বই পর্যালোচনা (রিভিউ) – ০৫
বইয়ের নাম – গৃহদাহ
লেখক – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ভাষা – বাংলা
ঘরনা – সামাজিক উপন্যাস
বইয়ের পৃষ্ঠা – ২৬৬
হাদিয়া (বিনিময় মূল্য) – ১৫৪ টাকা
প্রকাশনী – কল্লোল।
ব্যক্তিগত অনুযোগ (রেটিং) – ৪.৬/৫
গৃহদাহের সর্বশেষ উক্তি পড়ে মনে হচ্চিলো যে, আমার জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখগুলোতে বান এসে গেছে। আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছিলাম তখন!
“....গাড়ির বাঁশী বাজিয়া উঠিল। মৃণাল বৃদ্ধের স্খলিত ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া বলিল, চল বাবা, আমরা যাই।”
আহ!
কি পরিসমাপ্তি!
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে আবেগ, মনোনির্ভরতা, ভাবালুতা ও অন্তরের কমনীয় অনুভূতিকে উপন্যাস শিল্পে বিশেষ করে চিত্রায়্যত করলেও ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের ব্যাপারে উপর্যুক্ত অনুভবরাজি গভীরতমভাবে প্রভাববিস্তারী না।
আর, একারণে এই শিল্পকর্মটি আমাদের বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে স্বকীয়তাবাহী।
সমাজ-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ন্যায়-নীতি যে কিভাবে সম্পূর্ণ রূপে এই সমাজের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তা এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
শরৎচন্দ্র জানতেন কি করে গল্প বলতে হয়, কি করে আবেগকে নিয়ে খেলা করতে হয় এবং এর মাঝে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের বিষ্ময়কর জনপ্রিয়তার মূল সূত্রটি নিহিত।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে মানুষ এবং মানুষের হৃদয় ছিল অনুসন্ধানের ক্ষেত্র, তাঁর রচনায় উচ্ছাসের বাহুল্য আছে। হৃদয়ের রহস্য আত্ম প্রকাশ করেছে কিন্তু নিজেকে মাধুর্য ও সংযমে রিক্ত করেননি।
আর, ঠিক তেমন একটি উপন্যাস হচ্ছে শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ।’
পিতৃগৃহে মানসিক অসম্পূর্ণতায় লালিত, কেদার বাবুর সংসার অসংগঠিত ছিলো। তিনি নিজে ছিলেন অস্থির চিত্তের, টাকা-পয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারে মন ভারমুক্ত হলে বায়োস্কাপও দেখতে যান। পেটি বর্জোয়া প্যাটার্নে তার চিন্তাভাবনা আচার আচরণ বিন্যস্ত।
অচলা ছোট বেলা থেকে তার বাবার দেয়া শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই তার সত্ত্বা, চিত্ত, মন সবকিছু দোলাচলে আন্দোলিত। তাই প্রথম দিকে সুরেশের অসংযত আবেগদীপ্ত ব্যবহার বিরক্ত করেনি এবং তার প্রতি আমন্ত্রণও ছিল না প্রত্যাখ্যানও না।
বিয়ের পর মহিমের সাথে গ্রামে এসে মৃনাল ও মহিমের সম্পর্কে কদর্য সন্দেহ, সর্বোপরি মহিমের নিঃস্নেহ কঠোর কর্তব্য পরায়নতা তার মনেপ্রাণে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মহিম সব সময়ই ছিল নিরুত্তাপ আবেগহীন। অচলা মহিমকে একান্তভাবে পেয়েও তার প্রোমোচ্ছল হৃদয়েখানি মেলে দিতে পারেনি। এর সাথে সুরেশের আগমন এক সর্বব্যাপক অগ্নিশিখা তার লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে!
আর ধীরে ধীরে জীবন এগুতে থাকে গল্পের দিকে, মোহের দিকে, অন্ধত্বের দিকে.....
নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া সমুচিত না হলেও ভাবোলপদ্ধি দিয়ে কিছু বলতে পারি।
উপন্যাসে লেখক শরৎচন্দ্র সমসাময়িক সামাজিক জাতির আত্মিক বৈশিষ্ট্য,পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ব্যক্তিমানসের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম-পরিণয়বিশ্বাস... ইত্যদিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর সেখানে ত্রয় চরিত্র হয় সুরেশ-অচলা-মহিম!
নিজের অজান্তে অচলা সুরেশের প্রবৃত্তিকে ইন্ধন যুগিয়েছে।
হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠের আত্নক্ষয়ী আর্তনাদ অচলাকে দ্বিধান্বিত সত্তায় এনে সময়কে গহ্বরে টেনে নিয়েছিলো। আর এভাবে, ক্রমাগত সুরেশ ও মহিমের গ্রাস করা জীবনের প্রজ্বলন্তশিখায় অচলার জীবন-হৃদয় দ্বিধান্বিত সত্ত্বা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়েছে আমৃত্যু পর্যন্ত!
বাংলা সাহিত্যের পাঠককে পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এই দৃষ্টিনন্দন আর নান্দনিক শিল্প কর্ম পড়ার জন্য, যার প্রতিটি প্রচ্ছদ দুর্দান্ত এক অবিস্মরণীয় আবেগের স্পর্শ পাবেন....
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৯:০৭