অলীক হলেও সত্য, রমণে রমণীয় হয় রমণী এবং রত্নশিল্পীর কলাকৌশলে নীল পাথর হয় নীলকান্তমণি। কিংবদন্তি হলেও রত্নবনিকরা বিশ্বাস করে এবং বাতাসে কানাঘুষো, নীলগিরির গুপ্ত গুহায় সংগুপ্ত নবরত্ন আছে। তাদের কথা শোনে পর্ণিকরা হাসে আর বলে, এসব আজগুবি গুজব গ্যাঁজালে হাভাতে হয়ে মরবে, পর্ণাহারে পরিপুষ্ট হলে মনে থাকে যেন, নালিতা শাক পুষ্টিবর্ধক হলেও পর্ণিকরা রত্নবনিক হতে পারে না। হয়তো তাদের কথা সত্য, কিন্তু কোটারি যেমন কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে পারে তদ্রুপ নীলগিরিতেও রত্নের খনি থাকতে পারে। সত্যাসত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হলে নীলগিরির গুপ্ত গুহায় প্রবেশ করতে হবে। সাধকরা জানে, যে যার সন্ধানে থাকে সে তার সন্ধান পায়। যেমন, আত্মান্বেষীরা আত্মদর্শন করে কৃচ্ছ্রসাধনায় এবং পরমসত্য অন্বেষণে সত্যান্বেষীরা চিন্ময় হয় ধর্মোপাসনায়। তত্ত্বানুসন্ধানে সমাজতাত্ত্বিক না হতে পারলেও মনস্তাত্ত্বিক অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক হওয়া যায় এবং আপখোরাকির জন্য স্বার্থান্বেষীরা তক্কেতক্কে ঘুরায়। এমন এক অন্বেষক জাঁকজমকপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানের অলোকসুন্দরী উপস্থাপিকার কণ্ঠহারের মধ্যমণি দেখে নবরত্নের অন্বেষী হয়। তার নাম আনীল। বই অভিধান ঘেঁটে নবরত্নের নাম জানলেও নিশ্চিত হতে পারেনি, নীলাচলের নীলগিরি না ওড়িশার নীলগিরিতে তা লুক্কায়িত। বিধায় নবরত্নের সন্ধানে সন্ধ্যানী হয়। সে কোথায় থাকে এবং কী করে তা কেউ জানে না। হঠাৎ একদিন সিলেট শহরে আবির্ভূত হয় এবং নীলা নামক যুবতীর মুখোমুখি হলে উদ্ভট কাণ্ড ঘটে। তার হাবভাবে বিস্মিত নীলা বিলুণ্ঠিত হয়। তখন ভরদুপুর ছিল। আনীল চোখ বুজে বাতাসে হাত বুলায়, তার হাতের ছায়া মুখের উপর পড়লে সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়ে নীলা চোখ বুজে চিৎকার করে। লোকজন জড়ো হলে নিলীয়মান আনীলের কণ্ঠ নীলার কানে প্রতিধ্বনিত হয়, ‘নভোনীল শাড়ি পরে নীলা হয়েছ তুমি নীলিমা হতে পারনি। আনীলে নীল মিলে নীলিমা হলেও নীলাঞ্জনাকে নীলা ডাকা যায় না। অলোকসুন্দরীর নয়ন নীল হলে ওকে নীলনয়না না ডেকে নীলা ডাকা মানানসই।’
বিস্মায়াভিভূত নীলার জন্ম নীলাচল, লেখাপড়ার জন্য সিলেট এসেছে। অনিল নামক যুবকের সাথে চোখাচোখি হলে তার বন্ধুরা ইয়ারকি করে বলে, নীলাকে তুই পাবে না রে বন্ধু। নীলাকে পেতে হলে আনীল হতে হবে। সমস্যা হলো তুই তো বাতাস। বন্ধুদের ব্যঙ্গোক্তি শুনে অনিলের মন টলে। অসহায়ের মত নীলার দিকে তাকিয়ে বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সাদরে দাদি তাকে অনিল ডাকেন। আনীল ডাকার জন্য কত মিনতি করেছে কিন্তু দাদি তাকে অনিল নামেই ডাকেন। নীলনয়ানারা নাকি কুহকিনী। নীলনয়নাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তাকে আদেশ করেছেন। নীলা আড়চোখে তাকালে চোখ বুজে সে শিউরে উঠে এবং তার কানে আদেশাজ্ঞা প্রতিধ্বনিত হয়। গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদা দাদিকে দেখার জন্য অনিল গ্রামে যায়। ফজরের নামাজ পড়ে জানালা খুলে পরিপার্শ্বে তাকিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। সূর্যের তেজে কোয়াশা বাষ্প হয়ে আস্তেধীরে পরিবেশ পরিষ্কার হয়। বারোমাসি বড়ুইর ডালে নতুন পাতা গজিয়েছে। শিশিরধৌত ফুল কুঁড়িরা শীতল বাতাসের স্পর্শে ফুরফুরে হয়। পলাশডালে বসে পাখিরা ভোরাই গায়। টোনাটুনির টুনটুন ভোরকে প্রাণবন্ত করে। হঠাৎ ছোট্ট পাখি তার সামন দিয়ে উড়ে যায়। দেখতে সোনা চড়াইর মত। টুনটুনি ভেবে চকিত হলেও পরক্ষণে অত্যাশ্চর্য হয়। ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে দ্রুত দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোয়। সাতসকালে হন্যের মত হাঁটতে দেখে দাদি হেঁকে বললেন, ‘অনিল! কোথায় যাচ্ছিস? পাকঘরে আয়, আমার সাথে নাস্তা খাবে।’
‘জি দাদিজান আসছি।’ বলে অনিল দৌড়ে পাকঘরে যেয়ে বলল, ‘দাদিজান, আমাদের গ্রামে নুরি আসল কোথা থেকে?’
‘পূবের বাড়ির নুরির কথা বলছিস নাকি? তোকে দেখার জন্য এসেছে হয়তো। তোর পছন্দ হল বিয়ের আলাপ নিয়ে এখুনি যাব।’
‘ও আম্মা গো, এ কী করলাম গো?’
‘মুখে বুজে গণ্ডে-পিণ্ডে গিল গরম চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। মনে রাখিস, বেপাড়ায় মস্তানি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’ বলে দাদি বিদ্রুপ হাসেন। অনিল কথা না বলে চার আনা তিন সিকি মানত করে নাস্তা খেয়ে পাকঘর থেকে বেরিয়ে বেড়াতে যায়। বন বাগানে কাঁচপোকারা ভনভন করে। বভ্রু ফুলের সাথে ভ্রমরীরা ভাব জামাতে ব্যস্ত। দোরসা জমিতে ধান এবং রাই চাষ করা হয়েছে। ধানের শিষে ঢেউ তুলে রাই রেনুর সুবাসে সুবাসিত বাতাসে অনিল প্রাণবন্ত হয়। পল্লি বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশে কত জীবনীশক্তি আছে তা অনুভব করতে হলে বাংলার বাতাসে মন ভাসাতে হয়। অনিল তাই করেছে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমুদ্ধ হয়ে হেঁটে দেখছিল। পাড়াকুঁদুলি নুরি তাইরে নাইরে করে নেচে বেড়াচ্ছিল। দুজন চোখাচোখি হলে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে চোখ টেপে নুরি বলল, ‘বাতাস বন্ধু, এক কাহনে কয় কড়া বলতে পারলে তোকে আমি বিয়ে করব না।’
হঠাৎ ঠাঠা ফাটার বিকট শব্দে চমকে উঠে অনিল দৌড়াতে চাইলে খিল খিল করে হেসে নুরি বলল, ‘ভুল উত্তর বললে বাসর-ঘরে ঠিকঠাক করব।’
‘তাইলে ঠিকাছে, তুই যা আমি হিসাব কষে তোকে জানাব।’ বলে অনিল বিড়বিড় শুরু করে, ‘কার্ষাপণের অর্থ ষোলো পণ অথবা এক কাহন। এক পণে কুড়ি গণ্ডা। কুড়ি শব্দের অর্থ বিশ এবং গুণ্ডা শব্দের অর্থ চার। কুড়ি গণ্ডায় চব্বিশ না আশি? মহা সমস্যা, নুরির বাসরে বসতে চাই না রে মনা।’
‘বাতাস বন্ধু! আমার বাগিচায় আয়, নিম্বু ফুলে গাঁথা মালা তোর গলে দেব।’ বলে নুরি হাত দিয়ে ইশারা করলে অনিল বলল, ‘কুঞ্জে অঞ্জুকে না পেয়ে মঞ্জু রেগে সঞ্জুকে সঞ্জে পাঠিয়ে রঞ্জু এবং অঞ্জুকে দিয়ে দই ঘুটিয়ে ঘোল বার করিয়েছিল কেন?’
নুরি মুখ বিকৃত করে বলল, ‘উড়ে এসে ঘুঘুটা বসেছিল গাছের ডালে, ছায়ে টাটু, দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক দৃশ্যে দালানটা হয়েছিল দৃষ্টিকটূ।’
অনিল… ‘আমি তোকে প্রশ্ন করেছিলাম।’
নুরি… ‘কবিতার ভিড়ে কবিতা হারায় কবির ভিড়ে কবি, আয়নার ভিতর ছায়া লুকালে হয় ছবি।’
অনিল… ‘জয়োস্তু! অবশেষে সবশেষ করে কবিতার ভূতরা তোকে জেঁতেছে।’
নুরি… ‘কবিতা পড়লে কবিতা লিখতে হয়। কয়টা লিখেছিস?’
অনিল… ‘জলে চাঁদ ঝিকমিক করে রাতে ঝিঁঝি পোকার ডাকে মাথা ঝিমঝিম করে। ঠায় দাঁড়ালে হাত পা ঝিনঝিন করে জানি ঝিরঝিরে বাতাসে মন ফুরফুরে হলেও রিমিকি-ঝিমিকি শব্দে জান চমকে, যদি মাথায় ঠাঠা পড়ে।’
নুরি… ‘আমার উরে আয়, দাদুর মতো আদর করব।’
‘দূর যা।’ ধমকে বলে অনিল হাঁটতে শুরু করলে তালে বৈতালে নুরি গায়, ‘সোনা বন্ধে আমারে উদাসিনী বানাইলো গো, সোনা বন্ধু ও সোনা বন্ধু গো, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে ছাতি হাতে আসো গো।’
‘আমাকে কিছু বলছিস নাকি?’ বলে অনিল কপাল কুঁচ করলে বিদ্রুপহেসে সুর-ছন্দে নুরি বলল, ‘বাতাস বন্ধু ও বাতাস বন্ধুরে আর কত জ্বালাবে আমারে? রোদে জ্বলি আগুনে জ্বলি আরো জ্বলি রোষানলে, ও বাতাস বন্ধুরে আর কত জ্বালাবে আমারে?’
‘তোর গান শুনলে গুনগুন করে কাঁদে ভোমরে, দৌড়ে বাড়ি যা নইলে চেঁচাড়ি মারব তেড়ে।’ বলে অনিল চোখ পাকালে নুরি তার সামনে যেয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘আমার এক বন্ধুর প্রয়োজন, যে সফলতার মাথায় হাত বুলাতে চায়। নিঃসঙ্গতা আমার সঙ্গি হয়েছে। এমন এক বন্ধু চাই, যে আমার সাথে মন খুলে কথা বলবে, সুখের ষোলোকলা জানতে চাইবে বুঝতে চাইবে এবং শিখতে চাইবে। আমি কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে চাই, যে আমার সাথে কথা বলতে চায়, যে নতুন কিছু করতে এবং জানতে আগ্রহী।’
অনিল... ‘আড়াই প্যাঁচে বেশি সমস্যা। আমি জানি নদীতে জোঁক এবং কুমিররা বসবাস করে। আমার একমাত্র ভরসা হলো পায়ের খরম। পায়ে না থাকলে জলে নামবে কেমনে?’
বানান এবং ব্যাকরণে সমস্যা ধরা পড়লে দয়া করে মন্তব্যে জানাবেন, উপকৃত হব।
সত্য প্রেম (উপন্যাস)
প্রথম প্রকোশ ২০/১২/২০১৭
Copyright © 2017 by Mohammed abdulhaque
ISBN-13: 978-1982087326
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৫৩