আইনুল সাহেব ১০টার ভিতরে খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণের জন্য ফাইল পত্র নিয়ে বসলেন। পরবর্তী দিনের করণীয় কাজ গুছিয়ে নিলেন। ব্যালকনিতে ১৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি করে অন্য যে কোন রাতের মতোই বিছানায় শুতে গেলেন।
মাঝরাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জানালা দিয়ে তখনো পরিষ্কার আলো এসে পড়েনি। সাধারণত এক ঘুমেই রাত পার করে দেন তিনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছাদের তাকিয়ে কোথায় সমস্যা হয়েছে সেটা বোঝার চেষ্টা করলেন। এসি বন্ধ হয়ে যায়নি। গায়ে চাদর থাকার কারণে আরামদায়ক উষ্ণতায় শরীর ঢেকে আছে। ঘরের যান্ত্রিক আসবাবের নিরন্তর মৃদু শব্দ ছাড়া সম্পূর্ণ ঘর নিস্তব্ধ। কোথাও ব্যতিক্রমী কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে মস্তিষ্ক হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলো কেন?
একটু দেরীতে হলেও আইনুল সাহেব অসময়ে ঘুম ভাঙার কারণটা ধরতে পারলেন। তিনি সাবধানে বাম দিকে পাশ ফিরলেন। আবছায়া আলোতেও দেখতে পেলেন একজন লোক তার পাশে শুয়ে আছে। মোটামুটি দীর্ঘদেহী স্বাস্থ্যবান লোকটি খুবই সাধারণ ভঙ্গিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মাথা সোজা, মুখটা ঈষৎ হা করে খোলা। খোলা চোখ ছাদের দিকে নিবদ্ধ। হাত দুটো ভাঁজ করে পেটের উপর স্থির পড়ে আছে।
আইনুল সাহেব বিবাহিত হলেও তার স্ত্রী বেশ কয়েক বছর হলো অন্য ঘরে ঘুমান। একা বিছানায় তিনি বেশ আরাম করেই থাকেন। বেডসাইড টেবিলে একটি কলিং বেল আছে। ঐটা চেপে ধরলে কাজের লোক এসে খোঁজ নিয়ে যায় তার কিছু লাগবে কি না।
আইনুল নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই হাতড়ে হাতড়ে টেবিল সুইচটা চাপার চেষ্টা করলেন, কিন্তু খুঁজে পেলেন না। ঠান্ডা ঘরেও তিনি ঘামতে লাগলেন। তাকে চমকে দিয়ে টেবিলের উপরে রাখা ব্যক্তিগত টেলিফোনটা বেজে উঠলো। পাশের লোকটা তখনো নিশ্চল রইলো।
***
একই সময়ে সবকটা দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এত বিচিত্র কোন খবর প্রথম পাতায় ছেপেছে বলে মনে করতে পারলো না কেউ।
"...বিগত কয়েক সপ্তাহে শহরের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে কয়েকটি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের বরাতে এখন পর্যন্ত ২টি লাশ উদ্ধারের কথা জানানো হলেও স্থানীয় সূত্রে আরো বেশি সংখ্যক লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানা গেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, পুরো বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা উদ্ধারকৃত লাশগুলোর পরিচয় জানার চেষ্টা করছি। সত্যি বলতে সবগুলোর পরিচয় সম্পর্কে আমরা এখনো নিশ্চিত নই। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে গুজবে কান..."
আরিফ সিগারেটে টান দিয়ে চায়ের কাপের ভিতরে ধোঁয়া ছাড়লো। ধোঁয়ার সাথে সাথে মনের ভিতরের জমানো কথাগুলো যেন পাঁক খেয়ে খেয়ে বের হয়ে আসতে চাইলো। পত্রিকায় সব কথা লেখা হয়নি। শহরে রীতিমত মহামারি লেগেছে। হুটহাট করে একেক জনের বাড়িতে এসে হাজির হচ্ছে এরা। যাদের বাড়িতে হাজির হচ্ছে তারা কেউ এদের চেনে না। কীভাবে হাজির হচ্ছে কেউ জানে না। এমন উদ্ভট সব জায়গায় হাজির হচ্ছে যে এদেরকে কেউ রেখে যাচ্ছে কী না তাও বলা যাচ্ছে না। ধরা যাক, আপনি বাথরুমে গেছেন। হাত মুখ ধোয়ার পরে পেছন ফিরে দেখলেন দরজায় হেলান দিয়ে কেউ একজন বসে আছে। একেবারে পাথরের মূর্তির মত। শরীরে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। এমন না যে শ্বদন্ত বের করে আপনার ঘাড়ে হামলে পড়ছে। অথবা বুক কাঁপানো হুংকার দিচ্ছে। নাহ! এমন কিছুই করছে না সে। তারপরেও এ অবস্থায় আপনার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
আপনি চিৎকার করে উঠলেন। চোখ বন্ধ করে ভাবলেন যে এটা হ্যালুসিনেশন অথবা অতিপ্রাকৃত কিছু। যেটা চলে যাবে এক্ষুণি। কিন্তু চোখ খুলে দেখলেন মোটেও তেমন কিছু না। যা দেখছেন তা একেবারে বাস্তব। জীবন নেই, তবে অস্তীত্ব আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এড়ানোর সুযোগ নেই। জিজ্ঞেস করেও জানা যাবে না সে কে, কেন এসেছে, কী চায়।
সংখ্যাটা বাড়ছেই দিনদিন। উঁচু মহল থেকে নিচু মহল, কোন মহলই এদের থেকে নিরাপদ নয়। আতঙ্ক বাড়ছে। আরো বাড়বে। আরিফের ধারণা এরা শুধু ঘরের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আজকে ঘরের ভিতরে হাজির হচ্ছে। কাল অফিস আদালতে হাজির হবে। বিচারক বিচার করছেন। হঠাৎ দেখবেন এজলাসে একদল প্রাণহীন মানুষ জায়গা দখল করে বসে আছে। রেস্টুরেন্টে হৈ হুল্লোড় করছেন। হঠাৎ বিনা দাওয়াতে এক বা একাধিকজন এসে উপস্থিত হবে। মাছের মত চোখ করে তাকিয়ে থাকবে আপনার দিকে। সব আনন্দ নিমিষে আতঙ্কে রুপ নেবে। একে একে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, শপিং মল, স্টেডিয়াম, ব্যাংক ইত্যাদি জনবহুল জায়গায় এসব অপ্রত্যাশিতরা যদি উপস্থিত হতে থাকে তাহলে কি হবে!
এই কথাটাই কিছুক্ষণ আগে আরিফ "নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক" উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অফ দা রেকর্ডে জিজ্ঞেস করেছিলো। তিনি হাত নেড়ে উঁড়িয়ে দিয়ে বললেন, "আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছুই নেই। আপনারা সাংবাদিক। জনগণের পালস নিয়ন্ত্রণের কাজ আপনারা করেন। আপনাদের কাগজগুলো সাবধানী হন। বাকীটা আমরা দেখছি। এতো নার্ভাস হচ্ছেন কেন?"
এত সহজে কি নার্ভাসনেস যায় না কি? মাঝরাতে ফাঁকা রাস্তায় বাইক চালাতে গিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। বাসায় পৌঁছে দুই বার কলিং বেল টেপার পর দরজা খুলে দেয় কলেজ পড়ুয়া ছোট বোন।
খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ার পরেও ঘুম আসছিলো না আরিফের। বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে চারপাশে বালিশ আর কোল বালিশ ছড়িয়ে রেখেছে সে। বুকের ভিতরে কেমন জানি চাপ অনুভব করছে। ছোট বোনের ঘর থেকে গুণগুন করে পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা মায়ের ঘরের আলো নেভানো। ঘুমিয়ে পড়েছে সম্ভবত। আরিফের চোখও কখন যেন লেগে আসলো।
ওর ঘুম ভাঙলো ভোরে। কিছুক্ষণ পড়ে থেকে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম আসলো না আর। বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। মুখ ধুয়ে রান্না ঘরে গেলো। সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে। তাই নিজেই কফি বানিয়ে মগ হাতে বারান্দায় এসে বসলো।
রাতের ঘুমটুকু একদমই ভালো হয়নি। কিসব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখেছে। দেখেছে যে শহরের মাথার উপরে আকাশে বিরাট এক যন্ত্র ভেসে বেড়াচ্ছে। জীবন্ত প্রাণীর মতো অসংখ্য শুড় বেরিয়ে আছে গা থেকে। কিছুক্ষণ পর পর যন্ত্রটা আকার বদলাচ্ছে। শুঁড় নাড়িয়ে নাড়িয়ে শহর থেকে কি যেন তুলে নিয়ে শরীরের ভিতরে বিভিন্ন ফাঁক ফোঁকরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একটা সময়ে দৃশ্যপট পাল্টে বিরাট এক হল ঘরে হাজির হলো সে। চারিদিকে অসংখ্য মনিটর, সুইচ, লাল নীল বাতি জ্বলছে নিভছে। অনেকগুলো প্রাণী খুব দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে। প্রাণীগুলোর শরীর খুবই সরু এবং লম্বা, মাথার জায়গায় বড় একটা সাদা রঙের জেলীর মত থকথকে পদার্থের গোলাকার বুদবুদ বসানো। এই বুদবুদের মতো মাথার ভেতর থেকে অনেকগুলো শুঁড় বেরিয়ে সুইচগুলো টেপাটেপি করছে। অর্থাৎ এগুলোই ওদের হাত। আর সরু দেহের একেবারে নিচে পায়ের বদলে সরাসরি মানুষের পায়ের আঙ্গুলের মতো আঙ্গুল বেরিয়েছে। সংখ্যায় অনেক, লম্বায় বেশ অনেকটা বড়। এগুলো কিলবিল করে নড়াচড়া করে এরা চলাচল করছে। স্বপ্নের ভিতরেই আরিফ বুঝতে পারলো এটা ঐ যন্ত্রের ভিতরেরই একটা অংশ।
ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই কেমন যেন অস্বস্থি লাগছিলো আরিফের। এসব স্বপ্নের কোন মানে হয় না। আজকাল বিদেশি নাটক,সিনেমায় এ ধরণের বিদঘুটে দৃশ্য অহরহ দেখা যায়। তার উপরে কদিন ধরেই একের পর লাশের স্টোরি করতে গিয়ে স্নায়ুর উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। কফিতে চুমুক দিলো আরিফ।
ভোরে ওঠার অভ্যাস নেই ওর। তাই ভোরের পরিবেশটা ওর কাছে নতুনই লাগছে। বারান্দা থেকে ওদের বাড়ির সীমানা প্রাচীর দেখা যায়। সেখানে ওর চোখ আটকে গেলো। অর্ধেক কাটা শরীরের একটি মেয়ে দেওয়ালে উপুড় হয়ে ঝুলে আছে। ছিমছাম গড়নের মেয়েটির বয়স হয়তো বেশি নয়। উপুড় হয়ে থাকায় এবং খোলা চুলের কারণে মেয়েটির চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আরিফ কফির কাপেই বমি করতে লাগলো।
***
আরিফ বিদায় নেওয়ার পরে মুক্তার সাহেব ফোর্স নিয়ে বের হলেন। একজন ভি আই পির বাড়িতে যেতে হবে। উপরের নির্দেশে বাছাই করা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়েছেন। এরকম নির্দেশের কারণ তিনি কিছুটা অনুমান করতে পারছেন। অনেক বছর হলো এই লাইনে আছেন। কত বিচিত্র জিনিসই তো দেখছেন।
কিন্তু যা দেখছেন আর যা শুনছেন সবকিছুই বলতে পারেন না। যেমন সাংবাদিকদের সব কথা তিনি বলতে পারেননি। খবর সংগ্রহ করাই সাংবাদিকদের কাজ। কিন্তু অনেক খবরই তাদের কাছে থাকে না। উপরওয়ালা চাইলে খবরের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন মুক্তার সাহেব ইতোমধ্যে জানেন সম্প্রতি উদ্ধার করা মানুষগুলোর পরিচয় কি, তারা কারা। কিন্তু এটা সাংবাদিকদের জানানো যাবে না। জানানো যাবে না কারণ এই মানুষগুলো কীভাবে এখানে এসেছে সেটা তারা জানেন না। এটা না জানা পর্যন্ত কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। তবে সাংবাদিকটার আশংকা তাকেও কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে। মুক্তার আলী ভাবতে থাকে, "এরপর যদি মালগুলো পাবলিক প্লেসে হাজির হয়, তখন পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাবে। বিষয়টা নিয়ে উপর মহলের সাথে কথা বলা দরকার।"
উপর মহলের কথা মনে আসতেই অন্যমনষ্কভাবেই চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে আকাশে তাকালেন তিনি। পরিষ্কার রাতের আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে।। শুধু একটা জায়গাতেই যেন নিকশ অন্ধকার হয়ে আছে। যেন কেউ একজন এক বোতল কালো রঙ স্প্রে করে দিয়েছে। মুক্তার আলী ভ্রু কুঁচকালেন। উনি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র না। বিষয়টা অদ্ভুত লাগলো তার কাছে। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কী? ওনার ছোট ছেলেটা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে। ভালো ছাত্র। মুক্তার আলী ভাবলেন ওকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন।
***
লম্বা লম্বা আঙ্গুল ফেলে GH41k99PwYkJ এসে MUIH97JO94lK এর পিছনে দাঁড়ালো। তারপর একটা মোটা লম্বা সাইজের শুঁড় বের করে ঠাস করে ওর মাথার পেছনে চড় মেরে ঝাঁঝালো গলায় বললো,"হারামজাদা, এতক্ষণে স্যাম্পলগুলো জায়গামত পাঠাইয়া বাড়ি চইলা যাইতে পারতাম। তোগো দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে একের পর এক ঝামেলা হইতেছে।" ওজনদার চড়খেয়ে MUIH97JO94lK এর বুদবুদের ভিতর উথাল পাথাল শুরু হলো। সাদা থেকে নীল বর্ণ ধারণ করলো ব্যাথায়। "বস, আমার কী দোষ! ঠিকমতই ইনপুট দিছিলাম। কিন্তু হঠাৎ প্রোগ্রাম গ্লিচের কারণে র্যানডোম ঠিকানায় স্যাম্পল চইলা গেছে। দ্রুতই সব ঠিক কইরা ফেলতেছি বস। আপনে চিন্তা কইরেন না।" GH41k99PwYkJ এর চলে যাওয়ার শব্দ টের পেয়ে MUIH97JO94lK মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে আরো কয়েকটা শুঁড় বের করে সামনের সুইচগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ছবির উৎস