তুরাগ পাড়ের বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে আমিও একটি পোষ্ট দিতে চেয়েছিলাম। জনাব সোহান চৌধুরীর পোষ্ট পড়ে উদ্বুদ্ধ হলাম। উনি এটিকে বিদাআত বলে অভিহিত করেছেন। হ্যা এটিকে বিদাআত বলতেই পারেন। তবে বিদাআত মানেই যে খারাপ, তা কিন্তু নয়। বিদাআতের রকম সকম আছে। বিদাআতে হাসানাহ (উত্তম বিদাআত) আর বিদাআতে সাইয়্যা(খারাপ বিদাআত)। যেমন ২০ রাকাত তারাবিহর নামাজ জামাতের সাথে নিয়মিত আদায় করা বিদাআতে হাসানাহ। সুতরাং বিদাআত সম্পর্কে আগে ভালো ভাবে জানতে হবে। এই যে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে জাকির নায়েকের লেকচার শুনছেন, আল আফাসাই বা সুদাইস সাহেবের কোরআন তেলাওয়াৎ শুনছেন, এসবই বিদাআতের অন্তর্ভুক্ত।
ধর্মের মধ্যে নতুন কোন কিছু সংযোগ বলতে যে বিদাআত আমরা বুঝি, সেই ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন বলতে কি বোঝায় সেটাই আমরা বুঝি না। যদি কেউ ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ এর বদলে ৬ ওয়াক্ত নামাজ জারী করে বা ২৯/৩০টি রোজার বদলে ৩১ টি বা ২৮টি রোজাকে ফরজ বলে তা পালন করতে চায়, সেটাকে আপনি আমি নব সংযোজন বা বিদাআত বলতে পারি, ইজতেমাকে দ্বিতীয় হজ্ব বলে প্রচার করা হলে অবশ্যই তা বিদাআতে সাইয়্যার পর্যায়ে পড়ে যাবে, যা খারাপ বা অবশ্যই বাতিল। আবার ছয় উসুল বলে বিষয়টি তাবলীগ প্রচার করে বেড়ায় সেটাও মনে হয় বিদাআতে সাইয়্যার পর্যায়েই পড়ে। কারণ ইসলাম ৫টি স্তম্ভের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
এই যে ঘড়ি ধরে নামাজ আদায়, সেহরী ইফতার আদায়, মাইকে আজান, যের জবর পেশ দিয়ে লিখা কোরআন হাদিস পাঠ, মাদ্রাসা মক্তবে বিদ্যালয়ে পাঠ লাভ এ সবই তো বিদাআতে হাসানাহ! অর্থাৎ উত্তম সংযোজন। ধর্ম চর্চাকে সহজ ও সাবলীল করার উদ্দ্যেশ্যেই এগুলো করা হয়েছে। নতুন কোন আমল এখানে বাড়ানো বা কমানো হয়নি।
আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ রুপ দান করে দুনিয়ায় পঠিয়েছেন। আর তা দেখভালের জন্যও তিনি তাঁর কিছু সহিহ বান্দাকে সব সময়ই পাঠিয়ে থাকেন। যাঁদের দিল বা অন্তর আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর রাসুলের অন্তর থেকে সঠিক আর বাতিলের নির্দেশ লাভ করে থাকে এবং তিনি তা মানব কল্যাণে ছড়িয়ে দেন। যাঁকে আরবীতে বলে ইলমে লাদ্দুনী। লক্ষ লক্ষ ওলি আল্লাহ পীর মাশায়েখ দ্বারা যুগ যুগ ধরে আল্লাহ পাক তাঁর মনোনিত ধর্ম ইসলামকে জাগ্রত রেখেছেন। যাঁরা মুজাদ্দেদ নামেও স্বিকৃত। হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ), হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (রহঃ). হযরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দী ফারুকী (রহঃ), হযরত মুজাদ্দেদ আল ফেসানী (রহঃ) সহ প্রমুখ ওলি আল্লাহদের জীবনি ঘাটলেই তাঁর সত্যতা মেলে। তাবলীগের প্রধান আমীর ইলিয়াস সাহেবও এমনই একজন পীরের মুরিদ ছিলেন। কিন্তু বর্তমান জামানার তাবলীগ পীর মুরদের সম্পর্ক ও ইসলামে এর ভুমিকাকে সম্পূর্ণ অস্বিকার করে। মূলতঃ এটাই একটা বিরাট ফ্যকড়া।
তাবলীগ জামাতের শেকড় বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক গভীরে ঢুকে গেছে এবং মসজিদ ভিত্তিক সুসংগঠিত প্রচার প্রসার এত ব্যপক হারে ছড়িয়েছে যে, তাবলিগের সহিহ ও গলদ কর্মকান্ডকে আলাদা করে দেখানোটা বেশ জটিল হয়ে গেছে। বিষয়টা জটিল হয়েছে মূলত তাবলিগের কিছু কিছু কর্মকান্ড ও কথা বার্তার কারণেই।
সাধারণতঃ আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক মুসলমান ঘরের ছেলে মেয়েরা নামাজ কালামের ধার ধারে না। বাবা মা বলে বলেও ধর্মীয় ফরজ বিধি বিধানগুলো ছেলে মেয়েকে দিয়ে পালন করাতে পারে না। কিন্তু পরবর্তিতে তাবলীগের মসজিদ ভিত্তিক কর্মকান্ড, ঘরে ঘরে গিয়ে ধর্মীয় ফরজ কাজ গুলো আদায়ের তাগিদ, বেনামাজী বেরোজদার লোককে সাথে করে ঘুরে বেড়িয়ে তার মনে ধর্মের প্রতি দূর্বলতা পয়দা করার দরুণ অনেক মুসলমান বেনামাজী বেরোজদার নামাজী রোজাদার বান্দায় পরিণত হয়। যা অবশ্যই প্রশংসনিয়।
তবে এই কর্মকান্ড সেই সব স্তরের লোকজনের জন্যই উপকারী যারা মুসলমান হয়েও নামাজ পড়ে না, রোজা রাখে না তাদের জন্য। কিন্তু তাবলীগের এই কর্মকান্ড সেই সব মানুষের জন্য নয়, যাঁরা সঠিক পন্থায় হাক্কানী এলেম দ্বারা দ্বীনের চর্চা করেন, এলমে জাহের এলমে বাতেন, এলমে শরিয়ত, এলমে মারেফত এলমে তাসাউফ এঁর জ্ঞ্যানে যাঁরা জ্ঞ্যনবান, তাদের জন্য এই তথাকথিত তাবলিগি কর্মকান্ড প্রযোজ্য হয় না। কিন্তু তাবলীগের মুরুব্বীরা এই সিমানাটা মানতে নারজ। তারা মনে করেন, সর্ব রোগের একমাত্র প্রতিশেধক তারাই। সর্বত্রই তারা জ্ঞ্যান বিতরণ করে বেড়াতে সক্ষম, তাদের সেই ক্ষমতা আছে।
আর এই মন মানসিকতার প্রচার প্রসারের জন্য তারা এমন কিছু গোষ্ঠির সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন, যাঁরা বহুকাল আগে থেকেই এই দেশে ইসলাম চর্চার সাথে জড়িত। অর্থাৎ পীর আউলিয়াকেরাম গন ও তাঁদের হাক্কানী মূরীদ মাশায়েখ। তারা নিজেদেরকেই ইসলামের একমাত্র সঠিক ধজাধারী হিসেবে জাহির করতে গিয়ে পীর - মূরীদের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বিকার করে শুধু তাদের মতাদর্শ প্রচার করে বেড়ান। কিন্তু বাংলার আবহমান কাল ধরে অর্থাৎ তাবলীগেরও শত শত বছর আগে থেকে এই বাংলায় যে সকল আউলিয়া কেরামগনের মাধ্যমে ইসলামের আগমন, সেই পীর মাশায়েখদেরকে তাঁরা বেমালুম অবজ্ঞা ও অস্বিকার করে তাদের বানানো পন্থার মাধ্যমেই ইসলামের দাওয়াতি প্রচার শুরু করেন।
হোমিওপ্যাথির ডাক্তার যদি এলোপ্যাথিক চিকিৎসাকে অগ্রাহ্য করে নিজ পদ্ধতিতেই সবাইকে চিকিৎসা দিতে চায় তাহলে কি সব অসুখ দূর হবে? হবে না। সর্দি কাশি সহ অনেক রোগের উপশম হোমিওপ্যাথি দ্বারা সম্ভব, তবে সব রোগীর জন্য হোমিওপ্যাথি নয়, এ্যালোপ্যাথিক ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন অনস্বিকার্য। তাবলীগ হলো ঐ হোমিওপ্যাথি টাইপের চিকিৎসা পদ্ধতি। কিছু মানুষের এই ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন আছে, তবে সবার নয়, সেটা বুঝতে হবে। তাবলীগেরা হোমিওপ্যাথির ডাক্তার হয়ে এলাপ্যাথিক ডাক্তারের চিকিৎসা করতে যায়, গন্ডগোলের সূত্রপাত এখানেই!
আর তাদের কর্মকান্ডের মধ্যে, আক্বিদার মধ্যে যে সকল ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো ধর্তব্যে নিতে গলে অনেক সূক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যেটা সবাই ধরতে পারে না, আর সবার ধরার জ্ঞ্যানও নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৫১