somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

এক নিরুদ্দেশ পথিক
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব,ইইই প্রকৌশলী। মতিঝিল আইডিয়াল, ঢাকা কলেজ, বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।টেলিকমিউনিকেশন এক্সপার্ট। Sustainable development activist, writer of technology and infrastructural aspects of socio economy.

বাংলা ভাষার ভাবনা।

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলা ভাষার ভাবনা।
ক।
নানাবিধ কারনে বাংলাদেশ বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ গন্তব্য হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিযোগীতার শিকার যেমন হয়েছে, তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেও পড়েছে। সময়ের সাথে এর মাত্রা আরো বাড়বে বলেই মনে করি। পশ্চিম বাংলার যুবক যুবতী আজকে বাংলাকে পিছনে ঠেকে ইংরেজি ও হিন্দিকে বেছে নিয়েছে, আধুনিকতা অথবা কর্মের খাতিরে। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষার গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব শুধুমাত্র সাহিত্য রচনা ও চিন্তা তৈরিতে নেতৃত্ব দিবার কারনে নয়। বরং এটা পারিপার্শ্বিক বহু ঘটনার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া। তাই সবমিলে বাংলা ভাষা বিকাশে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের দায়িত্ব বেড়েছে। চিন্তায় ও সৃজনে বাংলাকে যত্নের সাথে এগিয়ে নিবার এই দায়িত্ব আমাদের সবার।

খ।
সংস্কৃত ভাষার মোড়ক দিয়ে বাংলাকে সংস্কৃত উদ্ভূত ভাষা হিসেবে চালিয়ে দিবার বয়ান খারিজ হতে চলেছে। ঔপনিবেশিক ঔরসে গড়ে উঠা 'আভিজাত্য' মোড়ানো 'জমিদারি' বাংলাকে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আলো ছড়াচ্ছেন, এটা আনন্দের বিষয়। বাংলা ভাষায় আমারা গাইবো সাধারণ মানুষের জীবনের জয়গান। কৃষক শ্রমিক জেলে কামার কুমার তাঁতি ছাত্র যুবা যে ভাষায় জীবনকে দেখে, যে ভাষায় স্বপ্ন দেখে, অনুভুতি প্রকাশ করে সেটাই আমাদের ভাষা মান। যাপিত জীবনের আনন্দ বেদনা প্রতিবাদের ভাষাই আমাদের প্রাণের ভাষা, আমার মায়ের ভাষাই আমার গৌরব, হোক অভিজাতদের কাছে তা আদিখ্যেত্যা, হোক তা চাষার ভাষা!

গ।
অভিজাত'দের প্রমিত ভাষা কাঠামো নির্মাণে পুর্ব বাংলার মানুষের সবগুলো ধ্বনিকে বিবেচনায় আনা হয়নি বলে দীর্ঘ অভিযোগ আছে। সুতরাং এই বিষয়ে আমাদের ভাষা বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব দেয়া চাই। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৌলিক ধ্বনি গুলোকে বর্ণে কিংবা ভাবের প্রকাশে কিভাবে স্থান দেয়া হবে, তা তাঁদের এখতিয়ারে দেয়া চাই। একই সাথে অভিজাত প্রভাবে বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, পরিভাষা নির্মাণ ও নির্ধারণ, বানান রীতি সহ বাংলা ব্যাকরণে যে যে বিকৃতি গুলো আনা হয়েছে, সেগুলো সংশোধনে আঞ্চলিক গনশুনানি করা দরকার। যে পদ্ধতিতে কলকাতায় বসে পুর্ববঙ্গের মানুষের ভাষাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে, একই ভাবে ঢাকার নতুন অভিজাতদের হাত দিয়ে আঞ্চলিক ভাষা গুলোর একই ক্ষতি আমরা করতে পারি না। এইক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীর নেতৃত্ব নির্বাচনে আঞ্চলিক কবি সাহিত্যিক শিল্পীদেরও সংশ্লিষ্টতা রাখা উচিৎ। বাংলা একাডেমীকে স্বৈরাচারের প্রতিনিধিত্ব মুক্ত করা আজ সময়ের দাবী।


মানুষের সাথে মানুষের সংযোগে মান ভাষার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না, তবে তাকে অন্তর্ভূক্তিমূলক করা চাই। মান ভাষা বা প্রমিত ভাষা এমন হতে হবে যাতে আঞ্চলিক ভাষা গুলোর রূপ থেকে তা অনেক দূরে অবস্থান না করে। ঢাকার তথাকথিত অভিজাতরা যে ভাষায় রেডিও টিভিতে এসে কথা বলেন, তা যশোর সাতক্ষীরা বরিশাল সিলেটে চট্রগ্রাম নোয়াখালী রাজশাহী রংপুরের ভাষা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ভাষা বহমান নদীর মত। জীবনধারা ব্যবসা ধর্ম ও লোকায়ত সংস্কৃতির প্রভাবে আঞ্চলিক যোগাযোগের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন নতুন শব্দ বাক্য প্রবাদ স্লোক বয়ান তৈরি হয়। গ্রণযোগ্যতার ভিত্তিতে ভাষায় বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে সহতাজ প্রক্রিয়ায়, লম্বা সময় নিয়ে। অভিজাত প্রমিত বাংলার সমস্যটা হচ্ছে এই মান ভাষার সাথে পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষা সমূহের দুরত্বটা অনেক। অধ্যাপক রাজ্জাক এই নিয়ে যা বলেছেন তাঁর ভাবার্থ এরকম- এই দুরত্বটা এতই বেশি যে সাধারণের মুখে ভাষাটা আসে না। সাধারণকে ভাষাটা শিখতে হয়। রবং লেখাপড়া করে 'লায়েক' হওয়ার পরেই কেমন এই ভাষায় কথা বলা যায়! অথচ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রধানতম বিষয়টা হচ্ছে শিক্ষার্থীর উপর থেকে ভাষার দেয়াল সরিয়ে দিয়ে শিশুর বিকশকে, সাহিত্যের সৃষ্টিকে স্বাভাবিক করা, সহজাত করা, দৈনন্দিন জীবনের অংশ করা।

ঘ।
ঔপনিবেশিক বিকাশের বেলায় কলকাতার জমিদারি প্রভাবশালীরা 'প্রমিত বাংলা'র নাম করে সংস্কৃতকে বলপ্রয়োগে অনুপ্রবেশ করানোর পাশাপাশি আসাম, সিলেট, উড়িষ্যার নিকটাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা গুলোকে স্বাধীন ও একক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে কিংবা উপেক্ষা করে যে ভুল করা হয়েছে, তার মাশুল পশ্চিমের বাঙ্গালীরা আজ রাজনৈতিক ভাবে দিচ্ছেন। আমরা দেখছি এই মাশুল প্রাণঘাতী। এসব থেকে শিক্ষা নেয়া হোক। পূর্ব বাংলার অবহেলিত ধ্বনি গুলো মূল ভাষায় এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্থান না পেলেও এই নিয়ে করা গবেষণা কাজগুলোকে সম্মান জানাই। সিলেটের নাগরিক বর্ণমালা সহ পূর্ব বাংলার অপরারাপর ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক (চাকমা, সাঁওতাল ইত্যাদি) জনগোষ্ঠীর ভাষা গুলোর বিকাশ ও সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্টতা খুব জরুরী বিষয়।

ঙ।
প্রত্যেক শিশুর মায়ের ভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারকে স্বীকার করতে হবে, একই সাথে দায়িত্বও নিতে হবে। মানুষের সাথে মানুষের সংযোগে মান ভাষার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না, তবে তাকে অন্তর্ভূক্তিমূলক করা চাই। মায়ের ভাষা হিসেবে আঞ্চলিক ভাষা (প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষারও একটা সাধু রূপ থাকে) যত বেশি সমাদৃত হবে মান বা প্রমিত ভাষা তত বেশি সাধারণের কাছাকাছি আসবে। এতে করে নতুন শিল্প ও সাহিত্যের সৃজনে, চিন্তার গঠনে ভাষার প্রভাব আরো বলবান ও বেগবান হবে। বাংলাকে যত্নের সাথে এগিয়ে নিতে হলে মান ভাষাকে 'অভিজাতদের গুরুগম্ভীরতার মোড়কে' রেখে না দিয়ে সাধারণের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে।

"ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়" এটা দিয়ে আক্ষরিক ভাবে আসলে মুখের ভাষা নয়, আমি মনে করি অধিকারের বিষয়টাই সমানে আসে। মাতৃভাষা আসলে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তবে মাতৃভাষায় শিক্ষার ও কর্মের অধিকার কেড়ে নেযা যায়। সমস্যা হচ্ছে শিক্ষার ও কর্মের অধিকার কড়ে নিলে চিন্তার স্বাধীনতা ধীরে ধীরে হারায়, এতে ভাষার বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হয়। উর্দুকে আসলে ইংরেজির বদলে নতুন লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ভাষা করার একটা চেষ্টা হয়েছিল- আমরা যে যেভাবে বুঝি। পাকিস্তানে উর্দু আর ভারতে হিন্দি ইংরেজির বিপরীতে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে ক্যান্ডিডেট। ইংরেজির বিপরীতে স্থানীয় একটা প্রধান ভাষাকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করার চেষ্টাটা কতটা সফল তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক করা যায়। ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশে দারিদ্র্যের যে হার, তাতে মনে হয় না যে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ভিত্তিক ভাষা আঞ্চলিক ভাষাভাষী মানুষের স্বাভাবিক শিক্ষা ও চিন্তার বিকাশে ভাষা নামক 'দেয়াল' বা বাঁধাকে ভেঙে দিতে পেরেছে। শিক্ষাই দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধানতম বিনিয়োগ। তাই লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ভাষার সাথে মাতৃভাষার খুব কাছাকাছি ভাষায় একটা স্তর পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে ভাবা যায়। এমনকি অভিজাত প্রমিত বাংলাকে আমি আঞ্চলিক পরিবেশে শিশুর স্বাভাবিক শিক্ষার পথে কিঞ্চিৎ বাঁধা হিসেবে দেখি। সময়ে এসেছে নতুন ভাবনার।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৪১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×