somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাহলে বোধহয় মানবসঙ্গবিরলই...(বুক রিভিউ)

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বইয়ের নাম: মানবসঙ্গবিরল
লেখক: সালাহউদ্দিন শুভ্র
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: ভাষাচিত্র
মূল্য: ১১০টাকা
...........................................................................................................
যত দিন যাচ্ছে আমাদের সামষ্টিক অনুভূতিগুলো বা চিন্তা-চেতনার জায়গাগুলোও প্রকট আকারে ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে। 'নিঃসঙ্গতা'র বোধটিই প্রগাঢ়ভাবে প্রোথিত হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের অভ্যন্তরে; সচেতন অথবা অবচেতনভাবে। এই বোধগুলি নিয়ে নড়াচড়া করতে করতেই লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনার সামগ্রীক রূপায়নের নাম 'মানবসঙ্গবিরল' বইটি। কথাটায় হয়ত একটা অতিসরলীকরণের আভাস আছে, কারণ বইটিতে গল্প আছে মোট ৭টি, এবং বিষয়বস্তুর নিরিখে সাতটি গল্পের বাস ৭টি ভিন্নরাজ্যে, স্রেফ 'ব্যক্তিগত, বোধ, নিঃসঙ্গতার' মত কিছু কেতাবি শব্দ দিয়ে গল্পগুলোকে ট্যাগ করে দেয়াটা একধরনের দায়সারা বৃত্তি। এজন্যই প্রয়োজন বিশদীকরণের।

আগেই বলেছি বইয়ে গল্পের সংখ্যা ৭। আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করতে যে শব্দগুলোর সহায়তা নেব সেগুলো এরূপ: অভিনব, অসাধারণ, চমৎকার, নিষ্প্রভ এবং সাদামাটা।

আমার কাছে চমৎকার গল্পের সংজ্ঞায়ন হচ্ছে যে গল্প একবার পড়লে অন্তত আরও একবার পড়তে ইচ্ছা করে, এবং প্রতিবারেই ভাল লাগবার অনুভূতির পাল্লা একইরকম থাকে। সে হিশেবে কররেখায় জমানো গল্প, এবং 'ভূতগ্রস্থ মানুষেরা' গল্প দুটি চমৎকার।

কররেখায় জমানো গল্প বস্তুত আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প। আপনার হাতের রেখায় তাকিয়ে দেখুন, সেখানে লেখা আছে আপনার জীবনের হারিয়ে যাওয়া গল্প, কিংবা যে গল্পটি আপনি সযতনে লুকিয়ে রেখেছেন। সেই গল্পে সময় থাকে, চরিত্র থাকে, শুধু ব্যক্তিভেদে প্রেক্ষাপটটা আলাদা হয়, পার্থক্য বলতে এটুকুই। এ গল্পে আমরা মফঃস্বলের একদল কলেজ পড়ুয়া তরুণকে খুঁজে পাই, যারা তারণ্যের দূর্বল দিকটিকে গ্রহণ করে গাঁজা খায় কোন এক বাঁশঝাড়ে বসে। সেখানে করমের চায়ের দোকান আছে, বাকিতে চা খাওয়া চলে। গাঁজা খাওয়ার ফাঁকে চলে দর্শনচর্চা, তাই তখন বাঁশঝাড়কে তারা বলে সংসদ। কিংবা টেলিভিশনকে তারা ব্যাখ্যা করে এভাবে :
'টেলিভিশন মূলত শব্দ নির্ভর মাধ্যম, অথচ তা হবার কথা ছিল রেডিওর ক্ষেত্রে, এখন টেলিভিশনে সবকিছু শব্দ করে এমনকি রঙও। টেলিবিশন আমাদের চিৎকার আর শীৎকারের পার্থক্য চেনায়, খালি রঙ দিয়াই চিনতে পারে। শব্দ না থাকলে রেডিও হয়ত থাকতই না, কিন্তু টেলিভিশন থাকত। কারণ আলো আর রঙেরা শব্দ করে।'
গাঁজার প্রভাবে আরও বেশকিছু বিষয় তাদের কথায় স্থান পায়। একধরনের হতাশা-ক্ষোভ, এই ক্ষোভ তাদের নিজেদের প্রতি, কখনোবা সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি, জীবনের কোন অবস্থানকেই তার নিজস্ব বলে দাবি করতে পারেনা, কোথাও নিজেদের খুঁজে পায়না, এ যেন 'অন্যদের সময়ে বেঁচে থাকা'। হয়তবা সব মানুষই এভাবেই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বেঁচে থাকে। সেই বেঁচে থাকাটাই লেখক আমাদের দেখিয়েছেন এই তরুণদের দর্পণে। এই তরুণদের মাঝেও একজন থাকে যে হতাশা-ক্ষোভকে বয়ে না বেড়িয়ে বেছে নিয়েছে রাজনীতি, আরও স্পষ্টভাবে বললে রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইপ্রোডাক্টে রূপান্তরিত হয়েছে। মুসা নামের এই তরুণটি তার বন্ধুদের কাছে আশ্রয়ের নাম, ভরসাস্থল, কারণ গাঁজা খাওয়া শেষে, শহরময় চষে বেরিয়ে যখন কলেজ পড়ুয়া তরুণগুলো সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি না ফেরার, তখন মুসার কাছেই তাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়, এমনকি করমের দোকানের বাকিও শোধ হয় মুসার বদৌলতেই। সেই মুসাসহ তারা তখনো গভীর রাত্তিরে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় গোরস্থানে। নেশার ঘোরেও সেখানে কখনোবা চলে আসে মৃত্যুভয়। এই আড্ডাচ্ছলেও লেখক গল্পের চরিত্র তাপসের জবানে আমাদের জানান এক নির্মম দর্শন:
'আমরা যত বড় হতে থাকি, অর্থাৎ এই যে এখন যেমন বেকার, চাকরি খুঁজি, এমন বয়স যার আসে সে ক্রমশ মানবসঙ্গবিরল জীবনের দিকে ধাবিত হয়, এই জীবনের শেষ হয় কবরে গিয়া। বা আসলে মিনিপ‌্যাক-সভ্যতা মানুষের সঙ্গকে ক্রমশ বিরল করে তুলছে। '
তবে এরপরও জীবন চলে, যেমন জীবন চলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় মুসা নিহত হবার পরও। ততদিনে সময় চলে গেছে অনেকদূর, মফঃস্বলের সেইসব গাঁজায় আসক্ত তরুণরাও ব্যস্ত ঢাকা শহরে কর্মব্যস্ততার রুটিনে বাধা পড়ে যায়। মুসা তখন তাদের গল্প বলার একটা বিষয় উঠে, সময় কাটানোর একটা উপলক্ষ হয়ে উঠে। জীবনের এই নির্লজ্জ বাস্তবতা অন্য সবার মত তারাও অস্বীকার করতে পারেনা। তাই তাদের ভাবনায় ঘুরপাক খায়:
'শহরের সকলেই আমরা গড় মানুষ। আমাদের বয়েস-রুচি-খাদ্য-কবিতা সকল কিছুর গড় হিসাব চলে। বাজারে কী উঠল তা দিয়েই আমাদের জীবন চলে। যা বাজারে নাই তা আমাদের জীবনেও নাই। ফলে মানবিক সম্পর্কহীন সময়ে আমরা তলপেটের বেগ চেপে সুদিনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি প্রায় প্রতিদিন'।
গল্পের ট্রানজিশনগুলো অনেকটা হুট করে হয়ে যায়, যেটা একইসঙ্গে অস্বস্তিকর আবার চমকপ্রদও। অস্বস্তিকর, কারণ এতে মাঝে মাঝে চিন্তার প্রবাহটা বাধাগ্রস্থ হয়, আর চমকপ্রদ, কারণ লেখক কোন একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে চুইংগাম ফোলানোর মত অহেতুক প্রলম্বিত করেননি। সার্বিক বিবেচনায় তাই গল্পটি আমাদের প্রত্যেকের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলোরই মুখপত্র।

ভূতগ্রস্ত মানুষেরা গল্পটি হতে পারে ম্যাজিক রিয়ালিজম বা যাদু বাস্তবতার নান্দনিক নিদর্শন। গল্পের শুরুর লাইনাটিই এরকম ' রহম তার মৃত্যুর বাহান্ন দিন পরে কবর থেকে উঠে আসে। একটানা বাহান্ন দিন শুয়ে থাকবার পর প্রথমে সে পা টেনে এনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ'।
গল্পের একটি দীর্ঘ অংশ পর্যন্ত মনে হবে রহমের উঠে আসাটা বাস্তব, এবং গল্পের এই বুননে লেখকের মুন্সিয়ানা প্রশংসার দাবিদার। রহমের সূত্র ধরে আমরা জানতে পারি বয়রা মাঝির কথা, হারু আর তার স্ত্রী কালিয়ার কথা, আমরা দেখি নাছিমাকে, যার প্রতি জীবদ্দশায় রহমের ভালবাসা জন্মেছিল। এছাড়া আরও দেখি রহমের চাচা, মসজিদের হুজুর, কিংবা মাতাল জব্বরকে। এক রহমকে কেন্দ্র করে ভবগায়ের টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে দেখতে পাই, জানতে পারি কালিয়ার সঙ্গে বয়রা মাঝির নিষিদ্ধ সম্পর্কের কথা, আরও জানি কখন-কিভাবে হারু-কালিয়া ভবগায়ে এসেছিল, এরপর মদ বিক্রি করে কিভাবে সংসার চালাত। গল্পের একটা পর্যায়ে আমরা উপলব্ধি করি সব মানুষের মনের ভেতরেই ভূত থাকে, সেই ভূতটা তার নিজের ভুত, সে নিজেই তাকে জাগিয়ে তোলে। এজন্যই রহম ভূত হয়ে আসে নাছিমার কাছে, কারণ রহমকে সে ভালবাসত, মসজিদের হুজুর যে রহমের জানাযা পড়িয়েছিল সেও রহমকে দেখে, কিন্তু কালিয়া কখনো রহমকে দেখেনা, সে দেখে বয়রা মাঝির ভূত, কারণ বয়রা মাঝি আর তাকে কম্প্রোমাইজিং অবস্থায় আবিষ্কার করে স্বামী হারুই বয়রা মাঝির মদে বিষ মিশিয়ে তাকে ভুতে রূপান্তরিত করেছিল। ভূতের এই ব্যাখ্যাটা পাঠক পাঠ করে নিজেই তৈরি করে নিতে পারত, কিন্তু লেখক অতিরিক্ত ডিটেলিংয়ে ঝুঁকতে গিয়ে গল্পের কোন কোন পর্যায়ে একে প্লেইন টেক্সট ভাবতে রসদ যুগিয়েছেন, যদিও সেই ভাবনার রেশ খুব সামান্যই হবে, কেননা গল্পের প্রবাহটা এতই মসৃণ যে গল্পের বাইরে অন্য কিছু ভাবার জায়গাটা বলতে গেলে পাওয়াই যায়না।

নিষ্প্রভ গল্পের সংজ্ঞায়নটা আমি এভাবে করি, যে গল্পের আড়ালে বা নেপথ্যে লেখকের উপস্থিতিটা বাড়াবাড়িভাবে চোখে পড়ে, এবং ক্ষণে ক্ষণেই মনে হবে, হ্যা আমি একটি গল্প পড়ছি, এবং গল্পটা একজন লেখকই লিখেছেন।

প্রত্যবরোহণ গল্পটাকে নিষ্প্রভ লাগার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে গল্পটার গন্তব্য স্পষ্ট নয়, বক্তব্যও জোরালো নয়, গল্পের অগ্রগতি হয়েছে লেখক যখন যেভাবে চেয়েছেন সেভাবে। ফলে গল্পটা সেই অর্থে গল্প হয়ে উঠতে পারেনি বলেই মনে হয়েছে।
এবার আসি গল্প প্রসঙ্গে। শ্রাবণ পূর্ণিমাতে সাপের ভয়ে মানুষ মাটি ছেড়ে খাটিয়ায় শয়ন করত, এই শয়নের নাম প্রত্যবরোহণ। গল্পে আমরা দেখতে পাই সময়ের চাহিদা মেনে লখাই তার পূর্বপুরুষের কুমোর পেশা ছেড়ে জেলে হয়, মাছ ধরে। সন্তানসম্ভাবা স্ত্রী মণিকার জন্য সে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করতে চায় কিন্তু অভাব তার আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখে। গল্পে ক্ষুধাকে বলা হয়েছে সাপ যা কিনা প্রতিটি মানুষের পেটের ভেতর নিবাস গেড়েছে। গল্পটা ঘুরপাক খায় লেখকের মানসে, কখনো ফিরে আসে মণিকা, কখনোবা লখাই, কিন্তু লখাই, মণিকা ইন্টিগ্রেটেড হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প হয়ে হয়ে পারেনা, বরং লখাইয়ের মানস নিয়ে নড়াচড়া চলতে চলতেই গল্পে সত্যিকারের সাপ প্রবেশ করে লখাইকে উপহার দেয়া মরণকামড়। সাপের এই প্রবেশকে আমি বলবো অনুপ্রবেশ, কেননা তা গল্পের ট্রানজিশনকে আরোপিত একটি বিষয়ে রূপান্তর করে। ফলে গল্পটিতে গল্পের চেয়ে লেখকের বাক্যশৈলী ও বক্তব্যই প্রধান হয়ে উঠে। সবকিছু যদি লেখকের বয়ান থেকেই জানতে হয় তবে পাঠক গল্পের জায়গাটা খুব বেশি মিস করে। অন্তত আমি তেমনটাই করেছি।

'লাল রঙ কৃষ্ণচূড়া' গল্পটি সংশয়পূর্ণ, কারণ কিছু কিছু বিশেষ পয়েন্ট অফ ভিউতে এটি অনেকের কাছেই সুখপাঠ্য হতে পারে, আবার ঠিক সেই ভিউ পয়েন্টের ভিন্নতাতেই এটিকে আমার নিষ্প্রভ গল্প মনে হয়েছে।
গল্পটি রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে দ্বিধান্বিত এক ভার্সিটি তরুণীকে আমাদের সাথে পরিচিত করে দেয়। বর্ণাণাশৈলীতে আমরা বুঝে নিই মেয়েটি বামপন্থী সমর্থক, যে ভরদুপুরে রাজধানীর এক অফিসে এসেছে দলিয় পত্রিকা বিক্রি করতে। আসার আগের কাহিনী আমরা জানতে পারি, তার ভাবনার কথাও আমরা শুনি। যে লোকটির কাছে সে আসে, সে তেমন কোন কারণ ছাড়াই তাকে অনেকক্ষণ ধরে বসিয়ে রাখে। শুরুতে লোকটিকে তার কামুক পুরুষ বলে সন্দেহ হয়, নিজেকে বেশী করে নারী মনে হতে থাকে, কিন্তু একটু একটু করে সে নিজের রাজনৈতিক সত্তার প্রতি আস্থা ফিরে পেতে থাকে, লোকটিকেও স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। আমরা এও জানতে পারি, অনেকে যেমন ছবি আঁকে, গান গায়,বিতকৃ করে, তেমনি সে রাজনীতি করে। অর্থাৎ রাজনীতির বোধটা তার মধ্যে দৃঢ় নয়, রাজনীতিটা তার একটা কর্মকান্ডের মতই। কোন বড় ভাবনাচিন্তা তার মধ্যে নেই। এর মধ্যেই আমরা জানি 'অন্য'র কথা, যার প্রতি গল্পকথকের একধরনের অনুরাগ আছে, কিন্তু তা ভালবাসা পর্যায়ের কিনা তা নিয়ে স্বয়ং গল্পকথকই বিভ্রান্ত। অন্যকে একজন আদর্শ কর্মী বলে মনে হয় তার, যদিও অন্য আসলেই তেমনটি কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরির অবকাশ লেখকই আমাদের জন্য রেখে দিয়েছেন। কারণ যে শাহেদ আহমেদের কাছে কথক পত্রিকা বিক্রি করতে এসেছে তার বোনও ফ্রন্ট করত, নয়ন নামের সহকর্মীকে ভালবাসত, যাকে তার চরম আদশৃবাদি বলে মনে হত। কিন্তু পরে শাহেদ আহমেদ জানতে পারেন আদর্শটা নয়নের ভেক মাত্র। যেহেতু গর্পে অন্য প‌্যাসিভ হিসেবে এসেছে তাই অন্যের প্রতি কথকের মনোভাবকে নারীসুলভ মুগ্ধতার বহি:প্রকাশ ধরে নেয়া যায়। শাহেদ আহমেদের সঙ্গে কথকের কথোপকোথনের উত্থান-গতি পুরোসমযেই আমাদের তাই লেখকের উপর নির্ভর করতে হয়েছে, মনে হয়েছে লেখক আসলে একটা গল্পই বলতে চাচ্ছেন, যেকারণে গল্পের ভেতরকার রাজনৈতিক বিশ্বাসজনিত স্খলন আর আদর্শের প্রকাশটা ফিকে হয়ে যায় প্রায়শই। গল্পের আরেকটি প্রধান সমস্যা ভাষাভঙ্গি। কখনো পুরো প্রমিত বা পুরো কথ্য ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে লেখক হয়ত চিন্তার অস্থিতিশীলতার ব্যাপারটাতে ফোকাস করতে চেয়েছেন, কিন্তু এর প্রয়োগটা যথার্থ হয়ে উঠতে পারেনি বর্ণনার প‌্যাটার্নহীনতার কারণে।

অসাধারণ গল্প হচ্ছে যে গল্প একই সঙ্গে মুগ্ধতা ও ভাবনা সৃষ্টি করে, কয়েকবার পড়লেও যাতে ক্লান্তি না এসে উপরন্তু মুগ্ধতা আর ভাবনার পাল্লাই ভারী করে।
'মহব্বতের খুরধ্বনি' গল্পটি যতবারই পড়া হয় পড়ার ইচ্ছা বাড়ে বৈ বাড়তেই থাকে। এটি একটি সুররিয়ালিস্টিক গল্প।
মহব্বত নামের এক ষাড় এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' নামে যে গল্পটা আমাদের প্রায় সকলেরই পড়া, তার সঙ্গে এর একমাত্র মিল গরুর মূখ্যচরিত্র হওয়া। সেই গল্পে প্লেইন বর্ণনায় গরুর চেয়ে ম ানুষই উঠে এসেছে আলোচনায়, কিন্তু এখানে গরুই গল্পজুড়ে। কুরবানী অথবা অন্য কত-শত উদ্দেশ্যে যত গরুর জীবন বিসর্জিত হয় সেই আলোকেই গল্পটি। লেখক গরুর দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের ভাবিয়েছেন, পড়ার সময় মানুষ নয়, নিজেকে নিয়ে যেতে হয়েছে গরুদের অদৃশ্য সমাজে। এখানেই গল্পের শ্রেষ্ঠত্ব। গরুর সূত্রধরে এসেছে সীমান্তের রাজনীতি, গ্রাম্য রাজনীতি এমনকি মানবিক মূল্যবোধজনি সংঘাতের বিষয়টিও । ছোট্ট একটা পরিসরে সিম্বলিক দৃষ্টান্তকে কখনো স্পষ্ট, কখনো উহ্য রেখে মহব্বতের খুরধ্বনি দিয়ে লেখক যে গল্পটি আমাদের শোনাতে চেয়েছেন বা আমাদেরকে বিবশ করেছেন, তা যেমন আমাদেরকে ভাবায়, আবার অসংখ্য জিজ্ঞাসারও মুখোমুখি করে।

সাদামাটা গল্পে বিশেষ কোন বাঁক বা ঝোঁক থাকেনা, বিষয়বস্তুতে কোন আহামরিত্ব থাকেনা, কিন্তু বর্ণনা আর ভাষার সৌকর্যে পড়তে ভাল লাগে।
হলুদ রঙের স্কুল তেমন একটা গল্প। বলা যায় করতলে জমানো গল্প আর হলুদ রঙের স্কুল মূলত ২ খন্ডে লেখা একটা গল্প। হলুদ রঙের স্কুল গল্পের চরিত্রগুলো স্কুল পড়ুয়া কিশোর, আর করতলে জমানো গল্পে এসে সেই চরিত্রগুলোই কলেজে ভর্তি হয়। এটি আরও স্পষ্ট হয় হলুদ স্কুলের শেষ লাইনটাতে : 'আমরা আমাদের শহরের কারাগার দেখেছিলাম- হলুদ রঙের কারাগার। অপরপক্ষে করতলে জমানো গল্পের একটা জায়গায় আমরা দেখতে পাই হলুদ রঙের কারাগার।
যাহোক, গল্পে স্কুল পড়ুয়া কিশোরদের কৌতূহল দেখি, হলুদ রঙের প্রতি নানাবিধ কৌতূহল দেখি, কখনোবা জন্ডিজ রোগ আর স্কুলের মধ্যেও মিলের উপলক্ষ হয়ে উঠে হলুদ রঙ। জন্ডিসের কবিরাজের উদ্ভট পোশাক, কিংবা কবিরাজির সময কবিরাজের মুখে শোনা হাছুলু দেবতা তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। সেই কবিরাজকে খুঁজে বের করবার তাড়নাও তৈরি হয়ে যায় । কিন্তু হলদে রঙের স্কুলের কড়াকড়িতে সেই তাড়না পূর্ণতা পায়না। গল্পের একটা অংশে এসে আমরা তার নমুনা পাই:
'বইয়ের কালো অক্ষর-শব্দ-বর্ণ-বাক্য আসলে জোড়া দেয়া শেকল। চারকোনা বইয়ের সীমানা ছাড়িয়ে সেই শেকল আমাদের হাতে পায়ে পেচিয়ে ধরে। আমরা আসলে কবন্ধ। কারণ ঘাড়ের ওপরে যা আছে সেখানে কেবলই কালি-কলমের খসখসানি। আমরা বই ঘষা চোখে আমাদের বন্ধুদের দিকে তাকাই। আঁতকে উঠি। সবার ঘাড়ের উপর কাগজের ঠোঙা। ফাঁপা'
আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই আমাদের আমিত্বকে স্বীকার করেনি, কোনদিন করবে তেমন সম্ভাবনাও সুদূর পরাহত। এই সত্যিটাকেই এমন ক্যারিশমাটিক কৌশলে গল্পের ক্যানভাসে নিয়ে আসা একটা কৃতিত্বই বলবো।

অভিনব গল্প নিয়ে আসলে তেমন কিছু বলবার নেই। এধরনের গল্প কালেভদ্রে সৃষ্টি হয় এবং স্থায়িত্বের দাবি নিয়েই তা অধিকার করে নেয়।
'সাকিনি' তেমনই এক অভিনব গল্প। আমরা মনসামঙ্গল পড়েছি, বেহুলা-লক্ষিন্দর পড়েছি, কিন্তু সাপের মনস্তত্ত্ব নিয়ে, সাপকে মানবিক করে তুলবার তীব্র বাসনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কোন ছোটগল্প সম্ভবত নেই। এখানেই সাকিনির অনন্যতা। শুধুমাত্র এই একটি গল্পই লেখকের প্রতিভা প্রমাণে যথেষ্ট।


গল্পগুলোতে লেখক সচেতনভাবে নিজেকে ভাঙতে চেয়েছেন, কখনো বর্ণনাভঙ্গিতে, কখনো ভাষায়, কখনো ট্রানজিশন স্টাইলে। সর্বক্ষেত্রে হয়ত সমতা রক্ষা হয়নি, তবে প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র আসক্তিকে অভিবাদন না জানানোটাও একধরনের কূপমন্ডুকতার শামিল। তাই লেখককে জানাই নিঃসঙ্কোচ অভিবাদন।
..................................................................................................
সালাহউদ্দিন শুভ্র একজন ব্লগার। এখন ব্লগে অনিয়মিত হলেও পুরনো ব্লগারদের কাছে তিনি একটি পরিচিত নাম।।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:২৭
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×