মুসলমানদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটা ধারনা আছে যে ইসলামে যুদ্ধ বন্দী নারীদেরকে গণিমতের মাল হিসাবে গণ্য করা হয় এবং তাঁদের সাথে অবাধে সেক্স করা যায়। নারী দাসীদের সাথেও (যুদ্ধ বন্দী অথবা যুদ্ধবন্দী না ) অবাধে সেক্স করা যায়। কারন উহা আপনার ইমাম/ ধর্মীয় নেতা/ মোল্লা /হজুর বলেছেন। যেহেতু তারা বলেছেন, উহা জায়েজ। আসলে কি তাই?
যারা হাদিস নামক একখানা জিনিষ লিখছেন, কোরআনের তফসির করেছেন তারা প্রায় সবাই মোটামুটি এই বিষয়ে একমত। এর মধ্যে হালের মওদুদী তাঁদের মধ্যে একজন উজ্জল নক্ষত্র। কারন এই বিষয়ের পক্ষে সবচেয়ে এক্সট্রিম মতামত আমার দেখামতে এই মওদুদী করেছেন। তার মুল রেফারেন্স ঐ একই জিনিষ- হাদিস।
এর বিপক্ষে একটা মত লক্ষ্য করা যায়, যাহারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে উহা সঠিক নয়। এর জন্য উনারা যে যুক্তি দেন তা পক্ষান্তরে তাঁদের জ্ঞানের অজ্ঞতা প্রকাশ করে, এবং তাঁদের দেওয়া যুক্তি এর চেয়েও বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়- এর কারন ও একি-সেই হাদিস।
যারা পক্ষে বা বিপক্ষে বলছেন, তারা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছেন- তা হচ্ছে হাদিসের বর্ণনা। কিন্তু এই দুই দলের কেউই কোরআন খুলে দেখেন না আসলে কোরআনে এই ব্যাপারে কি বলা আছে। কারন মনে হয় প্রায় সবারই কোরআনে এলার্জি আছে (আমার ব্যক্তিগত মতামত)
আমার এই বিষয়ে লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্- যিনি বিধান দেবার মালিক এবং যার কথাই চূড়ান্ত (যদিও বেশিরভাগ মানুষ এইটা মানেনা) সে আল্লাহ্ এই ব্যাপারে কি বলেছেন।
এই জিনিসটাকে কোরআন দিয়েই ৪/৫ ভাবে ব্যাখা করা যায়, এবং প্রতি ব্যাখার উপসংহার একই- এই ধরনের কোন বিধান আল্লাহ্ কোরআনে দেয় নাই। আমি ব্যাপারটাকে জটিল না করে সহজ ভাবে ব্যাখা করার চেষ্টা করব, যাতে ব্যাপারটা সবার জন্য বোধগম্য হয়।
যুদ্ধবন্দীঃ
এই ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশ খুব পরিষ্কার।
So when you meet those who disbelieve, then strike the necks until when you have subdued then bind firmly the bond, then either a favor afterwards or ransom until lays down the war its burdens. That. And if Allah had willed surely, He could have taken retribution from them, but to test some of you with others. And those who are killed in (the) way of Allah, then never He will cause to be lost their deeds.
অর্থাৎ, যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দীদের হয়ঃ
১। দয়া করে ছেড়ে দিতে হবে, অথবা
২। মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে হবে।
এই দুইটা অপশনের সারমর্ম হচ্ছে যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দিতে হবে দয়া করে অথবা মুক্তিপণের বিনিময়ে। সমগ্র কোরআনে আল্লাহ্ কোন তৃতীয় অপশন দেন নাই। কেউ দেখাতে পারবে না। সুতরাং যুদ্ধ বন্দী নারী গনিমতের মাল, তারে আপনি যা খুশি তাই করবেন- এই ধরনের কমান্ড আল্লাহ্ দেয় নাই। এই কমান্ড কারা আল্লাহর নামে বানিয়েছেন এবং তাঁদের উদ্দেশ্য কি ছিল সেটা আপনারা নিজেরাই বুঝে নেন।
দাসীঃ
এই গণিমতের মাল এবং যৌন দাসী সম্পর্কে আরও বলার আগে একটা জিনিষ এইখানে বলে রাখা ভাল যে কোরআনে দাসীর জন্য স্পেসিফিক শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে। কোরআনের ২৪:৩২, এবং ২:২২১ এই দাসী শব্দটা এসেছে। আমাদের মোল্লারা যখন কোরআন পড়েন, তখন সম্ভবত চোখ, কান বন্ধ করে সোয়াবের আশায় কোরআন পড়েন। যদি তাই না হত, তবে এই দাসী শব্দটা তারা কোরআনে দেখতে পেতেন।
মা- মালাকাত- আইমানুকুমঃ দক্ষিণ হস্ত যার অধিকারীঃ
কোরআনের সবচেয়ে বিকৃত অনুবাদের মধ্যে “মা- মালাকাত- আইমানুকুম”- এইটা অন্যতম। এইটার অনুবাদ করতে গিয়ে অনেকে এইশব্দটার পরে একটা ব্রাকেট দিয়ে তার মধ্যে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপঃ কোরআনের ৪:২৪ নম্বর আয়াতের বিভিন্ন অনুবাদঃ
অনুবাদ-মহসীন খানঃ
Also (forbidden are) women already married, except those (captives and slaves) whom your right hands possess
অনুবাদ- পিকথলঃ
And all married women (are forbidden unto you) save those (captives) whom your right hands possess
অনুবাদ-আল- মুন্তাখাবঃ
Nor can you marry the women who are married except the captives on hand; a prescriptive rule imposed by Allah on you to observe.
(উনি ত ব্রাকেট ছাড়াই বসিয়ে দিয়েছেন)
অনুবাদ- আব্দুল হালিমঃ
women already married, other than your slaves
মনে হয় বোঝানোর জন্য এই কয়েকটা অনুবাদ যথেষ্ট। এই “মা- মালাকাত- আইমানুকুম” কেন যুদ্ধবন্দী নারী বা দাসী হবে না, তার ব্যাখা উপরে দেওয়া আছে। বুঝতে সমস্যা হলে প্রথম থেকে আবার পড়ে আসেন।
তাহলে এইটা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে। এইটা একটা phrase।
আরবী শব্দ “ইয়ামিনিকুম” এর বহুবচন রুপ হচ্ছে “আয়মানাকুম” যা দ্বারা “ দক্ষিণ হস্ত” অথবা “শপথ” এই দুইটাই বুঝাতে পারে। এই “আয়মানুকুম” শব্দটা কোরআনের আরও অনেক জায়গায় এসেছে। আসেন দেখি সেখানে কি অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছেঃ
And (do) not make Allah's (name) an excuse in your (aymanikum) oaths………(২:২২৪)
...... you take your (aymanikum) oaths……… (১৬:৯২)
And not take your (aymanikum) oaths……… (১৬:৯৪)
Indeed, Allah has ordained for you (the) dissolution (of) your (aymanikum) oaths… (৬৬:১০)
এই রকম অনেক আয়াতে এই শব্দটা কোরআনে এসেছে, এবং এই phrase বাদে সবখানেই অনুবাদ করা হয়েছে oaths /“শপথ”।
এইটা টার্মটা কোন দাসী বা যুদ্ধ বন্দীদের লক্ষ্য করে বলা হয়নি। এইটা একটা idiomatic expression- যার আক্ষরিক অর্থ দাড়ায় “ দক্ষিণ হস্ত” বা “ Right Hand” । এর সত্যিকারের অর্থ sworn oath.
সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে কাদের সম্পর্কে বা কোন নারীদের সম্পর্কে এই কথা বলা হয়েছে?
এই টার্ম টা সেই সকল অসহায়দের (নারী এবং পুরুষ) সম্পর্কে বলা হয়েছে যারা আর্থিক ভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল এবং তাঁদের কে দেখার মত কেউ নেই। নারীদের ক্ষেত্রে- বিশ্বাসীদের বলা হচ্ছে তারা এই সকল নারীদের কে শপথের দিব্যি দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব নেবে। এইটাকে বলা হয় Bond Akin/ Committed by oath.
কোরআনে স্পেসিফ্যাক্যলি এই ধরনের নারীদের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে ৬০:১০ এঃ
মুমিনগণ, যখন তোমাদের কাছে ঈমানদার নারীরা হিজরত করে আগমন করে, তখন তাদেরকে পরীক্ষা কর। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জান যে, তারা ঈমানদার, তবে আর তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিও না। এরা কাফেরদের জন্যে হালাল নয় এবং কাফেররা এদের জন্যে হালাল নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে, তা তাদের দিয়ে দাও। তোমরা, এই নারীদেরকে প্রাপ্য মোহরানা দিয়ে বিবাহ করলে তোমাদের অপরাধ হবে না। তোমরা কাফের নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না। তোমরা যা ব্যয় করেছ, তা চেয়ে নাও এবং তারাও চেয়ে নিবে যা তারা ব্যয় করেছে। এটা আল্লাহর বিধান; তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। (৬০:১০)
এর চেয়ে এক্সপ্লিসিট ব্যাখা আর কি হতে পারে?
যদি কোন বিবাহিত নারী ইসলাম গ্রহণ করে সেই ক্ষেত্রে তার কাফের স্বামীর সাথে থাকতে পারে না, সেইক্ষেত্রে যদি কোন বিশ্বাসী/মুমিনের নিকট আশ্রয় খুজে তবে সেই মুমিন ব্যাক্তি তাকে আশ্রয় দেবার শপথ গ্রহণ করবে। সেই নারী শপথ দ্বারা আশ্রিত হবে। সেই আশ্রয় দাতা মুমিন ব্যাক্তি এবং আশ্রিত মুমিন নারী পরস্পরের সম্মতি ক্রমে উপযুক্ত মোহরানার বিনিময়ে বিবাহ করতে কোন বাধা নেই কারন সেই আশ্রিত মুমিন নারীর পূর্বের স্বামী কাফের হওয়ার কারনে ঐ বিবাহ বিচ্ছেদ বলে গণ্য হবে।
অর্থাৎ, যদিও যে কোন বিবাহিত নারী পুরুষের জন্য হারাম, সেই সব আশ্রিত নারী বিবাহিত হলেও তাদেরকে বিবাহ করা যাবে কারন ঐ নারীদের পূর্বের স্বামী কাফের হবার কারনে সেই বিবাহ বৈধ বলে গণ্য হবে না। কোরআনে এই কথাটাই বলা হয়েছে।
এই বার কোরআনের ২৪:৪ এবং এই ৬০:১০ একসাথে মিলিয়ে পড়ুন, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াবেঃ
১। সকল বিবাহিত নারী আপনার জন্য হারাম।
২। যেসব নারী ইসলাম গ্রহণ করার কারনে স্বামী ছেড়ে কোন মুমিনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে, তাঁদের কে মুমিন ব্যাক্তি আশ্রয় প্রদানের শপথ নিবেন।
৩। ঐ নারীর আগের বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে।
৪। পরস্পরের সম্মতি ক্রমে ঐ নারীকে বিবাহ করতে কোন বাধা নেই। এই ক্ষেত্রে ঐ নারীর পূর্বের কাফের স্বামীকে ঐ নারীকে পূর্বে দেওয়া মোহরানা পরিশোধ করে দিতে হবে।
সুতরাং ২৪:৪ এর সঠিক অনুবাদ হবে
“ …. All married women except committed by your oath….”
যদি ঐ রকম নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ নাও হয়, তথাপি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মুমিন কতৃক ঐ নারীকে আশ্রয় দেওয়ার শপথ নেওয়ার কারনে ঐ আশ্রিত নারীও মুমিন ব্যাক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসাবে গণ্য হবে, যাতে ঐ মুমিন ব্যাক্তির মৃত্যুর পর ঐ আশ্রিত নারী কে আবার আগের অসহায় অবস্থানে পরতে না হয়।
পিতা-মাতা এবং নিকটাত্নীয়গণ যা ত্যাগ করে যান সেসবের জন্যই আমি উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। আল্লাহ নিঃসন্দেহে সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন। (৪:৩৩)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:৪১