আজ একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছেন ইজাজুল ইসলাম সাহেব। বুধবারে সাধারণত কোনো ক্লাশ নেন না তিনি, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলেও সমস্যা নেই। নাস্তার টেবিলে বসে ইজাজুল ইসলাম সাহেবের যখন মনে পড়লো, থার্ড ইয়ারের ফাইনালের আগে শেষ একটা ক্লাশ নেবার কথা দিয়েছিলেন, আর সেই ক্লাশের জন্য সময় দিয়েছিলেন আজ বারোটা দশে; তখন তাঁর এটাও মনে পড়লো, একমাত্র গাড়িটা আজ তাঁর স্ত্রীর দখলে থাকবে এবং তা কাল রাতেই ঠিক হয়েছে। সকালের নাস্তা ডাইনিং টেবিলে রেডি রেখে স্ত্রী বেরিয়ে পড়েছে উত্তরা, তার বোনের বাসার উদ্দেশ্যে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে হবে যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবহার তিনি পরিহার করেছেন। অথবা আজকের ক্লাশটা বাতিল করতে হবে। কিন্তু ক্লাশটা বাতিল করা ঠিক হবে না, ছেলেগুলোর পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই যাবেন। ট্যাক্সি ক্যাব পাওয়াটা দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার, তারচেয়ে বরং সবুজ রঙের সিএনজি চালিত অটো রিক্সায় ভ্রমন করা যেতে পারে। সবুজ রঙের এই বাহনগুলোর জন্য মিটারের ব্যবস্থা থাকলেও তারা যে মিটারে না চলে দ্বিগুণ বা তিনগুণ ভাড়ার দাবী নিয়ে কন্ট্রাক্টে চলে সেটা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই, বরং অনেকদিন পর এই বাহনে ভ্রমন করবেন বলে তাঁর মধ্যে মৃদু উত্তেজনা দেখা দিল।
পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটির দুই নম্বর রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে শ্যামলী পর্যন্ত হেঁটে এলেন ইজাজুল ইসলাম সাহেব। পাঁচ মিনিটের পথ পেরোতে তিনি দশ মিনিট সময় ব্যয় করলেন। এই সময়ের মাঝে তিনি কয়েকটা সবুজ রঙের অটো রিক্সার দেখা পেলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, কোনো অটো রিক্সাই কলা ভবন যেতে রাজি হলো না। তবে অটো রিক্সা পাবার আশা এখনো ছেড়ে দেননি। শ্যামলী বাসস্টান্ডে কোনো একটা ব্যবস্থা হবে বলে তাঁর ধারণা। কিন্তু অনেকদিন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার না করার ফলে তিনি আসলে জানেন না যে, দশটা-সাড়ে দশটার দিকে শ্যামলী বা তার আশপাশের এলাকা হতে অটো রিক্সা পাওয়া কত কঠিন! আর তারচেয়েও কঠিন হলো পাবলিক বাসে উঠতে যাওয়া। শ্যামলী হলের সামনের ফুট ওভারব্রিজ পার হতে হতে নিচে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন, অসংখ্য গাড়ি ছুটে চলছে ক্রমাগত আর কিছু কিছু গাড়ির কালো ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠতে উঠতে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। অথচ যে গাড়িগুলো এই কালো ধোঁয়া ছাড়ছে সেগুলোর তো রোড পারমিটই পাবার কথা না! কিন্তু দিব্যি পেয়ে যাচ্ছে ছাড়পত্র। এসব নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে ওভারব্রিজ থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ালেন তিনি।
মিনিট বিশেক ধরে সিএনজি অটোরিক্সা ধরার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলেন। সিএনজি অটোরিক্সা পাবার আশা নিয়ে শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলেন কিন্তু এখানে যে অবস্থা, তাতে তো কোন ট্রান্সপোর্টই পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। একটা করে বাস আসছে আর অপেক্ষারত মানুষগুলো রীতিমত মারামারি করে বাসে উঠছে। বাস যাবার সাথে সাথে ফুটপাথটা একটু হালকা হলেও পরক্ষণেই আবার ভারী হয়ে উঠছে মানুষের উপস্থিতিতে। এসময় তাঁর মনে একটা শংকার উদয় হলো যে, আজ হয়তো তিনি ক্লাশটা মিস করবেন। হঠাৎ করেই তাঁর খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেলো। সাধারণত তিনি নিয়মিত সিগারেট খান না, তবে মাঝে মাঝে খুব তৃষ্ণা পায়। ফুটপাথের পাশে একটা ভ্রাম্যমান সিগারেট বিক্রেতাকে দেখা যাচ্ছে। তিনি ভাবলেন, একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ফুটপাথের অপেক্ষাকৃত খালি অংশে চলে যাবেন।
ভীড় ঠেলে বের হতে যাবার সময় পেছন থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিল। ধাক্কার চোটে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন প্রায়, তাল সামলে উঠার আগেই একজন যুবক এগিয়ে এসে তাঁকে ধরে ফেললো। পাঞ্জাবী-জিন্স পরা যুবকটি তাঁকে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে যুবকটিকে চেনার চেষ্টা করছেন।
- স্যার, কেমন আছেন?
- ভালো। তুমি কেমন আছো?
- স্যার, মনে হয় আমাকে চিনতে পারেন নি?
- না এখনো চিনতে পারিনি। কোন ইয়ারে পড় তুমি? নাকি পাশ করে গেছো?
- আমি আপনার সরাসরি ছাত্র ছিলাম না স্যার।
- ও। কোন ডিপার্টমেন্টের?
- স্যার, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও ছিলাম না। আপনার সাথে একবার পরিচয় হয়েছিল আর আপনি আমাকে দুইশো টাকা ধার দিয়েছিলেন সেদিন।
- তাই নাকি? মনে করতে পারছি না।
- আপনি ব্যস্ত মানুষ স্যার, হয়তো ভুলে গেছেন।
- কি করছো এখন?
- গ্রামের বাড়িতে জানে যে চাকরি করছি, কিন্তু আসলে টিউশনি করি। আর টুকটাক একটা ব্যবসা আছে, স্বাধীন ব্যবসা।
যুবকটি পকেটে হাত দিয়ে দু’টো একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল। বললো, স্যার নিন। আপনি বলেছিলেন, যেদিন দেখা হবে সেদিন ফেরত দিও।
ইজাজুল ইসলাম সাহেব কি করবেন বুঝতে পারছেন না। যুবকটিকে চিনতে পারছে না, অথচ যুবকটি বলছে যে তিনি তাকে দুইশো টাকা ধার দিয়েছেন। এখন সে ধার শোধও করতে চাইছে!
- আমি কি সত্যিই তোমাকে টাকা ধার দিয়েছিলাম? আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।
যুবকটি এক গাল হেসে বললো, স্যার, আমি মোটেও মিথ্যা বলছি না। আপনার সঙ্গে আমার যখন দেখা হয়েছিল তখন আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। পিক-পকেট হয়েছিল। একটু চেষ্টা করলেই মনে করতে পারবেন স্যার।
ইজাজুল ইসলাম সাহেব যুবকটির দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। হয়তো মনে করার চেষ্টা করছেন কিন্তু মনে করতে পারছেন না যে কোথায় দেখা হয়েছিল যুবকটির সাথে। তবে হাসিটা বেশ পরিচিত লাগছে। বললেন, না না, এটা হয় না। আমি তো তোমাকে চিনতেই পারছি না, তোমার টাকা আমি নেবো কিভাবে!
যুবকটি আবারো এক গাল হেসে বললো, স্যার টাকাটা রাখুন। আমি মোটেও মিথ্যে বলছি না। একটু ভাবুন মনে করতে পারবেন, আর যদি আমার কথা আপনার মনে না পরে তাহলে ফকিরকে টাকা দিয়ে দেবেন। আমি বরং চলি, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ইজাজুল ইসলাম সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবকটি তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে গিয়ে এক দৌড়ে প্রায় চলন্ত একটি লোকাল বাসে উঠে পড়লো।
তিনি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হচ্ছে। খানিকটা ধাতস্ত হয়ে ভ্রাম্যমান সিগারেটের দোকানের দিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে পাঞ্জাবীর ডান পকেটে হাত দেওয়া মাত্রই যুবকটিকে চিনতে পারলেন তিনি! যুবকটি মোটেও মিথ্যা বলেনি। তার সাথে দেখা হয়েছিল এক ইন্টারভিউ বোর্ডে। সেবার একটি বেসরকারী ব্যাংকের প্রবেশনারী অফিসারের জন্য আয়োজিত ভাইভা বোর্ডে ছিলেন তিনি। যুবকটিকে সেখানেই দেখেছেন। যুবকটির কথা বিশেষভাবে তাঁর মনে থাকার কথা ছিল, কিন্তু ভুলে গেছেন। যুবকটি ভাইভায় খুব একটা খারাপ করেনি সেদিন। তিনি ভাল নাম্বারও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কথা শুনে তো মনে হলো, ঐ চাকরিটা সে পায়নি!
সেদিন প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে যুবকটি যখন পিছন ফিরে ভাইভা রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলো, তখন বোর্ড মেম্বারদের একজন লক্ষ্য করলেন যে, যুবকটির পিছনের পকেটটি কাটা! তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে যুবকটিকে ডেকে বললেন, এ রকম একটা ছেঁড়া প্যান্ট পড়ে ভাইভা দিতে এসেছো?
যুবকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলেছিল, স্যার, পিক-পকেট হয়েছে। অফিসের নিচে এসে বুঝতে পেরেছি। ততক্ষণে আর পাল্টিয়ে আসার মতো সময় ছিল না। সরি স্যার।
- এরকম কেয়ারলেস হলে চাকরি করবে কিভাবে? ব্যাংকে চাকরি করতে হলে সবদিকেই সিরিয়াস হতে হয়।
- চাকরিটা হয়তো হবে না স্যার। চাকরির পরীক্ষা দেবার বয়স প্রায় শেষ, আর হয়তো দুই একটা পরীক্ষা দিতে পারবো। তবে স্যার বারবার যদি পিক-পকেট হতে থাকে তাহলে হয়তো চাকরিও আর পাওয়া হবে না, সেক্ষেত্রে পকেটমারের স্বাধীন ব্যবসায় নাম লেখাতে হবে। কে জানে, এই পকেটমারও হয়তো আমার মতোই মাস্টার্স পাশ বেকার!
ইজাজুল ইসলাম সাহেব সেদিন বলেছিলেন, হতাশ হবে না। এটা হবে কি না জানি না, তবে দোয়া করি চাকরি একটা ঠিকই হবে তোমার।
সেদিনও একগাল হেসে যুবকটি বিদায় নিয়েছিল। বিদায় নেবার আগে যুবকটিকে দু’টো একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছিলেন ধার হিসেবে।
যুবকটির শোধ দেয়া টাকা থেকে সিগারেট দাম চুকিয়ে ফুটপাথ ধরে এগিয়ে এসওএস শিশু পল্লীর সামনে অপেক্ষাকৃত খালি জায়গায় দাঁড়ালেন। যুবকটির কথা ভাবতে ভাবতে মন খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। পাশাপাশি একটাও ভাবছেন, দুইশো টাকার কম টাকা পকেটে নিয়ে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়াটা ঠিক হবে, নাকি বাসায় ফিরে যাবেন?
ছবি: গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৩