আরিফ ভাইয়ের পোস্ট পড়লাম । হাসি পেল । কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এটা কোন নাস্তিককে হেদায়াতের উদ্দেশ্যে মোল্লা সাহেবের কোরানের আয়াতের রেফারেন্স টানা ।তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন এটা প্রমানে তার লেখার আশ্রয় নেয়া । আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন... কি কি লিখেছেন তা আপনারা পড়েছেন । সেসব নিয়ে আমি কিছু বলব না ।আমি বলছি অন্য কথা আল-মাহমুদের মুখেই-
"আমাদের দেশের প্রধান লেখক ও কবিগণ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেননি । আমাদের বামপন্থী প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী এবং কবি-সাহিত্যিকগণ সেকালে আওয়ামী লীগ এবং এর অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবকে মূর্খ বলে গালি দিতেন।.....হাতে গোনা যে দু'একজন কবি মুক্তিযুদ্ধে সামিল হতে ঢাকা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় পৌঁছেন এবং যুদ্ধের প্রপাগান্ডায় সাধ্যমত অবদান রাখেন তাদের একজন আমি নিজে ।স্বধর্ম এবং স্বদেশের প্রতি আস্থা উঠে যায়নি বলে আমাকে আখ্যায়িত করা হয় মৌলবাদী বলে ।"
-রূপম, মার্চ ১৯৯৩
"মুক্তিযুদ্ধের ভেতরটা আমি দেখেছি । যুদ্ধের সময় উদ্দীপিত হয়ে দু'য়েকটা কবিতাও লিখেছি । পরে এ নিয়ে কবিতা লিখতে না পারলেও উপন্যাস লিখেছি ।আমার কবিতা হোক বা গদ্যই হোক যা কিছু মুক্তিযুদ্ধের ওপর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি । যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত একটা নিষ্ঠুর ব্যাপার । কবি হৃদয় সর্বক্ষণ এ নিয়েই পড়ে থাকতে পারেনা ।তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আমার পরিবার পরিজনের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে ।" -বিচিত্রা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৫
"চিন্তা করুন, আমরা ক'জন মিড ফিফটিজের লেখক একজন জাতীয়তাবাদী নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জীবনের এই মহার্ঘ্য সময়ে তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম । স্ত্রী পুত্রকে পথে রেখে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম ।আমাদের অদম্য আগ্রহে শুরু হয়েছিল বাঙালি মুসলমানের প্রথম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ।"-জলঘড়ি, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭
আল-মাহমুদের এমন হাজার হাজার কথার উদ্ধৃতি দিলেই কি তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাবেন ? কিংবা তার আত্মজীবনী থেকে কাট-ছাট করে পছন্দসই উদ্ধৃতিগুলো তুলে দিলেই কি তিনি অমুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাবেন ?
যে জাতি গুণীর কদর জানেনা সে জাতির মধ্যে গুণীর জন্মও হয়না । আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে আজ আমরা রাজনীতি নামক ফালতু বিষয়ের কারণে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নরকের কীটের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসছি ।আমি ঘৃণা জানাই সেই সব নোংরা রাজনীতিকদের যারা তাদের ঘৃণ্য রাজনৈতিক স্বার্থে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করেছে ।
আল-মাহমুদ বা শামসুর রাহমান-এরা যে কোন ধরনের রাজনৈতিক দলের পদলেহি যদি হয়েও থাকেন এটা তাদের নিজস্ব । আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মত লেখককেও শেষ পর্যন্ত আনন্দ বাজারিদের পুরস্কার হাতে নিতে হয়েছে - অর্থের দায়ে । কত কবি- লেখক বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার হিসাব আমরা কজন রাখি ? ক'জন আছেন সৈয়দ হকের মত সম্পদশালী ?
যখন তারা আর্থিক অনটনে থাকেন আমরা তাদের খোঁজ নেইনা । তাদেরকে দেই মরনোত্তর পুরস্কার ।বক্তৃতা, সভা-সমাবেশে ভরিয়ে তুলি গোটা দেশ । আর তাদের জীবদ্দশায় কেবল থাকে অনটন ।যখন তারা স্ত্রী-পরিজনের দিকে তাকিয়ে আপোষ করেন সম্পদশালী কিংবা ক্ষমতাবানের সাথে আমরা তাদেরকে তাদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেই । অথচ আমাদেরই কৃত ভুলের দায়ে আজ তাদের আপোষকামী হতে হয়েছে এই সত্যটি আমরা ভুলে যাই ।
যে কোন বিচারেই আরিফ জেবতিকের লেখাটা পক্ষপাতদুষ্ট । কবিকে অমুক্তিযোদ্ধা প্রমানের চেষ্টা । যে কারনে কবির -
" আমাকে কেউ কোন নির্দিষ্ট দায়িত্ব না দিলেও আমি কলকাতার লেখক , শিল্পী , ও সাহিত্যিকদের মধ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন যোগানোর কাজ করে চলছিলাম ।"
এই বাক্যটি তিনি সদর্থে নেননি । তিনি তার আত্মজীবনীতে কেবলই খুঁজে বেড়িয়েছেন তাকে অমুক্তিযোদ্ধা প্রমানের উপযুক্ত তথ্য । অথচ এমন একজন কবিকে নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত একেবারেই নির্মোহভাবে ।
ভিন্ন মতের বলে একজন সম্মানিত লোককেও অসম্মান করার প্রবনতা তো এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ । এই সংস্কৃতি যখন আরিফ ভাইয়ের মত কান্ডারিদের গ্রাস করে আমি আতংকিত হই । আমার মনে হয় আমরা দিন দিন বেশি মাত্রায় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি ।আমরা এগিয়ে যাবার বদলে পিছিয়ে যাচ্ছি ।