আজ দু’জন নকল নবিস (মূহুরি বা দলিল লেখক)-এর কথা মনে পড়ছে। এরা হলেন আসগর আলি ও সুধিরচন্দ্র পাল। স্বাধীনতার আগে থেকে এই দু’জন নকল নবিস আমার আব্বার সেরেস্তায় কাজ করতেন। আব্বা ছিলেন রাজশাহী বারের এ্যাডভোকেট। তিনি এ দু’জনকে নিয়ে খুব পেরেশানির মধ্যে থাকতেন। আসগর আলি ছিলেন অবাঙ্গালী মোহাজির, আর সুধিরচন্দ্র পাল ছিলেন স্থানীয় লোক। কিন্তু একই সেরেস্তায় কাজ করা সত্ত্বেও তাদের দু’জনের মধ্যে কোন সদ্ভাব ছিল না। দলিল বা পিটিশন লেখা, দলিলের সার্টিফায়েড কপি লেখা, ওকালতনামা মুসাবিদা করা, বেল বন্ডের ফরম পূরণ করা ইত্যাদি কাজ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কাড়াকাড়ি ও ঝগড়া বিবাদ ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তাদের একজনের বিরুদ্ধে অন্য জনের নালিশ আব্বাকে শুনতে হতো। দু’জনেই খুব ভালো নকল নবিস ছিল বলে আব্বা তাদেরকে সেরেস্তা থেকে বাদ দিতে পারতেন না। এটা ওটা বলে আপোষ রফা করে দিতেন।
ঘটনাচক্রে দু’জনেরই পেশাগত কাজে একটা সমস্যা ছিল। আর তা’ হলো মক্কেলের নাম লিখতে ভুল করা। দলিল লিখতে গিয়ে কোন হিন্দু মক্কেলের নাম হলে আসগর আলির ভুল হবেই। তবে তার আর দোষ কী? সে তো বিহারী মানুষ। আমরা বাঙ্গালীরাই অনেকে এখনো বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী ইত্যাদি লিখতে গিয়ে কলম ভেঙ্গে ফেলি। আসগর আলি ঠিক মতো বাংলা লিখতে পারতেন না বলে ইংরেজিতে দলিল লিখতেন। আব্বার কাছে শুনেছি, তার ইংরেজি ড্রাফ্ট ছিল খুব উচ্চমানের। ওদিকে সুধির বাবু স্থানীয় লোক হলেও মুসলমান মক্কেলের নাম লিখতে গিয়ে প্রায়ই বানান ভুল করে ফেলতেন। যেমন, তার মুসাবিদায় রাজ্জাক হয়ে যেত রজ্জাক, কলিমউল্লাহ হয়ে যেত কালিমুল্লা। তবে তিনি ইংরেজি বাংলা দুই ভাষাতেই দলিল লিখতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আব্বা দু’জনকেই ধমক ধামক দিয়ে নাম ঠিক করিয়ে নিতেন।
অন্যান্য অবাঙ্গালীদের মতো আসগর আলিরও মৌখিক বাংলা উচ্চারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তার উচ্চারণের সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল, তিনি ‘স’ বা ‘শ’ উচ্চারণ করতেন ‘চ’ দিয়ে। বাংলা লিখতে গেলেও তিনি একই কাজ করতেন। এই কারণে আব্বার ধমক খেয়ে তিনি বাংলায় দলিল লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন।
কিন্তু মক্কেলের সাথে তো বাংলায় কথা বলতে হয়। মক্কেলকে সাক্ষী আনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলতেন, ‘আগলা ডেটে চাক্ষি আনবেন। ওকিল চাব বলিয়ে দিয়েছে।’ অথবা চা খাওয়ার আগে দোকানদারকে বলতেন, ‘এক গেলাচ পানি দে চম্ভু (শম্ভু)।’
তো এদের এক কীর্তির কথা শুনুন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের ঘটনা। আমি নিজে এক ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে জেলে গেলাম। ছয় মাস জেল খাটার পর আব্বার প্রাণান্তকর চেষ্টায় জামিন পেলাম ঠিকই, কিন্তু কিছুদিন পর জামিন বাতিল করে আমার নামে আবার ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হলো। গ্রেপ্তারের ভয়ে আমি রাজশাহী থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেলাম। পুলিশ আমাকে খুঁজতে লাগলো। ওয়ারেন্ট ইস্যুকারি ম্যাজিস্ট্রেট বদলী হয়ে যাওয়ার পর নতুন ম্যাজিস্ট্রেট আব্বাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ছেলেকে কোর্টে হাজির করে বেল পিটিশন দেন। আমি জামিন দিয়ে দেব। বারের একজন সিনিয়র এ্যাডভোকেট হিসাবে আপনাকে আমি এটুকু সম্মান করতে পারি।’
আব্বা আমাকে কোর্ট স্যারেন্ডার করিয়ে জামিন করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মোতাবেক আমি নির্ধারিত দিনে কোর্টে হাজির হলে আব্বা ওকালতনামা ও বেল বন্ড তৈরির কাগজপত্র আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘তুমি সুধিরের কাছে চলে যাও। ওকে এগুলো লিখে নিয়ে আমার কাছে আসতে বলো। তোমার কেস নিয়ে আমি আমার কলিগদের সাথে এখন আলোচনায় বসবো। ঠিক আছে?’
কোর্টের ভেতর বিশাল বটতলার নিচে মূহুরিদের বসার জন্য টানা লম্বা টিনের শেড। সামনে একটা করে কাঠের বাক্স নিয়ে বসে অসংখ্য মূহুরি মক্কেল পরিবেষ্টিত হয়ে দলিল লেখায় ব্যস্ত। আমি সুধির বাবুকে খুঁজে বের করে আব্বার দেওয়া কাগজপত্র গুলো তাকে দিলাম। সুধির বাবু সব কাজ ফেলে রেখে আমার কাজ শুরু করে দিলেন। কাগজপত্র লেখা শেষ হলে তিনি একটা ছোট্ট চিরকুটে কয়েকটা কথা লিখে চিরকুটসহ সব কাগজপত্র আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘বাবু, আপনি এগুলো নিয়ে একটু আজগর বাবুর কাছে যান। উনি দেখে দিলে আবার আমার কাছে নিয়ে আসেন। আজগর বাবু কোথায় বসে, জানেন তো?’
আমি বললাম, ‘জানি কাকা।’
‘ঠিক আছে, যান।’
আসগর আলি ও সুধিরচন্দ্র পালের মধ্যে সদ্ভাব না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উকিল সাহেবের হাতে দেওয়ার আগে তারা একে অন্যকে দেখিয়ে নিত। আমি আসগর আলির কাছে যেতে যেতে সুধির বাবুর চিরকুট খুলে দেখলাম, লেখা আছে, “প্রিয় অজগর বাবু, উকিল সাহেবের ছেলের কাগজপত্র পাঠালাম। ঠিক আছে কী না একটু দেখে দেন।”
আসগর আলি কাগজপত্র খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে আমাকে ফেরত দিলেন। তারপর তিনিও এক খানা চিরকুট লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘চব ঠিক আছে। কোয়ি ডর নেহি। জামিন হইয়ে যাবে। ওকিল চাবের লাড়কার জামিন না হইবে, এটা কোন কথা হইল?’
আমি কাগজপত্র গুলো নিয়ে সুধির পালের কাছে যেতে যেতে আসগর আলির চিরকুট খুলে দেখলাম, ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে লেখা আছে, “Dear ুদির বাবু, চব ঠিক আছে। আপনি ওস্তাদ লোগ আছেন।”
চিরকুটে লেখা সুধির বাবুর নামের প্রথম অংশে হ্রস্ব উ-কারের ওপর একটা হরফ ছিল। এই রম্যরচনার শ্লীলতাহানির ভয়ে সেটি আমি বৃত্তাকার ডট দিয়ে উহ্য রেখেছি। আশা করি, পাঠকরা ঠিকই বুঝতে পারছেন হরফটি কী ছিল?
*******************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:৪৭