মাঝে মাঝে ফজরের আযান চলাকালীন সময় রাস্তায় কুকুরগুলোর চিৎকার চ্যাঁচামেচি বেড়ে যায়। কিন্তু এর কোন সুনির্দিষ্ট কারণ আমার জানা নেই। মাথায় এলো সোলেমান চাচার নাম। একমাত্র তার কাছেই এ ধরনের রহস্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সোলেমান চাচা আমাদের এলাকার টং দোকানদার। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জিই তার একমাত্র পরিধানের বস্ত্র। তবে মাথায় একটি সাদা রঙের টুপি পরে থাকেন সবসময়। গোঁফ কামিয়ে মুখে লম্বা দাড়ি রাখেন। কিন্তু কখনও নামায পড়তে দেখা যায়না। সারাদিন দোকানদারী করেই হয়ত আর নামাযের সময় পান না তবে ধর্ম নিয়ে অনেক জ্ঞান রাখেন। দোকানে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছেন যেখানে লাল রং দিয়ে লেখা রয়েছে সোলেমান চা স্টল। চা, সিগারেট, কলা আর নানান রকমের বণ রুটি বেঁচেই তিনি সারাদিন একা মানুষ হিমশিম খান।
চাচার দোকানে বিরাট হট্টগোল বেঁধেছে। সিফাত ভাইয়ের সাথে চাচার তুমুল বাকবিতন্ডতা হচ্ছে। সিফাত ভাই আমাদের এলাকার সবচেয়ে স্মার্ট একজন মানুষ। চাচা চা বানিয়ে ফেনা সহ চা দেয়াতেই এই ঝগড়ার উৎপত্তি। চামচ দিয়ে ফেনা না সরিয়ে চা পরিবেশন করা অভদ্রতা আর সিফাত ভাইয়ের মত একজন স্মার্ট মানুষের পক্ষে এতটুকু অভদ্রতা মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি সোলেমান চাচা কে এই বিষয়ের উপর এক বিশাল লেকচার দেয়াতেই চাচাও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে তার মুখের উপরেই বলে দেন যে তার মতন এমন ভদ্র কাস্টমার তার দরকার নাই। দাড়িয়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষন বেশ উপভোগ করলাম দুইজনের ঝগড়া। তবে আরও মজা পেলাম যারাই ভিড় করে ঝগড়া দেখছে তারা সবাই আমার মতই উপভোগ করছে এই ঝগড়া। ঝগড়ার মাঝ খানেই আমি চাচাকে বললাম চা আমাকে ফেনা যুক্ত এক কাপ চা দিনতো। ব্যাস সিফাত ভাইয়ের চেহারা তখন দেখার মত হল। আমার দিকে রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে তিনি হুড়মুড় করে ঝগড়া থামিয়ে হেটে চলে গেলেন।
সোলেমান চাচার মুখে তখন যে হাসি দেখলাম কয়েক কোটি টাকা খরচ করলেও এমন হাসি কেনা সম্ভব হবে না এই পৃথিবীতে। চাচা নিজ থেকেই আমার দিকে একটি সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন আর কইয়না বুঝলা, আরে এতই যদি তোমাগের প্রেস্টিজ তাইলে ফাইভ স্টারে গিয়াই চা খাইলে পার; এই সোলেমান মূর্খের দোকানে কি ? আমি সিগারেট ধরিয়ে তার কথার সাথে মাথা নাড়ালাম। এই মুহূর্তে চাচার কাছে যাই জানতে চাইব একদম পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা সহ জানতে পারব কারণ আমার কথাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। সোলেমান চাচার মতে ফজরের আযানের সময় শয়তান তার অস্তিত্বের ধ্বংসের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে কুকুরের পেটে ঢুকে গিয়ে সুরসুরি দেয়। এতে করে কুকুরগুলো চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দেয়। আযানের পবিত্রতা নষ্ট করার কৌশল হিসেবে শয়তান এই কাজ করিয়ে থাকে। ব্যাখ্যাটা আমার কাছে দুর্বল বলে মনে হয়নি।
উঠে আসার সময় পকেট থেকে টাকা বের করছি বিল দেব বলে কিন্তু চাচা বলল যাও তোমার আজকে বিল দেয়া লাগবে না এইটা আমি এমনি তোমারে খাওয়াইলাম। চাচা কাল মিশর যাচ্ছি অফিসিয়াল ট্যুরে দোয়া করবেন।
কিন্তু ওইখানেতো বিরাট গণ্ডগোল চলতাছে। এই বিপদের মইধ্যে তোমার অফিস ওইখানে কেমনে যাইতে দিতাছে !
চাচা চাকরী জিনিসটাই এমন। বিপদ আপদ মেনে চলেনা। সবসময় তার নিজের স্বার্থ ভাবে। গোলামের জীবন নিয়ে ভাবার অবকাশ রাখেনা।
চাচা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন। আর এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে বললেন এই নাও এইটা তুমি ওই দেশে গিয়া খাইয়ো। আমি সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে চলে আসার সময় বললাম শুনেন চাচা এখন থেকে সিফাত ভাই এলে, তার চায়ে দরকার পরলে একটু শ্যাম্পু মিশিয়ে আরও বেশি করে ফেনা তৈরি করে দিয়েন। এই কথা শোনার পর চাচা আরেকটি সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজেই লাইটার দিয়ে আমার সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। আমি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাসায় চলে এলাম।
আমার স্বপ্নের দেশ মিশর। অফিসিয়াল ট্যুরে মিশর এসেছি হোরাসের চোখের উপর একটি রিসার্চ করতে। এই রিসার্চের উপর আমার ক্যারিয়ারের পুরোটাই নির্ভর করছে। অনেক কষ্টে এই রিসার্চটি করার জন্য বসের কাছ থেকে কাজটি বাগিয়ে নিয়ে মিশর এসেছি। এর জন্য আমাকে বসের বাসার বাজার পর্যন্ত করে দিতে হয়েছে। রিসার্চের কিছু থিউরিগত কাজ করেছি কিন্তু কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিনা।
ওয়ান হু ডাজ !! অল সিয়িং আই!!!
যেনস প্যারাডক্স অনুযায়ী হোরাসের চোখ
১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ + ১/৬৪ = ৬৩/৬৪ = ০,৯৮৪৩৭৫ ≈≈ ১
প্রতীকে ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ + ১/৬৪
সিক্সথ সেন্স !!! চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, মন!
তাই আরও তথ্য প্রমানের জন্য এসেছি দেবী আইসিসের মন্দিরে। দেবী আইসিসের মন্দিরে ঘুরে ঘুরে দেখছি আর বার বার আবেগে আপ্লুত হয়ে পরছি। ফিরে আসব ঠিক এমন সময় দেবী আইসিস আমাকে পেছন থেকে ডেকে উঠল। প্রথমটায় ধাক্কা খেলেও সামলে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেবীর চোখ বেয়ে রক্ত ঝরছে। আর অস্পষ্ট কণ্ঠে একবার উচ্চারন করল শুধু ওসাইরিস। তারপর আবার চারদিকে সেই আগের মতই নীরবতা। কিন্তু ধীরে ধীরে পুরো মন্দির আইসিসের চোখ হতে ঝরে পরা রক্তে ভেসে যেতে লাগল। আমি আর সেখানে এক মুহূর্ত দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। এই ঘটনার পর আর এক মুহূর্ত মিশর থাকার কথা ভাবতে পারছিনা তাই অফিসিয়াল কাজ অর্ধ সমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে যাওয়ার সিধ্যান্ত নিয়ে ফেললাম।
দেশে ফিরে আসারপর অনেক দিন কেটে গেছে। কিন্তু আমার মাথা থেকে কিছুতেই সেই দৃশ্য দূর হচ্ছেনা। আজ সকালে পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখলাম বড় করে হেডিং দিয়ে ছাপা হয়েছে, মিশরে চলমান দাঙ্গায় দেবী আইসিসের মূর্তি ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। সংবাদটি পড়ে বুকের ভেতর এক অজানা শঙ্কা হল। আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না কিছুতেই। স্থির করলাম আজই মিশর যাবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে হবে। মিশর যাবার প্রস্তুতির সবকিছু ঠিকঠাক হতে আরও সপ্তাহ ক্ষানেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু এই সময়গুলো কিছুতেই কাটতে চাইবেনা। সারাক্ষন এক অস্থিরতা কাজ করবে। তাই এই সময়টাতে দূরে কোথাও হতে ঘুরে এলে মন্দ হতনা। স্থির করলাম টেকনাফ থেকে ঘুরে এলে হয়ত সময়গুলো কিছুটা হলেও বীণা অস্থিরতায় কেটে যাবে। তাই টেকনাফের পথে বেরিয়ে পরলাম। একপাশে উঁচু পাহাড় আর সরু পথের একপাশ দিয়ে বয়ে চলে গেছে নাফ নদী। এমন মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে অবশেষে টেকনাফ শহরে এসে পৌঁছেছি। এর আগেও বেশ কয়েকবার টেকনাফ এসেছি কিন্তু এবারের আসাটা আমাকে জীবনের এমন এক পর্যায়ে এনে দাড় করিয়ে দিল যেখান থেকে ফিরে আসার কোন পথ আমার জানা নেই।
পর্যটন মোটেলের রুম নাম্বার ১৩। হঠাৎ সেল ফোনে একটি অজানা নাম্বার থেকে কল এলো। হ্যালো আমি যূথী বলছি। তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাই এক্ষুনি। আমি কি আসব তোমার রুমে ?
আমি কিছু বলার আগেই লাইনটি কেটে গেলো। এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া ভীষণ কষ্ট সাধ্য। তবু যে কল এসেছে সেটাই ভাগ্যের ব্যাপার। ফোন রেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পরলাম। যূথী নামের কাউকে কি আমি চিনি ? আর আমি যে এখানে এসেছি কাউকে কিছুইতো জানাইনি তাহলে আমি যে এখানে আছি এই মেয়েটি জানল কিভাবে ? আর আমার সাথে এখানে এভাবে দেখা করতে চাচ্ছে ? কোন প্রকার হিসাব মেলাতে পারছিনা। ভাবতে ভাবতে বিছানার পাশে সাইড টেবিলের উপরে রাখা বার্মিজ রামের বোতলটির দিকে চোখ পড়ল। বোতলটি অর্ধেক খালি কেউ হয়ত খেয়ে রেখে গেছে। যতদূর মনে পরছে এটি আমি এখানে খেয়ে রাখিনি। এমনকি বোতলটি আমি আনায়নি। তাহলে কেমন করে এলো এটি এখানে ? নাহ সবকিছু এলোমেলো লাগছে ! তবু হাতের কাছে এমন একটি অমৃত সুধা পেয়ে অবজ্ঞা করলে অন্তর আত্মা কষ্ট পাবে। তাই বাকিটা শেষ করে একটি সিগারেট ধরালাম। সাধারনত সিগারেট টানলে বুকের ভেতর সুখ অনুভূত হয় কিন্তু প্রথমবারের মত সিগারেট টেনে কোন তৃপ্তি পেলামনা। তবু নির্বিকার টেনে যাচ্ছি। মনের ভেতর যূথী নামের মেয়েটির আসার প্রতীক্ষা কাজ করছে।
দরজায় কাড়া নাড়ার শব্দ হল। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই মেয়েটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকেই বিছানায় বসে পড়ল। মেয়েটি এমন ভাবে বিছানায় বসল যে পরনের নীল শাড়ির আঁচলটি বিছানায় ছড়িয়ে পরল। আঁচলে একটি পেখম তোলা ময়ূরের ছবি আঁকা রয়েছে। সেই পেখমে আঁকা নীলাভ চোখে আমি মিশরের চলমান দাঙ্গার রূপরেখা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আর মুগ্ধ চোখে ময়ূরের ছবিটি দেখছি মনে হল যেন ঠিক এমনটি করেই মেয়েটি তার পেখমের সবটুকু সৌন্দর্য মেলে ধরে বিছানায় বসেছে। এখনই হয়ত প্রকৃতি তার সুরের মূর্ছনায় আমাকে নাচাবে।
আমার মুগ্ধতাকে গ্রাস করে নিয়ে মেয়েটি বলল, তুমি যে এখানে এসেছো আমাকে জানালে না কেন ? কি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমাকে চেনইনা !
সত্যি আমি আপনাকে চিনতে পারছিনা ! কে আপনি বলুনতো ?
বুঝেছি একটু বেশি খেয়ে ফেলেছ তাই তোমার নেশাটা আজ একটু বেশিই চড়েছে, এই কারণে প্রলাপ বকছো ! যাও হাত মুখ ধুয়ে এসে ফ্রেস হয়ে নাও। দেখবে ধীরে ধীরে সব মনে পরে যাচ্ছে। যাও লক্ষ্মী সোনা আর ওভাবে বোকা ছেলের মত দাড়িয়ে থেকোনাতো। তোমাকে এমন ভাবে মানায় না। ফ্রেস হয়ে এসো, আজ সারাদিন এই রুমের ভেতর তোমাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বসে থাকব। সেই কতদিন পর তোমাকে আজ কাছে পেয়েছি ! অপেক্ষায় থাকার কষ্ট তুমি কি করে বুঝবে ? কত কাল এভাবে কাটিয়ে দিয়েছি শুধু তোমার একটু স্পর্শ ফিরে পাবো বলে। তোমার একটু স্পর্শ আমাকে আবার প্রাণের স্পন্দনে জীবিত করে তুলবে। সেসব বোধ যদি তোমার থাকত তবে তুমি কিছুতেই এভাবে এতকাল ধরে আমাকে অপেক্ষায় রাখতে পারতেনা। আমার কাছ থেকে এত দূরে থাকতে পারতেনা। অবশ্য আমারই ভুল ছিলো সেদিন তোমাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিয়ে আমার চোখের সীমানা থেকে।
চোখ শব্দটি কানে বাজতেই হঠাৎ কেমন যেন আমার চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসল। চোখের সামনে দেবী আইসিসের মন্দিরের সেই দৃশ্য দেখতে পেলাম। যূথী আমাকে দেখে হাসছে। উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার চোখে তখনও আইসিসের সেই রক্ত ঝরা চোখের দৃশ্য ভাসছে। কেউ যেন কান্না জড়ান কণ্ঠে আমার কানের কাছে এসে শুধু একবার ডাকল ওসাইরিস ! আমি যূথীকে আরও শক্ত করে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলাম।
যূথীর সাথে সেটাই ছিলো আমার শেষ দেখা। টেকনাফ থেকে বিদায় নিয়ে মিশর এসেছি। মন্দিরের ভেতর দেবী আইসিসের মূর্তি ভাঙা অবস্থায় পরে রয়েছে। বুঝলাম কেউ সাহস করে এখানে আর হাত দেয়নি। তবে কোথাও রক্তের চিহ্ন পেলামনা। তাহলে হয়ত সেটি আমার নিতান্তই কল্পনা ছিলো অথবা কেউ রক্ত ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখে গেছে ! আমি ভাঙা টুকরো গুলো স্পর্শ করছি আর অবচেতন মনে কাঁদছি। আমার চোখ থেকে অশ্রু নয় রক্ত ঝরে এলো। আমি ভীষণ ভয় পেলাম। দৌড়ে বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে। বালু ভূমির উপর দিয়ে এভাবে কতক্ষন পালিয়ে বেড়াচ্ছি মনে নেই। মাথার উপর সূর্যের আগুন পোড়া রোদ। ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু কোথাও পানি পেলামনা। চৈতন্য হারিয়ে বালুর উপর শুয়ে পরলাম। যখন জ্ঞান ফিরে এলো নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি প্রাসাদের ভেতর মেঝেতে শুয়ে আছি। পাশেই একটি পিতলের জগ রাখা আছে। পানি ভেবে একটু পান করেই বুঝলাম এটি পানি নয় ঠিক যেন সেই বার্মিজ রাম। প্রাসাদের চারদিকের দেয়ালে আঁকা রয়েছে হোরাসের প্রতিচ্ছবি আর দেবী আইসিসের কোলে শিশু হোরাসের স্তন্য পানের দৃশ্য। আমি মুগ্ধ চোখে দেখছি সেই মমতাময়ী মায়ের নিঃসঙ্গতা যেন দেবতাদের হিংস্রতার কবল থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রতীক্ষায় আছে তার ওসাইরিসের।
পেছন থেকে একটি হাত আমার কাঁধে স্পর্শ করল। আমি ফিরে তাকিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। যূথী আমাকে অভয় দিয়ে বলল ভয় পেয়না। ভাল করে তাকিয়ে দেখ আমি তোমার সেই যূথী। তুমি যখন মরুভূমিতে অজ্ঞান হয়ে পরেছিলে, আমিই তখন তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।
কিন্তু তুমি এখানে কবে এলে ?
আমিতো এখানেই থাকি। এটাইতো আমার বাড়িঘর, ঠিকানা সবকিছু।
কিন্তু সেদিন যে তোমার সাথে টেকনাফে দেখা হল !
হ্যাঁ আমিই ছিলাম সেদিন তোমার সাথে। কেন আমি কি ওখানে যেতে পারিনা ?
না তা কেন পারবেনা ? অবশ্যই পার যেতে। আবার চলেও আসতে পার। কিন্তু আমাকে কিছুই যে বললেনা। আগে বললে দুজনেতো একসাথেই এখানে আসতে পারতাম।
হুম তা হয়ত পারতাম ! কিন্তু তোমাকে তাহলে এভাবে যে পাওয়া হতোনা আমার।
আমাকে এভাবে পেয়ে তুমি কি সুখ পেলে ?
অনেক অনেক অনেক বেশি সুখি হয়েছি ! তোমাকে বোঝাতে পারবনা আমি। শুধু জেনে রেখো, অনেক কাল পর, অনেক সাধনায় তোমাকে পেয়েছি। আর হারাতে দেবোনা তোমাকে আমার কাছ থেকে। আমার চোখের সীমানা থেকে তুমি আর কখনো কিছুতেই হারিয়ে যেতে পারবেনা। আমার বিশ্বাস ছিলো আমাদের একমাত্র সন্তান হোরাসের চোখ কখনও মিথ্যে হতে পারেনা। তুমি তাকিয়ে দেখো তোমার ছেলে হোরাসের চোখের দিকে। আজ ওর চোখে তৃপ্তির হাসি ফুটেছে। এই প্রাসাদের দেয়ালে আঁকা ওর চোখের সমস্ত হিসাব মিলে গেছে।
যূথী কাঁদছে। সেই কান্নার শব্দ প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে ফিরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে আমার কানে। সেই কান্নার সাথে অশ্রু নয় রক্ত ঝরে এলো চোখ থেকে যূথীর। আমি উঠে গিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম যূথীকে।
ফজরের সময় হয়ে এসেছে। বাড়ির পাশেই মসজিদ হতে আযান দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় কুকুরগুলোর নিয়মমাফিক চিৎকার চ্যাঁচামেচি বেড়ে গেছে। ঘুম ভেঙে গেলো আমার। এতক্ষন তবে স্বপ্ন দেখছিলাম ! পাশেই গভীর ঘুমে শুয়ে আছে আমার স্ত্রী আর দুই ছেলে। ওরা এসব স্বপ্নের কিছুই জানেনা আর জানবেওনা কখনও। আমি রেশমির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি কতটা নিশ্চিন্ত নিরাপদ অভয়আশ্রমে তার নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবীর কোন ব্যাঞ্জনা তাকে বিচলিত করবেনা। আমি রেশমির ঘুমন্ত চোখে একরাশ আদর মাখা চুমু খেয়ে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। একটি সিগারেট মুখে নিয়ে দেয়াসলাইয়ের কাঁঠি জ্বালিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ প্রচন্ড বাতাস এসে কাঁঠির আগুন নিভিয়ে দিলো। আরেকটি কাঁঠি জ্বালাব কিন্তু সেই সৌভাগ্য হল না এই ভোরে। বাক্সে আর কোন কাঁঠি অবশিষ্ট নেই সিগারেট জ্বালানোর জন্য। সোলেমান চাচার দোকান সকাল আটটার আগে খুলবে না। কাজেই সকাল হবার প্রতীক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কাল দুপুরেই আমার ফ্লাইট। অফিসিয়াল ট্যুরে মিশর যাচ্ছি। আমার স্ত্রী আর আর বড় ছেলে বেশ বড় একটি লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে যেন আমি ওদের জন্য মিশর থেকে সেগুলো কিনে আনি। অনলাইনে বসেছি পত্রিকা পড়ব বলে। আজ সারাদিন পত্রিকা পড়া হয়নি নানা রকম কাজের ভিড়ে ব্যাস্ত থাকার কারণে। অনলাইন পত্রিকার হেডিং এ দৃষ্টি আঁটকে গেলো। আমি শুধু নির্বাক হয়ে পড়লাম, লেখা রয়েছে ব্রেকিং নিউসঃ মিশরে চলমান দাঙ্গায় দেবী আইসিসের মূর্তি ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৯