ভারতের লৌহ মানবী বলা হয় তাকে...সেই ২০০০ সাল থেকে এখনো আমরন অনশন করছেন...গত তেরো বছর ধরে তিনি মুখে কিছু নেন নি...এক ফোটা পানি থেকে শুরু করে খাবারের ক্ষুদ্র কনাটিও তিনি গ্রহন করেননি!! মুখ থেকে লালা পর্যন্ত যেতে দেন না পেটে...আর তাই ঠোট মুছেন স্পিরিট দিয়ে...দাত মাজেন শুকনো কাপড় দিয়ে! আর দশজন মানুষের মতো আর নেই এই মানুষটা...স্বাভাবিক মানুষদের মতো আর নেই তার শারিরীক অবস্থা...ক্ষীন দেহের এই মহিলাকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে...নারীর জৈবিক ধর্ম ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে গেছে সেই কবেই!!
বেঁচে আছেন কিভাবে তিনি??
ভারতীয় সরকারই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে... নাসোগ্যাস্ট্রিক ইনটিউবেশন এর মাধ্যমে নল দিয়ে নাকের মধ্য দিয়ে খাবার সরবরাহ করে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে...অবশ্য সুযোগ পেলে তিনি সেই নলও খুলে ফেলেন...আত্মহত্যা চেষ্টার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় অনশন শুরুর কদিন পর থেকেই...ভারতের আইনে আত্মহত্যাচেষ্টার অভিযোগে শাস্তি এক বছর...আর তাই এক বছর পর পর তিনি জেল থেকে ছাড়া পান...ছাড়া পেয়েই আবার অনশন শুরু করেন তিনি...ব্যাস আবারও জেলে পুরে রাখা হয় তাকে...জেল থেকে পরে হসপিটালে নিয়ে রাখা হয় তাকে...বলতে গেলে তিনি নিজের জীবনটাই ধ্বংস করে দিয়েছেন এরকম করে...কিন্তু কেনো???
২০০০ সালের ২ নভেম্বর...ভারতের মনিপুর রাজ্যের এক বাস স্ট্যান্ডে ১০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী...এই ১০ জনের মধ্যে সিনাম চন্দ্রমনি নামের এক আঠারো বছর বয়সী তরুন ছিলেন, যে কিনা মাত্র কদিন আগে ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে সাহসিকতার জন্য জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল!! নিহতদের মধ্যে আরো ছিল লেইসাংবম ইবতেমি নামের এক ৬২ বছর বয়সী বৃদ্ধা...
২৭ লক্ষ মানুষের ছোট্ট রাজ্যটাতে নিরপরাধ মানুষ হত্যার এই ঘৃন্য ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিল...কিন্তু সেনাবাহিনীকে এর জন্য শাস্তি তো পেতেই হয় নি, এমনকি জবাবদিহিতা পর্যন্ত করতে হয় নি...কারন সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই এসব মনিপুর রাজ্যে AFSPA নামের আইন চালু করা আছে, যার ফলে সেনাবাহিনীকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় নাহ...মূলত সেনাবাহিনীর দায়মুক্তির জন্যই আইনটি প্রনয়ন করা হয়েছিল!! মনিপুরের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে ভারতের জন্মের পর থেকেই...আর এই আন্দোলন দমানোর জন্যই আইনটি প্রনয়ন করা হয়েছিল...এই আইনের বলে যে কাউকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারে সেনাবাহিনী, এমনকি হত্যা থেকে শুরু করে যেকোনো কিছু! AFSPA আইনের কারনে সেনাবাহিনীর এতোটাই প্রভাব এসব অঞ্চলে যে, সেনাবাহিনীর মতো একটি রেপুটেটেড বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষনের মতো ন্যাক্কারজনক কাজ করতেও পিছু পা হয় নাহ...তাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল ১২ জন নারী...সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে রাস্তায় নেমেছিল "ইন্ডিয়ান আর্মি রেইপ আস" লেখা ব্যানার নিয়ে!!
দশ জন মানুষকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল তার আশেপাশেই থাকতেন ইরম শর্মিলা নামের এক ২৮ বছর বয়সী তরুনী...সেনাবাহিনীর এমন স্বেচ্ছাচারিতা দেখে শর্মিলার ভাবান্তর হয়েছিল...মনে হচ্ছিল কিছু একটা করা দরকার...আর তাই ২০০০ সালের ৪ নভেম্বর মায়ের পা ছুয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন AFSPA আইন মনিপুর রাজ্য থেকে প্রত্যাহার করার দাবী নিয়ে...শর্মিলা দাবী আদায়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন আমরন অনশনকে...
সেই থেকে এখনো নিজের দাবী নিয়ে অনড় অবস্থানে আছেন তিনি...ভারতীয় রাজনীতিতে কত পরিবর্তন আসল,কত কিছু ঘটে গেলো কিন্তু তবুও শর্মিলা নড়েননি তার অবস্থান থেকে...তবে শর্মিলা মিডিয়াকে কখনোই তার পাশে পাননি যেমনটা বাবা রামদেব কিংবা আন্না হাজারে পেয়েছিল!! এটা ভারতীয় মিডিয়ার জন্য লজ্জাজনকও!!
এটা সত্যি যে, মেয়েরা শারিরীক ভাবে দূর্বল...কিন্তু নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে এই দূর্বলতা কিছুই নাহ...ইরম শর্মিলা সেটাই প্রমান করেছে...কত মানুষ অনশন করে...দু চারদিন অনশন করে অমুক/তমুকের অনুরোধে অনশন ভেঙ্গে ফেলে...কিন্তু ইরম শর্মিলা তা করেননি...তেরো বছর ধরে অনশন করছেন তিনি...
ইরম শর্মিলার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই...নারী হয়েও তার এমন নীরব আন্দোলন সবাইকেই আশ্চর্য্য করে দেয়...ইরম শর্মিলা শুধু নারীদের জন্যই অনুপ্রেরনা নাহ, তিনি সব মানুষের জন্য অনুপ্রেরনা...অনেকেই সহজে সাফল্য না পেলে হাল ছেড়ে দেন, তাদের জন্য শর্মিলা এক বিশাল অনুপ্রেরনা...
ইরম শর্মিলা মহাত্ম্যা গান্ধীর অনুসারী...আর তাই মহাত্ম্যা গান্ধীর মতো শান্তিপূর্ন প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি...ও হ্যা, শর্মিলা কিন্তু কবিও!
আশা করি, একটু দেরীতে হলেও শর্মিলা সফল হবেন...বিকজ শী ট্রুলি ডিজার্ভস ইট! আর যদি সফল না হয় তাহলে ইতিহাস নিজেই লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পাবে নাহ...কারন ইতিহাসের পাতা বলে যে, সত্যিকারের বীর আর বীরাঙ্গনারা কখনো ব্যার্থ হয় নি! আশা করি শর্মিলাও ব্যার্থ হবে নাহ।