আমরা বন্ধুরা মিলে একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম দার্জিলিং। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি বীরবিক্রমে চলা আমাদের শপিং স্প্রী’এর একপর্যায়ে সেখানকার কোলকাতানিবাসী এক ‘বাঙ্গালী’ দোকানদারের দোকান থেকে কেনাকাটা করছিলাম। ভীণদেশে বাংলায় দামাদামি করে আমরা বেশ রোমাঞ্চিত। এক দোকানে লেদার জ্যাকেটের দাম শুনে বিমর্ষ হয়ে বাইরে বেরুতে বেরুতে শুনি, জনৈক দাদাবাবু আরেক দাদাবাবুকে বলছে, “দেকেচেন, আজকালকার এই বাংলাদেসেড় ছেলেগুলো কিরকম লম্বা চওড়া, স্মার্ট হয়। কিন্তু এড়া সালা’র মুক কুললেই না, স্রদ্দা ভক্তি ছব উবে যায়!!”
“কয় কি হালায়?” মনটা চাইসিল ফেরত গিয়া বইলা আসি, “ওরে হাউয়ার নাতি, তোদের বাংলা উচ্চারন শুনলেই আমাগো প্যাটের ভিত্রে মোচড় দেয় !! গা শিরশির কইরা উঠে!! গালের মিধ্যে বাতাস ভইরা মুখ গোল কইরা আমরা বাংলা কথা কইনা!”
যাইহোক, সুশীল বাংলা, প্রমিত বাংলা, আদি বাংলা কিম্বা বাংলা ভাষার পৈত্রিক বাড়ি ইত্যাদি বিতর্কে আমি নাই। কোলকাতার বাংলা উচ্চারন, অভিনেতা’দের অতি অভিনয় আর হাইলি রিকমেন্ডেড কোন এক উচু মার্গীয় সিনেমা দেখতে গিয়ে আমার হাপানি’র টান উঠে যাওয়া – ইত্যাদি নানাবিধ কারনে দুনিয়ার অন্য সব দেশের মুভি দেখলেও কোলকাতার সিনেমা দেখার গন্ডি আমার উত্তম কুমার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু গত সপ্তায় নামকরনে আকৃষ্ট হয়ে, বহুল প্রচারনায় কিম্বা রিভিউ’য়ের ব্যাপক প্রশংসায় জর্জরিত হয়ে অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যত’ দেখে ফেললাম। এবং এক কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
পরিমিত অভিনয়, সূক্ষ্ম ডিটেলস, ডায়লগে প্রচুর হিউমারের ব্যবহার, ক্যামেরার অসাধারন কাজ-বিশেষ করে আলো ছায়ার খেলা, গল্প বলার স্টাইল আর চমতকার পরিচালনা- সব কিছু মিলিয়ে খুবি উপভোগ্য একটি সিনেমা। যদিও কিছু বোকা ডায়লগের কারণে পরিচালক যেই টুইস্ট দিতে চেয়েছিলেন, তা আর টুইস্ট থাকেনি।
ভূতের ভবিষ্যত
পরিচালনা - অনীক দত্ত
বর্তমান
২৫০ বছরের পুরনো আলিশান বাড়ী। বনেদী ভাব খোদাই করা যেন প্রতিটি ইটে, স্তম্ভে আর পাথর বসানো মেঝেতে। ওয়ারিশরা কেউ থাকেনা তেমন। সিনেমার শ্যুটিংয়ে ভাড়া দেয়া হয়। তেমনি এক সিনেমা’র শ্যুটিং চলছে। হিন্দী সিরিয়ালের মত উতকট সাজগোজ করা নায়িকা আয়নায় হঠাত নিজের রূপ দেখে ভীমরি খেলেন। দোষ চাপল ভূতের উপর। তিনি নাকি ভূত দেখেছেন! আর যায় কোথায়? হৈচৈ। শ্যুটিং প্যাকআপ।
ভূতুড়ে বাড়ী হিসেবে নাম কিনে নিল এই চৌধুরী বাড়ী।
বেশ অনেকদিন পর উঠতি পরিচালক অয়ন সেন গুপ্ত; কালো কালো ডাগর চোখের মিষ্টি চেহারার বিড়িখোর এসিস্ট্যান্ট রিনকা আর বাচাল প্রোডাকশন ম্যানেজার’কে নিয়ে লোকেশান হিসেবে চৌধুরী বাড়িটা দেখতে এসে পছন্দ করে ফেললো। বাকিরা কাজের তাড়ায় ফিরে গেলেও অয়ন রয়ে গেল ক্যামেরাম্যানের অপেক্ষায়। পুরনো সব ছবি, তৈলচিত্র, বহু বছরের ধুলোপড়া পত্রিকা, শতবছরের স্মৃতি বিজরিত আসবাবপত্র আর ঘরের প্রতিটি কোণায় যেন অভিজাত রহস্যের আনাগোনা – কখন যে অয়ন ঘুমিয়ে পড়লো জানেই না।
দরজা খোলার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো অয়নের। এক দীর্ঘাঙ্গী পুরুষ দাঁড়িয়ে। যেমন তার ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন ঋজু ভঙ্গী, তেমনি ভরাট গমগমে স্বর। ঠিক যেন সব্যসাচী। তিনি নাকি এখানেই থাকেন। ফিল্ম নিয়ে এই কথায় সেই কথায় জমে উঠলো আড্ডা। অয়ন স্টোরী সঙ্কটে ভুগছে জেনে চট করে কি ভেবে নিয়ে বললেন, “আমার কাযে জব্বর একটা গল্প আচে, শুনবেন?”
ভূত
ব্রিটীশ রাজত্ব। জমিদার রায় বাহাদুর দর্পনারায়ণ চৌধুরী। জমিদার বাড়ী-
: “হুজুর, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে...
: বলিস কি? তবে সরকার বাহাদুরের পাওনা মেটাবে কে? আমার পিসে?
শোন, বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভাল কাজ না ।!”
খাজনা আদায় করে জমিদার যখন ফিরছিলেন, পড়লেন কুখ্যাত নসু ডাকাতের কবলে,
“টাকা পয়সা সব চাই, নইলে......জবাই”
পালাতে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়লেন রায়বাহাদুর দর্পনারায়ন চৌধুরী এবং ভূত হয়ে আশ্রয় নিলেন নিজের জমিদার বাড়ীতে।
এদিকে বড়লাট লিটনের পরিবর্তে ব্রিটিশ সাহেব মিঃ রামসে ক্ষুদিরামের বোমা খেয়ে অক্কা পেলেন। বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের লবিং করে তিনিও চৌধুরী বাড়িতে রেফার্ড হয়ে গেলেন।
চল্লিশের দশকের সাদাকালো সিনেমার যুগ। নানা সুকুমার কলায় পারদর্শী নটি কদলীবালা, প্রেমের অভিনয়ের নানা ছলা-কলা জানা স্বত্তেও চৌধুরী বংশের এক কুলাঙ্গারের প্রেমে পড়ে ধরা খেয়ে গেলেন। কুলাঙ্গার চৌঃ সুন্দরী কদলীবালাকে রক্ষিতার পোস্ট থেকে স্ত্রী’র পোস্টে প্রোমোশান না দিয়ে আরেকজনকে এপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দেয়াতে তিনি ক্ষোভে দুঃখে জীবনের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। অবসর জীবনে তিনি স্ত্রী হিসেবে না পারলেও ভূত হিসেবে সেই চৌধুরী বাড়িতে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেন।
কমিউনিজমে উত্তাল ৭০ এর কলকাতা। আরো অনেক তরুণের মত রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে একদিন পুলিশের এনকাউন্টারে নিহত হোল চৌধুরী বাড়ীর দূরসম্পর্কের ভাগনে বিপ্লব দাসগুপ্ত। বুর্জোয়া শ্রেণীশক্তির প্রতিভূ এই জমিদারের বাড়িতে উঠলেও প্রায়ই পূর্বপুরুষ দর্পনারায়নের সাথে ঠোকাঠুকি লাগে বিপ্লবের। একদিন রেগেমেগে বাড়ীই ছেড়ে গেল সে।
এরাই হলেন এই চৌধুরী বাড়ীর আদিভূত। শিল্পায়নের ক্রমবর্ধমান চাপে মানুষের যেমন বাসযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, তেমনি পুরোন বাড়ীসব ভেঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সের নবজোয়ারে ভূতেদেরও ভূতুড়ে বাড়ীর অভাব বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। এই অভূতপূর্ব সমস্যায় বোধশক্তি হারিয়ে আতঙ্কিত আজ ভূত সমাজ। এহেন পরিস্থিতি সামাল দিতে চৌধুরী বাড়িতে যোগ্য এবং সত্যিকারের অভাবী ভূত খুজে বের করতে আয়োজন করা হোল, ‘বোটানিক এরোমা - কে হবে সেরা অভাবী?’
খাজা খান; নবাব সিরাজউদ্দৌলার খাস বাবুর্চী, যিনি রান্নাঘরে নন, পলাশীর ময়দানে শহীদ হয়েছিলেন। নবাবী রান্না এবং কাওয়ালীতে তার বিশেষ দখল।
৪২ এর দাঙ্গায় দেশ ছেড়ে রিফিউজি হয়েছিলেন বাঙ্গাল ভূতনাথ ভাদুড়ী। ট্রেনে কাটা পড়ে অপমিত্যু হওয়ায় ব্রক্ষ্মদত্যি হয়ে গাছের আগায় বসত করেছিলেন। কিন্তু গেটে বাতের কারনে গাছ বেয়ে উঠতে নামতে খুব কষ্ট। পৌরসভা সব গাছ কেটে ফেলায়, আবারো সেই রিফিউজি।
গরীব আদমী বিহারী আত্মারাম। রিকশা চালায়, আর রাতে ফুটপাতে ঘুমায়। কোন এক নিউ ইয়ারের রাতে মাল খেয়ে মাতাল গাড়ীচালক তাল হারিয়ে আত্মারামের আত্মাকে অচিন পাখী বানিয়ে দিল।
ইন দ্য ইয়ার ১৯৯৯...ব্রিগেডিয়ার যুদাজিত সরকার, ধর্মবীর চক্র (মরনোত্তর)কারগিল যুদ্ধে শহীদ। অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ; যিনি সুযোগ পেলেই নিজের কৃতিত্বের বয়ান শুরু করে দেন।
পাবলো পত্রনবীস। বাবা-মা চাইতেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে, আর ছেলে দিন কাটাতে চায় গান নিয়ে। এক্সপেক্টেশন থেকে ফ্রাস্ট্রেশন। সমাজ বদলে দেবার নেশাটা বদলে গেল হেরোইনের নেশায়। একসময় অকাল মৃত্যু।
হাই, আমি কোয়েল। বড়লোক বাপের একমাত্র কণ্যা। প্রেমে পড়ি এক গরীব ছেলের, নাম স্যাম। আমার বাপি তো কিচুতেই মানবেনা এই সম্পর্ক। একদিন শুনি স্যাম’কে গায়েব করে দিয়েচে আমার বাপি। আমিও আমার স্যামের কাছে যেতে ১০তলা থেকে উড়াল দিলাম পাখি হয়ে। ব্যাস, তারপর তো আমি কিউট একটা ভূত !! আমার ভূত হবার শানে নযুল যদি আপনাদের ভাল লেগে থাকে, তবে প্লিজ প্লিজ প্লিজ আমাকে ভোট করুন অমুক নাম্বারে।
ভবিষ্যত
ভিন্ন বর্নের, ভিন্ন ধর্মের, চিন্তা চেতনার, ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ভূত চৌধুরী বাড়ীর ছাদের তলে সহাবস্থান করতে লাগল। কিন্তু দেহ নশ্বর, মনুষ্য স্বভাব অবিনশ্বর। মুরুব্বীদের সেই চিরকালীন বিরক্তি সেই আজকালকার ছেলে ছোকরাদের উপর; যারা দুইপাতা বিজ্ঞান পড়ে ভূত অবিশ্বাস করে, যারা শতবছরের ধ্যান ধারনাকে থোড়াই কেয়ার করে, আর সেই ছেলে ছোকরাদের সেই নিয়ম ভাঙ্গার রোমান্স। নারী; ভূত হয়ে গেলেও বুঝি তার রহস্যময়তা কমে না, আরো ঘনী‘ভূত’ হয়। আর কদলীবালা’র সেই রহস্যে হাবুডুবু খায় আর ঝগড়া করে ভূতনাথ আর খাজা খান। কোয়েলের মন ভূতুড়ে দোলায় রকিং চেয়ারের মত দুলতে থাকে, পাগলাটে পাবলোকে ভেবে। আর গরীব আদমি আত্মারামের ফুটফরমাশ খাটার ভাগ্যের বদল হয়না ভূত হয়েও। কিন্তু তারপরেও তারা সুখী, তারা পিকনিক করে, গান গায়, ফূর্তি করে। কারন, তাদের আছে মাথা গোজার না হলেও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার ঠাই – চৌধুরী বাড়ী- এমন ভূতের বাড়ী কোথাও পাবে নাকো তুমি...
কিন্তু এই চৌধুরী বাড়ীর উপর বদ নজর পড়লো পাষাণ প্রোমোটার – মারোয়ারী ভূতোরিয়া’র। সে এই বিশাল বনেদী বাড়ী ভেঙ্গে বানাতে চায় মাল্টিপ্লেক্স, যার মানে চৌধুরী বাড়ীর ভূতদের শেষ আবাসস্থলটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। আবার সেই ঠিকানা হারিয়ে পথে পথে অভূতোবিক জীবন যাপন।
কিন্তু বেচে থেকে সংগ্রাম করা, যুদ্ধ করা, কষ্ট পাওয়া মানুষগুলো কি ভূত হয়ে বিনা যুদ্ধেই হাল ছেড়ে দেবে?
এবারের সংগ্রাম, অভূতপূর্ব সংগ্রাম, ভূতের ভবিষ্যতকে ভূতপূর্ব না হতে দেয়ার সংগ্রাম।
কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার নিওফাইটের রাজ্যে আর হিল্লোল দা, যাদের জন্য এই রিভিউ লিখতে হোল। জানিনা আপনাদের মান রাখতে পারলাম কিনা।
টরেন্ট ডাউনলোড লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৪৪