somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিক্রমপুরের লোকজনের আসাম ব্যবসার ইতিহাস

১৮ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অতিতে ব্যবসা বানিজ্যের জন্য বিক্রমপুরের লোকজন ভারতের আসাম রাজ্য এবং দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলে কেন ছড়িয়ে পড়েছিলেন- এ প্রশ্ন অনেকের নিকট হতে আমাকেও শুনতে হয়েছিল।

আসলে মুন্সিগঞ্জের এ এলাকাটি বন্যা প্লাবিত, নদী ভাঙন ও ডুবা এলাকা হিসাবে পরিচিত ছিল, আষাঢ়-কার্ত্তিক এ ৫/৬ মাস ভরা বর্ষায় তেমন একটা কাজ থাকত না অথবা কাজ থাকলেও পরিবারের ২/১ জনই একাজের জন্য যথেষ্ট ছিল।

‘১৮ শতকের শেষ দিকে পদ্মার প্রবল ভাঙনে লৌহজং ও শ্রীনগরের বিরাট অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, সে সময় আমাদের পূর্ব পুরুষের ভিটা লৌহজং থানার ‘পাইনপাড়া’ গ্রামটিও হারিয়ে যায়।

পদ্মা সেতুর অধিগ্রহন করা জাজিরা উপজেলার তালিকায় পাইনপাড়া নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মুলত: সহায় সম্বলহীন জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কাজের সন্ধানে ভারতবর্ষের আসামে চলে যান, সেখানে গিয়ে দর্জি, তৈরি জামা কাপড়, হাড়িপাতিল, মনোহরি, ছাতা মেরামতি, হুক্কা তৈরি ইত্যাদির কাজ যুগিয়ে নেন।

প্রথম দিকে ব্যবসাটি মৌসুমী ছিল অর্থাৎ ৬ মাস বিভিন্ন হাটেও চা বাগান এলাকায় ভাসমান দোকান দিয়ে ব্যবসা করে অগ্রহায়ন- পৌষ মাসে গাট্টি বেঁধে গ্রামে ফিরে এসে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হয়ে যেতেন। গ্রামের কাজ শেষে আবার আসাম গিয়ে গাট্টি খুলে পুনরায় ব্যবসা শুরু করতেন।

পরিবারের জনসংখ্যা বেড়ে গেলে আসামের ব্যবসাটি আর মৌসুমী থাকে নি, এরপর একজন যেত, একজন আসত এভাবে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকলে ভাসমান দোকানের বদলে স্থায়ী দোকান হতে থাকে।

আমাদের পরিবারের প্রথম বাবা মোহন খান মাত্র ৯ বছর বয়সে ১৯২৮ সালে তাঁর মামা খাদিম শেখের সাথে আসামের লক্ষ্মীপুরে যান, শুরুটা হয় সাগরেদের ভুমিকা নিয়ে, এরপর খলিফার যোগানদারী, দর্জির কাজ শেখা, এ পর্বগুলো শেষ হলেই স্বাধীন ব্যবসা।

বছরখানেক পর গ্রামে এসে একমাত্র খালার নিকট হতে ১০ টাকা নিয়ে বাবা দীঘলী বাজারে গিয়ে একটি ‘বগা’ নামক হালকা সেলাই মেশিন কিনে আবার আসামের চীন সিমানার কাছে শিবসাগর জেলার ‘মরানহাট’ নামক স্থানে কাকা ফৌজদার খাঁর নিকট গিয়ে উঠলেন, মরানহাটটি ডিব্রুগর জেলা সংলগ্ন, শুরু হল তাঁর নিজস্ব ব্যবসা। এরপর স্থায়ী দোকান দিলেন, থান কাপড়ের পাইকারী ব্যবসার পাশাপাশি তৈরি পোশাকের পাইকারী ব্যবসাও চলেছে। থান কাপড় দীঘলীর পালের বাজার হতে কিনে স্টীমারে বুকিং দিলে ২ দিনেই গন্তব্যে চলে যেত।
নদী ভাঙন, দূর্ভিক্ষ, ২য় মহাযুদ্ধ ও গোর্খা সৈন্যদের কান্ড

১৮৯o- ৯৮ সময়কালে বিক্রমপুরের সাবেক দীঘলী বন্দরের ১ কিমি দক্ষিনে পূর্বপুরুষের পাইনপাড়া গ্রামটি পদ্মায় ভেঙে গেলে আমাদের অভিজাত গৃহস্থ পরিবার ও নিকটজন শ্রীনগর ও লৌহজং এর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। বাবার দাদা বেঙ্গু খাঁ উত্তর কোলাপাড়ার দুখাই হাজী বাড়ির কাছে তাঁর নিকটজন সিএস রেকর্ডের মালিক গোলাপ খাঁর বাড়ি (বর্তমান ভাগ্নে শহীদুলদের বাড়ি) এসে উঠলেন, আমাদের তিন দাদার জন্ম ওখানেই।

পিতা মোহন খানের ১৯২৮ সালে আসাম যাবার প্রায় ৩০ বছর আগে থেকেই দাদা আদালত খান এবং দাদু আরজুদা বেগম এর নিকটজনসহ গ্রামের ও বিক্রমপুরের অন্যান্য এলাকা থেকে আসাম যাবার প্রবণতা ছিল, ১৯৩০-৪৭ সময়কালে লোকজনের আসাম যাবার ঢল নেমেছিল।

একজন গেলে পরিবারের বা গ্রামবাসী ধরাধরি করে আসাম চলে যেতেন, যেমনটা পরবর্তীতে দেখেছিলাম বিদেশ যাবার ও গার্মেন্টস এর চাকুরির ক্ষেত্রেও।

রাড়িখালের মাইনুদ্দিন খলিফা দেশে এসে ডেকে ডেকে লোকজনকে আসাম নিয়ে যেতেন, ভারতবর্ষে আসাম যেতে আসতে এক টিকেটে স্টীমার/রেলে চড়ে এদিকে গোয়ালন্দ-পার্বতীপুর- লালমনিরহাট হয়ে আসাম রুট ছিল, অপর দিকে মৌলভীবাজারের লাতু দিয়ে আরেকটি রুট ছিল।

আপার আসামের শিবসাগরে পিতার ব্যবসা কেন্দ্র মরানহাট যেতে ১দিন ১রাত পাড়ি দিয়ে কাছাকাছি শিমুলগুড়ি রেল জংশনে নামতে হত।

যাওয়া আসার পথে ৩৬টি পাহাড়ের গুহা (স্থানীয় ভাষায় বুগদা) ডিঙ্গিয়ে যেতে হত, ৭টি বড় গুহায় ঢুকার আগে কয়লায় চালিত রেল বগিতে লাল বাতিসহ রিং বেজে উঠলেই যাত্রীরা জানালা বন্ধ করে দিত নইলে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হবার উপক্রম হত।

২য় মহাযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হলে বাবা বুঝতে পেরেছিলেন- গ্রামে থাকলে খাদ্যাভাব হতে পারে, এজন্য পুরো পরিবার নিয়ে আসাম চলে এলেন, তাঁর দেখাদেখি বাবার দুই কাকার পরিবার ও আসাম চলে এলেন, বাড়িতে সবার দোতালা ঘরসহ অন্যান্য ঘরে তালা লাগিয়ে দিলেন, বাবা প্রয়োজনীয় খোরাকীসহ পাশের কারিগর বাড়ির ‘গইজ্জার মা’কে রেখে আসেন ঘর পাহাড়া দেয়ার জন্য।

পিতার পরিবার মরানহাটের নাসির খাঁ পট্টিতে বসবাস শুরু করলেন, আমাদের পরিবারের বাসা শিবসাগর জেলার মরানহাটের মসজিদ রোডের নাসির খাঁ পট্টিতে আগুন লাগার কারনে জুম্মন বেপারীর বাড়িতে স্থানান্তরিত হল, ২ বছর থাকার পর দোকান বা ব্যবসা কেন্দ্রের পেছনে ইয়ারনির বাড়িতে বাসাটি চলে এলো, এ বাড়িতে কাঠ টিনের ঘরে বসবাসরত থাকা অবস্থায় মামলায় জিতে অর্ধেকটা রানির মা দখলে নিলেন, উল্লেখ্য, নাসির খার বাড়ি ওয়ারীতে, জুম্মন বেপারী, ইয়ারনি ও রানির মা সবার বাড়ি বিক্রমপুরে, ইয়ারনি আমাদের ভাগ্নে শহীদুলদের আত্মীয়।

বাবা ২য় ভাই ছামাদ খান কে ব্যবসায় সম্পৃক্ত করলেন, গ্রাম থেকে খবর আসতো সেখানে খাবার সংকট ও বসন্ত রোগে বহু লোক মারা যাচ্ছে, ইংরেজী ১৯৪৩ বাংলা ১৩৫০ সময়কালকে ইতিহাসে ‘পঞ্চাশের মণন্তর’ বলা হয়, তখন আমাদের দেশেও বহু লোক মারা যায়, যুদ্ধের কারনে সরবরাহ না থাকায় টাকা দিয়েও খাবার পাওয়া যায় নি।

বাবা যে মহিলাকে ঘরে রেখে এসেছিলেন তিনি বসন্ত রোগে ঘরেই মরে পঁচেছিলেন, দুর্গন্ধ ছড়ালে লোকজন দরজা ভেঙে বেত দিয়ে বেঁধে পানিতে টেনে নিয়ে হাতারপাড়া গোরস্থানে মাটিচাপা দিয়ে আসেন।

এ ঘটনা শুনে দাদী গ্রামে আসার জন্য কান্নাকাটি করেন, যুদ্ধের কারণে রাস্তায় চলাচল বিপদজনক ছিল, পরিস্থিতি কিছুটা অনুকুল হলে বাবা এবং তার ভাই ছামাদ খান বাদে সবাই গ্রামে চলে আসেন।

কাকা ছামাদ খান আলাদাভাবে একটি প্রসাধন সামগ্রীর মনোহরী দোকান দিয়েছিলেন, তখনো ২য় মহাযুদ্ধ শেষ হয়নি পাশেই মিত্র বাহিনীর সেনা ক্যাম্প, এখানকার গোর্খা সৈন্যরা দোকানের জিনিষপত্র বাকী নিয়ে টাকা দিত না, কাকার দোকানে অনেক বাকি পড়ে গেল , মাল না দিলে ভয় দেখাতো, বিষয়টি বাবাকে জানালে তিনি একদিন দোকানের পাশে বসে থাকলেন দৃশ্য দেখার জন্য, দু ‘জন গোর্খা সৈন্য এসে কাকার সাথে তর্কে লিপ্ত হলে সুঠামদেহী বাবা ঐ দু’জনকে গামছা দিয়ে বেঁধে রাখেন, এ খবর কাম্পে পৌঁছালে সাইরেন বাঁজিয়ে অনেক সৈন্য চলে আসে , আত্মরক্ষার জন্য বাবা ঘোড়ায় চড়ে ১০ কিমি পর্যন্ত গিয়ে একটি খাবার হোটেলে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা হয় নি, ওরাও ১০/১২ জন ঘোড়ায় চড়ে পিছু নিয়ে বাবাকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়, মরানহাটের সুশীল ডাক্তার চিকিৎসা করে সুস্থ্য করেন, কিন্ত পিতার নাকের ক্ষত সাড়াতে বহু বছর লেগে যায়। ঐ দিন থেকে কাকার মনোহরী ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল।
বিক্রমপুর হতে আসামে ব্যবসার ক্ষেত্রসমূহ

আসামে ব্যবসার উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য জেলাগুলো হল- লক্ষ্মীপুর, করিমগঞ্জ, মানিকারচর, গোয়ালপাড়া, ডিব্রুগড়, শিবসাগর, জোঁরহাট, তিনশুকিয়া, ধুবড়ি, গোলাঘাট ও গৌহাটি শহর।

বাবা আমাদের অনেক নিকটজনকে আসাম নিয়ে যান, বড় ফুপা মুক্তার খান খোরহাটে, খালাতো ভাই মজিদ খান আলীরমোড়ায় ব্যবসা করতেন এ ছাড়া আছালত খাঁর বাকী তিনভাই নিম্নিঘর, গোয়ালপাড়ায় ফুপা হাশেম দেওয়ান, খালু রমিজ শেখ, লতিফ শেখ, আলেক খলিফা, কাদের শেখ ইন্তাজউদ্দিন খলিফারা কয়েক ভাই, শিকদার বাড়ির ইয়াকুব শিকদার,মাঝি বাড়ির ইয়াকুব মাঝিরা তিন ভাই আসামে ছিলেন। উত্তর কোলাপাড়ার ধনাঢ্য হাজী আহাম্মদ আলীকে আসাম নিয়ে গিয়েছিলেন ইয়াকুব শিকদার। রাড়িখালের হায়দার খান, মন্নান খান ও কেব্বত খান আসামে ব্যবসা করতেন।

আসামে যারা নবাগত তাঁরা প্রথমে ভাসমান দোকান দিয়ে গ্রামীণ সাপ্তাহিক হাট ও চা বাগানের নির্দিষ্ট স্থানে ছাউনি টাঙিয়ে বসতেন। সাইকেলের পেছনে কাঠ লাগিয়ে গাট্টি বেঁধে অথবা ঘোড়ার পিঠে গাইট বেঁধে বিক্রির জন্য যেতেন, পুঁজি বেড়ে গেলে কোথাও স্থায়ীভাবে বসে যেতেন, যেখানে থাকতেন সেখানে বিক্রমপুরের লোকজন আলাদা থাকতেন বা জমি কিনে বসতি গড়তেন এভাবে স্থানে স্থানে বাঙালি মুসলিম সোসাইটি গড়ে উঠত।

আমার বাবা মোহন খান স্থানীয় বিচার সালিশিতে অংশগ্রহণ করে ‘সর্দার’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি অনর্গল অসমিয়া ও হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারতেন।

রাড়িখালের মাইনুদ্দিন শেখ আগে থেকেই সর্দার ছিলেন। ২য় মহাযুদ্ধ শেষ হলে বাবার ব্যবসার দ্রুত বিস্তার লাভ করে, ভাই ছামাদ খানকে দিয়ে গ্রামে টাকা পাঠাতেন সেখানে ৩য় ভাই মোফাজ্জল হোসেন খান বর্তমান রাড়িখালের বাড়িসহ অনেক ধানী জমি কিনেছেন, পাশাপাশি তিনিও গ্রামে নামকরা মাদবর হয়ে গেলেন।

আসামে ‘কাবুলীওয়ালা’ নামে প্রচুর ব্যবসায়ি ছিল, এরা বিক্রমপুরের লোকজনের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতেন।

কাবুলীওয়ালারা বাবাকে সর্দার হিসাবে একটি পশমি ওভার কোট উপহার দিয়েছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে বাবার পরিচয় ঘটে তেলইজানের চা বাগানের ম্যনেজারের সাথে, আসামে প্রচুর চা বাগান ছিল, বাগানের ম্যনেজারকে সবাই “সাহেব” বলত।

একদিন কাবুলীওয়ালাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেব বাবার থান কাপড়ের পাইকারি দোকানে এলেন, তিনি প্রস্তাব দিলেন তাঁর বাগানে চা শ্রমিকদের কেনা কাটার জন্য একটি স্থায়ী দোকান বানাতে হবে দোকানে কাপড় চোপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী (মুদী মালামাল) থাকতে হবে।

তখন বাবা শর্ত দিলেন ওখানে বিল্ডিংসহ দোকানঘর, পেছনে বাসভবন ও একটি দুধেল গাভী দিতে হবে। ম্যানেজার তাঁতেই রাজী হয়ে গেলেন, মরানহাট থেকে ১২ কিমি পূর্বে তেলইজানে নুতন ব্যবসা শুরু হয়ে গেল, আরেক ভাই সামসুল হক খান ও ছামাদ খানকে মরানহাট রেখে বাবা চলে এলেন তেলইজানে।

১৯৪৬ সালের কথা- বাবার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে দেশে বাবাসহ মেঝো কাকা অনেক সওদা নিয়ে রওনা হলেন, পার্বতীপুর- গোয়ালন্দ হয়ে কেদারপুর স্টিমার ঘাটে নামলেন, চর পড়ায় ভাগ্যকূল স্টিমার ঘাট তখন কয়েক বছরের জন্য বন্ধ ছিল।

১০/১২ টি ঘোড়ায় করে মালামাল নিয়ে পুরান বাড়িতে (উত্তর কোলাপাড়া) সবাই উঠলেন, এ খবর এলাকায় চাউর হয়ে গেলে ৩ দিনের মাথায় বাড়িতে কামারগাঁর মান্দারী ডাকাত বাহিনী ডাকাতি করতে আসে। ঘরের দরজা ভেঙে ওরা সোনাদানা টাকাপয়সা লুটে নেয়, বাঁধা দিতে গিয়ে ঘরের সবাই আহত হন, পাশের ঘরের ছোট দাদি (ইয়ার মাহমুদের মা) দায়ের কোপে মারাত্মক আহত হন, অন্যেরা পেছনের দরজা দিয়ে পুকুরে নেমে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পান।

গ্রামের ইন্তাজুদ্দিন খলিফার ঘটকালিতে উত্তর রাড়িখালের নেওয়াজ খানের মেয়ে (হেলু শেখের ভাগ্নি) মুক্তা খানম কে বাবা বিয়ে করেন।
এক টিকেটেই রেল ও স্টীমার

বৃটিশবঙ্গে কলকাতার শিয়ালদা রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের প্রায় শত বছর আগের একটি ছবি পাওয়া গেল। সেখানে ইস্টার্ন রেলওয়ের কতিপয় গন্তব্যস্থান ও সময়সূচী উল্লেখিত আছে।

বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা, চট্টগ্রাম, গোয়ালন্দ এর পাশাপাশি ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নামে স্টেশনের নাম লিখা রয়েছে। যদিও খুলনা থেকে বরিশাল, গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম যেতে যমুনা পারাপারে স্টীমারের ব্যবহার ছিল।

চুক্তি অনুযায়ী ট্রানজিট পয়েন্টে রেল এবং স্টীমারে একই টিকেটে ভ্রমন সুবিধা বিদ্যমান ছিল। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তৎকালীন লৌহজং এর দীঘলি বাজার হতে স্টীমারে থানকাপড় বুকিং দিলে ২ দিনেই রেলগাড়িতে আসামের শিবসাগর জেলার শিমুলগুড়ি রেলস্টেশনে পৌঁছে যেত।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী

১৮২৬ সালে ইঙ্গ বর্মী যুদ্ধের পর ইয়ান্ডাবু চুক্তি বলে আসাম অংশটি ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আইনে পূর্ববঙ্গের সাথে আসাম যুক্ত হয় আবার তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়।

ঐসময় কালে বিক্রমপু্র, সিলেট, ফরিদপুরসহ অন্যান্য এলাকা হতে আসামে বহু লোক চলে আসে। আসামে তখন বাংলাভাষী ছিল ২৭% অসমিয়া ৪৮% এদের মধ্যে ৩০% মুসলমান ৬৪ % হিন্দু।

৪৬ এর পর দেশ ভাগ হলে আসামে থেকে যাওয়া অভিবাসীরা অনেকটা অসহায় অবস্থায় পড়ে যান, তখনো রাজধানী গৌহাটিতে ৫০ হাজার রিফিউজি অবস্থান করছিল। বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক দাংগা ও স্থানীয়দের বঙ্গাল খেদা আন্দোলন চলতে থাকল, মরানহাটে দাংগা বা মিছিল হবার আগেই লোকমুখে শুনে আমাদের পরিবার ব্যবসা কেন্দ্র/ বাসা বাড়ি বন্ধ করে গ্রাম এলাকার নিকটজনদের বাড়িতে চলে যেতেন, স্বাভাবিক হলে ফেরত আসতেন।

মায়ের কাছে শুনেছি, ৫৩ সালে রেলে বিক্রমপুর যাবার পথে যাত্রীরা দাংগার শিকার হয়, কোলের শিশু আমার মেঝোভাই শাহআলম ও ২ বছর বয়সী বড় ভাই কাইয়ুম, বাবা ও মা একই রেলের যাত্রী ছিলেন, মা বাবা দেখতে পেলেন দাঙ্গাবাজরা তলোয়ার হাতে মুসলিম চিহ্নিত করে জবাই করে বাইরে ফেলে দিচ্ছে ,হুলস্থুল ও কান্নাকাটি পরে গেল, রেলের বগি ও প্ল্যাটফর্ম রক্তাক্ত হয়ে গেল। বাবা বাথরুমে ঢুকে থাকলেন, মা টিটি কে পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করলেন, টিটি র মায়া হল, তিনি মা বাবাকে তাঁর কক্ষে বসে থাকতে বললেন, দাঙ্গাকারিরা টিটির কক্ষে আসে নি, ওরা দুটি বগিতে ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশ আসার আগেই দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।

পরবর্তী স্টেশনে গিয়ে রেলের দুটিবগি ওয়াশ করা হয়। গ্রামে ফিরে গিয়ে এ জন্য সবাইকে নিয়ে মিলাদ পড়ানো হয়েছিল।

বাবা মোহন খানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বরগুনার দোকান পরিচালনার জন্য ভাই ছামাদ খানকে স্থায়ীভাবে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন, বাবা মা আসাম ফিরে গেলে কিছুদিনের ব্যবধানে ১৯৫৩ সালে দাদা আদালত খান কলেরায় এবং নানা নেওয়াজ খান আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন।

কয়েক দিন বাড়ি কাটিয়ে কাকা সামসুল হক খান আগেই এবং এক বছর পর বাবা পূনরায় আসাম চলে গেলেন।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন দিয়ে ক্ষমতায় এলে আসামের অভিবাসীদের মনে শক্তি ফিরে আসে। দাঙ্গার ভাব টা একটু কমে এলো। আইয়ুব খান কে আসাম প্রবাসীরা ভালবাসতেন, এজন্য তৎপরবর্তী ছেলে সন্তান হলেই অনেকে নাম রাখতেন আইয়ুব খান বা আইয়ুব। আমাদের এক ফুপাতো ভাই ও চাচাতো ভাইএর নাম আইয়ুব খান। আবার গভর্নর মোনায়েম খান ও আজম খানের নামেও দুই ভাইয়ের নাম আছে। ওখানে বড় ভাই কাইয়ুম খান ও শাহআলম খানের সুন্নতে খাতনা বড় আয়োজনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে বাবা গৌহাটি গিয়ে মাকে গ্রামোফোন কিনে দিলেন, ৫ম ভাই সামসুল হক খানকে আগেই একটি রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। মা তেলইজানে বক্স সিস্টেমের গ্রামোফোন বাজাতেন আমরা পাশে বসে গান শুনতাম। এরই মধ্যে ৫ম কাকা সামসুল হক খানের বিয়ে হল লৌহজং এর বাসিন্দা আসামের ছেপনহাটের এল্যুমিনিয়ামের ব্যবসায়ী কদম আলীর মেয়ে সুফিয়া খানমের সঙ্গে। অনেক গাড়ির বহর ও পটকা ফুটানোর মাধ্যমে মহাধুমধামের সাথে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

নানা কদম আলীর বাসা ছেপনহাটে জমিতে রসুনের মত ঘেচু পাওয়া যেত যা খুবই মিষ্টি এবং সুস্বাদু, এ ফলটি আমাদের দেশে হয় না। আমার এ স্মৃতিগুলো মনে আছে।
আসাম ব্যবসার ভিন্ন মোড়

আসামের মরানহাট এবং তেলইজানে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বাবা মোহন খান এর সাথে মেঝো কাকা আঃ ছামাদ খান ও ৫ ম ভাই মোঃ সামসুল হক খান থেকে গেলেন।

বাবা মাকে নিয়ে বিক্রমপুর এবং আসাম আসা যাওয়া করতেন, দেশভাগের আগে নগদ টাকা নিয়েই বাবা এবং কাকা ছামাদ খান গ্রামে যেতেন, গ্রামের মানুষজন এ টাকাকে আসামের ‘কাঁচা টাকা’ বলতেন।

দাদা আদালত খান ও ৪র্থ কাকা মোফাজ্জল হোসেন খান এর নিকট টাকা দিয়ে এলে তাঁরা পছন্দমতো জমিজমা কিনতেন, মাদবরি করতে গিয়ে ৪র্থ কাকা টাকা পয়সা অনেক অপচয় করতেন, এটা বুঝতে পেরে বাবা দেশেই ব্যবসার জন্য দোকান দেখতে বললেন। এরই মাঝে ৪৬ সালের নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ভারতের অন্যান্য স্থানের দাঙ্গার প্রভাব আবারো আসামে পড়তে শুরু করলো।

হিন্দু, মুসলিম ও অভিবাসীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিল, কোন কোন স্থানে বাড়িঘর ভাংচুর, অগ্নিপ্রজ্জলন ও রক্ত ঝরল। স্থানীয়রা অস্থানীয়দের বিতারনের আন্দোলনের নাম দিলেন ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। ওখানে অবস্থানকারী বিক্রমপুরীরা একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ না করে ওদের সাথে মিলেমিশে থাকার কৌশল নিলেন।

‘৪৭ এর দেশভাগের পরে আরেকটি ধাক্কা বাংলাদেশ হতে অন্যান্য স্থান ও বিক্রমপুর হতে আসা বাঙালী মুসলমানদের সইতে হয়েছে। আসামে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি বিনষ্ট হয়ে গেল।

বাবা বুঝতে পারলেন, এদেশে আর থাকা যাবে না তাই দেশে গিয়ে দোকান খোঁজার চেস্টা করলেন, ঢাকায় সদরঘাটে গিয়ে জায়গা পছন্দ না হওয়ায় ফেরত এলেন, আসামের মতো অনুন্নত এলাকায় ব্যবসা করায় অভ্যস্ত ও মানষিকতা থাকায় আমার বাবা কাকারা বড় শহর বাদ দিয়ে বরগুনায় আগে থেকে ব্যবসারত ছোট ফুপাজান মাওয়ার নুরুল হক এর পরামর্শে বরগুনাতেই দোকান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

দেশভাগের পর সবাই পাসপোর্ট করে নিলেন। নগদ টাকা আনায় সমস্যা হওয়ায় বাবা ১৯৪৯ সালে ভাই ছামাদ খানকে উড়োজাহাজে করে কলকাতা পাঠালেন বরগুনার বড় ব্যবসায়ি বেনু তালুকদারের কাছে তাঁর মাধ্যমে বরগুনায় টাকা পাঠানোর জন্য। সে সময়ের প্রেরিত ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বরগুনা শহরের খলিফা পট্টিতে ‘খান ব্রাদার্স’ নামে দোকান দিলেন
আসামের ফেলে আসা স্মৃতি

আমাদের পর পর চার ভাইয়ের জন্ম গ্রামের বাড়ি রাড়িখালে আমি ৪র্থ,পরবর্তী ৩ বোনের জন্ম আসামে।

৬ মাসের কোলের শিশু হয়ে আসাম গিয়েছি, জ্ঞান হওয়ার পর হতে ৯বছর অবধি আসামের অনেক স্মৃতি এখনো মনে গেঁথে আছে, খোরহাটের ফুপাতো বোন বিলকিস আগুনে পুড়ে মারা গেলে বাবা তৎক্ষনাত চলে গেলেন,পরদিন কিছু পথ রেলে বাকি ১ ঘন্টা পথ কাঁচাপথে গরুর গাড়িতে হেলেদুলে ‘কে কো’ শব্দে মাসহ আমরা সকলে খোরহাটে পৌঁছালাম, ফুপাতো ভাই দেলু, আনুদা আমাদেরকে গোরস্থানে নিয়ে গেল, এই প্রথম গোরস্থান দেখলাম, ২দিন কাটিয়ে ফিরে এলাম।

মরানে হোলি উৎসবে পিচকারি দিয়ে রঙ ছিটানো হতো তখন দোকানপাট বাসাবাড়ির দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হতো। বাসা লাগোয়া হরিকৃষ্ণের মুদি দোকান,বটতলার আতোর খার চকলেটের দোকান, কাছেই তোলারাম মাড়োয়ারির রাইস মিলের জমা করা পাহাড়সম তুষ, সেই তুষের উপর উঠে খেলতাম, আসামে হেলিকপ্টার উড়তে দেখতাম পেছনটা রেলিং এর মত। বড় ভাইরা মার্বেল খেলত, সুন্দর মার্বেলগুলো জমা করে রাখতাম।

মা তেলইজানে গেলে দেশী লোকজন না থাকাতে একা হয়ে যেতেন, তাঁর কাছে সেখানে ভাল লাগতো না, মা ইচ্ছে পোষণ করলেন, শিলচরে মেঝো খালার বাড়ি যাবেন, বাবা লম্বা পথে আমাদের নিয়ে রেলে চড়লেন। পথে বিছাফল ও লটকা খেয়েছি, কালো বিছার মত দেখতে ফলটি খুবই মিস্টি, লটকা আমাদের দেশের লটকনের মত হলেও আসামেরটি বড় ও রসালো। সিলেট সিমান্তের কাছে শিলচরে পৌঁছে বন্যায় আটকে গেলাম,খালাম্মা কাঠের দোতালায় আশ্রয় নিয়েছেন, ৪দিন কাটিয়ে আমরা ফের মরানে চলে এলাম,পথে পাহাড়ের গুহার ভেতর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রেল চলা দেখলাম।

তেলইজানে রাখালরা আমাদের গাভীটি সকালে নিয়ে যেত আবার বিকেলে দিয়ে যেত, জয়নাল কাকা গাভীটি ধুতেন, মাঝে মাঝে গাভীর গায়ে লাগানো জোঁক আসতো। আমরা মজা করে লবন দিয়ে জোঁক মারতাম।

আসামের বাড়িটির চারদিক বেড়া দেয়া, ভেতরে পাঁতকুয়া ছিল, একটি পেয়ারা গাছে প্রচুর পেয়ারা হত,খেয়ে শেষ করা যেত না,গাছেই পাখির খাদ্য হত, বরই গাছ ও সাজনাগাছ ছিল। বড় দু’ভাই আসামের বাংলা স্কুলে পড়তেন, তাঁদের আনা টিফিনের ডালডায় ভাজা পরোটা মজা করেই খেতাম, ৩য় ভাই এবং আমি গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়তাম, আসামের পেটকাটা র এর কথা ভুলি নি। বাসার সামনে রেডিমেট কাপড় তৈরির ফ্যাক্টরি ছিল, ১৫/১৬ জন দর্জি সেখানে কাজ করতেন ৫ম কাকা সামসুল হক খান এ ব্যবসা দেখাশুনা করতেন, অন্য দোকানে পাইকারি থান কাপড় বিক্রি হত, গৌহাটি হতে মাল ট্রাকে চলে আসত, মা সহ আমরা প্রায়ই কালো রঙের ট্যাক্সিতে করে তেলইজান আসা যাওয়া করতাম, বাংলা এবং অসমিয়া ভাষার মধ্যে খুব একটা তফাৎ ছিল না, অসমিয়দের অতিরিক্ত চা পান, পান সুপারি, সাদাপাতা ও গুল নেয়ার অভ্যাস ছিল এ কারনে আমার মা বাবা কাকাদের পান ও চা খেতে দেখতাম,আসামের কোকিজ বিস্কুট জনপ্রিয় ছিল।

এখানে সব ধরনের মাছ পাওয়া যেত, তবে বোয়াল মাছ মজা করে খেতাম, ৪৭ এর আগে প্রকাশ্যে গরু জবাই হলেও পরে আড়ালে আবডালে বিক্রমপুর মুসলিম পট্টিতে জবাই হত। দেশ অর্থাৎ বিক্রমপুর থেকে মাটির পাতিলে করে লবন দেয়া ইলিশ আসতো, অনেকে মজা করে খেত, আমি খেতাম না। আসামে টাটকা ইলিশ পাওয়া যেত না। সেমাই মজা করে খেতাম, পিতলের একটি সেমাই কলে ঘরে হাতল ঘুরিয়ে সেমাই বানানো হত।

মরানহাটে কলকাতা থেকে আসা অনেক মাড়োয়ারি ধনাঢ্য ব্যবসায়ি ছিলেন, কাবুলী ওয়ালারাও চীনামাটির সামগ্রীর ব্যবসা করতেন, আসামে প্রচুর বেদে সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল ওরা খালি যায়গায় ছাউনি করে থাকতেন, ওরাও তাঁদের বাড়ি বিক্রমপুর বলত, জনশ্রুতি আছে, দাওয়াই কবিরাজি,তাবিজের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য আসাম আসতে গিয়ে একটি অংশ ওখানে রয়ে গেছেন।

আসামের চা বাগানে সপ্তাহের ১দিন বিনে পয়সায় রাতে পর্দা টাঙিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখানো হত, তরুন এবং বয়স্কদের একটি অংশ প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন বাগানে ছুটে যেতেন।

মরানহাটের একমাত্র কামারপট্টির মিনাক্ষি সিনেমা হল লোকে লোকারন্য থাকতো। চৌরাস্তায় বিশাল বট গাছের গোঁড়ায় অনেক নরসুন্দর বসতেন।

মরানহাটের FB বন্ধু Julfikar Ali এর নিকট হতে সাম্প্রতিককালে জানলাম, মিনাক্ষি সিনেমা হলটি ভেঙে SBI BANK হয়েছে। বটগাছ কেটে আধুনিক শহর হয়েছে, আমাদের বাসাটি যেখানে ছিল সেখানে মাড়োয়ারীদের ৯ টি দোকান বসেছে। মরানহাট পেট্রোল পাম্পটি আগের মতোই আছে। শিমুলগুড়ি থাকে মরানহাট পর্যন্ত নুতন রেললাইন চালু হয়েছে।
আসাম হতে বিক্রমপুর ফেরত

১৯৬০ সালে আসামে আরেকটি দাংগা হল, দাংগার প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো, আসামের আদি বাসিন্দা ও হিন্দু সম্প্রদায় ‘বংগাল খেদা’ আন্দোলনে পথে নামলেন।

বাংলাদেশ ও বিক্রমপুর হতে আসা লোকজনের তালিকা হতে লাগলো। বাবা মোহন খানসহ সর্দারি করেছে এমন অনেকের নাম তালিকায় ছিল।

একদিন সরকারি দফতর থেকে বাবার নামে আসাম ছাড়ার নোটিশ এল, তেলইজানের ম্যানেজারকে দিয়ে বাবা সময় বাড়ালেন, এদিকে ব্যবসাপাতি গুটানোর কাজ চলতে থাকলো, বাবার সাথে তাঁর কাকা ফৌজদার খার স্ত্রী আমেনা বেগম , দুইছেলে,দুই মেয়ে যাবেন এজন্য তাঁরা পাসপোর্ট বানালেন, বাবা মায়ের পাসপোর্ট আগেই ছিল।

জয়নাল কাকাও মানিককে বাবা সাথে নিলেন। বাবা তেলইজানের ব্যবসা গুটিয়ে মরানহাট এলেন। আসার আগের দিন আসবাবপত্র, সেলাই মেশিন আত্মীয়স্বজন কে দান করে দিলেন।

প্রিয় গ্রামোফোন টি দোকানের ম্যানেজার সুরেশকে দিয়ে দিলেন। খালাতো বোন পিয়ারা আপাকে বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন দোকানের নুরু খলিফার সাথে, তাঁকেও অনেক মালসামানা দিয়ে দিলেন।

মরানের ব্যবসা সম্পুর্ণ গুটানোর জন্য বাবা একা কিছুদিন পরে আবার আসবেন এবং ৫ম কাকা সামসুল হক খান ও এক সন্তানসহ কাকিকে নিয়ে যাবেন এ জন্য তাঁদেরকে আপাতত রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আমাদের নিকটজন যারা স্থায়ীভাবে আসামে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা হলেন, পিতার পূর্বপুরুষ পুরান বাড়ির গোলাপ খাঁ ও সাগির খাঁর পরিবার,জয়নাল খাঁর পরিবার,আলেপ সেখের পরিবার, চাচাতো বোন জরিনা বেগমের পরিবার, আমার খালতো বোন পিয়ারা বেগমের পরিবার, এছাড়া রাড়িখাল ও লৌহজং এর বহু পরিবার অসমিয়া পরিচয়ে সেখানে রয়ে গেলেন।

৬০ সালের আগে আসামে চিঠিপত্র ও টেলিগ্রাম যোগাযোগ থাকলেও ওদের গোয়েন্দা নজরদারির কারনে তা বন্ধ হয়ে গেলো, দেশে আসার জন্য দাদা ফৌজদার খার বাসা খুমটাই বাগান হয়ে ৩১-০১-১৯৬২ তারিখে মা বাবা ভাই বোনসহ আমরা সবাই রেলে চড়লাম।

প্রায় ২০ ঘন্টায় করিমগঞ্জ পৌঁছালাম, চেকপোস্টের কাজ সেড়ে নৌকায় খাল পাড় হয়ে বাংলাদেশের জকিগঞ্জে এসে ৪৫ মডেল খ্যাত নাক ওয়ালা বাসে উঠলাম, বিকালে কিন ব্রীজ পাড় হয়ে সিলেট রেল স্টেশনে এসে রাতের রেল ধরার অপেক্ষায় থাকলাম, শীতের কারণে মা আমাদের চারভাইকে নুতন বানানো নীল কোট প্যান্ট পড়িয়ে দিলেন।

পরদিন সকালে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে সদরঘাট, তারপর লঞ্চে আলমপুর হয়ে কেড়াই নৌকায় শ্রীনগর থানাঘাট নেমে বাবা চলে গেলেন ২দিন আগে ডাকাতের গুলীতে আহত হাঁসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রতিবেশি বেয়াই আছালত খাঁকে দেখার জন্য, বাবাসহ অন্যেরা নৌকায় বাড়ির নিকটবর্তী ফুলকুচির খালপাড় আর আমরা তিনভাই হালট ধরে পৌঁছলাম উত্তর রাড়িখালের বড় তেঁতুল গাছ চিহ্নিত বাড়ি, এই আমাদের দেশ, এই আমাদের গ্রাম, জননী জন্মভূমি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১০:০২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×