আমাদের পাশের গ্রামের ১টি হিন্দু মেয়ে জন্ম থেকে অনেকগুলো প্রতিকুল অবস্হার মাঝে পড়েছিলো; সে এসব প্রতিকুল অবস্হাকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো, এটি সেই কাহিনী।
আমাদের দক্ষিণ পাশের গ্রামটা হিন্দু গ্রাম; গ্রামের দক্ষিণ সীমানা বরাবর পুর্ব-পশ্চিমএকটি বড় খাল; গ্রামের সবচেয়ে দক্ষিণে, খালের সাথে লাগানো বাড়িটি রমনী কবিরাজের বাড়ি; কবিরাজ ব্রাম্মণ; কিন্তু তিনি পুরোহিত হননি, এক কবিরাজের কাছে কবিরাজী শিখে, আজীবন কবিরাজী করেছিলেন; অবস্হা তেমন স্বচ্ছল ছিলো না, চলে যাচ্ছিলো। আমাদের গ্রামের মাঝ বরাবর উত্তর-দক্ষিণ একটি রাস্তা আছে, এই রাস্তাটি হিন্দু গ্রামের মাঝ দিয়ে খাল অবধি গেছে; রাস্তার পশ্চিম পাশে কবিরাজের বাড়ী, রাস্তার পুর্বপাশে উনার পুকুর। পুকুরটি বেশ বড় ছিল; ফলমুল ও বিবিধ গাছের জন্য রাস্তা থেকে পুকুরটি অনেকটা দেখা যায় না, মনে হয় একটা বড় জংগল। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে গ্রামের শ্মশান। আমাদের রাস্তাটি যেখানে খালের পাড়ে লেগেছে, সেখানকার সাঁকোটা ছিল আজীবন নড়বড়ে; ভাংগাসেতু ও শ্মশানের কারণে এই রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল ছিলো না তেমন। আরো আধা মাইল পশ্চিম দিকে একটি ভালো সাঁকো ও রাস্তা আছে, লোকজন সেটা ব্যবহার করেন। নির্জনতার কারণে আমি রাস্তা হয়ে খালের দক্ষিণ পাড়ের গ্রামে আমার ক্লাসমেটদের এলাকায় যেতাম, ফুটবল খেলতাম; স্কুল থেকে ফেরার সময়ও মাঝে মাঝে এইপথ ধরে ফিরতাম। এই রাস্তায় আসতে যেতে প্রায়ই দেখতাম, কবিরাজের মেয়ে, সবিতা পুকুর থেকে বালতি করে পানি নিচ্ছে, হাঁড়পাতিল, বা কাপড় ধুচ্ছে। সবিতা মানুষকে খুবই ভয় পেতো, সে কারো সাথে কথা বলতো না, মানুষ দেখলে ভীত পাখির মতো ছটপট করতো; ভয়ের কারণে সে স্কুলে যেতো না, তার মাসীর কাছে পড়তো; বয়সে আমার থেকে সামান্য কম ছিলো। আমার সামনে পড়লে, আমি জিজ্ঞাসা করতাম,
-সবিতা, কেমন আছিস!
সে কখনো উত্তর দিতো না, ভীতু পায়ে বাড়ীতে চলে যেতো। রমনী কবিরাজ আমার চাচাদের পরিবারিক কবিরাজ ছিলেন; ২/১ সপ্তাহ পরপর কবিরাজকে ডাকার দরকার হতো; চাচাচাচী আমাকেই পাঠাতেন। কবিরাজের বাড়ী গেলে দেখতাম, সবিতা বারান্দায় বসে পড়ছে, না'হয়, গাভীটার পরিচর্যা করছে, না'হয়, পুকুরে কিছু ধুচ্ছে; সে বাবাকে ডেকে দিতো; বাবা বাড়ী না থাকলে সে বলতো যে, বাবাকে বলবে, এর চেয়ে বেশী কথা বলতো না; আমি বরাবরই জিজ্ঞাসা করতাম তাকে, সে কেমন আছে; সে ভয়ে ভয়ে তাকাতো।
কবিরাজের স্ত্রী জীবিত ছিলেন না, সবিতার জন্মের সময় কবিরাজের স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। মেয়েটাকে বড় করেছ মেয়ের মাসী, কল্যানী চক্রবর্তী, তিনি চট্টগ্রাম শহরের মেয়ে ছিলেন; বোনের মেয়েকে দেখাশোনা করতে এসে এখানে ছিলেন সবিতার বয়স ৭ বছর হওয়া অবধি। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে, কবিরাজের মৃত্যু হয়; সবাই বলাবলি করছিলো, তিনি লতাপাতা, গাছের ছাল-বাকল দিয়ে ঔষধ বানাতেন; এই ধরণের কোন ঐষধের বিষক্রিয়ায় উনার মৃত্যু হয়েছে। আমরা উনার শেষকৃত্ত দেখতে গিয়েছিলাম; সবিতা শোকে ও ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম, সে একা কিভাবে থাকবে? শুনলাম তার মাসী আবার এসেছেন, থাকবেন সবিতার সাথে।
কবিরাজের মৃত্যুর মাস'খানেক পরে, আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, বেলা ডুবার একটু আগে বাড়ী ফিরছিলাম; দেখি সবিতা, বাবার চিতায় রাখা একটা মাটির কলসীতে বালতি থেকে পানি রাখছে; আমি দাঁড়ালাম, সে কপালে হাত ঠেকিয়ে ১ মিনিট প্রার্থনা করে শ্মশান থেকে রাস্তায় এলো; আমাকে দেখে কোনভাবেই ভীত হলো না আগের মতো, স্বাভাবিকভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-বাড়ী যাচ্ছিস?
-হ্যাঁ, তুই কেমন আছিস, কেমনে চলছিস তোরা?
-কষ্ট হচ্ছে; তবে, চলছি। বাবা তো নেই, তুই তো আমাদের বাড়ী আর আসবি না; এই পথ দিয়ে আসা যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ী আসিস। আমি স্কুলে ভর্তি হবো।
-তুই তো আগে স্কুলে যাসনি! কোন স্কুলে যাবি?
-স্কুলে যেতে ভয় লাগতো; আমি বাড়ীতে নবম শ্রেণীর বই পড়ছি এখন, তোদের স্কুল আমাকে নেবে?
-তুই হেড মাষ্টারের সাথে দেখা কর, নেবেন; উনি না নিলে, গার্ল স্কুল নিবে তোকে।
-না, আমি গার্ল স্কুলে যাবো না। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ী আসিস, আমি একা হয়ে গেছি।
আমি হতবাক, তার মাঝে কোন ভয় নেই, জড়তা নেই, আমাকে যেন আজীবন চেনে। আমাদের স্কুল তাকে নেয়নি, সে পশ্চিম দিকের বেশ দুরে একটি জুনিয়র হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হলো। আমি সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই ওদের বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলতাম। সে সংসারটাকে চালিয়ে যাচ্ছে, পুকুরের মাছ ও কিছু গাছ বিক্রয় করে আরেকটা গাভী কিনেছে, দুধ বিক্রয় করে; গ্রামের সম্পর্কের এক চাচা গরুগুলো দেখে। মায়ের রেখে যাওয়া গহনা ও পুকুরের কিছু অংশ বিক্রয় করে কিছু ধানের জমি কিনেছে। গ্রামের জ্যোতি মহাজনের মা'কে জ্যোতির বউ পছন্দ করতো না, সবিতা উনাকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। তার মাসী তাকে চট্টগ্রাম শহরে নিতে চেয়েছিলো সে যায়নি; তার নিজ চাচা বাস করতো আগরতলায়, সে এসেছিলো ত্রিপুরা নিয়ে যেতে, সে যায়নি; নিজ বাড়ীতে থাকবে।
রমনী কবিরাজ খুব একটা সামাজিক মানুষ ছিলেন না; সবিতার সমস্যা ছিলো ছোটকালে, সে মানুষকে ভয় করতো; এখন সে গ্রামের সবার সাথে চলে, গ্রামের লোকজনের সহানুভুতি আছে সবিতার জন্য। আমি কলেজ থেকে বাড়ী এলে ওকে দেখতে যেতাম; দশম শ্রেণীতে উঠে সবিতা বিয়ে করলো; শর্ত, স্বামী তার বাড়ীতে থাকবে, সে নিজ বাড়ী ছেড়ে শ্বশুর বাড়ী যাবে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১০:০১