somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাষ্ট্রহীন শিশু তথা ‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’ আকসারের গল্প

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত, ঘিঞ্জি বিহারী ক্যাম্পের একরুমের একটা মাত্র পাকা ঘরে আরেক বোনের সাথে বেড়ে উঠছে ৮ বছর বয়সী ছোট্ট আকসার (ছদ্মনাম), যার বাবা পেশায় একজন নাপিত এবং মা অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ করে কোনমতে টেনেটুনে সংসারটিকে চালিয়ে নিচ্ছেন। সভ্য জগতের আর দশটা শিশুর মত স্বাধীন-সুন্দর নয় আকসারের শৈশব, বিহারী ক্যাম্পের লম্বা আজিজ লেন আর এনজিও পরিচালিত বিহারীদের স্কুল-এর মাঝেই সীমাবদ্ধ আকসারের জীবন। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা কিংবা ঘোরাঘুরি কোনটাই তার জন্য প্রযোজ্য নয় কারন সে ‘বিহারী’।

১৯৪৭ এর পর যখন দ্বিজাতিত্বত্ত্বের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হল তখন ভারত জুড়ে শুরু হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। আর এ দাঙ্গায় প্রায় ১০ লক্ষ লোক মারা যায় এবং ২ কোটি লোক বাস্তুহারা হয়। ফলে ভারতের বিহার রাজ্য থেকে প্রায় ১০ লক্ষ মুসলমান চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আর কিছু চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে অভিবাসী হবার পর এরা পরিচিত হতে থাকে বিহারি হিসেবে আর পশ্চিম পাকিস্তানে এরা পরিচিত হতে থাকল মোহাজির হিসেবে। আমাদের বয়ানের আজকের নায়ক ‘আকসারে’র পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল কুচবিহারের নীলকুঠি থানার হাতির পিলখানা নামক গ্রামে। তার দাদা কাশেম মিয়া পেশায় মাড়োয়ারীদের তামুকের পেটি বানানোর কাজ করতেন। বিয়ের কিছুদিন পর কাশেম মিয়া একদিন তার স্ত্রীকে মিথ্যে বলে লালমনিরহাট সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কুচবিহার হতে চলে আসেন রংপুরে তার বোনের বাড়িতে। এখানে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে সে তার বোনের স্বামীর ব্যবসার কাজে সহায়তা করতে থাকেন। এভাবে প্রায় দুই বছর কেটে যাবার পর দেশে যখন গন্ডগোল (মুক্তিযুদ্ধ) শুরু হল তখন তারা আবার লালমনিরহাট হয়ে ভারতের সিতাই বর্ডার দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে কুচবিহারে চলে গেলেন। কিন্তু এবার সীমান্ত অতিক্রম করবার সময় তাদের নাম পড়ে গেল ভারতীয় স্মরনার্থী তালিকায়। কুচবিহারে বসে তিনমাস ভারত সরকারের ফ্রি রেশন তো তারা খেল কিন্তু এই ফ্রি রেশন যে কাল হয়ে যাবে তা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারে নাই। তিনমাস পর ভারত সরকার আবার তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিল কারন তারা তখন গন্য হয়েছিলেন স্মরনার্থী হিসেবে।

যদিও আবুল কাশেম দেশ ত্যাগ করবার আগে জেনে গিয়েছিলেন যে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে উর্দুভাষী বিহারীরা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল কিন্তু এবার ফেরত এসে দেখলেন অবস্থা আরো ভয়াবহ। ১৯৫২-র ধারাবাহিকতায় সেই বিহারীদের অনেকেই স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে নিজেদের পাকিস্তানী দাবি করে সশস্ত্র লড়াই করার কারনে পুরো দেশ এখন বিহারীদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে। হাজার হাজার বিহারী মারা পড়ছিল, তাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে হত্যাকান্ডে সহযোগীতার পর ও এই 'বিহারী' রা প্রতারিত হলো পাকিস্তানীদের দ্বারা কারন পাকিস্তান জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আত্নসমর্পনকারী সৈন্যদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিলেও দায়িত্ব নিল না এই ‘বিহারী’ জনগোষ্ঠীর। ফলে 'বিহারী' রা আবারো আটকা পড়লো এমন এক ভূ-খন্ডে যার প্রধান জনগোষ্ঠির হত্যাকান্ডে তারা সরাসরি জড়িত ছিলো। এমন একটা অরাজক পরিস্থিতিতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে আর লুকিয়ে বেড়াতে শুরু করলেন আবুল কাশেম। তার ইন্ডিয়াতে চলে যাবার রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সে সময় এগিয়ে আসে ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টায় মনযোগ দেয়। তারা বিহারী নেতাদের সাথে কয়েক দফায় বসে এবং তাদের সিদ্ধান্ত চায়। বিহারীরা পাকিস্তানে চলে যাবার পক্ষে রায় দেয়, তখন থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের আটকে পড়া পাকিস্তানী বলে অভিহিত হতে থাকে। এমন অবস্থায় শুরুর দিকে রেডক্রস বিহারীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশকে পাকিস্তানে পুনর্বাসন করতে সক্ষম হয় এবং বাকীদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ৬৬টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। আবুল কাশেম ও তার পরিবারের ও ঠাই হয় এমন একটা ক্যাম্পে। পাকিস্তানে চলে যাবার আশায় প্রথম ১০ বছর আবুল কাশেমের পরিবার আটকে পড়া পাকিস্তানী হিসেবে তাবুতে বাস করা শুরু করে এবং এর মাঝেই আবুল কাশেমের মৃত্যু হয়। আবুল কাশেমের মৃত্যুর পর দুই পুত্র এবং এক কন্যাকে নিয়ে বিপদে পড়েন তার স্ত্রী পরিমন নেসা। এ যুদ্ধ যেন যুদ্ধ পরবর্তী একটা দেশে আরেকটা জীবন যুদ্ধ। এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে, ছোট ছোট সন্তানদের দিয়ে কাজ করিয়ে টেনে হিচরে তার সংসারটা কোন রকম টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন পরিমন নেসা। তাদের আর পাকিস্তানে ফেরা হয় না। তারপর তার সন্তানেরা বড় হয়, বিয়ে থা করে এবং সংসারের দায়িত্ব বুঝে নেয়।


প্রিয় আজিজ লেন

এবার আসি, আকসারের গল্পে। আকসারের বাবা মায়ের ইচ্ছা আকসার একদিন লেখা পড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হবে। কিন্তু সভ্য মানুষেদের সমাজ আকসারকে সে এখতিয়ার দেয় না। কারন সে বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দা, ‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’। আকসারকে যখন একটা পাবলিক স্কুলে ভর্তি করা হল তখন শুরুর দিকটায় স্কুল যাওয়াতে আকসারের আগ্রহের কোন কমতি ছিলনা কিন্তু ধীরে ধীরে সে আগ্রহে যেন ভাটা পড়া শুরু হল। কারন সহপাঠীরা তার সাথে বসত না, খেলাধুলা তো অনেক দূর। এমনকি স্কুলের শিক্ষকরা পর্যন্ত সুবিধাজনক আচরন করতনা। অবশেষে মাত্র কদিনের মাথায় আকসারের তীব্র আপত্তিতে তাকে স্কুল ছাড়িয়ে ক্যাম্পেই বিহারীদের জন্য একটা এনজিও স্কুলে ভর্তি করা হল। আকসারের জীবনটা ক্যাম্পের আজিজ গলিটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এটাই তার শৈশব। এটাই তার বেড়ে ওঠা। এর বাইরে যাবার কোন অনুমতি তার নেই কারন তার পরিবার ভয় করে বাইরের অমানুষেদের। এই অনুমতি যে শুধু আকসারের-ই নেই বিষয়টা তা নয় বরং এই ক্যাম্পের শয়ে শয়ে আকসারের বেড়ে ওঠা, শৈশব বলতেই তাদের ঘরের সামনের গলিটা। অন্যত্র গিয়ে বাসা ভাঁড়া করে কিংবা জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে থাকবার মত অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা শুধু আকসারের নাপিত পিতা কেন বরং বেশির ভাগ পিতারই নেই এখানে। ক্যাম্পের বেশির ভাগ পুরুষ পেশায় দর্জি, নাপিত কিংবা ভ্যান চালক। সরকার হতে বরাদ্দ দেয়া একটা মাত্র রুমে গাদাগাদি করে বসবাস পুরো একটা পরিবারের। আছে পানি, টয়লেট এবং হাজারো নানা সমস্যা। পড়াশোনা করে উঠে আসবার পরিবেশ কিংবা সামর্থ্য ছেলে শিশুদেরই নেই সেখানে মেয়ে শিশুদের পড়াশোনা করাটা যেন এলাহী কান্ড। তবে হ্যাঁ মেয়েরা কোরআন পড়া শেখে। কোরআন শিখতে শিখতে, ঠুস করে একদিন অল্প বয়সেই বিয়ে। বিয়ে বলতে ক্যাম্পের ভেতরেই কিংবা আরেক ক্যাম্পের কোন বিহারীর সাথে। তারপর তাদের বাচ্চা তথা স্বাধীন বাংলাদেশে আরেক ‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’র আবির্ভাব ঘটে। তারা উর্দুতে কথা বলা শেখে। ফরফর করে উর্দুতে কথা বলে, উর্দুতে খায় আর উর্দুতে ঘুমায়। আবারো আজিজ লেন কিংবা নাপিত অথবা দর্জি। তারপর বিয়ে, আবারো একটা ‘আটকে পড়া পাকিস্তানী’র আবির্ভাব।

উপরের গল্পটি শুধু একজন আকসারের নয় বরং বাংলাদেশে আটকে পড়া শয়ে শয়ে ‘বিহারী’র সন্তান আকসা্রের গল্প। পাকিস্তান-বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বিহারী ইত্যাদির কোন কিছু না জেনেও তারা আজ বংশ পরম্পরায় কিংবা জন্মসূত্রে 'আটকে পড়া পাকিস্তানী' হিসেবে সামাজিক ভাবে পরিচিত। রাষ্ট্র তাদের ভোটাধিকার প্রদান করবার মধ্য দিয়ে দায়মুক্তি নিলেও আকসারদের সামাজিক মুক্তির দায়ভার গ্রহন করে না। সভ্য মানুষেরা তাদের দেশাত্ববোধের নামে, আকসারদের প্রতি ছুড়ে দেয় তাদের অসম্ভব ঘৃনা। আর তাই প্রতিদিন আজিজ লেনে হাজারো আকসা্রের জন্ম হয় এবং হাজারো আকসার বিলীন হয়ে যায় আটকে পড়া পাকিস্তানী হিসেবে!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০২
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×