পৃথিবীর শব্দগুলো ঠিক সেভাবে আর শোনা হয় না। ভোরে কাজে বের হবার পূর্বে কানের মধ্যে একটি ইয়ার ফোন গুঁজে দিয়ে হাই রেজুলিউশন অডিও শুনতে শুনতে খুব কম সময়ে শেষ হয়ে যায় যাত্রা পথ, সাথে থাকে ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটেগ্রাম,স্নেপচাট, হোয়াটসআপ, ভাইবার ইত্যাদি ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া।তাই সময় স্রোতের অনুকূলেই বয়ে চলে খুব খুব বেশী তারাতারি। মুহূর্তেই যোগাযোগ হয়ে যায় পৃথিবীর নানান প্রান্তে থাকা শত সহস্র মানুষের সাথে।টাইম ট্রাভেলরের স্বাদ আমারা এখান থেকেই পাচ্ছি, কিন্তু পৃথিবীর শব্দগুলো কি আমরা সেই আগের মত শুনি?পৃথিবীর শব্দ বলতে পাখির ডাক, পাতা ঝরার শব্দ, বাতাসের শব্দ, শিশিরের শব্দ ইত্যাদি ইত্যাদি।সত্য বলতে এখনো অনেকেই শোনে এবং শুনতে ভালোবাসে , কিন্তু আরও কিছুকাল পরে অবশিষ্ট আর কেউই রইবে না।অথবা এই শব্দগুলো পৃথিবীর কাছ থেকে শোনারও কোন প্রয়োজন নেই আমাদের। আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স (AI) আমাদের জন্য এই কাজটি অতি সহজেই করে দিচ্ছে এবং আরও সহজ থেকে সহজতর করে দেবে ভবিষ্যতে ।সহজ সমাধান থাকতে কে চাইবে কঠিন পথে চলতে?
এই তো ক'দিন আগে লন্ডন ট্রান্সপোর্টের লাল বাসে বসে আছি। আমি শুনছিলাম হাইরিজলিউশন অডিও মিউসিক" আহারে জীবন আহারে জীবন" হেড সেটের সাহায্য। কি সুন্দর রিনিঝিনি শব্দ! আর আমার থেকে এক সিট আগে বসে থাকা একজন বেশ বয়জ্যেষ্ঠ ভদ্রমহিলা স্ব সুরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে দিব্যি গুন গুন করছিলো আমার খুব খুব পছন্দের একটি গান। গান গাচ্ছিলো আর জানালা দিয়ে তকিয়ে ছিল পৃথিবীর আকাশে, কি যেন এক অনাবিল প্রশান্তি ছিল তার বডি মুভমেন্টে । আর আমাদের মত ফেইসবুক অর্থাৎ নানান প্রকার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা যাত্রা পথে তাকিয়ে থাকি মোবাইলের জানালা দিয়ে ফেইসবুকের নীল আকাশে- কত তারার মেলা সেখানে, কত খেলা আর কতই না বাত বিতণ্ডা চলছে অনর্গল সেই নীল আকাশে।কিছুক্ষণের জন্য সব বন্ধ করে সেই বৃদ্ধার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের গুন গুন শুনছিলাম আর স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে দেখছিলাম, কেমন যেন এক পার্থিবতা ছুঁয়ে গেল আমার চোখে মুখে।পৃথিবীর নিজস্ব একটি অসাধরন শব্দ রয়েছে,আহ কি প্রশান্তি! ইয়ার ফোন ছাড়া ন্যাচারাল শব্দগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো আমি অন্য কোন জগতে চলে এসেছি। পৃথিবীটা বেশ অচেনা মনে হলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
আমারা সবাই পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড দখল করে আছি । ,পায়ের নীচে যে মাটি রয়েছে সেই মাটিও মাঝে মাঝে অনুভূত হয় না, ভার্চুয়াল পৃথিবীর বাসিন্দা হওয়ার ফলে। মাটির শরীরে বন্ধী এই বায়বীয় মন কয়েক মিলিয়ন, বিলিয়ন অথবা ট্রিলিয়ন ভার্চুয়াল পৃথিবী গড়ে তুলছে প্রতিনিয়ত । সেই পৃথিবীতে অনেক মানুষ, তবে তারা কেউই মাটির মানুষ নয়, সবাই কল্পনায় গড়ে ওঠা মানুষ।আমরা সেই কল্পনাতেই বসবাস করি আজকাল। পায়ের নীচের খণ্ডাংশ পৃথিবী নিয়ে অত শত ভাবার সময় নেই। কিছুকাল পরে হয়তো আমাদের আর শরীরের প্রয়োজন হবে না। আমাদের মনকে আমাদের মস্তিষ্ক থেকে ডাউনলড করে সুপার কম্পিউটারে আপলোড করে সংরক্ষণ করা হবে। আমারা অমর হয়ে যাবো আর ভার্চুয়াল পৃথিবীর স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবো। একদম মিথ্যে বলছি না, এডভান্স প্রযুক্তি এটা করার ক্ষমতা রাখবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই।
বেশ কিছুদিন আগে একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম, সেখানে লেখা ছিল অদূর ভবিষ্যতে মানুষেরা ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন অর্থাৎ নানান প্রকার আবেগ গুলো বুঝতে পারবে না। পড়তে পারবে না চোখের ভাষা , এমনকি রাগের সময় মানুষের মুখের এক্সপ্রেশন কেমন হবে, দুঃখে কেমন হবে, অথবা আনন্দের এক্সপ্রেশন সম্পর্কে কোন ধারনা থাকবে না। কারন মানুষ আর মানুষের মুখের দিকে তাকায় না, ধীরে ধীরে একেবারেই তাকাবে না , তারা তাকিয়ে থাকে ছোট্ট একটি ডিভাইসের গভীর জানালার দিকে যেখানে রক্ত মাংসের মানুষের মুখ তারা দেখে না।এমনও হতে পারে যে মানুষের দুঃখিত হওয়া বা আনন্দিত হবার ম্যাকানিজমই নষ্ট হয়ে যাবে রোবটের মত । জানি না আফসোস করা উচিৎ কিনা!! আসলে আফসোস করারও কিছুই নেই। কারন, পরিবর্তন অপরিহার্য, পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে থাকতে পারে না, সে গতিময়। আমাদের পৃথিবীসহ সম্পূর্ণ সৌরজগৎ ধীরে ধীরে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে ব্ল্যাক হোলের দিকে, সে একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকে না বা থাকবেও না কখনো।এভাবে একসময় এগোতে এগোতে ঝাঁপিয়ে পরবে ব্ল্যাক হোলের ভিতরে। এর পরে কি হবে কেউ জানে না। সেরকম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমারাও ধাবিত হই। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা আমারা কেউ জানি না, তবুও এগোচ্ছি। এছাড়া, আর কোন উপায়ও নেই। এগিয়ে যাওয়াই যে প্রকৃতির নিয়ম।
মানুষ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে প্রারম্ভে গ্রহণ করতে পারে না, অথচ এর স্বাদ যখন পেয়ে যায় তখন আর ছাড়তেও পারে না। যেমন- টেলিফোন আবিষ্কারের ফলে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং মানুষের সুযোগ সুবিধাও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কিন্তু তারপরও টেলিফোন আবিষ্কারের প্রারম্ভে মানুষের এ নিয়ে নানান দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল এবং ঐ উন্নত প্রযুক্তিকে তখনকার সময়ও তখনকার অতি প্রক্রিয়াশিল মানুষ অনুৎসাহিত করেছে। অথচ মানুষের টেলিফোনের আবিষ্কারে ক্ষতি তেমন কিছুই চোখে পরেনি , বরং আপাত দৃষ্টিতে মানুষ উত্তর উত্তর উন্নতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এখন এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষের সুবিধা এবং সুযোগ এতোটাই বেড়েছে যে কোনটা ফেলে কোনটা বলি ।
আসলে উপকার যেমন হয়েছে, ক্ষতিও হয়েছে অনেক যেটা অতি সহজে চোখের সামনে আসে না। সাইন্টিস্টরা চাইবেই বিজ্ঞানের উত্তর উত্তর উন্নতি। ব্ল্যাক হোলের দিকে পৃথিবী যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই আলোর দিকে যাচ্ছে, আর বিজ্ঞান আসক্তি সেই আলো অথবা আগুনে ঝাপ দিতেও দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু আমারা সাধারণ মানুষেরা কি চাই? হয়তো সুন্দর ভাবে পৃথিবীর জীবন কাঁটাতে চাই। তাই যত প্রকার সুযোগ সুবিধা আছে, সবই পেতে চাই সব রকম সাইড এফেক্ট ছাড়া। কিন্তু সাইড এফেক্ট ছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব নয়।যদি কেউ সাইড এফেক্ট না চায় তবে তাকে আদিম যুগে ফিরে গিয়ে অরগ্যানিক জীবন যাপন করতে হবে।কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়, কারন আধুনিক প্রযুক্তি এমনই এক খাঁচা তৈরি করে রেখেছে, যেই খাঁচায় আমরা সবাই বন্দী। চাইলেই সেখান থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই। আধুনিক প্রযুক্তি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে প্রকৃতি এবং মানুষের মাঝে এক বিশাল দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। তাই প্রকৃতির সাথে আমাদের আর ভালো সম্পর্ক নেই।
আমারা প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি আলোর পথে, মাঝে মাঝে ভয় হয় সেই আলো আগুন হয়ে আমাদের ছাই করে দেবে কিনা!!! তবুও আলোর পথে ছুটে চলা পিপীলিকার দল আগুন ছুঁয়ে ছাই হতে চায়।এ এক নেশা, মরন নেশা!!
ছবি সূত্রঃ গুগোল ইমেজ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০০