কয়েকজন বন্ধুর মারফত জানতে পেলাম “আমজনতা” শীর্ষক গানটার কথা, কিন্তু নিজে না শুনে কোন মন্তব্য করিনি। সকাল থেকে একনাগারে বেশ ক‘বার শুনলাম, আর এ নিয়ে কিছু না বলেও পারছিলাম না, তাই আমার কিছু কথা…
আমি সংগীত বিশারদ নই। তবে আমার মতে, যে গানে সাধারণের বাস্তবিক জীবন-সংগ্রামের ছোঁয়া না থাকবে, তা বাজারে নাম কামাতে পারলেও, সে গানের সামাজিক মূল্য থাকে শূণ্যের কোঠায়। বাজারী চিন্তার বাইরেও যে একটা চিন্তা রয়েছে সমাজে, যা ক্ষয়িষ্ণু নিপীড়ক সমাজের ভাঙনটাকেই তরান্বিত করে; যে চিন্তা সমাজটাকে আমূল বদলে দিতে চায়, সেই চিন্তা কখনোই একক বা ব্যক্তিগত নয়। সমাজ বদলের সেই চিন্তাটাই প্রকাশিত হয়েছে এই গানে…
এই গানে উঠে এসেছে রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের উপর গণ-বিরোধী আইনী খড়গের কথা, জনগণের মত প্রকাশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর কথা, এসেছে সাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কথা, ধর্ম ব্যবসায়ীদের কথা, আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের দলীয়করণ, এ দেশের আমজনতার উপর সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের শোষণ আরএখানকার নতজানু শাসক শ্রেণীর দ্বারা তাদের তোষণের কথা, সীমান্ত হত্যার কথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রকাশিত শাসক শ্রেণীর একাংশের দলীয় চেতনার কথা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই অগণতান্ত্রিক চেতনার কথা, শাসক শ্রেণীর মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে দিকভ্রান্ত আমজনতার কথা, পোষাকী দেশপ্রেমের কথা, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের কথা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা, অমানবিক সমাজের কথা, এসেছে পোষাকী গণতন্ত্রের নামে চলমান রাজতন্ত্রের কথা, ৫ বছর পর পর ভোটের প্রহসনের কথা, সুশীলতার দালালীর কথা, এখানে উঠে এসেছে হলুদ সাংবাদিকতা আর শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের কথা, এসেছে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার কথা, এসেছে নানান চুক্তিতে জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা। গানের মাঝামাঝি ব্যাক-গ্রাউন্ডে “জ্বালো জ্বালো” স্লোগান, জনগণের সহিংস আন্দোলনকেই প্রকাশ করে, কারণ শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই কখনোই অহিংস থাকে না, থাকতে পারে না। আর গানের শেষে সুস্পষ্টভাবেই নিপীড়িত জনগণের জেগে উঠার ইঙ্গিতটাও বিশেষ অর্থবহ, জনগণের ক্ষমতায়ন, তথা জনগণের গণতন্ত্রের কথাটাই স্পষ্টতঃসেখানে প্রকাশিত হয়েছে। তবে গার্মেন্টস সেক্টরে চলমান “শ্রেণী গণহত্যা” নিয়ে কিছু বলা হলে তা গানের মানটা আরো বাড়িয়ে তুলতো…
এই গানটি নিশ্চিতভাবেই পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের কোন কোন প্রথা-বিরোধী, বৈষম্যহীন সমাজ প্রত্যাশী গায়ক/গায়িকাদের দ্বারা, তাদের গান দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই গানে যা বলা হয়েছে, তা হয়তো আরো অনেকের গলাতেই শুনেছি আমরা, তবে তারা প্রায় সকলেই প্রথা-বিরোধী গায়ক/গায়িকা, আর এখানেই এই গানটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই গানের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রথা-বিরোধী, বা বাজার বিরোধী হিসেবে পরিচিত নন। বরং চলমান বাজার সংস্কৃতিতে তারা একটি বিশেষ জায়গা ধরে রেখেছেন, যাদের রয়েছে এক শ্রোতা শ্রেণী, যারা মূলতঃ মধ্য শ্রেণীর (মিডল ক্লাস) তরুণ প্রজন্ম। আর বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে গড়ে তুলছে তীব্রভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার আতিশয্যে, সেখানে গানটা ওই ইয়ো-ইয়ো তরুণ প্রজন্মের উপর এক ধাক্কা স্বরূপ…
সেই সাথে এই গানটি আরো একটি বিশেষ অর্থবহ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর নির্বাচনী রাজনীতি যখন তুঙ্গে পৌঁছাচ্ছে, তখনই গানটি প্রকাশিত হলো। আর আমরা নিশ্চয় ভুলে যাইনি, গত নির্বাচনে ওই তরুণদের সমর্থনই ছিল নির্ণায়ক। এবারেরও এমনটাই হওয়ার কথা, আর সেই তরুণদের দিকভ্রান্তি থেকে রুখতে গানটির বিশেষ গুরুত্ব অনুভব করছি। কারণ, এই গানের মর্মার্থ হলো (শ্রোতা হিসেবে আমার উপলব্ধি), শাসক শ্রেণীর আমজনতাকে নিপীড়নের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা, নিপীড়িতের সহযোগে নিপীড়ক শাসক শ্রেণী ও তার ব্যবস্থা, নির্বাচন, আইন, ইত্যাদিকে ছুঁড়ে ফেলে জনগণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা। মূলতঃ এই ব্যবস্থায় নির্বাচনের মানেই হলো - দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী, লুটপাটের টাকা আর সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের দালালী আর জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার প্রহসনের নির্বাচনী নাটকের বাইরে ভিন্ন কিছু নয়। সেই সাথে এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের পক্ষাবলম্বনের মানেই হলো - জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, আমজনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। প্রশ্ন আসতে পারে, আমজনতা এই নির্বাচনে ভোট দিতে যায় কেন? কারণ, আমজনতার সামনে রয়েছে জ্বলন্ত উনুন আর তপ্ত কড়াই, আর এর মাঝেই বেছে নিতে হবে, এর বাইরে কোন বিকল্প তারা (আমজনতা) দেখতে পাচ্ছেন না বলেই তারা ওই প্রহসনের নির্বাচনে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু জনগণ যে একদিন জেগে উঠবে, আর সেদিন যে ওই শাসকেরা পালিয়ে পার পাবে না, সেই কথাটাই আলোচিত গানে ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবেই…
এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, কয়েক বছর পর পর একটা দীর্ঘ সময়ের দৈন্যাবস্থা বিরাজ করে এখানকার আন্দোলন সংগ্রামে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণে। আমি নিরাশ নই, চারিদিকে নিরাশা বিরাজ করলেও চরমভাবেই আশাবাদী। মনে-প্রাণে আশা করছি, বর্তমানে চলমান এই খড়া কেটে যাবে শীঘ্রই। আর এ গানটা সেই সংকেতটাই বহন করে। সেই দিন বেশি দূরে নয়, যখন শ্রেণীগত অবস্থানের বাইরে এসে ওই মধ্য শ্রেণীর তরুণদের একটা বড় অংশ শ্রমিক-কৃষকের পাশে দাঁড়াচ্ছে, যুদ্ধ ঘোষণা করছে ওই শাসক শ্রেণী ও তার বিদেশী প্রভুদের বিরুদ্ধে…
খুব ইচ্ছে করে, যদি এমন হতো - এমন চিন্তার মানুষগুলো যদি বাজারী চিন্তার কাছে হার না মানতো!! এক একটা ক্ষুদ্র চিন্তাতেই ফুটে উঠতো সমাজের অমূল পরিবর্তনের কথা, সুতীব্রতার সাথে!!!
এখনো নিজেকে আশার জোগান দেই এই কথা বলে,
“রাত্রি যেথা গভীর, সেথায় আলোর হাতছানি”…
লাল সালাম, সুমন…
লাল সালাম, অর্থহীন…
লাল সালাম, আমজনতা…..
Click This Link
আমজনতা
দিনকে বানাও রাত তোমরা, রাতকে বানাও দিন
যতই হাসি, যতই কাঁদি, সবই অর্থহীন
নতুন নতুন নিয়ম বানাও, আমরা ভাঙবো বলে
নতুন চিন্তা ভাবতে গেলেই ভরবে মোদের সেল এ
অতীত এর সব হিসেব নিকেশ, ভবিষ্যতের মূলা
ধর্মটাকে নেড়েচেড়ে দিচ্ছ চোখে ধুলা
রামগরুড়ের ছানার ছিল হাসতে শুধু মানা
আমরা আজ করবোটা কি, সেটাও অজানা
Click This Link
মুখে মোদের সেলাই দেখে, হেসে ফেলে তারাও
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত দাও
মিথ্যে দিয়ে বাঁধাই করা বইটা যে পড়াও
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত দাও
ফটোশপে মেকাপ করা আমার দেশের ছবি
আহা আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি
হয়ে যাচ্ছি কেমন যেন, ঘৃণাই ভালবাসি
মানবতা হারিয়ে গেছে, মানুষ মরলে খুশি
কেউবা চাটে প্রতিবেশী, কেউবা বলে ‘ঘাউ’
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত দাও
ফেলানীর লাশ মাড়িয়ে ওপাড়ের ধর্ষিতা নিয়ে আমাদের কত দুঃখ
তাদের জন্য আমাদের অশ্রুর সাগরে নারী-অধিকার তত্ত্ব
৭১-এর ৩০ লাখ শহীদের পুনর্মৃত্যু হয় রাজনীতিরই হাতে
যখন নির্যাতন চলে ‘উপজাতি’ উপাধি পাওয়া আদিবাসীর সাথে
সংবিধানের গ্যাঁড়াকলের মধ্যাঙ্গুলি, বাঙ্গালিত্বের চাপে পিষ্ঠ মাইনরিটি
দেশপ্রেমের হিসেব চলে পোশাকে, ভালবাসার আত্মহুতি…হারায় সে রসাতলে
তোমাদের এই চুলাচুলি ভাল্লাগেনা আর
এক ‘রাজ আর গণ’-তন্ত্র… মিশে একাকার
তোমাদের এই কথা শুনেই নাচতে থাকি মোরা
হোক না ব্যথা পায়ের তলা, হোক না উঠোন ব্যাঁকা
৫ না, ১০ বছরের হিসেব করতে দাও
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত দাও
টিভির ভিতর সুশীল শিল্পী শিখায় রাজনীতি
সে ছাড়া সবাই নাকি হয়ে গেছে আজ ‘অবাঙালি’
বাঙালিত্বের সনদপত্র কোথা থেকে পাই?
নাম লেখাবো তোমার দলে? আমায় নেবে ভাই?
দেশটা আজ না খেয়ে ভাই অন্য কিছু খাও
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত দাও
ভাল্লাগেনা কোন কিছুই? মনটা তোমার খারাপ?
ভাঙতে থাকো বাড়ি গাড়ি, মুছে যাবে পাপ
হলুদ রঙের কালি দিয়ে চল খবর লিখি
‘বিশ্বাস’ বা ‘অবিশ্বাস’? নাচবো মোরা ঠিকই
অদ্ভুত এক হিসেবে সুন্দরবন হারাই
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত চাই
আমাদের বাঘ মামা ওপারে পালায়
আমরা যে ভাই আমজনতা, একটু ক্ষান্ত চাই
দিনের পর রাতটা আসে, রাতের পরে দিন
তাল গাছ কি সারাজীবন তোমারই অধীন?
ধীরে ধীরে হচ্ছে বড় মাথায় পাগলা ঘোড়া
আখলাক ভাই বদলে গেল, বদলাবিনা তোরা?
হঠাৎ যেদিন ক্ষ্যাপবো মোরা, বলবি তখন হায়
“আমজনতা ভাই বোনেরা, আমরা এখন যাই?”
হঠাৎ যেদিন ক্ষ্যাপবো মোরা, বলবি তখন হায়
“আমজনতা ভাই বোনেরা, একটু ক্ষান্ত চাই”
————————–
- অর্থহীন।
ডাউনলোড লিঙ্ক Click This Link
Click This Link
কিছু কথা
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:২৭