ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকরের মৃত্যুতে আমার এক নিকট বন্ধুকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। ছেলের জন্য পড়ার খরচা যোগাতে নিজের মাথায় নারিকেল তেলটুকুও দেবার বিলাসিতাও করতেন না বকরের মা। ছুটি-ছাটায় বাড়ি গেলে এলাকার অবস্থাপন্নদের ক্ষেতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতো বকর।
সেই বকর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বেঘোরে প্রাণ হারালো। তার খাতায় লেগে রইলো রক্তের দাগ। সেই রক্তমাখা খাতার ছবি আর বকরের খরচ হয়ে যাওয়া জীবনের গাঁথা ছাপা হলো প্রথম আলোয়। সেই গাঁথা পড়ে আমার এক নিকট বন্ধু তিন দিন ধরে কেঁদেছেন। ভাতের থালা সামনে নিতেই বকরের কথা বলতে-বলতে তার কান্না উৎলে উঠেছে হেঁচকি দিয়ে।
আমারই চোখের সামনে এমন ঘটনা না হলে, আর কারো কাছে শোনা কাহিনী হিসেবে হয়তো এই গল্প আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো।
এই সেদিন চকবাজারে আগুনের ঘটনা ঘটলো। ঘটনার দুইদিন পর। তখন মাঝ রাত। বারোটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখে ফোন দিলাম।
ফোন ধরে অন্তত প্রথম কয়েক মিনিট তিনি একটা শব্দ-ও মুখে উচ্চারণ করতে পারেননি। কেঁদেছেন। শুধু কেঁদেছেন। কান্না চাপাতে গিয়ে গুঙিয়েছেন। কিছু একটা কথা বলতে গিয়ে যখনই মুখ খুলছেন আরো জোরে বেড়েছে তার কান্নার দমক। অনেক কান্নার পর একটু বোধহয় হাল্কা লাগে মানুষের। কান্না কিছু থিতিয়ে এলে তিনি বললেন, “আর ভালো লাগে না। মানুষের এতো কষ্ট! এতোগুলো প্রাণ কেমন নিমিষে চলে গেলো। আর নেয়া যায় না।”
আমার চেয়ে বয়সে বড় আমার সেই নারী বন্ধুটি তখনো রাতের খাবার খাননি। তার আগের রাত ঘুমাননি। রাতভর টিভির সামনে বসে ছিলেন বিমুঢ়।
মানুষ এভাবে কাঁদে। লিমনের জন্য আমার খুব কান্না লেগেছিল। বিশ্বজিৎ-এর স্ট্রাইপ-স্ট্রাইপ শার্টটা ধীরে-ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে উঠার ছবিগুলো দেখে কান্না উৎলে উঠেছিল আমার। হয়তো আপনাদেরো বুকে রোদন জেগেছিল।
ক'বছর আগে বাসে, ট্রাকে সমানে ছোঁড়া হচ্ছিলো পেট্রোল বোমা। রোজ সকাল হচ্ছিলো পোড়া মানুষের ছবি দিয়ে। পত্রিকার পাতাগুলো মেতেছিল কে কারচেয়ে বেশি আবেদনময় করে পোড়া মুখের ছবি ছাপাবে সেই প্রতিযোগিতায়! সেই থেকে কাবাবে আমার অরুচি। প্লেটে কাবাব দিলে পত্রিকায় দেখা পোড়া মানুষের চিত্র ভেসে ওঠে।
কন্যা ও স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলতে-বলতে সেই কথার মধ্যেই গুলি খেয়ে প্রাণ হারানো একরামের আর্তি আর তার স্বজনদের আকুলতা শুনে টানা কয়েক রাত ঘুমাতে পারিনি। একটু তন্দ্রা এলেই দুঃস্বপ্ন দেখে আবারো জেগে উঠেছি।
সেদিন বনানীর আগুনের ঘটনায় টিভিতে কিয়ৎক্ষণের জন্য শুনেছিলাম মানুষের মর্মভেদী আর্তনাদ! সে-কী হাহাকার! বাঁচার জন্য সে কী মরিয়া ফরিয়াদ! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার হাঁটু অসাড় হয়ে এসেছিল। আমি টিভির কাছ থেকে দূরে সরে গেছি।
কিন্তু সরে কি আসলে থাকা যায়? আমার বুকের উপর একটি বাস উঠে পড়তে কতক্ষণই বা লাগবে! একটা বদ্ধ ভবনের ভেতর আমারই স্বজন বাঁচার জন্য আকুতি জানাতে-জানাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে যে পড়বে না সেই নিশ্চয়তাই-বা কে দেবে? আমারই কোনো নিকট বন্ধু যে চলতি পথে বাসে গণধর্ষণের শিকার হবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? আমারই কোনো পরিচিত লেখক বন্ধু যে অভিজিতের মতন পথে মরে পরে থাকবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
এভাবে এই নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে কতদিন? আর কাহাতক বয়ে নেয়া যায় এই পলাতক জিন্দেগী?
মানুষের কান্না দেখলে আজো অনেকেরই কান্না পায়। বনানীতে প্রাণপনে ফুটো পাইপ আঁকড়ে থাকা শিশুটির মতন মানুষ আজো আমাদের আছে।
এমন মানুষেরা আছে বলেই হয়তো এখনো এ পোড়ার দেশে কিছু আশা বাকি আছে। কিন্তু এই মানুষেরা আছে বিচ্ছিন্ন হয়ে। তাদের একের সাথে আরেকের কোনো যোগ নেই। আর দুর্নীতিবাজেরা ঐক্যবদ্ধ। রসুনের গোড়ার মতন তারা একাট্টা হয়ে থাকে। অন্যায় করেও তারা পাড় পেয়ে যায়। কারণ তারা দল বেঁধে সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে সেবা বন্ধ করে দিতে পারে। তারা দল বেঁধে সারা দেশে যান-বাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। তারা দলবেঁধে মানুষের উপরে অতর্কিতে বোমা মেরে সটকে যেতে পারে।
এটাই উৎকৃষ্ট সময়। এখনি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে হবে। পাড়ায়-পাড়ায় দুর্নীতি বিরোধী কমিটি হওয়া দরকার। মহল্লায়-মহল্লায় অনাচার বিরোধী সংঘ হওয়া দরকার। ছোটো দুর্নীতি থেকে বড় দুর্নীতি, কোনোটিকেই ছাড় দেয়া যাবে না।
কেউ পাড়ায় মাস্তানি করতে এলে তাকে সবাই মিলে ধরে ফেলুন। ধরে পুলিশে সোপর্দ করুন। পুলিশ যদি অন্যায়ভাবে সেই মাস্তান বা ক্ষমতাবানকে ছেড়ে দেয় সেটিও প্রকাশ করুন।
এই উদ্যোগে সাংবাদিকদের বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে। 'ইম্পেক্ট জার্নালিজম' বলে একটা জিনিষ আছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে আদতেই সমাজে ভূমিকা রাখার উদ্যোগ নেয়া। আপনারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করুণ। রুই-কাৎলাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিন।
এ্ই লড়াইয়ে আইনজীবীদের আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আপনারা জেলায়-জেলায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠণ করুন। তাদেরকে অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজ এবং অন্যের জমি-বাড়ি-সম্পত্তি কেড়ে নিতে উদ্যত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সপ্রণোদিত হয়ে মামলা লড়তে বলুন। কোনো প্রভাবশালী যদি বিচারকে প্রভাবিত করতে চায়, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে সেগুলো প্রকাশ করে দিন। জনগণের ঐক্য ছাড়া এই দেশের ‘সর্বাঙ্গের ব্যাথা’ সারবে না।
আমাদের খাদ্যে ভেজাল। আমাদের ওষুধে ভেজাল। আমাদের পানিতে দূষণ। আমাদের বায়ুতে দূষণ। আমাদের রাজনীতি মানে ভোগ-দখল-তেলবাজি আর নিজের আখের গোছানোর মচ্ছব।
এই মাৎস্যান্যায় থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই জনতার জাগরণ। নইলে চুড়িহাট্টার মতন ঘটনা, আবু বকরের মতন অকাতরে প্রাণ বিয়োগের ঘটনা, রানা প্লাজার মতন কেয়ামতের ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটতেই থাকবে। আর আমার বন্ধুদের মতন আপনি এবং আপনার বন্ধুরাও নীরবে, একা-একা ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠবেন অস্ফুট কান্নায়।
সময় এসেছে। নিজের মাতৃভূমির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিন। মনে রাখবেন, আপনি তুচ্ছ নন। আপনাকে কেউ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারবে না। এমনকি একক মানুষেরো অনেক ক্ষমতা। যে মানুষ রুখে দাঁড়ায় তার সামর্থ সীমাহীন।
আসুন, আমরা সকলে মিলে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। একমাত্র রুখে দাঁড়ানোর ভেতর দিয়েই থামবে সড়কে হত্যাকাণ্ড; থামবে অনাচার, অন্যায় ও দুর্নীতি। আর রুখে দাঁড়ানের ভেতর দিয়েই অর্থবহ হবে আমাদের সকল কান্না।
#দেশআমারদায়িত্বআমার
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:২৬