১৮৫০ সালের কথা! ভারতবর্ষে তখনও ব্রিটিশ সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি; সেখানে চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন, আর শাসন মানেই তো শোষণ। অনেক ইংরেজ তখন ভাগ্য গড়ার জন্য পাড়ি জমাত ভারতে। এরকমই একজন ইংরেজ ছিলেন হেনরি লেয়ার্ড। শ্রীলংকায় তার একটি ভাল চাকরি হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি রওনা দিয়েছিলেন ভারতের পথে। সোজা পথে জাহাজে রওনা দিলেই পারতেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর কী যে মনে হল!
সিদ্ধান্ত নিলেন মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেশ দেখে স্থলপথে ভারতে আসবেন। এসব দেশ তখন ছিল তুরস্কের ওসমানীয় খিলাফতের অধীনে; তাই অনুমতি নিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যে। উত্তর মেসোপটেমিয়ায় বেড়াবার সময় তার মনে হল, এই তো সেই প্রাচীন জাতির দেশ, এখানে খুঁজলে কি তাদের চিহ্ন পাওয়া যাবে না? তাঁর আর চাকরি করা হল না। কিছু মজুর নিয়ে লেগে গেলেন খননের কাজে। এক সময় সংগের টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেল।
চিত্র: মেসোপটেমীয় সভ্যতার নিদর্শন
আবার টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে খনন শুরু করলেন। খুড়া-খুড়ি দেখে আরও কিছু কৌতুহলী লোকজন এসে তাদের সাথে যোগ দিল। তুর্কী রাজ-কর্তৃপক্ষ ঘরবাড়ী ছেড়ে বিদেশে এসে এই মাটি কাটার কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তারা এর ব্যাখ্যা চাইল। তবে আরও কিছু খননের পরে যখন মাটির নীচ হতে নানা রকম অদ্ভূত মূর্তি আর ঘর-বাড়ি বের হয়ে আসতে লাগল তখন তাদের বিস্ময়ের আর সীমা থাকল না। অবশেষে ইংরেজ ও ফ্রান্স সরকারের সহায়তায় খনন কাজ আরও কিছু দূর অগ্রসর হল।
এক সময় শ্রমিকের গাইতি-কোদাল থেমে গেল। মাটির নীচ হতে বেরিয়ে পড়ল এক আশ্চর্য শহর। এই শহর ছিল অ্যাসিরীয়দের রাজধানী, এর নাম নিনেভা; এই শহর ধ্বংস হয়েছিল ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তবুও তার অনেক কিছুই আজও অক্ষত। এই শহরের ধ্বংসস্তুপে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন পৃথিবীর এক বিশাল গ্রন্থাগার! গ্রন্থাগারটি স্থাপিত হয়েছিল ৬৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে; স্থাপন করেছিলেন অ্যাসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপাল। এরও দেড় হাজার বছর আগের মৃৎফলক সেখানে পাওয়া গেছে।
চিত্র: কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা একটি মৃৎফলক
কাঁদামাটির মৃৎফলকে লিখে সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ইটের মত শক্ত করে নেওয়া হতো। তাই মাটির নিচেও সেগুলো অক্ষত অবস্থায় থেকে গিয়েছে। এগুলোই হল আসুরবানিপালের পাঠাগারের বই। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা এই পাঠাগারের হাজার হাজার মৃৎফলকের সাহায্যেই। আসুরবানিপাল তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা পুরনো আমল থেকে তখন পর্যন্ত লেখা যতগুলো মৃৎফলক ছিল তার সবগুলো জড়ো করেন তাঁর পাঠাগারে।
এখানে সুমেরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত বানানো মৃৎফলক ছিল। অনেক পুরনো সুমেরীয় মৃৎফলক তিনি সংরক্ষণ করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও সুমেরীয় শহর নিপ্পুরে পাওয়া গিয়েছিল ৫০০০ মৃৎফলক। এসব মৃৎফলক থেকেই বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়ের মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলোর ইতিহাস। এ অঞ্চলে কয়েকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল; এবার দৃষ্টি দেয়া যাক সে ইতিহাসের দিকে।
সুমেরীয় সভ্যতা:
সুমেরীয় সভ্যতার শুরু প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। এটিই মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। এর সমসাময়িক সভ্যতা হল মিসরীয় সভ্যতা। বেশ কিছু শহর নিয়ে সুমেরীয় সভ্যতার বিকাশ; এগুলোর মধ্যে উর, ইউরুক, লারসা, ইরুদু এবং কিশ ছিল উল্লেখযোগ্য। সুমেরের অবস্থান ছিল মেসোপটেমিয়ার সর্বদক্ষিণে। সুমেরীয় নগরগুলো ছিল বিভিন্ন দেবতার অধীনে সার্বভৌম। একক কোন রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। শুধু যুদ্ধের প্রয়োজন হলেই তারা একত্রিত হতো। কৃষি ছিল আয়ের মূল উৎস। সমাজ ছিল শ্রেণিবিভক্ত।
কিউনিফর্ম নামে একটি অক্ষরভিত্তিক বর্ণলিপি উদ্ভাবন করেছিল সুমেরীয়রা। ফিনিশীয় বর্ণমালার আরামীয় ভাষার আগ পর্যন্ত এটিই ছিল সে অঞ্চলের প্রচলিত লিপি। অসংখ্য মৃৎফলক লেখা হয়েছে এ লিপিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মহাকাব্যটি হল সুমেরীয়দের রচিত গিলগামেশ মহাকাব্য। আসুরবানিপালের পাঠাগার হতে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা এ মহাকাব্যটি উদ্ধার করা হয়েছে। সূর্যদেবতা শামাস ছিলেন সুমেরীয়দের প্রধান দেবতা। রাজাই হতেন একাধারে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কর্তা।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতা:
মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণের ব্যাবিলন নগরী ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিশাল সভ্যতা, যা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নামে পরিচিত। এ সভ্যতার গড়ে ওঠার শুরু খ্রিস্টপূর্ব ২০৫০ সাল হতে। এর আগে সুমেরের নগরগুলো বিভিন্ন দেবতার অধীনে ছিল সার্বভৌম। সমস্ত সুমেরে এক সার্বভৌম রাজশক্তি কখনও দেখা যয়নি। সেমেটিক ব্যাবিলনীয়রাই সুমেরে তথা মেসোপটেমিয়ায় প্রথম দেশব্যাপী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। রাজা হাম্বুরাবিই প্রথম সমগ্র মেসোপটেমিয়াকে ব্যাবিলনের অধীনে এনে এক অখণ্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম আইনের দৃষ্টান্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্বুরাবির আইনসংহিতা। হাম্বুরাবির রাজত্বকাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯২ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই বিয়াল্লিশ বছরে তিনি তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সম্রাটে পরিণত হন। রাজত্বের শেষ দিকে হাম্বুরাবি তাঁর আদেশিত বিধানমালা প্রস্তরখণ্ডে খোদাই করার নির্দেশ দেন। এই খোদাই করা প্রস্তর স্তম্ভগুলো বিভিন্ন মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এরকম একটি প্রস্তুর স্তম্ভ এখনো প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে চমৎকার অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে।
চিত্র: ব্যাবিলনীয় স্থাপত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন এই ধর্মমন্দির। সাতটি
ধাপে ৬৫০ ফুট উঁচু পিরামিডের মতো এই মন্দিরটির নাম ছিল জিগুরাত
এ স্তম্ভটি হাম্বুরাবির সময় সিপ্পার শহরের শামাশ দেবতার মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে পশ্চিম ইরানের দুর্ধর্ষ এলামীয়রা এটিকে যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্য হিসেবে তাদের রাজধানী সুসায় নিয়ে যায়। ফরাসি পুরাতত্ত্ববিদেরা ১৯০১ সালে এটিকে সুসার ধ্বংসাবশেষ থেকে খুঁড়ে বের করেন। স্তম্ভটি একটি আট ফুট উঁচু মসৃণ ব্যাসাল্ট পাথর, যার ওপর দিকটা স্থূলভাবে বৃত্তাকার। এখানে একটি ছবিতে দেখা যায় হাম্বুরাব্বি প্রার্থনার ভঙ্গিতে সিংহাসনে উপবিষ্ট শামাশ দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
ন্যায় বিচারের দেবতা সূর্যদেব শামাশ তাঁকে এই আইনসংহিতা দিচ্ছেন এরকমই একটা দৃশ্য খোদাই করা আছে। স্তম্ভের বাকি অংশে সংবাদপত্রের মতন কলামে দুইশত বিরাশিটি আইন অত্যন্ত বিশুদ্ধ ব্যাবিলনীয় ভাষায় খোদাই করা আছে। এই দু’শ বিরাশিটি আইন মূলত নানা রকম আইনভঙ্গ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, পরিবার, সম্পত্তি, বৃত্তিধারী লোকদের পারিশ্রমিক এবং দায়িত্ব, কৃষি সংক্রান্ত আইনগত সমস্যা, ভাঁড়ার হার এবং পরিমাণ, দাস ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি সংক্রান্ত।
চিত্র: হিট্টীয়, মিতানীয় ও প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার অবস্থান
অবশেষে এক লম্বা উপসংহারে বলা হয়েছে, “যে সুযোগ্য রাজা হাম্বুরাবি প্রতিষ্ঠিত এই ন্যায় আইনসংহিতা উৎকীর্ণ স্তম্ভের ক্ষতিসাধন অথবা পরিবর্তন করবে তার ওপরে দৈব অভিশাপ নেমে আসবে।” দৈব অভিশাপ! প্রাচীন যুগের ধর্মীয় কৌশলের কী চমৎকার উদাহরণ এটি। বিধান জারি করলেন রাজা হাম্বুরাবি আর অভিশাপ দেবেন সূর্য দেবতা শামাশ! আবার এই বিধানসমূহ স্থাপন করা হল মন্দিরে মন্দিরে। আইনের ওপরে রয়েছে শামাশ দেবতার ছবি।
অর্থাৎ সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে ধর্ম আর রাজতন্ত্রে মাখামাখি। আজকের যুগে আইনের কাজ হয় আদালতে, তখন হতো ধর্মমন্দিরে; দেবতারা পাহারা দিতেন সেসব আইন, রাজতন্ত্রের যেন একটি অনিবার্য অংশ রূপেই ধর্মের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছিল। তা কী আছে সেসব দৈব আইনে? হাম্বুরাবির আইনসংহিতা ও অন্যান্য প্রাপ্ত প্রমাণাদি থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সমাজ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল; যথা- আওএলুম, মুশকেলুম এবং ওয়ারদুম।
চিত্র: মেসোপটেমিয়ার সবগুলো সভ্যতাই ছিল কৃষি নির্ভর
আওএলুম মানে অভিজাত শ্রেণি, যারা ছিল দাস মালিক; মুশকেলুম মানে সাধারণ প্রজা; আর ওয়ারদুম মানে দাস। আইনসংহিতায় পলাতক ওয়ারদুমের আশ্রয়দাতার জন্য ছিল মারাত্মক শাস্তির ব্যবস্থা। একজন মুশকেলুম যদি কোন আওএলুমের চোখ অন্ধ করে দেয় তবে সেই মুশকেলুমের চোখ অন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু কোন আওএলুম যদি একজন মুশকেলুমের চোখ অন্ধ করে অথবা হাড় ভেঙ্গে ফেলে তাহলে সে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক মিনা পরিমাণ রূপা দিতে বাধ্য থাকবে; এ-ই হচ্ছে সে যুগের মহান রাজা ও মহাশক্তিধর দেবতার ন্যায়বোধ!
অ্যাসিরীয় সভ্যতা:
ব্যবিলনীয় সভ্যতার পতনের পরবর্তী দীর্ঘ সময় জুড়ে অ্যাসিরীয়দের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত মেসোপটেমিয়ায় চলছিল অন্ধকার যুগ। এক সময় মেসোপটেমিয়ার অন্ধকার যুগ কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠল উত্তরের অ্যাসিরিয়া। মেসোপটেমিয়ার উত্তর অংশকে বলা হত অ্যাসিরিয়া। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের সভ্যতাগুলোর মধ্যে সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সভ্যতা হল এই অ্যাসিরীয় সভ্যতা। অ্যাসিরীয় সভ্যতার গড়ে ওঠার সময়কাল অনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে শুরু। ব্যাবিলন থেকে প্রায় দু’শো মাইল উত্তরে দজলা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। এর রাজধানী নিনেভা ছিল ব্যাবিলন নগরী থেকে দুশ মাইল দূরে দজলা নদীর তীরে অবস্থিত।
চিত্র: ৮২৪ ও ৬৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি
লুটের মাল ছিল অ্যাসিরীয় অর্থনীতির মূল উৎস। তারা বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে লুটে আনতো ধন-সম্পদ। বৃত্তকে প্রথম ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করে অ্যাসিরীয়রা। পৃথিবীর সবেচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলেন শেষ অ্যাসিরীয় রাজা আসুরবানিপাল। প্রাচীন সুমেরীয় কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা ২২০০০ টি কাদামাটির শ্লেট ছিল এ লাইব্রেরির বই। সম্রাট আসুরবানিপাল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন। তিনি ছিলেন যেমনই নিষ্ঠুর, তেমনই বিদগ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে যিনি পরিচয় দিতেন চূড়ান্ত বর্বরতার, তিনিই গড়ে তুলেছিলেন প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাঠাগার! তার সময়কাল ছিল ৬৬৮ থেকে ৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
ক্যালদীয় সভ্যতা:
কোন সভ্যতাই ইতিহাসে দীর্ঘদিন পর্যন্ত টিকেনি; বিকাশের এক পর্যায়ে এসে তার পতন ঘটেছে অন্য কোন উদীয়মান সভ্যতার কাছে, অ্যাসিরিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৩০০ বছরের পুরনো এই সভ্যতা প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। নতুনভাবে জেগে ওঠা ব্যাবিলনের ক্যালদীয় রাজা আর পূর্বদিকের পারসীয়রা দখল করে নিলো এ সাম্রাজ্য।
রাজা আসুরবানিপালের মৃত্যুর পরে ব্যাবিলনের রাজা অ্যাসিরীয়দের রাজধানী নিনেভা ধ্বংস করলেন। এটি ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। পুরো অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে কতকগুলো পৃথক রাষ্ট্রের মধ্যে মিশে যায়; এগুলো হচ্ছে মিডিয়া, পারস্য, ক্যালদিয়া, মিসর এবং লিডিয়া। এদের মধ্যে সুযোগ সন্ধানী ক্যালদীয়রা ক্রমে নতুন ব্যাবিলন শহরকে কেন্দ্র করে পুরো মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের প্রভু হয়ে পড়ে।
চিত্র: শিল্পীর তুলিতে নেবুচাদনেজার ও তাঁর রাজধানী
নতুনভাবে জেগে ওঠা এই ক্যালদীয় সাম্রাজ্য ইহুদি ইতিহাসের গতিপথকে বদলে দিয়েছিল। এই সভ্যতা গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন সম্রাট নেবুচাদনেজার। তাঁর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ থেকে ৫৬১ অব্দ পর্যন্ত। বহুদিন আগের রাজা হাম্বুরাবির মতো তিনিও সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে তাঁর পদানত করলেন। বিশেষ করে মিসরীয়দের হাত থেকে সিরিয়া অঞ্চলটি দখল করে এশিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে উঠলেন।
ইতিহাসে তাঁর এ সকল বিজয় অভিযান অন্য আরও দশজন সাম্রাজ্যের অধিপতির মতই বৈচিত্রহীন। কিন্তু একটি নিষ্ঠুর অভিযান তাকে ইতিহাসে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছে; এটি হল ইহুদিদের জুডা রাজ্য ও জেরুজালেম ধ্বংসের অভিযান। নেবুচাদনেজার শেষ বয়সে উন্মাদ হয়ে যান। নিজেকে পশু ভাবতে লাগলেন এবং হাঁটু মুড়ে হাত পেতে পশুর মত হাঁটতে হাঁটতে ঘাস খাওয়ার ভঙ্গি করতে লাগলেন। যৌবনে তিনি বিয়ে করেছিলেন মিডিয়ার রাজকন্যাকে।
চিত্র: রাশিচক্র নামক সুপ্রাচীন কুসংস্কারটি ক্যালদীয়দের সৃষ্টি
মিডিয়া বর্তমান ইরানের অংশ। মিডিয়া ছিল পাহাড় পর্বতের দেশ। রাজকন্যার তাই সমতল ব্যাবিলন শহর ভাল লাগলোনা। রাজা নেবুচাদনেজার তাই রাণীকে খুশি করার জন্য রাজপ্রাসাদের ছাদে তৈরি করেছিলেন কৃত্রিম বাগান। এটিকেই বলা হয় ব্যাবিলনের শূণ্য উদ্যান যা প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। একই সাথে এটি রাজকীয় বিলাসীতারও এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার এসব রাজকীয় বিলাসিতার পেছনে লুকিয়ে আছে অজস্র মানুষের কান্না আর হাহাকার।
রাজ-রাজড়ারা তাদের তুচ্ছ শখ পূরণের জন্য এসব স্থাপনা নির্মাণ করতেন। অন্যদিকে রাজ্যের অসংখ্য মানুষ হয় অনাহারে নয়তো এসব স্থাপত্য নির্মাণ করতে গিয়ে অমানুষিক শ্রমের কারণে ধুকে ধুকে মারা যেতো। রাজতন্ত্রের ইতিহাসের সমস্ত স্থাপত্যকলাই আসলে নিষ্ঠুর কলংকের নিদর্শন। কারণ এসব স্থাপনার জন্য দাস কিংবা চাষীদের ধরে এনে শেকল পরিয়ে কাজে লাগানো হতো। ফলে তাদের জমিগুলো চাষ হত না। দেশে দেখা দিতো খাদ্যসংকট।
এ সংকট রাজারা চাপিয়ে দিত যেসব প্রজারা চাষের কাজে আছে তাদের ওপর; তাদের ফসলের ওপর করের হার বাড়িয়ে দিয়ে। রাজাকে ফসলের অধিকাংশই দিয়ে দেওয়ায় এসব চাষীদের সন্তানরা না খেয়ে মারা যেতো। এসবই হল প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমস্ত স্থাপত্যের পেছনের মর্মকথা। তাই এসব স্থাপত্য গৌরবের বিষয় নয়, বরং এসব স্থাপত্য দাঁড়িয়ে রয়েছে অবিচারের ইতিহাসের নির্মম সাক্ষ্য হিসেবে।
চিত্র: ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে মিডীয়
সাম্রাজ্য, উত্তর-পশ্চিম দিকে লিডিয়া ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মিসরের অবস্থান
প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজ-রাজড়াদের অতিরিক্ত আমোদ-প্রমোদ আর ফূর্তি-বিলাস দেশের সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিতো। এসব আমোদ-প্রমোদের মূল্য পরিশোধ করতে হতো দাস শ্রেণি ও চাষা শ্রেণির মানুষকে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে। অতিরিক্ত ফূর্তি-বিলাস রাজ্যের শ্রমজীবি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতো; ফলে দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়ত দূর্বল ও সংকটগ্রস্থ।
ক্যালদীয়দের ক্ষেত্রেও এটিই ঘটেছিল; অতিরিক্ত ভোগ-বিলাসের কারণে তাদের সাম্রাজ্য একসময় ভেঙ্গে পড়লো, পদানত হলো মেসোপটেমিয়া থেকে দূরে পূর্বদিকের পারস্য দেশে গড়ে ওঠা নতুন সভ্যতার কাছে। পারস্য সম্রাট সাইরাস ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্যালদীয় সাম্রাজ্য তথা সমগ্র মেসোপটেমিয়া দখল করে নেন। এই সাম্রাজ্যই ছিল মেসোপটেমীয় সভ্যতার শেষ ও চূড়ান্ত ধাপ।
পারস্যের উত্থান:
খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ অব্দে অ্যাসিরীয়দের পতন ঘটলে পারস্য উপসাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে আর্যদের একটি শাখা পারস্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তারা যে ভাষায় কথা বলত তাকে বলা হত পার্সি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষার নামে জাতির ও দেশের নাম নির্ধারিত হতো। তাই এক্ষেত্রেও জাতির নাম ‘পারসীয়’ ও দেশের নাম ‘পারস্য’; পরবর্তীতে ভাষার নাম হয় ফারসি। ইরান অঞ্চলে প্রবেশ করা পারসীয় আর্যরা দু’টি প্রধান গোত্রে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল মেডেস। অ্যাসিরীয়দের পতনের পরে এরা আর্মেনিয়া ও অ্যাসিরিয়া অধিকার করে মিডীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
এই মিডিয়ার রাজকন্যাকেই বিয়ে করেছিলেন নেবুচাদনেজার। তাঁর মতই মিডীয়রাও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের এ দূর্বলতার সুযোগ নিল অন্য আর্য গোত্রীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র আনশান। সুযোগ বুঝে এখানকার শাসনকর্তা সাইরাস মিডীয় সাম্রাজ্য দখল করে নিলেন। মিডিয়া ও আনশানের মিলিত শক্তিতে জন্ম নিল শক্তিশালী পারস্য সভ্যতা। ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নিলেন ক্যালদিয়ার রাজধানী ব্যাবিলন। এর আগে দখল করে নিয়েছিলেন লিডিয়া।
লিডিয়া বিজয়ের পরে তার সৈন্যরা অগ্রসর হয় ব্যাবিলনের দিকে; ব্যাবিলনের অভিজাত শ্রেণি তখন আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত। দজলা নদীর তীরেই ছিল ব্যাবিলন শহর। সাইরাসের সৈন্যরা নদীর বাঁধ বন্ধ করে নদীর পানি একদিকে সরিয়ে দিল। তারা শুকনো নদীর ভেতর দিয়ে শহরে ঢুকল এবং বিনাযুদ্ধে ব্যাবিলন দখল করে নিল। সাইরাস আনশানের ক্ষমতায় এসেছিলেন ৫৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বিশ বছরের মধ্যে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। ৫২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক বর্বর জাতির আক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়। এটিই প্রথম বাইরের কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্য যা সমগ্র মেসোপটেমিয়া ও মিসর দখল করে নিয়েছিল।
লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১৮