এই উপন্যাসটি এবার সাপ্তাহিক এই সময় পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হচ্ছে। আপনাদের মতামতের জন্য ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি শেয়ার করছি। পাঠকদের যে কোনো পরামর্শ আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে আপনাদের ফিডব্যাকগুলো যতোদূর সম্ভব সংযুক্ত করে নেবো। উল্লেখ্য, এই ব্লগে বহু আগে আমি "ভুতের আড্ডা" পরিচয়ে লিখতাম। সেই আইডিটি উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে স্বনামে আত্মপ্রকাশ। উপন্যাসটি পড়ে মতামত দেয়ার জন্য আগাম ধন্যবাদ।
Murder is like potato chips: you can't stop with just one.
― Stephen King
এক
সময় ঘনিয়ে আসছে, কদিন ধরেই টের পাচ্ছিলো। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। বেশ কিছুদিন ধরেই এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা, শেষ সময়ের জন্য প্রস্তুতিও নেয়া ছিলো। তার পরও শঙ্কা কাটছে না।
প্রথমবার মা হওয়ার আগে বুঝি এমনটাই হয়।
বুক চীরে নি:শব্দ দীর্ধশ্বাস উঠে আসে। আর দশজনের মতো ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসছে না তার অনাগত সন্তান। এই ভাবনাটি কুরে কুরে খেয়েছে গত কয়েকটি দিন। দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। বিনিদ্র ক্ষণ কেটেছে মাসের পর মাস। একটি শিশুর পৃথিবীতে আসার আগে কতোরকম প্রস্তুতি থাকে, থাকে নানা আয়োজন। তাকে ঘিরে মা-বাবার স্বপ্ন, সাধ। দোকান ঘুরে কেনা হয় নতুন জামা, ছোট্ট জুতো, ফিডার আরো কতো কী। কিন্তু এই হতভাগার জন্মটাই যেন তার অপরাধ। শত প্রতিকুলতার মধ্যে চরম মানষিক শক্তি আর সহ্যশক্তির চরম সীমায় পৌছাতে হয়েছে একে পৃথিবীর আলোতে মুখ দেখানোর সংকল্পে। কতো গঞ্জনা, নির্যাতন, নিপীড়ন আর অপমান লাঞ্ছনার পর পৃথিবীতে আসছে তার ঔরস।
শেষ কয়েকটা দিন যখন পেটের ভেতর জানান দিচ্ছিলো, নড়েচড়ে উঠছিলো, তখন যে অনুভূতি, তার সাথে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না। পরে সুযোগ হবে কিনা জানা নেই, তাই অনাগত আত্মজের সাথে চলতো কাল্পনিক কথোপকথন। আর এই নিয়ে কী হাসাহাসি, কেউ কেউতো রীতিমতো পাগল ঠাউরেছে। আবার কারো ধারণা, খারাপ বাতাস বা জ্বিনের কাজ।
দুনিয়াকে পাত্তা না দেয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়েছে বহু আগেই। আর উপেক্ষা করতে শিখেছে অপমান, লাঞ্ছনা। এমনকী একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ক্ষুধা, শারীরিক কষ্ট কিংবা মার খাওয়ার সহ্য ক্ষমতাও রপ্ত হয়েছে। তা না হলে এই নিষ্করুণ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হয়ে উঠতো। জন্মের আগেই শিশুটিকে হত্যার যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিলো, তা মোকাবেলা করেছে কঠোর হাতে। এতো যুদ্ধ, এতোটা সংগ্রাম কেন এই শিশুর জন্য? এই প্রশ্নটা অনেকবার মনে জেগেছে। নিজের কাছেই এর উত্তর মেলেনি ।
তার মতো আরো যারা আছে, তাদের একমাত্র ভরসা, রহিমার মা দাইয়ের হাতে সন্তানের জন্ম দেবেনা, আগাগোড়া এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলো। মনে আছে, আক্তারির ছেলেটা জন্মের সময় দাইয়ের হাতেই মারা গেল, আর আক্তারিকে নিয়ে চললো যমে মানুষে টানাটানি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু্ ছিনিয়ে নিয়েছিলো তাকে। ভালোই হয়েছে, যে জীবন তাদের যাপন করতে হয়, তার চেয়ে মৃত্যুই উত্তম। মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হয়, হাতুড়ে দাইয়ের হাতে জন্মের সময় যতোগুলো শিশুর মৃত্যুর কথা বলা হয়, সেগুলো কী স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি….এই সন্দেহটা পোক্ত হয়, যখন সে লক্ষ্য করলো মেয়ে শিশুরা বেচে যায়, মৃত্যুর ছোবল পড়ে বেশিরভাগ ছেলে শিশুগুলোর উপর। এটাকি নিছক কাকতাল?
দাইয়ের হাতে সন্তান জন্ম দেয়াতে তাই ছিলো ঘোর আপত্তি। কতো তাচ্ছিল্য, টিপ্পনী আর বিষ মাখানো কথার খোঁচা সহ্য করতে হয়েছে এ জন্য। কিন্তু ওই যে, একের পর এক আঘাত তাকে প্রায় সর্বংসহা করে তুলেছে, তাই কোনো কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না।
বহু দূরের এই প্রাইভেট ক্লিনিকটা ঠিক করাই ছিলো। গত কয়েক মাস শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এতো দূর পথ ভেঙ্গে এই নারী চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত চেকআপ করিয়েছে। খুলে বলেছে তার সব সমস্যার কথা। কথায় বলে, ডাক্তার আর উকিলের কাছে কিছু গোপন করতে নেই। সেই প্রবাদ মেনে ডাক্তারের কাছে মেলে ধরেছে নিজেকে। বিনিময়ে আশ্বাস মিলেছে, সাধ্যমতো সব সহায়তা করবেন ডাক্তার। প্রসব বেদনা শুরু হলেই খবর দিতে হবে। এক ডাকেই চলে আসবেন তিনি।
ক্লিনিকের সরু বেডটিতে শুয়ে অনাগত সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা আর শারিরীক যন্ত্রণা লাঘবের জন্য জোর করেই মনটাকে অন্যদিকে ফেরাবার জন্য যুদ্ধ করছে। রোমন্থন করার মতো খুব বেশি সুখস্মৃতি জমা নেই। অতীত পরিভ্রমন অনেকটাই বিভিষীকার মতো। এই বিভিষীকা হানা দেয় যখন তখন, স্বপ্নে, জাগরণে, অন্যমনষ্কতায় কিংবা অলস সময়ে। আয়োজন করে তাকে ডেকে আনার কোনো অর্থ নেই।
ঘুরেফিরে বার বার অমঙ্গল শঙ্কা ছায়া ফেলছে। সবকিছু ঠিকঠাক হবেতো! নিরাপদ আশ্রয় কী মিলবে তার গর্ভের সন্তানের।
ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। বড় এই ঘরটিতে মোট ছয়টি বেড। চারটিতেই সন্তান সম্ভাব্যা শুয়ে আছে। সবাইকে ঘিরে আছে স্বজনেরা। শুধু সেই ব্যতিক্রম। সম্ভবত এই ক্লিনিকের ইতিহাসে এটিই একমাত্র ঘটনা, যেখানে মা নিজেই সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য চলে এসেছে। সাথে কেউ নেই।
অলক্ষ্যে দু চোখের কোণ বেয়ে জল নামে।
ডাক্তার কখন আসবেন? আর কতো দেরি?
আরো একজনের জন্য তার অপক্ষা। মনের একটি অংশ অপক্ষা করছে, আরেকটি অংশ তীব্রভাবে চাইছে সে না আসুক। দ্বিতীয় চাওয়াটি একেবারেই অমূলক। ডাক্তারের পরই যাকে ফোন করা হয়েছে, সেটি এই ব্যক্তি। সুতরাং তার না আসার কোনোই কারণ নেই। সম্ভবত ডাক্তারের আগেই এসে হাজির হবেন তিনি।
এই লোকটির সাথে পরিচয় খুব অদ্ভুতভাবে। প্রথমদিনই মনে হয়েছিলো, তিনি এমন একজন মানুষ যার উপর নির্ভর করা যায়, যাকে বিশ্বাস করা যায় সর্বন্তকরণে। মূলত তার ভরসা এই শিশুটির জন্মের জন্য তাকে এতোটা সংকল্পবদ্ধ হওয়ার শক্তি যুগিয়েছে। হাসপাতালের যাবতীয় দেনা পাওনা তারই চুকানোর কথা।
কখন আসবে সে?
রাত বারোটা ছাব্বিশ মিনিটে অবসান হয় নয় মাসের প্রতীক্ষার, উদ্বেগ উৎকণ্ঠার। নবাগত শিশুর চিৎকার শুনেই ডেলিভারি রুমের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকায়। সময়টা দেখে রাখে ঠিকঠাক। কেন, কে জানে! এই শিশুর জন্মের দিন-ক্ষণ তার কী কাজে লাগবে জানা নেই। তার পরও প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার মুহূর্তটি জেনে রাখতে চায়।
এখন পর্যন্ত সবকিছু ভালোয় ভালোয় কেটেছে। ডেলিভারিটাও হয়েছে নরমাল। যতো দ্রুত সম্ভব সরে পড়তে হবে। ডাক্তাররা নিশ্চই একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে ছাড়তে চাইবেন না। আর এই প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতো আরো এক কাঠি সরেস, রোগীকে যতোক্ষণ আটকে রাখা রাখা যায়, ততোই ফায়দা। কিন্তু সুযোগ বুঝে পালাতে হবে। খুব বেশিক্ষণ এখান থাকা যাবে না। হাতে সময় বেশি নেই। সে জানে, যতো সময় পার হবে, ততোই মায়ার বাঁধনে জড়াবে। নিজের হাতে সন্তানকে অন্য কারো হাতে তুলে দেয়ার কষ্ট থেকে পালানোর তাগিদ অনুভব করছে প্রবলভাবে। শেষ সময়ে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে মায়ের মন, বাস্তবতাকে ছাপিয়ে প্রবল হয়ে উঠতে পারে মাতৃত্বের বন্ধন, সেই শঙ্কা কাটছে না। তাই সরে পড়তে হবে দ্রুত, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। শিশুটির মুখের দিকে আর তাকাবে না। মনকে শক্ত করে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে। পুরো শরীর বিদ্রোহ করছে, কিন্তু শারীরিক কষ্ট অনুভবের মতো অবস্থায় নেই এখন।
শেষ মুহূর্তে কেঁদে উঠে কয়েক ঘন্টা বয়সী শিশুটি। কয়েকটি সুতির ওড়না ধুয়ে শুকিয়ে রেখেছিলো, সন্তান জন্মের প্রস্তুতি বলতে এটুকুই। সেগুলোরই একটায় জড়ানো পুতুলের মতো ছোট্ট হাতপাগুলো ছুঁড়ছে এদিক সেদিক, মাকে খুঁজছে। তীব্র ক্ষুধার তাড়না জানান দিচ্ছে সব শক্তি দিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। প্রবল ইচ্ছে শক্তি জড়ো করে পেছন ফেরার তীব্র আকাঙ্খাকে দমিয়ে রাখে, ফিরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে নিজেকে আটকায়। এখন না হয় বুকের দুধ পান করালো, কিন্তু কাল সকাল থেকে কী হবে? তার চেয়ে এই ভালো, মায়ের দুধের স্বাদটা তার কাছে অপরিচিতই থাক। শ্রন্ত-ক্লান্ত দেহে ধীরে ধীরে পা ফেলে দরজাটা পেড়িয়ে যায়, পেছনে ফেলে যায় জীবনের একটি অধ্যায়, নাড়ী ছেড়া ধন, অমূল্য সম্পদ।
সঙ্গে তেমন কিছু নেই। ছোট্ট একটা কাপড়ের পোটলা আর এক লিটার পানির বোতল হাতে নিয়ে সিএনজিতে উঠেছিলো, ফিরিয়ে নেয়ার মতো কিছু নয়। আসলে এখান থেকে তার কিছুই নিয়ে যাওয়ার নেই, শুধু সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়ানোর মতো একটি দু:সহ স্মৃতি ছাড়া।
ভোরের আলো ফোটার আগেই যখন ক্লিনিকটির সদর দরজাগলে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, তখন বাইরের বেঞ্চটিতে কাত হয়ে শোয়া দারোয়ানটি প্রবল শব্দে নাক ডাকছে। ঢাকা শহরের সারা রাতই রিকশা চলে, তাই বাহন পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
গলিটার মোড় ঘুরে রিক্সাটি বড় রাস্তায় উঠার আগে একবার পেছন ফিরে তাকায়। বহু বছর আগে বাবার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ার মুহূর্তটি মনে পড়ে। অথচ, এই ক্লিনিকের সাথে তার সম্পর্ক মাত্র এক রাতের। কিন্তু মনে হচ্ছে জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন জড়িয়ে আছে এর সাথে। নি:শব্দ কান্না এবার অদম্য হয়ে উঠে। বুক ভেঙ্গে উঠে আসে তীব্র বিলাপ। রিক্সার প্রতিটি ঝাঁকুনির সাথে বাধ ভাঙ্গা ঢেউয়ের মতো উঠে আসে এক একটি ব্যথার ঝড়। সদ্য প্রসূতির বিধ্বস্ত শরীরটা বার বার প্রতিবাদ জানায় এই অযাচিত ধকলের। ব্যথা বোধ হওয়ার অবস্থায় নেই, বুক জুড়ে ফেলে আসা সন্তানের জন্য হাহাকার। নিজের অস্তিত্বের একটি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কে বুঝবে।
একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে রিক্সার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় চালক। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, রাত বিরাতের সওয়ারিরা আর দশটা প্যাসেঞ্জারের মতো না। নানা দিক থেকেই এরা আলাদা, কাজকারবারও ভিন্ন।
পূব আকাশে হলকা আলোর রেখা, আঁধার কাটেনি এখনো। জমাটবাধা অন্ধকার আর নি:শব্দতার বুক চীরে ছুটতে থাকে ত্রিচক্রযান। আলোর পথে, নাকি আরো গভীর অন্ধকারে?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৯ রাত ৯:১০