (বুখারী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন, আর আমি কিয়ামুল লাইল অর্থাৎ তারাবীহ’র নামাযকে সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম ও কিয়াম আদায় করবে, সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন সে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৬৬০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস-৭৭৮৭, মুসনাদে বাযযার, হাদীস-১০৪৮, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস-২২০১, সুনানে নাসায়ী, হাদীস-২৫১৮)
৪০. রোযা জান্নাত লাভের পথ :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহীহ বুখারী : ১৭৯৭)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন রামাদান মাস আসে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়া, জাহান্নামের দরজাগুনে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। (সহীহ আল বুখারী : ১৮০০; সহীহ মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল¬াহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “তোমাদের মধ্যে আজ কে সাওম পালন করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তোমাদের মধ্যে আজ কে জানাযার অনুসরণ করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তোমাদের কে আজ মিসকীনকে খাদ্য দান করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ রুগীর সেবা করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। অতঃপর রাসূল সাল¬¬ল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল¬া¬ম বললেন : উপরোক্ত গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে একত্রিত হবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
৪১. রোযা ও কুরআন রোযাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে :
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেইনি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদ : ৬৬২৬, সুনানে বায়হাকী ও শুয়াবল ঈমান)
৪২. রোযা জান্নাত লাভের ও জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তার এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরি করেন।’ (সহীহ বুখারী : ১৮৯৪)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ কোনোদিন সিয়াম পালন করলে তার মুখ থেকে যেন অশ্লীল কথা বের না হয়। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে অথবা ঝগড়ায় প্ররোচিত করতে চায় সে যেন বলে, আমি সায়িম বা রোযাদার। (সহীহ বুখারী : ১৮৯৪, সহীহ মুসলিম : ১১৫১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহীহ বুখারী : ১৭৯৭)
হযরত সাহল বিন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাতের একটি দরজা আছে, একে রাইয়ান বলা হয়, এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র সায়িম ব্যক্তিই জান্নাত প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ এই পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে আহবান করা হবে সায়িমগণ কোথায়? তারা যেন এই পথে প্রবেশ করে। এভাবে সকল সায়িম ভেতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অত:পর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করেবে না। (সহীহ বুখারী : ১৮৯৬, সহীহ মুসলিম : ১১৫২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (রামাদনের) প্রতিদিন ও প্রতিরাতে বহু মানুষকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে থাকেন এবং প্রতিটি রাত ও দিনের প্রত্যেক মুসলিমের দোয়া ও মুনাজাত কবুল করা হয়ে থাকে। (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন রামাদান মাস আসে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়া, জাহান্নামের দরজাগুনে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। (সহীহ আল বুখারী : ১৮০০; সহীহ মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল¬াহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “তোমাদের মধ্যে আজ কে সাওম পালন করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তোমাদের মধ্যে আজ কে জানাযার অনুসরণ করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তোমাদের কে আজ মিসকীনকে খাদ্য দান করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল¬াল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ রুগীর সেবা করেছো? আবু বকর রাদিয়াল¬াহু আনহু বললেন, আমি। অতঃপর রাসূল সাল¬¬ল¬াহু ‘আলাইহি ওয়াসাল¬া¬ম বললেন : উপরোক্ত গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে একত্রিত হবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা ঢাল স্বরূপ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার সুরক্ষিত দুর্গ বিশেষ। রোযার বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। অন্যান্য নেক কাজের বিনিময় গুনা মাফ করা হবে। কিন্তু রোযার বিনিময়ে শুধু গুনা মাফ নয়, বরং জান্নাতে প্রবেশের উপায় হিসাবে ব্যবহার করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ)
৪৩. রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম :
হযরত আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলাল¬াহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যার হাতে আমার সত্ত¡া তার কসম, সায়েম (রোজাদার) এর মুখের গন্ধ আল্ল¬াহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে মেস্ক-আম্বার (অত্যন্ত মনোরম একটি সুগন্ধি) থেকেও উত্তম, এবং সায়েম এর খুশি দুটি, প্রথম খুশি হল যখন সে ইফতার করে, এবং যখন সে তার রব এর সাথে সাক্ষাত করবে। (সহীহ বুখারী : ১৯০৪, নাসাই, ইবন মাজাহ, আহমাদ)।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের জন্য ১০ থেকে ৭শ গুণ পর্যন্ত সওয়াব নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু মহান আল্ল¬াহ বলেন, রোজা এর ব্যতিক্রম। সে একমাত্র আমার জন্যই রোজা রেখেছে এবং আমিই নিজ হাতে এর পুরষ্কার দেবো। সে আমার জন্যই যৌন-বাসনা ও খানা-পিনা ত্যাগ করেছে। রোজাদারের রয়েছে দুইটা আনন্দ। একটা হচ্ছে ইফতারের সময় এবং অন্যটি হচ্ছে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। আল্লাহর কাছে রোজাদারের মুখের গন্ধ মেশক-আম্বরের সুঘ্রাণের চাইতেও উত্তম। (মুসলিম : ১১৫১)
৪৪. রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায় :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘রোযাদারের জন্য দু’টো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয়প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ বুখারী : ১৮০৫)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ ত’আলা বলেছেন, সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি সায়িম (রোযাদার)। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তার শপথ! অবশ্যই সায়িমের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের গন্ধের চেয়েও সুগন্ধি। সায়িমের জন্য রয়েছে দু’টি খুশি, যা তাকে খুশি করে। যখন যে ইফতার করে, সে খুশি হয় এবং যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে।
(সহীহ বুখারী : ১৯০৪, সহীহ মুসলিম : ১১৫১)
৪৫. রোযদার ব্যক্তি জাহন্নামের আগুন থেকে দূরে :
হযরত সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তাকে দোযক থেকে সত্তর বছর দূরে রাখবেন। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে আত-তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমদ)
হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে তার ও জাহান্নামের মধ্যে আল্লাহ একটি পরিখা সৃষ্টি করবেন যা আসমান ও যমীনের দূরত্বের সমান। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম ও জামে আত-তিরমিযি)
৪৬. বিনা কারনে রোযা ভঙ্গ করা :
রামাদান মাসের প্রত্যেকটি রোজা সঠিকভাবে পালন করা বান্দার জন্য ফরজ। শরিয়তের অনুমতি ছাড়া বিনা কারণে একটি রোজা ভঙ্গ করার সুযোগ নেই। শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়া রোজা ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ তো আছেই, সে সঙ্গে রোজা ভাঙ্গার পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা বোঝা যায়।
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি বিনা কারনে বিনা অসুখে রামাদান মাসের কোন একটি রোযা ভঙ্গ করে সে সারা জীবন রোযা রাখলেও তার এই রোযার কাযা আদায় হবে না। (সহীহ আল বুখারী)
রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওজর (যৌক্তিক অপারগতা) বা রোগ ব্যতীত একটি রোযা ছেড়ে দেবে সে যদি পরবর্তীতে সারাজীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। (মুসনাদে আহমদ, জামে আত-তিরমিযি ও আবু দাউদ)
হযরত আবু উমামা বাহেলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, ‎একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সহসা দু’জন লোক এসে আমার বাহু ধরে আমাকেসহ তারা এক দুর্গম পাহাড়ে আগমন করল। তারা আমাকে বলল, আরোহণ কর। আমি বললাম, আমি আরোহণ করতে পারি না। তারা ‎বলল, আমরা তোমাকে সাহায্য করব। আমি ওপরে আরোহণ করলাম। যখন পাহাড়ের চূড়ায় ‎‎পৌঁছলাম, বিভিন্ন বিকট শব্দের সম্মুখীন হলাম। আমি বললাম, এ আওয়াজ কিসের? তারা ‎বলল, এগুলো জাহান্নামীদের ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ। অতঃপর তারা আমাকে নিয়ে রওনা করল, আমি এমন লোকদের সম্মুখীন হলাম, যাদেরকে হাঁটুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের চোয়াল ‎‎ক্ষতবিক্ষত, অবিরত রক্ত ঝরছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, এরা ‎হচ্ছে সেসব লোক, যারা রোজা পূর্ণ হওয়ার আগে ভেঙ্গে ফেলত। (নাসায়ী ফিল কুবরা : ৩২৮৬, তাবরানী ফিল কাবির : ৭৬৬৭)
৪৭. যাকাত আদায় করা ঃ
ইসলামী জীবন বিধানে যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি অন্যতম স্তম্ভ। ঈমান এবং নামাযরে পরেই এর স্থান। প্রত্যেক ধনবান নর-নারীর ওপর যাকাত ফরয করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে সবচেয়ে বেশি তাগিদ এসেছে নামাজের। এরপর এসেছে যাকাতের। যাকাতের কথা পবিত্র কুরআনে অধিকাংশ স্থানে নামাজের পাশাপাশি এসেছে পবিত্র কুরআনে বিরাশি বার নামাজের তাগিদ এসেছে। তার প্রত্যেকবারই যাকাতের কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রকুকারীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে রুকু কর। (বাকারা : ৪৩)
আর তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও, যেসব নেক কাজ তোমারা নিজেদের কল্যাণার্থে এখানে (দুনিয়ার জিন্দিগিতে) করবে তার সবটুকুর প্রতিফলই আল্লাহর কাছে পাবে। (বাকারা : ১১০)
তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদকা গ্রহণ কর, যার সাহায্যে তুমি তাদেরকে গুণাহমুক্ত করবে এবং তাদেরকে পাক-পবিত্র করে দেবে। (বাইয়েনাহ : ১০৩)
অবশ্যই যাকাত পাবে তারা যারা-১. ফকির (নি:শ^লোকে), ২. মিসকিন (অভাবীরা), ৩. যাকাত আদায় ও বন্টনের কর্মচারী, ৩. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব (ইসলামের পক্ষে যাদের মন জয় করা প্রয়োজন), ৪. ব্যয় হবে দায়গ্রস্তদের দায় (ঋণ) পরিশোধ, ৫. দায়মুক্তির (দাস) জন্য ৬. ব্যয় হবে আল্লাহর রাহে এবং ৭. মুসাফিরদের জন্য। উহা আল্লাহ কর্র্তৃক নির্ধারিত ফরয। আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান (তাওবা : ৬০)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। আমি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে সম্পদের সাথে যাকাতের (সম্পদ ও টাকা পয়সা) সংমিশ্রন ঘটে তা সম্পদকে ধ্বংস করে দেয়। (সহীহ আল বুখারী)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেছেন, রাসূলে করীম (স্:া) বলেছেন: আল্লাহতা’য়ালা যাকে ধন-মাল দান করেছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে তা হলে কিয়ামতের দিন তার ধন-মাল তার জন্য অধিক বিষধর সাপের আকার ও রূপ ধঅরণ করবে। তার কাপালের উপর দুইটি কালো চিহ্ন কিংবা দুইটি দাঁত বা দুইটি শৃঙ্গ থাকবে। কিয়ামাতের দিন তা তার গলায় পেচাইয়া দেওয়া হবে। অত:পর তা তার মুখের দুই পাশ, দুই গাল কিংবতা দুই কর্নলগ্ন মাংসপিন্ড এর গোশত খাবে ও বলতে থাকবে: আমিই তোমার মাল-সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চিত বিত্তসম্পত্তি। অত:পর রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন; যারা কার্পণ্য করে তাদো সর্ম্পকে ধারণা করো না। (সহীহ আল বুখারী ও আন নাসাঈ)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে লোকই তার ধন-মালের যাকাত আদায় করবে না, তারই মাল-সম্পদ কিয়ামতের দিন বিষধর সর্পের রূপ পরিগ্রহ করবে। শেষ পর্যন্ত সে সর্পটি তার গলায় পেচাইয়া দেওয়া হবে।
৪৮. শরীয়ত যা বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে তা বর্জন করা :
শরীয়তের পক্ষ থেকে মূলত ছোট-বড় সকল গোনাহ ও পাপ সর্বদা বর্জন করার নির্দেশ এসেছে। যে ব্যক্তি কল্যাণকামী মাস মাহে রামাদান পেয়ে নিজের গুনাহ মাফ করতে পারলো না, সে হল সবচেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি। এজন্যেই রোযাদারদের উচিত তাকওয়া বিরোধী সকল প্রকার মিথ্যা কথা ও কাজ এবং সর্বপ্রকার গোনাহর কাজ পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা।
১. ূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”। (সহীহ বুখারী : ১৮০৪)। ২. অন্য আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘‘তোমাদের কেউ রোযার দিনে অশ্লীল কথা যেন না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সাথে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি রোযাদার ।’’ (সহীহ বুখারী : ১৮০৫)
৩. এ প্রসঙ্গে হাদীস, হযরত কা'ব কর্তৃক হাদীসটি বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ইরশাদ করলেন : ‘‘তোমরা মিম্বরের নিকটবর্তী হও। আমরা নিকটে গেলাম। হুযুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, ‘আমীন'। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও দু'বার আমীন বললেন। খুতবা শেষে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত বললেন, এই মাত্র হযরত জিবরাঈল (আ:) তাশরীফ এনেছিলেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তির ওপর লা'নত যে রামাদান মাস পেয়েও নিজের পাপ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি। আমি বললাম, ‘আমীন' অর্থাৎ তাই হোক। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, লা'নত ঐ ব্যক্তির ওপর যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হওয়া সত্তে¡ও দরূদ পড়েনি। আমি বললাম, ‘আমীন'। অতপর তৃতীয় সিঁড়িতে আমি পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, লা'নত ঐ ব্যক্তির ওপর যার সামনে মাতা-পিতা উভয়ই অথবা দু'জনের একজন বার্ধক্যে পৌঁছেছে কিন্তু সে তাদের সেবাকর্মে নিজেকে জান্নাতের যোগ্য করতে পারলো না। উত্তরে আমি বললাম, ‘আমীন'।
যা করণীয় নয় :
রামাদান মাসের ফযিলত হাসিল করার জন্য এমন কিছু কাজ রয়েছে যা থেকে বিরত থাকা দরকার, সেগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :
মূলত আমাদের যতগুলো গুনাহ সংগঠিত হয় নি¤েœাক্ত চারটি কাজের কারনে সংগঠিত হয়। তাই আমাদেরকে উক্ত ৪ চারটি কাজ হতে বিরত থাকতে হবে।
ক) জবানের হেফাজত করা
খ) চোখের হেফাজত করা
গ) কানের হেফাজত করা
ঘ) অঙ্গ প্রত্যঙ্গের হেফাজত করা।
এছাড়াও নিম্মলিখিত কাজগুলো থেকে বিবরত থাকতে হবে।
১. বিলম্বে ইফতার করা
২. সাহরী না খাওয়া
৩. শেষের দশ দিন কেনা কাটায় ব্যস্ত থাকা
৪. মিথ্যা বলা ও অন্যান্য পাপ কাজ করা
৫. অপচয় ও অপব্যয় করা
৬. তিলাওয়াতের হক আদায় না করে কুরআন খতম করা
৭. জামা‘আতের সাথে ফরয সালাত আদায়ে অলসতা করা
৮. বেশি বেশি খাওয়া
৯. রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা
১০. বেশি বেশি ঘুমানো
১১. সংকট তৈরি করা জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির জন্য
১২. অশ্লীল ছবি, নাটক দেখা
১৩. বেহুদা কাজে রাত জাগরণ করা
১৪. বিদ‘আত করা
১৫. দুনিয়াবী ব্যস্ততায় মগ্ন থাকা
শেষকথা :
মাহে রমজানে রোযার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা মানুষের কুটপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভেতর তাকওয়া-খোদাভীতি ও আল্লাহ প্রেম জাগ্রত করতে চান। সেই সত্য-সুন্দরের পথ তাকে সাফল্য ও মুক্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে রামাদান মাসের রোযা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, সাহারী, ইফতার, তারাবি নামাজ, সাদাকাতুল ফিতর, জাকাত, দান-খয়রাত প্রভৃতি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতরাজি, যা রোযাদারদের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। পবিত্র মাহে রামাদানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সর্বজনীন-কল্যাণের শাশ্বত চেতনায় সকল অকল্যাণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজয়ী করার পথে আমাদের এগিয়ে দিক। আল্লাহ আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফীক দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২১ সকাল ৯:৩৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×