somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষজন্মের বেড়ি

০৬ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রকাশ: কালের খেয়া, দৈনিক সমকাল, ২০০৮।

এক সাধারণ ও আটপৌরে সন্ধ্যায় অভিজাত হোটেলের তরল ও মাতাল করা নির্জনতায় মদিরাগ্রস্ত জয়নাবেদীন আচমকা আপন সন্তানের মুখোমুখি হয়ে যায়। এমন নয় যে প্রায় সাধামাটা অথচ মনোরম একটি সন্ধ্যা তার জন্য নতুন ও অভিনব। এমন সময় সে বেছে নিত সচরাচর যখন বালকদের দুর্দান্ত বিকেলটা কান্তির সাথে সন্ধি করে মিলিয়ে যায়। যে সময়টা তার কর্মব্যস্ত দিনের বিষন্নতাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় অলৌকিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখতে পারে। অথচ সেদিন অসংখ্য মাইকের হর্ন একসাথে সন্ধ্যা নামার ঘোষনা দিলেও তার অস্থিরতা কমানো যায়নি। আযানের মানবিক আর্তিতে তার দেহ আরো বেশী তরতর করে কেঁপে উঠেছিল। মাত্রই মিনিট কয়েকের ফাঁস কতরকম চাতুরিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল, কত ইনিয়ে বিনিয়ে ধরনীকে দ্বিধা করতে চেয়েছিল!
নিয়তির এমন নিশংস খেলায় মেতে ওঠার প্রস্তুতি তার ছিল না। এই অমতা তাকে নিছক সেইসব মরা কুকুরে পরিণত করে, দুর্যোগ কবলিত রাস্তায় যেগুলো দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল। সেই পাহিহাঁসটাও তার মনে উঁকি মারে, বেওয়ারিশ হয়ে বিলের কোমর সমান জলে যেটি ভেসে গিয়েছিল।
মাত্র সতের মিনিটের সিদ্ধান্তে জয়নালাবেদীন সুদূর মফস্বলের অফিসে ছুটে গিয়েছিল। তিনদিনের এই মিশনটি দুর্যোগ চক্রের পর্যায়গুলোর মতো তাকে সেখানে জড়িয়ে ফেলেছিল। চব্বিশটি জেলার ছত্রিশটি উন্নয়ন এলাকায় এভাবে সে ছুটে যেতো, আর মানব সম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে জড়িয়ে পড়ত। বস্তুত সে ভেবেছিল দুর্যোগচক্রের উপাদানগুলাকে গ্রাসরুট লেভেলে সঠিকভাবে তুলে আনা সম্ভব হয়নি। প্রিভেনশন ও মিটিগেশন কার্যক্রমের ফাঁকফোকরের ফলে দুর্যোগের প্রতিকূল ফলাফলকে কমানো যায় নি। সে দিনের পর দিন ছুটেছে, প্রকৃত জরুরী অব¯হার সময় কার্যকর রেসপন্সের জন্য গৃহিত পদপেসমূহ বাতলে দিয়েছে। অথচ ফেরার পথে দুর্যোগ কবলিত রাস্তায় কিংবা রাস্তার পাশে উল্টে যাওয়া গাড়িতে মৃত যুবতির বেআব্র“ স্তন দেখে বেদনা ক্ষোভে নিষ্পেষিত হতো। অন্যসব মৃতমুখ কিংবা তাদের ফুলে ওঠা দেহ দেখে সে একটুও চমকায়নি। সে কেবল মৃত যুবতির বেআব্র“ স্তনের শোকে পীড়িত হয়ে ওঠেছে। তখন নিজের অস্থিরতা কমাতে, যা তাকে মাঝেমধ্যে করতে হতো, অভিজাত হোটেলের নিভৃত কে ওম খুঁজতে ছুটে গিয়েছিল।
যৌবনে মাদার তেরেসার প্রেমে পড়া যুবকটি শেষমেষ দেখার চোখকে ছাপোষা মানুষের থেকে ফারাক করতে পেরেছিল। যৌবনের পাঠটা সেই যে নানা রকম দায় দিয়ে শুরু এরপর সারাজীবন তাকে তাড়িয়ে নিয়েছে। তার দায় দীর্ঘ দেড়-দুই যুগের পলি জমে ফুলে ওঠে। তথাপি চল্লিশোর্ধ যুবক জয়নালাবেদীন দুর্যোগ কবলিত মানুষের সং¯হায় গুরু পদে আসিন হতে ব্যর্থ হয় না। তার মানবিক চিন্তার পথ আরও সুগম হয়। সুদূর মফস্বলে সে ছুটে যায় তাৎণিকের সিদ্ধান্তে, ফুড সিকিউরিটি এনহান্সমেন্ট ইনিসিয়েটিভ কার্যক্রমের আওতাধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ক হিসেবে। অথচ হোটেলকরে অস্থির সন্ধ্যায় তার মস্তিষ্কের কোষগুলো নিজেদের কাজের সমন্বয় করতে না পেরে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাকে প্লাবিত করে।
হাতের নাগালে যে কয়টা লাশকে আনা যাচ্ছিল সেসব মৃত ও ফুলে ওঠা দেহ কুড়াতে কুড়াতে সতীর্থ কারও কণ্ঠে শুনতে পেয়েছিল মাদার তেরেসার বাংলাদেশ সফরের কথা। তখন সে ছাব্বিশ কি সাতশ বছরের প্রাণশক্তিতে ভরপুর যুবক যে নিজ পেশা ও দায়ে শতভাগ নিবেদিত। খারাপ আবহাওয়ায় মাদার ও প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টারটি ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করতে বাধ্য হয়। সে সংবাদে তার নিদারুন বিচলিত হয়ে পড়া দেখে যখন সহকর্মীরা বিরক্ত হতে শুরু করে সেসময়, অর্থাৎ একানব্বইয়ের সে দুর্যোগে হয়ত সে চাকরি থেকেই পালাত। পরবর্তীতে বিষয়টা ভেবে খানিকটা অনুতাপও করে নিজে নিজে। সে অনুতপ্ত হয়েছিল মাত্র সাত বছরের বালিকার কথা ভেবে, যে মায়ের কাছ থেকে শিখেছিল ঈশ্বর ও প্রতিবেশিকে ভালবাসতে। মাত্র আটারতে যার সংকল্প হয়েছিল জীবনের ব্রত যাবে দরিদ্রদের অভিমুখে। বালিকার পাঠ তার যৌবনকে মাতাল করেছিল। মাদারের নাগাল সে হাতের মুঠোয় এনেছিল আর সেভাবেই পাল্টাতে চেয়েছিল নিজেকে। যদিও সে আদৌ পাল্টায়নি, তীব্র তাড়নাকে এগুতে দেয়নি। তবু সে ছুটেছিল দুর্যোগপ্রবন সময়গুলাতে। করণীয় বিষয়ে প্রশিণ ও মহড়ায় সভ্য করতো নিরর মানুষকে। সে তাদের জানাত জীবন হারানোর শংকার কথা। সতর্ক সংকেতের তাৎপর্য বুঝাত। বাড়িতে অন্তত একটা কাঠের মাস্তুল পোঁতার পরামর্শ দিত, আর প্রয়োজনে ঝড় ও জলোচ্ছাসে পরস্পরকে কিভাবে মাস্তুলে আটকাবে তার কায়দা বাতলে দিত। সে সময় সবার অট্টহাসির শব্দ কানে বাজত, তারপরও সে সফল হতো বাড়িতে ও রাস্তায় নারিকেল গাছ, কলাগাছ, বাঁশ কিংবা শক্ত গাছপালা লাগাতে, যা ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেগ কমিয়ে দেয়। পাড়ার পুরুষদের চক্ষুশূল হতো মেয়েদের শাড়ি পরার অসুবিধার কধা বলে। পলিথিনের বস্তায় ভরে ঘরের চাল-ধান মাটিতে পুঁতে রাখার পরামর্শ দিয়ে তাদের সেই ক্ষোভ শীতল করতো। মহড়া করে শেখাত কিভাবে ডাল, চাল, শুকনা কাঠ, ফিটকিরি, চিনি, গুঁড়াদুধ, ব্যাণ্ডেজ, তুলা, ওর স্যালাইন ও কলসি ভরা বিশুদ্ধ পানি গর্তে রেখে ঢাকনি দিয়ে পুঁতে রাখতে হয়। কলসীতে পানি ভরে মুখ পলিথিনে বন্ধ করে মাটির তলায় রাখার কথা বললে হয়ত তারা পাগল বলত। তবুও সে বলত। কাঁথা-বালিশ, কাপড় কিংবা দলিলপত্র প্লাস্টিকে মুড়ে নির্ভয়ে মাটিতে পুঁতে রাখার কায়দা বলত। সে তাদের শেখাত কিভাবে নলকূপের মাথা খুলে পৃথকভাবে সংরণ করতে হবে কিংবা নলকূপের মুখটা পলিথিনে আটকাতে হবে যাতে ময়লা আর বন্যার নোংরা পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। আট-দশটি শুকনা নারিকেল একত্রে আটাকিয়ে পানিতে ভাসিয়ে বিস্মিত মুখগুলাকে দেখাত কিভাবে ছোট দুটি শিশুকে নারিকেলগুলা ভাসিয়ে রাখে। তাদের সতর্ক করতো বড়জোড় দুই বা তিনঘন্টা নারিকেলগুলা ভাসিয়ে রাখতে পারবে, কেননা নারিকেলে পানি ঢুকলে তা আর ভেসে থাকতে পারে না। দুর্যোগপ্রবন মৌসুমে লম্বা সময়ের জন্য দূরে কোথাও যেতে বারন করত। সে তাদের বুঝিয়ে দিত যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারকৃত সংকেত সমূহ। হুঁশিয়ারি সংকেতে করনীয় কী, কিংবা বিপদ সংকেতে শিশু, বৃদ্ধ, অথবা গর্ভবতীদের প্রয়োজনকে কিভাবে আগ বাড়িয়ে গুরুত্ব দেবে তার পাঠ দিত। সে তাদেরকে এমন কোন সত্যের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলত যেখানে এমন অব¯হারও সৃষ্টি হয় যখন বাবা-মা’র সামনে সন্তান কিংবা সন্তানের সামনে বাবা-মা ভেসে যায়, অথচ সত্যকে মেনে নেয়া ছাড়া কোন বিকল্প থাকে না।
তখন সে তাদেরকে মাদার তেরেসার ত্যাগ ও মহিমার কথা বলতো, যিনি এই বাংলা মুল্লুকে সুদূর ইউরোপের আলবেনিয়া রাজ্য থেকে ছুটে এসেছিলেন মায়ের আঁচল ছিঁড়ে। কিভাবে ক্ষীণকায় এক যুবতি আর্তের সেবায় জাহাজে চেপেছিল সেসব কাহিনী শুনিয়ে দরিদ্র মানুষগুলার মধ্যে সাহস যোগাত। হয়ত তখন অনেক কিছু এড়িয়ে যেত যা সে মাদারের কাছে জেনেছিল। সে হয়ত এড়িয়ে যেত তার সৌভাগ্যের সেসব ছেঁড়া অংশের কথা যা মাদারের নিজ জবানি থেকে আত্ম¯হ করার সৌভাগ্য তার হয়েছিল। মাদার তাকে শুনিয়েছিলেন তার পৈতৃক নাম পাল্টানোর গল্প, সেই ফরাসী সন্ন্যাসিনী তেরেসা মাঁত্যর কথা, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে যার অকাল মৃত্যু হয়। নতুন নাম গ্রহণের বিভ্রাট কিংবা লরেটা স¤প্রদায়ের কাছে বাঙালি তেরেসায় পরিণত হবার কথা সে জেনেছিল। মাদার তাকে শুনিয়েছিল ঈশ্বরের সেই আহবানের কথা, যে আহবানে সবকিছু ছেড়েছুড়ে সত্য ও সেবার ব্রত নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। সেই অর্থে মাদারের কথা বিশ্বাস করতে পারত না, হয়ত সে আদৌ ঈশ্বরের উপর এতটা নির্ভরশীলতায় সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ত, তবু সে মাদারের মুখে ঈশ্বরকে নতুন করে আবিষ্কার করত। আর শুনত লরেটায় তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা, দেশভাগের ভয়াবহ দুর্ভি ও দাঙ্গার কথা, কিভাবে তিনি দরিদ্র ও অনাথদের জন্য পীড়িত হয়ে উঠেছিলেন। নিজেকে শুধরে নিয়ে গড়ে তুললেন মিশনারিজ অব চ্যারিটি। তিনি শুনিয়েছিলেন সেই তরুনের কথা যে তার জীবনের প্রথম মাইনের টাকা মাদারের হাতে তুলে দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপো করেও কান্ত হয় নি, যে ছিল সত্যিকার অর্থেই গরিব, মাদার যাকে দু’হাতে আশির্বাদ করেছিল। সামান্য ক’টা অর্থের মূল্য তিনি অনুভব করেছিলেন গভীর ও পরিপূর্ণভাবে। তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর সে মুহূর্তের অনুভূতির কথা যখন তাঁর কাছে সামান্য অর্থ পৃথিবীর সর্বাপো দামী মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছিল। অনেক কথাই মাদার তাকে শুনিয়েছিল, কিংবা এমনও হতে পারে এর সবটা মাদার তাকে বলেনি। তাকে আদৌ কিছু বলে নি, কোন না কোনভাবে সে এসব কথা জেনেছিল। প্রতিরাতের স্বপ্নচারি বালকটি তাকে এসব সত্যমিথ্যা শুনিয়েছিল আর সে স্বপ্নতাড়িত হয়ে তার সব কথা শুনত। এমনো হতে পারে এসবের কিছুই হত না, আপনা-আপনি সে মানবিক বিষয়সমুহে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল।
জন্মের পর জয়নালের বেড়ে ওঠায় ছিল নানা চড়াই উতরাই। জন্মের প্রথম দু’বছরে পিতৃপরিচয়ের দায় অতটা মাথাচাড়া না দিলেও বাস্তবিকই এর সূরাহা তার জন্মদাত্রীর ছিল না। কুমারী মায়ের গর্ভে তার জন্ম হয়। মাত্র চৌদ্ধ বছর বয়সে মায়ের অপরিসর গর্ভে তার আগমন ঘটে। তার এই আবির্ভাব পরিবারটির জন্য কেবল অভিশাপই বয়ে আনেনি, মায়ের অবিবাহিত বাকি দুই বোন যারা বিয়ের বাজারে রীতিমতো বাসি হয়ে উঠছিল তাদের জন্যও নিয়ে আসে বিপর্যয়। তার নানা ছিল গ্রামের কাজী। সততার জন্য খানিকটা সুখ্যাতিও তাঁর ছিল। সারা গাঁ চষে বেড়ানোর সময় কখনও মাথায় ছাতা তুলতে কেউ দেখে নি। এক ধরনের সহজাত ব্যস্ততা তাকে তাড়া করে ফিরত, আর ছুটিয়ে নিত গাঁয়ের এবড়োথেবড়ো পথে। কাঁঠালপাকা রোদে মাঝেমধ্যে হয়ত হাতের ঝোলাটা মাথায় উঠত কিংবা চুলবিহীন মাথাটা হাতের তালু দিয়ে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাত! বর্ষায় যদি পূর্বের আকাশে মেঘের উজান আসত তাতেও পথের ব্যস্ততায় তার কান্তি আসত না। বুড়ো কি আধবয়সীরা স্বভাবগুণে বিষয়টা বুঝে নিত, কিন্তু লুঙির কোনা ধরে হাঁটা তরুনরা খানিকটা বাঁকা মন্তব্য করতে চাইলেও দোষের কিছু থাকে না। তিন-তিনটা বিবাহযোগ্য যুবতি কন্যার ভারে এতটা কুঁেজা হয়ে চলতে হতো, তরুনদের এই নাকউঁচা ােভ ধর্তব্যে না এনেও তার দিব্যি চলে যেত। তারপরও দোষের রাহু থেকে তার পরিত্রাণ হয় নি।
তার নানার পরিবারকে সামাজিকভাবে একঘরে করা হয়, আর অপকর্মের জন্য দায়ী মাস্টারকে স্কুলমাঠে ধরে এনে সালিশে বিষয়টার একপ্রকার রফাও হয়। কিন্তু শেষমুহূর্তে হঠাৎ করেই গোল বাঁধে এবং কি একটা অজুহাতে উপ¯িহত জনতা এতটাই েেপ যায় যে পুরো মাঠ রনেেত্র পরিণত হয়। মাস্টারপরে কোন এক সালিসকারকের উস্কানিমূলক মন্তব্যে এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জনাকয়েককে হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ হলেও স্বুলমাস্টার যুবকটির জন্য সে সুযোগ আসেনি। ঘটনার রেশ ধরে বিশাল এক হাঙ্গামা গাঁয়ের মানুষ জিইয়ে রাখে বছরের পর বছর। সেই ফাঁকে কাজীর পরিবারের দুর্ভাগ্যের গিঁটও খানিকটা আলগা হয়। কেননা গাঁয়ের একপ মৌলিক বিষয়টার কথা সাময়িকভাবে বিস্মৃত হয়ে ইজ্জত পুনরুদ্ধারের দায় ঘাড়ে নিলে তাদের এই আপাত আশ্রয়ের সুযোগ তৈরী হয়। সেই সম্ভাবনার খুঁটি কিছুটা পোক্ত হয় যখন ঘটনার রেশ খুব সহজে মিলিয়ে না যেয়ে দুই গাঁয়ের মানুষের কাছে দীর্ঘদিন ঠিকে থাকে। ইত্যবসরে কুমারী মায়ের কোল বেয়ে সে মাটিতে নামতে শেখে আর এভাবে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে উঠানের নামতে শিখলে পুনরায় বিষয়টা কারও কারও নজরে আসে। তারপর একদিন এক বেদনার্ত সন্ধ্যায় নানার পরিবারের পুরনো চাকর আয়নালের সাথে তার মায়ের বিয়ে পড়ানো হয়। আয়নালুদ্দিন সব শর্তই মেনে নেয় কেবল কোলের সন্তানকে নববধুর সাথে গ্রহণ করা ছাড়া! শেষপর্যন্ত তার পে সিদ্ধান্তে ¯িহর থাকা সম্ভব হয়নি। আশ্চর্যের বিষয়, যখন সে নববধুর কোল থেকে বাসরঘরের নির্জন আঁধারে জারজ শিশুটিকে কোলে নেয় তখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিস্ময়ের সাথে ল্য করে, প্রায় দুই বছর বয়সের মাথায়ও এই অনাথ শিশুর কোন নাম রাখা হয় নি! তারপর স্ব-উদ্যোগে, স্বেচ্ছায় ও পরম মমতায় আয়নালুদ্দিন স্ত্রীকে সাী রেখে সন্তানটিকে নিজের বলে গ্রহন করে নেয় এবং নিজের নামের সাথে মিল রেখে সন্তানের নাম রাখে জয়নালাবেদীন।
তাদের দাম্পত্য জীবন সুখকর হয়। কিন্তু বুদ্ধি ও বিবেক হবার পর যখন জয়নাল ঘরছাড়া হয়, পালক পিতা ও কুমারী মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা সত্বেও তার অভিশপ্ত জীবনের ভার সে তাদের সাথে ভাগ করেনি। তারপর কাকতালীয়ভাবে পড়াশোনার পাঠ চুকানোর পুর্বেই আরেকটি সংসারের দায় ঘাড়ে নিলেও সুখ তাকে আগলে ধরেনি। দাম্পত্য জীবনের মাত্র ছয়মাসের মাথায় সে বেশ হৃষ্টপুস্ট সন্তানের পিতা হয়।
পড়াশোনার পাঠ চুকোলে এদেশে কর্মরত বিদেশী এনজিও-তে তার নিয়োগ আসে, আর খুব দ্রুততায় নিজের অব¯হানকে ছাড়িয়ে যায়। তবুও দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়েনি। মাত্র ষোল বছর বয়সে তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম ও একমাত্র ফসল মেয়েটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও মেয়েটিকে ফেরানো যায় নি। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে একদিন সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাবার বছর তিনেক পর তার খোঁজ পায়। নিজের অ¯িহর ও অভিশপ্ত জীবনকে রাজধানীর এক অভিজাত হোটেলে ণিকের জন্য ভাগাভাগি করতে গেলে হোটেলের নিভৃত কে জয়নালাবেদীন আপন সন্তানের মুখোমুখি হয়ে যায়!
এমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে তাবৎ দুর্যোগ তার মাথায় ঝড় তোলে। হোটেল থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়তে পড়তে যা সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেছিল তা হয়ত বায়ান্ন, চুয়ান্ন, চৌষট্টি, চুরাশি কিংবা অন্য কোন দুর্যোগ কবলিত সাল যার কোনো অর্থ তখন তার কাছে ছিলনা। নানা রকম উত্তেজনা নিজের ভেতর শোরগোল তোলে। বেওয়ারিশ পাঁতিহাস কিংবা মরা কুকুর ভেবে সে তার পাঘাতগ্রস্ত ভাবনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করে। আক্রান্ত বিশাল কমিউনিটির মতো নিজেকে রা করার চেষ্টা করে। হয়ত তা তার কেতাবি কার্যক্রমের সে পর্যায় যাকে তারা ‘রিকভারি পেজ’ বলে। পতিত পুওর কমিউনিটির স্বার্থে গৃহিত প্রতিরোধমূলক ব্যব¯হা। কিন্তু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে নিজেকে রা করার প্রাণপন চেষ্টায় পথের মরা কুকুরকে টপকে কোনো মতেই সে বেরিয়ে আসতে পারে না। দুর্যোগ কবলিত রাস্তায় উল্টে যাওয়া গাড়িতে একদা মৃত যুবতির বেআব্র“ স্তন দেখে পীড়িত হয়ে ওঠা যুবকটি শেষমেশ জন্মের বেড়ি টপকাতে না পেরে কেবল ছুটতে থাকে, ছুটতে থাকে...। ঠিক তখনই যেন মৃত যুবতিটি উল্টে যাওয়া গাড়ি থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে।


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×